বীর প্রতীক মো. শাজাহান কবির
মো. শাজাহান কবির, বীর প্রতীক (জন্ম ১৯৫১) নৌকমান্ডো ও অপারেশন জ্যাকপট সহ একাধিক নৌ অপারেশনে অংশগ্রহণকারী অকুতোভয় বীর মুক্তিযোদ্ধা, যাঁর জীবন বাঁচানোর জন্য তাঁর পিতা নিজের জীবন উৎসর্গ করেন। তিনি ১৯৫১ সালের ১লা ফেব্রুয়ারি চাঁদপুর জেলার সদর উপজেলার কল্যাণপুর ইউনিয়নের দাশদী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মোহাম্মদ ইব্রাহীম এবং মাতার নাম আছিয়া বেগম। মো. শাজাহান কবির চাঁদপুরের সফর আলী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১৯৬৭ সালে এসএসসি পাস করেন। ছাত্রজীবন থেকে তিনি রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তিনি ছাত্রলীগ-এর সক্রিয় কর্মী ছিলেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান- ঘোষিত ৬ দফা ও ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ১১ দফার পক্ষে তিনি কাজ করেন। ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানে আইয়ুব সরকারের পতন এবং ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ-এর বিজয়ের পর তিনি স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হতে থাকেন।
৭১ সালে মো. শাজাহান কবির ঢাকার জগন্নাথ কলেজে স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ছিলেন। লেখাপড়া স্থগিত রেখে তিনি মার্চের অসহযোগ আন্দোলন এবং ২৫শে মার্চ পাকহানাদার বাহিনী কর্তৃক গণহত্যা শুরুর পর মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। মুক্তিযুদ্ধের শুরুর দিকে তিনি চাঁদপুরে নিজের বাড়িতে গিয়ে ছাত্র-যুবকদের সংগঠিত করেন। এ-সময় তাঁরা চাঁদপুর শহর থেকে গ্রামে আশ্রয় নেয়া লোকজনের খাদ্য ও নিরাপত্তা প্রদানের দায়িত্ব পালন করেন। এপ্রিল মাসে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিতে তিনি ভারতের আগরতলার হাতিমারা ক্যাম্পে যান। প্রশিক্ষণ শেষে তিনি ২ নম্বর সেক্টরে নিযুক্ত হন। কিন্তু বাংলাদেশের নৌকমান্ডো দল গঠনের সিদ্ধান্ত হলে মো. শাজাহান কবির তাতে যোগ দেন। আগরতলা থেকে তিনি কলকাতা হয়ে মুর্শিদাবাদ জেলার ভাগীরথী নদীর তীরবর্তী পলাশিতে যান। সেখানে নৌকমান্ডোদের প্রশিক্ষণের জন্য স্থাপিত প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে তাঁকে অন্য কমান্ডোদের সঙ্গে বিশেষ প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। আগস্ট মাসে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কমান্ডোরা চট্টগ্রাম, মংলা, চাঁদপুর, নারায়ণগঞ্জসহ বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তানিদের জাহাজ, গানবোট, ফেরি ও জেটিতে আক্রমণ শুরু করেন। মো. শাজাহান কবির প্রথমে অপারেশেন জ্যাকপট-এর অধীনে চাঁদপুর নৌবন্দর আক্রমণে অংশ নেন। এ আক্রমণে তাঁরা ৬টি জাহাজ, পন্টুন ও বার্জ ডুবিয়ে দেন। ১৫ই আগস্ট পরিচালিত এ সফল আক্রমণের পর তিনি কয়েকজন সহযোদ্ধাসহ নিজের গ্রামের বাড়িতে আশ্রয় নেন। কিন্তু পরদিন বাড়ি থেকে পাকসেনারা তাঁকে এবং তাঁর পিতা মোহাম্মদ ইব্রাহীমকে ধরে ফেলে। ধরার পর তাঁদের ওপর অমানবিক নির্যাতন চালানো হয়। পাকসেনারা পিতা-পুত্রকে নিয়ে নৌকায় তুলে শক্ত করে বেঁধে তাদের ঘাঁটির দিকে রওনা দেয়। পথে পিতা নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পুত্রের বাঁধন খুলে দিলে মো. শাজাহান কবির নদীতে ঝাঁপ দিয়ে জীবন রক্ষা করেন। ছেলের বাঁধন খুলতে সহায়তা করায় পাকসেনারা মোহাম্মদ ইব্রাহীমকে নির্মম অত্যাচার শেষে গুলি করে হত্যা করে। শাজাহান কবির আরো কয়েকজন সহযোদ্ধা নিয়ে ভারতের পলাশিতে তাঁদের প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে যান। সেখানে কিছুদিন বিশ্রামের পর আবার মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। তিনি অক্টোবরের শেষের দিকে চাঁদপুর নৌবন্দরে পরিচালিত দ্বিতীয় আক্রমণে অংশ নেন। এ-সময় তাঁরা পাকসেনাদের ২টি খাদ বোঝাই নৌকা ও এম ভি লোরেম জাহাজ ডুবিয়ে দেন। এছাড়াও মেঘনায় এম ভি সামী জাহাজে মাইন বিস্ফোরণ, চাঁদপুরের এখলাসপুর ও মোহনপুর অপারেশনে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
মহান মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ সরকার মো. শাজাহান কবিরকে ‘বীর প্রতীক’ খেতাবে ভূষিত করে। স্বাধীনতার পর তিনি নিজস্ব ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন সংগঠন ও প্রগতিশীল একাধিক সংস্থা পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত। মুক্তিযোদ্ধা ঐক্য পরিষদ, চাঁদপুর জেলা মুক্তিযোদ্ধা পরিষদ, বঙ্গবন্ধু পরিষদ, মুক্তিযোদ্ধা নৌকমান্ডো এসোসিয়েশন এবং বিভিন্ন সামাজিক ও উন্নয়ন সংস্থার কর্মকর্তা হিসেবে তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি ১ কন্যা ও ৩ পুত্র সন্তানের জনক। তাঁর স্ত্রীর নাম বেরজিছ বেগম। [জালাল আহমেদ]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৮ম খণ্ড