বীর প্রতীক মো. শামসুল হক
মো. শামসুল হক, বীর প্রতীক (১৯২৭-২০১০) বীর মুক্তিযোদ্ধা। তিনি ১৯২৭ সালে চাঁদপুর জেলার সদর উপজেলার খাসিপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম ইসমাইল মিয়াজি, মাতার নাম উলফতেন্নেসা| শামসুল হক পাকিস্তান সেনাবাহিনীর চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে চাকরি করতেন। ১৯৭১ সালে এ রেজিমেন্টের অবস্থান ছিল কুমিল্লার ময়নামতি সেনানিবাসে। শামসুল হক ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় নিজ ইউনিটের সঙ্গে ছিলেন। তখন তাঁর পদবি ছিল নায়েব সুবেদার। এ-সময় তিনি সপরিবারে সেনানিবাসে বসবাস করতেন। ২৫শে মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গণহত্যার পর মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই তিনি মেজর শাফায়াত জামিল বীর বিক্রম-এর, (পরে কর্নেল) নেতৃতে বিদ্রোহ করে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন এবং বিভিন্ন প্রতিরোধযুদ্ধে অংশ নেন। শুরু থেকেই যুদ্ধক্ষেত্রে শামসুল হক অত্যন্ত সাহসী ভূমিকা পালন করেন।
প্রতিরোধযুদ্ধে অংশ নেয়ার পর শামসুল হক ২ নম্বর সেক্টরের মন্দভাগ সাব-সেক্টরে যুদ্ধ করেন। পরে তাঁকে ‘কে’ ফোর্সের অধীন নবগঠিত নবম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। শামসুল হক যেসব যুদ্ধে অংশ নেন, তার মধ্যে নোয়াগাঁও যুদ্ধ উল্লেখযোগ্য।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার কসবা উপজেলার নোয়াগাঁও গ্রামে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর শক্ত ঘাঁটি ছিল। কুমিল্লা থেকে পাকিস্তানি সামরিক কর্মকর্তারা কয়েক দিন পরপর সেখানে আসা-যাওয়া করত। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও জনসাধারণকে সেখানে বাধ্যতামূলকভাবে ডেকে এনে শান্তি- -শৃঙ্খলা রক্ষার নামে সভা করত। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের কর্মকাণ্ডের ওপর নজর রাখা। এলাকাটি ছিল মুক্তিবাহিনী-র ২ নম্বর সেক্টরের মন্দভাগ সাব-সেক্টরের অধীন। এ এলাকায় যুদ্ধরত মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দলের দলনেতা ছিলেন আবদুল ওয়াহাব, বীর বিক্রম। শামসুল হক ছিলেন মর্টার প্লাটুনের দলনেতা। ১৭ই জুলাই তাঁরা খবর পান পাকিস্তানিরা পরদিন নোয়াগাঁওয়ে শান্তি সভার আয়োজন করেছে। এরপর তাঁরা দুদল মিলে সেখানে অপারেশন করার সিদ্ধান্ত নেন।
১৮ই জুলাই নোয়াগাঁও স্কুল ঘরে পাকিস্তানিরা সভার আয়োজন করে। এদিন ভোরে আবদুল ওয়াহাব ও শামসুল হক তাঁদের সহযোদ্ধাদের নিয়ে স্কুল ঘরের পেছনে অবস্থান নেন। সভা শুরু হয় বেলা ১১টার দিকে। প্ৰায় দুঘণ্টা সভা শেষে স্থানীয় লোকজন চলে গেলে পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তারা স্কুলমাঠ সংলগ্ন অবজারভেশন পোস্টে উঠে বাইনোকুলার দিয়ে সীমান্ত এলাকা পর্যবেক্ষণ শুরু করে। এ সুযোগে মুক্তিযোদ্ধাদের দুটি দল একত্রে তাদের ওপর আক্রমণ শুরু করে। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রচণ্ড আক্রমণে পাকিস্তানি সৈন্যরা হতবিহ্বল হয়ে পড়ে। কিছুক্ষণ পর তারা পাল্টা আক্রমণ শুরু করে। তখন দুপক্ষে তুমুল গোলাগুলি হয়। কাছে অবস্থিত উজানিসারে পাকিস্তানিদের মিডিয়াম আর্টিলারির অবস্থান থেকেও গোলাবর্ষণ শুরু হয়। এরপর শামসুল হক সহযোদ্ধাদের নিয়ে নিরাপদ স্থানে চলে যান। এ যুদ্ধে ২ জন পাকিস্তানি সামরিক কর্মকর্তাসহ কয়েকজন নিহত ও অনেকে আহত হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের এ সফল অপারেশনে শামসুল হক যথেষ্ট কৃতিত্বের পরিচয় দেন।
মহান মুক্তিযুদ্ধে সাহসিকতা ও বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক শামসুল হককে ‘বীর প্রতীক’ খেতাবে ভূষিত করা হয়। স্বাধীনতার পর তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর চাকরিতে বহাল হন। সেখান থেকে অনারারি ক্যাপ্টেন হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন। তাঁর স্ত্রীর নাম জয়নব বানু। এ দম্পতির ২ কন্যা ও ৩ পুত্র সন্তান রয়েছে। ২০১০ সালের ৩রা জুন শামসুল হক মৃত্যুবরণ করেন। [রেহানা পারভীন]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৮ম খণ্ড