বীর উত্তম মো. শাহ আলম
মো. শাহ আলম, বীর উত্তম (১৯৪৮-১৯৮৫) বীর মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিবাহিনীর নেভাল কমান্ডো দলের সদস্য এবং বিশিষ্ট চিকিৎসক। তাঁর ডাক নাম ছিল আলম। তিনি ১৯৪৮ সালের ১৩ই নভেম্বর নোয়াখালী জেলার বেগমগঞ্জ উপজেলার করমোল্লাপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম আলী আহমদ চৌধুরী এবং মাতার নাম জমিলা বেগম। পিতার কর্মস্থল কাপ্তাই এলাকায় তাঁর শৈশব, কৈশোরসহ জীবনের অধিকাংশ সময় কেটেছে। যদিও শাহ আলমের প্রাথমিক শিক্ষাজীবন শুরু হয় তাঁর জন্মস্থান করমোল্লাপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে, শিশু বয়স থেকেই তিনি পিতার কর্মস্থল কাপ্তাই শিল্প এলাকা চন্দ্রঘোনা চলে আসেন; দ্বিতীয় শ্রেণিতে ভর্তি হন কর্ণফুলী কাগজকল উচ্চ বিদ্যালয়ে। এ বিদ্যালয় থেকে তিনি ১৯৬৭ সালে কৃতিত্বের সঙ্গে ১ম বিভাগে এসএসসি পাস করার পর রাঙ্গুনিয়া কলেজে ভর্তি হন। ১৯৬৯ সালে এ কলেজ থেকে তিনি ১ম বিভাগে এইচএসসি পাস করার পর চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে এমবিবিএস কোর্সে ভর্তি হন।
শাহ আলম মুক্তিযুদ্ধের শুরুর প্রাক্কালে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে অধ্যয়নরত ছিলেন। একাত্তরের মার্চের উত্তাল দিনগুলোতে বিশেষ করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর সাতই মার্চের ভাষণ-এর পর তিনি চট্টগ্রাম থেকে চন্দ্রঘোনা চলে আসেন। সেখানে তিনি ছাত্র, জনতা, কৃষক ও শ্রমিকদের সংগঠিত করে একটি দল গঠন করেন। ২৫শে মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনা শাসকরা ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ব্যাপক গণহত্যা ও নির্যাতন শুরু করলে শাহ আলম মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নেন। এপ্রিল মাসে তিনি তাঁর দল নিয়ে রামগড় হয়ে ভারতে চলে যান। যুদ্ধের প্রাথমিক ট্রেনিং গ্রহণের পর তিনি মুক্তিবাহিনীর নৌ-কমান্ডো দলে যোগ দিয়ে উচ্চতর ট্রেনিং-এর জন্য ভারতের মুর্শিদাবাদ জেলার পলাশী নৌ-প্রশিক্ষণ ঘাঁটিতে যান। পলাশী থেকে নৌ-যুদ্ধে বিস্ফোরক ব্যবহারে উচ্চতর প্রশিক্ষণ শেষে সাবমেরিনার আবদুল ওয়াহেদ চৌধুরী, বীর উত্তম ও বীর প্রতীক-এর নেতৃত্বে অপারেশন জ্যাকপট–এ অংশ গ্রহণের জন্য তিনটি দলে বিভক্ত হয়ে মোট ৬০ জন নৌ- কমান্ডোর সঙ্গে তিনি চট্টগ্রাম আসেন। তারপর তাঁরা চট্টগ্রাম শহরের পানওয়ালাপাড়ার সবুজবাগে আব্দুল হাই সরদারের বাড়িতে মৌলভী সৈয়দ আহমদ (বেইস কমান্ডার) সহ অন্যদের সঙ্গে অপারেশন পরিকল্পনা নিয়ে এক গোপন বৈঠক করেন। এ অপারেশনের উদ্দেশ্য ছিল একযোগে চট্টগ্রামসহ দেশের সকল নৌ ও সমুদ্র বন্দরে অবস্থানরত শত্রু বাহিনীর জাহাজ বিস্ফোরক দিয়ে উড়িয়ে দেয়া।
নৌ-কমান্ডোদের এ অপারেশনটি ছিল অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। তাই অপারেশনের পূর্বেই বন্দরের সঠিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ করার জন্য একটি রেকি দল গঠন করা হয়। শাহ আলম ছিলেন এর দলনেতা। তাঁর দায়িত্ব ছিল সে সময় চট্টগ্রাম বন্দরের কোন কোন স্থানে কত পরিমাণ পাকিস্তানি সৈন্য মোতায়েন ছিল, কোন কোন স্পটে কতগুলো জাহাজ নোঙ্গর করা ছিল, বয়রাগুলোর অবস্থান, সে সময়ের কর্ণফুলী নদীর টাইটাল চার্ট সংগ্রহ করা, ইত্যাদি। শাহ আলম অপারেশন পরিচালনার পূর্বে অত্যন্ত ঝুঁকি নিয়ে দক্ষতার সঙ্গে কখনো জেলে, কখনো ফেরিওয়ালা, কখনো বা কৃষকের ছদ্মবেশে বন্দর এলাকা রেকি করে সফলতার সঙ্গে এ দায়িত্বটি পালন করেন। শাহ আলমের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী নৌ-কমান্ডোগণ ১৫ই আগস্ট অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে অপারেশন জ্যাকপট সম্পন্ন করেন। নৌ-কমান্ডোগণ পানিতে নেমে সাঁতরে বন্দরে নোঙর করা অনেকগুলো নির্দিষ্ট টার্গেটে সফলতার সঙ্গে লিমপেট মাইন স্থাপন করে নিরাপদ দূরত্বে চলে আসেন। আধ ঘণ্টা পর থেকে মাইনগুলো একের পর এক বিস্ফোরিত হতে থাকে। এ অপারেশনে মুক্তিযোদ্ধারা ৯টি টার্গেট সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করেন। এ সকল টার্গেটের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো বাণিজ্য জাহাজ এমভি আল আব্বাস, এমভি হরমুজ, বার্জ ওরিয়েন্ট এবং পাকিস্তান নৌবাহিনীর দুটি গানবোট ও একটি পন্টুন। এ অপারেশনের ফলে পাকসেনাদের মধ্যে ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় এবং বন্দর প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়লে তাদের মনোবলও ভেঙ্গে পড়ে। চট্টগ্রাম বন্দরের এ ভয়াবহ অপারেশনের খবর সারা বিশ্বের বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে ফলাও করে প্রচার করা হয়। তাছাড়া এতে মুক্তিযুদ্ধ নতুন মাত্রা পায়। শাহ আলমের নেতৃত্বে নভেম্বর মাসে চট্টগ্রাম বন্দরে আরো একটি অপারেশন পরিচালিত হয়। এতে একটি বিদেশী অয়েল ট্যাংকারসহ বেশ কয়েকটি জাহাজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে বীরত্ব ও সাহসিকতাপূর্ণ অবদানের জন্য গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার মো. শাহ আলমকে ‘বীর উত্তম’ খেতাবে ভূষিত করে। মুক্তিযুদ্ধ শেষে শাহ আলম ছাত্রজীবনে ফিরে আসেন। ১৯৭৫ সালে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে এমবিবিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে কাপ্তাই থানা হেলথ কমপ্লেক্সে চিকিৎসক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৭৮ সালে তিনি চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে হাসপাতালে আবাসিক মেডিকেল অফিসার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে এ বীর মুক্তিযোদ্ধা ১৯৮৫ সালের ২৬শে মার্চ ইন্তেকাল করেন। তাঁর স্মৃতিকে সংরক্ষণ করার জন্য চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মিলনায়তনের নামকরণ করা হয় ‘ডা. শাহ আলম, বীর উত্তম, মিলনায়তন’। এছাড়াও তাঁর নামে মাইজদী-চৌমুহনী প্রধান সড়কের একলাসপুর বাজারের দক্ষিণ দিক থেকে করমোল্লাপুর বাজার পর্যন্ত সড়কটির নামকরণ করা হয় ‘বীর উত্তম ডা. শাহ আলম সড়ক’। তাঁর স্ত্রীর নাম নাসিরা আক্তার। এ দম্পতির এক কন্যা সন্তান রয়েছে। [সাজাহান মিয়া]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৮ম খণ্ড