You dont have javascript enabled! Please enable it!

বীর বিক্রম মো. শাহজাহান আলী

মো. শাহজাহান আলী, বীর বিক্রম (১৯৫৬-১৯৭১) শহীদ বীর কিশোর মুক্তিযোদ্ধা। তিনি ১৯৫৬ সালের ২৭শে জানুয়ারি জামালপুর জেলার মাদারগঞ্জ উপজেলার সিধুলী ইউনিয়নের চরভাটিয়ালি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবার নাম জসীমউদ্দিন সরকার ও মায়ের নাম তছিরন বেওয়া। ৩ ভাইয়ের মধ্যে তিনি সবার ছোট।
১৯৭১ সালে মো. শাহজাহান আলীর বয়স ছিল মাত্র ১৫ বছর। তিনি মাদারগঞ্জের চরভাটিয়ালি গ্রামের শ্যামগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয়ে সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেন। পরিবারের দারিদ্র্যের কারণে তাঁর আর বিদ্যালয়ে যাওয়া হয়েনি। সংসারের অভাব দূর করতে বাবার সঙ্গে তিনি কৃষিকাজে যুক্ত হন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি এলাকার যুবকদের পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য সংগঠিত করেন। গেরিলা প্রশিক্ষণের জন্য তিনি মে মাসে ভারতে যান। ভারতের তেলঢালায় সামরিক প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করে ১১ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার মেজর আবু তাহেরের অধীনে মহেন্দ্রগঞ্জ সাব-সেক্টরের লে. মান্নানের নেতৃত্বে জামালপুর এলাকার মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন।
জামালপুরের বকশীগঞ্জ উপজেলার ধানুয়া-কামালপুরের সীমান্ত ফাঁড়িতে পাকবাহিনীর শক্ত ঘাঁটি ছিল। এ ঘাঁটি ছিল অত্যন্ত সুরক্ষিত। পাকবাহিনী বিওপি-র চারপাশে মোটা গাছের গুঁড়ি ও কংক্রিট ব্যবহারের মাধ্যমে আর্টিলারি শেল প্রতিহত করার ক্ষমতাসম্পন্ন বাংকার নির্মাণ করেছিল। রাতে পাকসেনারা সুরক্ষিত বাংকারে অবস্থান করত। কামালপুর সীমান্ত ফাঁড়ি এলাকা মুক্তিবাহিনী এবং পাকবাহিনীর কাছে কৌশলগত দিক থেকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ভারত সীমান্তের নিকটবর্তী এ স্থানে পাকবাহিনীর দুটি শক্তিশালী ইউনিট অবস্থান করছিল। পাকবাহিনী এ স্থান তাদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে মরিয়া ছিল। অন্যদিকে মুক্তিযোদ্ধারা এ স্থান নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা চালান। এখানে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধারা প্রায়ই অতর্কিতে আক্রমণ চালাতেন। কয়েকবার এখানে উভয় পক্ষে হতাহতের ঘটনা ঘটে। আগস্ট মাসে মো. শাহজাহান আলীসহ অন্য মুক্তিযোদ্ধারা কয়েকদিন পরপর সন্ধ্যার দিকে মহেন্দ্রগঞ্জ ক্যাম্প থেকে বাংলাদেশে ঢুকে কামালপুরে পাকবাহিনীর ঘাঁটিতে অতর্কিতে আক্রমণ করে আবার ক্যাম্পে ফিরে যান। পাকসেনাদের মনে ভীতি সঞ্চার করা ছিল তাঁদের এ ধরনের আক্রমণের মূল লক্ষ্য।
৩০শে অক্টোবর মো. শাহজাহান আলীসহ ৬০ থেকে ৭০ জন মুক্তিযোদ্ধা ধানুয়া-কামালপুরে পাকসেনাদের আক্রমণের জন্য মহেন্দ্রগঞ্জ ক্যাম্প থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করেন। তাঁরা সীমান্ত সংলগ্ন আখক্ষেতের ভেতরে পরিখা খনন করেন। শাহজাহান আলীসহ মুক্তিযোদ্ধারা মধ্যরাতে পরিখায় অবস্থান নেন। এর অদূরেই পাকবাহিনীর ঘাঁটি ছিল। পাকসেনারা যাতে বাংকার থেকে বেরিয়ে আসে সেজন্য তাঁরা কয়েক রাউন্ড গুলি ছোড়েন। মুক্তিযোদ্ধাদের গুলির জবাব দিতে পাকসেনারা বাংকার থেকে বেরিয়ে ঘাঁটির চারদিকে অবস্থান নেয়। এ-সময় একযোগে মুক্তিযোদ্ধারা তাদের ওপর আক্রমণ করেন। পাকসেনারা পাল্টা আক্রমণ করলে উভয় পক্ষের মধ্যে প্রচণ্ড যুদ্ধ শুরু হয়। সিদ্ধান্ত ছিল মুক্তিযোদ্ধারা আক্রমণ করে ভোর হওয়ার পূর্বে নিজেদের ক্যাম্পে ফিরে যাবেন। কিন্তু মো. শাহজাহান আলীসহ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা গুলি চালিয়ে যেতে থাকেন। তাঁদের ছোড়া গুলিতে ২-৩ জন পাকসেনা নিহত হয়। পাকসেনাদের আর্তচিৎকার শুনে শাহজাহান আলী আরো বেপরোয়াভাবে আক্রমণ চালিয়ে যান। কয়েক ঘণ্টা ধরে উভয় পক্ষে যুদ্ধ চলে। ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে-সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটতে থাকেন। কিন্তু শাহজাহান আলীসহ কয়েকজনের সেদিকে লক্ষ নেই। তাঁরা লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। এক পর্যায়ে পাকসেনারা তাঁদের পরিখা চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে। এ-সময় মুক্তিযোদ্ধাদের গুলি শেষ হয়ে যায়। অন্যদিকে পাকসেনারা তাঁদের বাংকার লক্ষ করে বৃষ্টির মতো গুলি ছুড়তে থাকে। এ গুলিতে পরিখার ভেতরে মো. শাহজাহান আলী শহীদ হন। ধানুয়া-কামালপুরের বিডিআর ক্যাম্পের সামনে তাঁকে সমাহিত করা হয়।
মহান মুক্তিযুদ্ধে আত্মদান ও বীরত্বপূর্ণ লড়াইয়ের স্বীকৃতিস্বরূপ বঙ্গবন্ধুর সরকার মো. শাহজাহান আলীকে ‘বীর বিক্রম’ খেতাবে ভূষিত করে। [রীতা ভৌমিক]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৮ম খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!