You dont have javascript enabled! Please enable it!

বীর বিক্রম মো. শাহজাহান সিদ্দিকী

মো. শাহজাহান সিদ্দিকী, বীর বিক্রম (জন্ম ১৯৫০) বীর মুক্তিযোদ্ধা। তিনি ১৯৫০ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নবীনগর থানার সাতমোড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম আলহাজ আব্দুর রাজ্জাক সিদ্দিকী এবং মাতার নাম মারজিয়া সিদ্দিকী।
মো. শাহজাহান সিদ্দিকী ১৯৬৫ সালে ম্যাট্রিক এবং ১৯৬৭ সালে এইচএসসি পাস করেন। উভয় পরীক্ষায় তিনি মেধাবৃত্তি লাভ করেন। ১৯৭১ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগ থেকে বিএসসি (সম্মান) এবং ১৯৭২ সালে এমএসসি পরীক্ষায় কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হন। বিএসসি (সম্মান) পড়ার পাশাপাশি তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মিলিটারি সায়েন্স কোর্সও সম্পন্ন করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নের সময় মো. শাহজাহান সিদ্দিকী ছাত্রনেতা সিরাজুল আলম খান, তোফায়েল আহমেদ, আ স ম আব্দুর রব, আব্দুল কুদ্দুস মাখন প্রমুখের সংস্পর্শে আসেন। তিনি শ্রীকাইল কলেজ ছাত্র সংসদ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঢাকা হল (বর্তমান শহীদুল্লাহ হল) ছাত্র সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন। ছাত্রলীগ-এর একজন নেতা হিসেবে ছাত্রদের ১১-দফা আন্দোলনে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
২৫শে মার্চ রাতে পাকিস্তানি বাহিনী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়-সহ অন্যান্য স্থানে নির্মম হত্যাকাণ্ড শুরু করলে মো. শাহজাহান সিদ্দিকী অন্য বন্ধুদের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। যুদ্ধের শুরুতে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মিলিটারি কোর্স থেকে অর্জিত অভিজ্ঞতা নিজের গ্রামে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ প্রদানে কাজে লাগান। এরপর সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নেয়ার প্রশিক্ষণ গ্রহণের জন্য তিনি ভারতে যান। তিনি মুক্তিবাহিনীর নৌ-উইং-এ যোগ দিয়ে যুদ্ধ করতে মনস্থির করেন। এজন্য পলাশী প্রান্তরের কাছে ভাগীরথী নদীতে ভারতীয় বাহিনীর তত্ত্বাবধানে নৌ-কামান্ডো হিসেবে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন।
নৌ-কমান্ডোর প্রশিক্ষণ শেষ করে মো. শাহজাহান সিদ্দিকী ৮ জন কমান্ডোসহ ভারতের ত্রিপুরার নিউ ক্যাম্পে যোগ দেন। সেখানে তিনি মেজর খালেদ মোশাররফ, বীর উত্তম, ক্যাপ্টেন হায়দার, ভারতীয় নৌবাহিনীর কমান্ডার এম এন সামন্ত, লে. কমান্ডার রায় প্রমুখের সঙ্গে পরিচিত হন।
আগস্ট মাসে মো. শাহজাহান সিদ্দিকীকে একটি গুরুত্বপূর্ণ অপারেশন দলের নেতার দায়িত্ব দেয়া হয়। ঢাকার সঙ্গে কুমিল্লার ময়নামতি সেনানিবাসের নৌযোগাযোগে দাউদকান্দি ফেরিঘাটের একটি অবস্থানগত গুরুত্ব ছিল। মুক্তিযোদ্ধারা এ ফেরিঘাটে আক্রমণ করে পাকিস্তানি বাহিনীর যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করার সিদ্ধান্ত নেন। শাহজাহান সিদ্দিকীর নেতৃত্বে ৮ সদস্যের একটি নৌ-কমান্ডো দল এ অপারেশন পরিচালনার দায়িত্ব পায়। দলের সঙ্গে ছিল একটি স্টেনগান ও একটি রেডিও। এছাড়া দলের প্রত্যেক কমান্ডো একটি করে লিমপেট মাইন, ছুরি ও এক জোড়া ফিনস নিয়ে অপারেশনে যোগ দেন। এ দলের উপনেতা ছিলেন কমান্ডো মতিউর রহমান। ১৬ই আগস্ট রাতে তাঁরা প্রহরারত পাকিস্তানি সেনাদের ফাঁকি দিয়ে ঘাটের ২টি ফেরি ও পন্টুনে লিমপেট মাইন স্থাপন করেন। এরপর সাঁতরে নদী অতিক্রম করে নিরাপদ স্থানে পৌঁছেন। নির্ধারিত সময়ে মাইনগুলো বিস্ফোরিত হয়। শাহজাহান সিদ্দিকীর নেতৃত্বে অপারেশন সফল হয়। ফেরিঘাট বিধ্বস্ত এবং পাকসেনারা হতাহত হয়। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে বীরত্ব প্রদর্শন এবং সাহসিকতাপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ সরকার মো. শাহজাহান সিদ্দিকীকে ‘বীর বিক্রম’ খেতাবে ভূষিত করে (গেজেট নম্বর ২১৪, খেতাবের সনদ নম্বর ১৩৯)।
স্বাধীনতার পর মো. শাহজাহান সিদ্দিকী ১৯৭২ সালের প্রথম সুপিরিয়র সার্ভিস প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসে যোগ দেন। একজন পেশাদার কর্মকর্তা হিসেবে তিনি শিল্প মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি নজরুল ইন্সটিটিউট, ইসলামিক ফাউন্ডেশন এবং ডেসা-র সচিব হিসেবেও কাজ করেন। তিনি ময়মনসিংহ-এর জেলা প্রশাসকের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি প্রথমে আবুধাবিস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসে কাউন্সিলর এবং পরে দুবাইস্থ বাংলাদেশ কনস্যুলেটে ভারপ্রাপ্ত কনসাল জেনারেল নিযুক্ত হন। ২০০৮ সালে তিনি বাংলাদেশ সরকারের সচিব হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন। এরপর তিনি ২০০৯ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত ডেসকো পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিল, জেলা/মহানগর কমান্ড ও উপজেলা কমান্ড নির্বাচন পরিচালনার জন্য গঠিত নির্বাচন কমিশনের কমিশনার নিযুক্ত হন। ২০১৩ সালের আগস্ট থেকে ২০১৫ সালের জুলাই পর্যন্ত তিনি এ দায়িত্ব পালন করেন।
বীর বিক্রম খেতাব ছাড়াও মো. শাহজাহান সিদ্দিকী বিভিন্ন খেতাব, পদক ও সম্মাননায় ভূষিত হন। সেগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক ১৯৯৮ সালে প্রধানমন্ত্রীর পদক ও বীরত্ব-ভূষণ সনদপত্র, সশস্ত্র বাহিনী সম্মাননা (২০০৩, রাষ্ট্রীয়), মৃত্তিকার কৃতী সন্তান খেতাব (২০০১, মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়), বাংলার স্বাধীনতা স্বর্ণফলক (১৯৯৪, সিটি সমাজ কল্যাণ সংস্থা), মহান স্বাধীনতা দিবস সম্মাননা ক্রেস্ট (২০০৬, বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা নৌকমান্ডো এসোসিয়েশন), সম্মানসূচক ক্রেস্ট (ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার্স অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রি) ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। ব্যক্তিজীবনে মো. শাহজাহান সিদ্দিকী ৩ কন্যা সন্তানের জনক। তাঁর স্ত্রীর নাম মোছা. আশরাফুন নেছা সিদ্দিকী। [জালাল আহমেদ]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৮ম খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!