বীর প্রতীক মো. লনি মিয়া দেওয়ান
মো. লনি মিয়া দেওয়ান, বীর প্রতীক (মৃত্যু ১৯৯৪) বীর মুক্তিযোদ্ধা। তিনি লক্ষ্মীপুর জেলার রায়পুর থানার দেবীপুরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম বছির উদ্দীন এবং মাতার নাম ময়না বেগম৷ রায়পুর লিয়াকত মেমোরিয়াল মডেল হাইস্কুলে তিনি পড়াশোনা করেন।
মো. লনি মিয়া দেওয়ান ইপিআর (ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস)-এ চাকরির মাধ্যমে কর্মজীবন শুরু করেন। ১৯৬৫ সালে তিনি
পাক-ভারত যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে মো. লনি মিয়া দেওয়ান বীরত্বের পরিচয় দেন। ১৯৭১ সালে তিনি চট্টগ্রাম ইপিআর হেডকোয়ার্টার্সে নায়েব সুবেদার হিসেবে একটি প্লাটুনের দায়িত্বে ছিলেন।
২৫শে মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ঢাকার রাজারবাগ পুলিশ লাইন, পিলখানা বিডিআর ক্যাম্প ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন স্থানে গণহত্যা শুরু করলে ক্যাপ্টেন রফিকুল ইসলামের নেতৃত্বে চট্টগ্রামের ইপিআর বাহিনী বিদ্রোহ করে। ক্যাপ্টেন রফিকের নির্দেশে মো. লনি মিয়া দেওয়ান অবাঙালি সৈনিকদের বন্দি করেন। এরপর তিনি তাঁর প্লাটুন নিয়ে পাহাড়তলীর পিএনএস জাহাঙ্গীর গেটে অবস্থান নেন। পাকবাহিনী তাঁদের ওপর গোলাবর্ষণ করলে তাঁরাও পাল্টা জবাব দেন। ফলে দুই পক্ষের মধ্যে তুমুল যুদ্ধ শুরু হয়। সারারাত ধরে যুদ্ধ চলে। এক পর্যায়ে তাঁরা টিকতে না পেরে পশ্চাদপসরণ করেন। এরপর সেক্টরভিত্তিক যুদ্ধ শুরু হলে মো. লনি মিয়া ১ নং সেক্টরের অধীনে বিভিন্ন স্থানে সম্মুখ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।
মহান মুক্তিযুদ্ধে বীরত্ব ও সাহসিকতাপূর্ণ অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার মো. লনি মিয়া দেওয়ানকে ‘বীর প্রতীক’ খেতাবে ভূষিত করে (গেজেট নং ৪৩৬, খেতাবের সনদ নং ১৮৬)। মুক্তিযুদ্ধের পর তিনি পুনরায় বিডিআর (বাংলাদেশ রাইফেলস)-এ যোগদান করেন। চাকরি থেকে অবসর গ্রহণের পর তিনি পারিবারিক ব্যবসা পরিচালনা করেন। পাশাপাশি তিনি বিভিন্ন সামাজিক উন্নয়নমূলক কাজের সঙ্গেও সংশ্লিষ্ট ছিলেন। ব্যক্তিজীবনে তিনি দুই কন্যা ও চার পুত্র সন্তানের জনক। তাঁর স্ত্রীর নাম ফুল বানু। ১৯৯৪ সালের ১০ই ফেব্রুয়ারি এই বীর মুক্তিযোদ্ধা পরলোক গমন করেন। [জালাল আহমেদ]
মো. লোকমান, বীর প্রতীক (১৯২৪-১৯৭১) শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা। তিনি নোয়াখালী জেলার সোনাইমুড়ি (পূর্বের বেগমগঞ্জ) থানার ওয়াসেকপুর গ্রামে ১৯২৪ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম ইসমাইল হোসেন ও মাতার নাম সামসুন্নাহার। তিনি শান্তিরহাট প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত অধ্যয়ন করে ওয়াসেকপুর হাইস্কুলে ভর্তি হন। এ স্কুল থেকে তিনি ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন।
ইপিআর (ইস্ট পাকিস্তান রাইফেল)-এ চাকরির মধ্য দিয়ে মো. লোকমানের কর্মজীবন শুরু হয়। তিনি ইপিআর-এর নায়েক হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন|
১৯৭১ সালে মো. লোকমান সিলেট জেলা ইপিআর উইং হেডকোয়ার্টার্সে কর্মরত ছিলেন। ২৫শে মার্চের পর পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে তিনি মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। প্রথম দিকে মো. লোকমান সিলেটের বিভিন্ন প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেন। পরে মেজর খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে ২ নম্বর সেক্টরে যোগ দেন। তিনি রাজনগর সাব- সেক্টরে ক্যাপ্টেন জাফর ইমামের নেতৃত্বে বিভিন্ন সম্মুখ যুদ্ধে বীরত্বের সঙ্গে লড়াই করেন।
জুনের শুরু থেকে পাকবাহিনীর কয়েকটি কোম্পানি অত্যাধুনিক অস্ত্রসহ ফেনীর বিলোনিয়ার দিকে অগ্রসর হতে থাকে। ৪ঠা জুন মুক্তিযোদ্ধাদের একটি অগ্রবর্তী দলের সঙ্গে পাকবাহিনীর যুদ্ধের পর তারা (পাকবাহিনী) পিছু হটতে বাধ্য হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের এ অগ্রবর্তী দলে মো. লোকমানও ছিলেন। পরদিন পাকবাহিনী আরো সংগঠিত হয়ে বেপরোয়াভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর আক্রমণ করে। পাকবাহিনীকে প্রতিরোধের এ যুদ্ধে অন্য মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে মো. লোকমান অসীম সাহসিকতার সঙ্গে লড়াই করেন। কয়েক ঘণ্টা এ-যুদ্ধ চলে। এক পর্যায়ে শত্রুদের এক ঝাঁক গুলি মো. লোকমানের শরীরে এসে বিদ্ধ হয়। সঙ্গে-সঙ্গে তিনি শহীদ হন। স্থানীয় জনগণ ফেনীতেই তাঁর লাশ দাফন করে।
বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে বীরত্ব প্রদর্শন এবং আত্মোৎসর্গ করায় বাংলাদেশ সরকার শহীদ মুক্তিযোদ্ধা মো. লোকমানকে ‘বীর প্রতীক’ খেতাবে ভূষিত করে (তাঁর গেজেট নম্বর ৪৬৪, খেতাবের সনদ নম্বর ২১৪)। তাঁর স্ত্রীর নাম কাওছারা বেগম। [জালাল আহমেদ]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৮ম খণ্ড