You dont have javascript enabled! Please enable it!

বীর প্রতীক মো. নজরুল ইসলাম ভূঁইয়া

মো. নজরুল ইসলাম ভূঁইয়া, বীর প্রতীক (জন্ম ১৯৫০) বীর মুক্তিযোদ্ধা। তিনি ১৯৫০ সালে নরসিংদী জেলার রায়পুরা উপজেলার আমিরগঞ্জে মাতুলালয়ে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম ডা. আবুল হাকিম ভূঁইয়া এবং মাতার নাম আক্তার-উন-নেছা। তিনি নরসিংদী কে কে মল্লিক হাইস্কুলে সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশুনা করে অষ্টম শ্রেণিতে ক্যাডেট কলেজে ভর্তির সুযোগ পেয়ে মারী হিলস- এ অবস্থিত পাকিস্তান এয়ার ফোর্স (পিএএফ) পাবলিক হাইস্কুলে ভর্তি হন এবং ১৯৬৭ সালে এখান থেকে এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯৬৯ সালে তিনি পিএএফ কলেজ (সারগোদা) থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। তারপর তিনি ঐ বছরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিষয়ে অনার্স শ্রেণিতে ভর্তি হন।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর প্রাক্কালে নজরুল ইসলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩য় বর্ষে অধ্যয়নরত ছিলেন। তিনি ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধের পূর্ব পর্যন্ত প্রতিটি রাজনৈতিক ঘটনা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর ৭ই মার্চের দিকনির্দেশনামূলক ভাষণ এবং ২৫শে মার্চ রাতে ঢাকাসহ সারাদেশে পাকহানাদার বাহিনীর নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর ব্যাপক গণহত্যা ও নির্যাতনের ঘটনা তাঁকে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে উদ্বুদ্ধ করে। অতএব ১লা এপ্রিল তিনি সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন এবং প্রতিরোধযুদ্ধে অংশ নেন। প্রতিরোধযুদ্ধ শেষে তিনি ভারতে যান। জুন মাসে তিনি প্রথম বাংলাদেশ ওয়ার ফোর্সে ক্যাডেট হিসেবে নির্বাচিত হন। ২৫শে জুন থেকে ৯ই সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ি জেলার মূর্তিতে অবস্থিত ইন্ডিয়ান মিলিটারি ট্রেনিং একাডেমি থেকে সফলতার সঙ্গে প্রশিক্ষণ সমাপ্তির পর তিনি কমিশনপ্রাপ্ত হন। উল্লেখ্য, মোট ৬১ জনের প্রথম ব্যাচে তাঁর কোর্সমেটদের মধ্যে ছিলেন শেখ কামাল, আবু মঈন মো. আশফাকুস সামাদ, বীর উত্তম, শহীদ খন্দকার আজিজুল ইসলাম, বীর বিক্রম, সায়ীদ আহমেদ, বীর প্রতীক, কে এম আবু বাকের, বীর প্রতীক . «ওয়াকার হাসান, বীর প্রতীক প্রমুখ।
কমিশন প্রাপ্তির পর নজরুল ইসলাম নিয়মিত বাহিনীর অন্তর্ভুক্ত হয়ে ৩নং সেক্টরে যোগদান করেন। এ সেক্টরে তিনি কে এম সফিউল্লাহ, বীর উত্তম ও এ এন এম নূরুজ্জামান, বীর উত্তম-এর অধীনে বিভিন্ন যুদ্ধে বীরত্বের সঙ্গে অংশগ্রহণ করেন। পরবর্তীতে অক্টোবর মাসে ব্রিগেড আকারে ‘এস’ ফোর্স গঠন করা হলে তিনি ১১তম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের চার্লি কোম্পানির কমান্ডিং অফিসারের দায়িত্ব পালন করেন। ‘এস’ ফোর্সের অধীনে তিনি যে-সকল যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন তার মধ্যে ৬ই ডিসেম্বর সংঘটিত ইসলামপুর যুদ্ধ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ঐদিন ‘এস’ ফোর্সের অধিনায়ক কে এম সফিউল্লাহ এবং এ ফোর্সের ১১তম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ব্যাটালিয়ন কমান্ডার আবু সালেহ মোহাম্মদ নাসিম, বীর বিক্রমসহ নজরুল ইসলাম ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার সরাইল উপজেলায় শাহবাজপুর সেতু দখলের জন্য যাত্রা করেন। তাঁদের দল শাহবাজপুরের অদূরে ইসলামপুর নামক স্থানে পৌঁছলে হঠাৎ তাঁরা দুটি ট্রাকে করে আসা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ৩০ ফ্রন্টিয়ার ফোর্সের মুখোমুখি হন। কে এম সফিউল্লাহ তাদের তাৎক্ষণিক আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেন। পাকসেনারা আত্মসমর্পণের ভান করে হাত মাথার ওপর তুলে ট্রাক থেকে নেমেই মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর আক্রমণ শুরু করে। ইতোমধ্যে আরো দুটি বাসে করে আরো কিছু পাকিস্তানি সৈন্য এসে তাদের সঙ্গে যোগ দেয়। শুরু হয় প্রচণ্ড লড়াই। ঘটনার আকস্মিকতায় মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে কিছুটা বিশৃঙ্খল অবস্থার সৃষ্টি হয়। নজরুল ইসলামের ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক মোহাম্মদ নাসিম গুরুতর আহত হন। এমতাবস্থায় নজরুল ইসলাম অত্যন্ত সাহসিকতার সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবেলা করেন। তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের পুনর্গঠিত করে পাল্টা আক্রমণ চালান। এ যুদ্ধে শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানি সেনারা পরাজিত হয়। যুদ্ধে ২৫ জন পাকসেনা নিহত এবং ১৪ জন মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে বন্দি হয়। দুজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ এবং ১১ জন আহত হন।
মহান মুক্তিযুদ্ধে বীরত্ব ও সাহসিকতাপূর্ণ অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার মো. নজরুল ইসলাম ভূঁইয়াকে ‘বীর প্রতীক’ খেতাবে ভূষিত করে (গেজেট নং ২৭০, খেতাবের সনদ নং ২১)। মুক্তিযুদ্ধ শেষে নজরুল ইসলাম তাঁর কর্মক্ষেত্র বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন এবং পর্যায়ক্রমে পদোন্নতি পেয়ে ১৯৮১ সালে লে. কর্নেল পদে উন্নীত হন। তিনি ১৯৮৭ সালের জুলাই থেকে ১৯৯০ সালের সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত লন্ডনে অবস্থিত বাংলাদেশ হাই কমিশনে সহকারী সামরিক উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ১৯৯১ সালে স্বেচ্ছায় সামরিক বাহিনী থেকে অবসর গ্রহণ করেন। অতঃপর তিনি নিজস্ব ব্যবসা পরিচালনা করতে থাকেন। পরবর্তীতে তিনি সক্রিয়ভাবে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন। ২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি আওয়ামী লীগ-এর প্রার্থী হিসেবে নরসিংদী-১ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ২০১৪ সালের জাতীয় সাংসদ নির্বাচনে তিনি পুনরায় এ আসন থেকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত হন। ২৮শে ফেব্রুয়ারি ২০১৪ থেকে তিনি বাংলাদেশ সরকারের পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি এক কন্যা ও এক পুত্র সন্তানের জনক। তাঁর স্ত্রীর নাম ফারজানা নজরুল। [সাজাহান মিয়া]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৮ম খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!