বীর বিক্রম মো. নুরুল হক
মো. নুরুল হক, বীর বিক্রম (জন্ম ১৯৪৬) নায়েক সুবেদার ও যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা। তিনি ১৯৪৬ সালে যশোর জেলার কাশিমপুর ইউনিয়নের ইছালি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মো. শমছের আলী মোল্লা এবং মাতার নাম রাহেলা বেগম। তিনি নিজ গ্রামের বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেন।
মো. নূরুল হক ১৯৬৩ সালের ২০শে ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে তিনি যশোর ক্যান্টনমেন্টে ১ম বেঙ্গল রেজিমেন্টে কর্মরত ছিলেন। ২৯শে মার্চ তিনি যশোর
সেনানিবাস থেকে বিদ্রোহ করে প্রতিরোধযুদ্ধে অংশ নেন।
প্রতিরোধযুদ্ধ শেষে ভারতের বনগাঁ মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে যোগ দেন। তিনি ৮ নম্বর সেক্টরের অধীনে মেজর আবু ওসমান চৌধুরীর নেতৃত্বে পাকসেনাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন স্থানে সম্মুখ সমরে অংশগ্রহণ করেন। পরবর্তীতে ‘জেড’ ফোর্সে যোগ দেন। ‘জেড’ ফোর্সের সদস্য হিসেবে তিনি হৈবাতপুর, চিলমারী, ময়মনসিংহ ও সিলেট জেলার এম সি কলেজে পাকসেনাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ নেন। তিনি অসংখ্য সম্মুখ যুদ্ধ ও গেরিলা হামলায় বীরত্ব ও সাহসিকতার পরিচয় দেন। ১৪ই ডিসেম্বর সিলেটের এম সি কলেজে পাকসেনাদের সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে তিনি গুরুতর আহত হন। ঐ যুদ্ধে বহু পাকিস্তানি সৈন্য হতাহত হয়। মুক্তিযুদ্ধে অসম সাহসিকতা ও বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য তিনি ‘বীর বিক্রম’ খেতাবে ভূষিত হন।
মো. নুরুল হক ২ কন্যা ও ১ পুত্র সন্তানের জনক। তাঁর স্ত্রীর নাম জাহানারা বেগম। [হারুন রশীদ]
মো. নূর ইসলাম, বীর বিক্রম ও বীর প্রতীক (জন্ম ১৯৫৫) স্কুলের ছাত্রাবস্থায় মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা। তাঁর জন্ম ১৯৫৫ সালের ১২ই ডিসেম্বর জামালপুর জেলার অন্তর্গত বকশীগঞ্জ উপজেলার সূর্যনগরের পূর্বপাড়ায়। তাঁর পিতার নাম মো. রইছ উদ্দিন এবং মাতার নাম নবিরন নেসা। ১ ভাই ও ১ বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন কনিষ্ঠ|
৭১-এ মো. নূর ইসলাম ধানুয়া-কামালপুর কোঅপারেটিভ উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্র ছিলেন। তিনি বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা সংগ্রামের আহ্বানে অনুপ্রাণিত হয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের প্রস্তুতি নেন এবং যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিতে এপ্রিলের শেষদিকে মহেন্দ্রগঞ্জ সীমান্ত দিয়ে ভারতে প্রবেশ করেন। মহেন্দ্রগঞ্জ ইয়ুথ ক্যাম্প থেকে মেজর আবু তাহেরের নেতৃত্বে তেলঢালায় ৩১দিন গেরিলা প্রশিক্ষণ নেন। প্রশিক্ষণ শেষে তিনি মহেন্দ্রগঞ্জ ইয়ুথ ক্যাম্পে ফিরে আসেন। ২২শে মে তিনি মহেন্দ্রগঞ্জ সাব-সেক্টর কমান্ডার কর্নেল আব্দুল মান্নানের নেতৃত্বে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। ভারতীয় সেনাবাহিনী এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যদের গাইড করে তিনি কামালপুরের বিভিন্ন যুদ্ধক্ষেত্রে নিয়ে যান। তিনি জামালপুর জেলার বকশিগঞ্জ উপজেলার উঠনপাড়া, কামালপুর, রামরামপুর, টেংরামারি, সিধাপাড়া, সাড়মারা, দেওয়ানগঞ্জ উপজেলার বগারচর ও শেরপুর জেলার শ্রীবর্দী উপজেলার ভাড়েরা নামক স্থানে পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নেন।
আগস্ট মাসের শেষদিকে রাত ১০টার দিকে তিনি মহেন্দ্রগঞ্জ ইয়ুথ ক্যাম্প থেকে কোম্পানি কমান্ডার এম আর হোসেন পান্নার নির্দেশে ৩০-৪০ জন মুক্তিযোদ্ধাকে পথ দেখিয়ে ভোরে বকশিগঞ্জ উপজেলার বাট্টাজোড়ের নতুন বাজারে নিয়ে যান। মুক্তিযোদ্ধারা রাস্তার পূর্ব-পশ্চিম দুপাশে এম্বুশ করে অবস্থান নেন। পাকিস্তানি সেনারা বকশিগঞ্জ থেকে কামালপুরের দিকে আসার পথে সড়কের দুপাশ থেকে তাঁরা আক্রমণ চালালে উভয় পক্ষের মধ্যে যুদ্ধ হয়। এ যুদ্ধে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়। মো. নূর ইসলাম সেখানে একটি ডোবায় লুকিয়ে থাকেন। এসএলআর-এর বেল্ট ওপরের দিকে রেখে কচুরিপানা মাথায় দিয়ে সারাদিন সেখানে অবস্থান করেন। সন্ধ্যার দিকে সেখান থেকে সীমান্ত পার হয়ে মহেন্দ্রগঞ্জ ইয়ুথ ক্যাম্পে ফিরে যান।
সেপ্টেম্বর মাসের শেষদিকে মো. নূর ইসলাম ৪০ জনের মতো মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে মহেন্দ্রগঞ্জ ইয়ুথ ক্যাম্প থেকে সীমান্ত পার হয়ে ভোর ৫টার দিকে কামালপুরের নিকটবর্তী খাসির গ্রামে পৌঁছান। পাকিস্তানি সেনারা প্রায়ই এ গ্রামের ওপর দিয়ে যাতায়াত করত। মুক্তিযোদ্ধারা এদিন গ্রামের বিলের পশ্চিম পাশে অবস্থান নেন। পাকিস্তানি সেনারা আগে থেকেই বিলের পূর্ব পাশে অবস্থান করছিল। তারা বিলের পূর্বপাশ থেকে প্রথম গুলি চালালে উভয় পক্ষের মধ্যে আধঘণ্টা তুমুল লড়াই চলে। অবস্থা বেগতিক দেখে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী পিছু হটে।
১৭ই অক্টোবর রাত ২টার দিকে মো. নূর ইসলাম কোম্পানি কমান্ডার সদরুল জামান হেলালের নির্দেশে প্লাটুন কমান্ডার আবু সাঈদের নেতৃত্বে ৩০-৩৫ জন মুক্তিযোদ্ধাকে মহেন্দ্ৰগঞ্জ ইয়ুথ ক্যাম্প থেকে বাংলাদেশের সীমান্ত দিয়ে ধানুয়া গ্রামে নিয়ে আসেন। ভোর ৪টার দিকে মুক্তিযোদ্ধারা ২, ৩ ও ৪ নম্বর বাংকারে অবস্থান নেন। মো. নূর ইসলাম ৪ নম্বর বাংকারে অবস্থান নিয়ে বীরত্বের সঙ্গে লড়াই করতে থাকেন। এক পর্যায়ে বাংকার ছেড়ে পিছু হটে নিরাপদ স্থানে সরে যান। পরে সহমুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে তিনি ভারতের বান্ডরোডে অবস্থান নেন। সেখানেও পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সঙ্গে তাঁদের প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়। মো. নূর ইসলাম গাছের আড়াল থেকে পাকিস্তানি সেনাদের লক্ষ করে গুলিবর্ষণ করতে থাকেন। পাকিস্তানি সেনারা তাঁকে লক্ষ করে গুলি চালালে তিনি মারাত্মকভাবে আহত হন। সহযোদ্ধারা তাঁকে মহেন্দ্রগঞ্জ ইয়ুথ ক্যাম্পে নিয়ে প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে ভারতের তুরায় নিয়ে যান। তুরায় ৬ দিন চিকিৎসার পর তাঁকে গোহাটি নিয়ে যাওয়া হয় এবং সেখানে ৭ দিন থাকার পর উত্তর প্রদেশের সেন্ট্রাল কমান্ড হাসপাতালে তাঁকে চিকিৎসা দেয়া হয়।
মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে বীরত্ব ও সাহসিকতাপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক মো. নূর ইসলামকে ‘বীর বিক্রম’ ও ‘বীর প্রতীক’ খেতাবে ভূষিত করা হয়। তিনি ৪ পুত্র সন্তানের জনক। তাঁর স্ত্রীর নাম মোসাম্মৎ নূরুন্নাহার। [রীতা ভৌমিক]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৮ম খণ্ড