You dont have javascript enabled! Please enable it! বীর প্রতীক মো. খোরসেদ আলম - সংগ্রামের নোটবুক

বীর প্রতীক মো. খোরসেদ আলম

মো. খোরসেদ আলম, বীর প্রতীক (জন্ম ১৯৫১) নৌ- কমান্ডো ও চট্টগ্রামে অপারেশন জ্যাকপট-এ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনকারী বীর মুক্তিযোদ্ধা। তিনি ১৯৫১ সালের ১লা জুন চট্টগ্রাম জেলার কোতয়ালি থানার নন্দন কাননে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম সাদত আলী ও মাতার নাম সুফিয়া খাতুন। তিনি ১৯৬৭ সালে চট্টগ্রামের প্রবর্তক বিদ্যাপীঠ থেকে এসএসসি পাস করেন। ১৯৬৯ সালে তিনি চট্টগ্রামের সিটি কলেজ থেকে এইচএসসি এবং স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে বিএসসি পাস করেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর আদর্শের অনুসারী হিসেবে মো. খোরসেদ আলম স্কুলের ছাত্র থাকাকালে ছাত্রলীগ-এর সক্রিয় কর্মী ছিলেন। ছাত্রজীবন থেকেই তিনি সাহসী ও স্বাধীনচেতা ছিলেন।
৭১-এর ১লা মার্চ ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য মুলতবি ঘোষণা করলে চট্টগ্রাম শহরে এর প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিল হয়। মো. খোরসেদ আলম সেদিন কেমিস্ট্রি প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষা শেষে মিছিলে যোগ দেন। ২রা ও ৩রা মার্চ চট্টগ্রামে হরতাল পালিত হয়। অন্য ছাত্র-তরুণদের সঙ্গে তিনি হরতালের পক্ষে মিছিল- সমাবেশে অংশ নেন। বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ-এর পর চট্টগ্রামে তাঁদের এলাকায় মো. খোরসেদ আলমসহ অন্য ১২-১৪ জন ছাত্র-তরুণের একটি দল গঠিত হয়। চট্টগ্রামের নামকরা শিকারী এনায়েত মাওলা এ দলের সদস্যদের মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ দেন। ১০ দিন ঐ প্রশিক্ষণ চলে। এখানে তাঁরা বন্দুক ও রাইফেল চালানো এবং গ্রেনেড নিক্ষেপের কৌশল আয়ত্ত করেন। ২০শে মার্চ চট্টগ্রামে আওয়ামী লীগ নেতা জহুর আহমেদ চৌধুরী এমএনএ-র নেতৃত্বে হাউজিং এন্ড সেটেলমেন্ট অফিসে মুক্তিযুদ্ধের নিয়ন্ত্রণ কক্ষ স্থাপিত হলে মো. খোরসেদ আলম তাতে যুক্ত হন। ২৫শে মার্চ রাতে পাকিস্তানি সৈন্যরা গণহত্যা শুরু করলে তাঁরা মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে ভারতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। মো. খোরসেদ আলম ১লা মার্চ বাড়ি ত্যাগ করে মীরেশ্বরাই যান। সেখানে ৭ দিন অবস্থানের পর বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী চাঁদগাজীতে যান। এখানে পাকিস্তানপন্থী পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলস্ (ইপিআর)-এর সদস্যদের বিরুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের পরিচালিত যুদ্ধে তিনি বাংকারে-বাংকারে গুলি সরবরাহের দায়িত্ব পালন করেন। এটি ছিল খুবই ঝুঁকিপূর্ণ কাজ। যে-কোনো সময় প্রতিপক্ষের শেলের আঘাতে তাঁর প্রাণহানি ঘটতে পারত। ১০ই এপ্রিল ৩০ জন মুক্তিযোদ্ধার একটি দলসহ তাঁরা ভারতের সীমান্ত শহর শ্রীনগরে যান। এখান থেকে তাঁরা হেঁটে হরিণা ক্যাম্পে যান। এ ক্যাম্পে তিনি ৮ দিনের প্রশিক্ষণ নেন। হরিণা ক্যাম্পে চট্টগ্রামের তখনকার ছাত্রনেতা এস এম ইউসুফের সঙ্গে তাঁর দেখা হয়। তাঁর কাছে তিনি বিমান বাহিনীতে যোগ দেয়ার ইচ্ছা ব্যক্ত করেন। কিন্তু এস এম ইউসুফের পরামর্শে তিনি হরিণায় নৌবাহিনীর রিক্রুটিং ক্যাম্পে যান এবং নৌবাহিনীতে যোগ দেন। এখানে রিক্রুট হওয়া ৬০ জনের সঙ্গে তিনি আগরতলা যান। সেখানে ৭ দিন অবস্থানের পর ট্রেনে কলকাতায় এবং পরে কলকাতা থেকে মুর্শিদাবাদ জেলার ভাগীরথী নদীর তীরবর্তী পলাশিতে প্রতিষ্ঠিত নেভাল কমান্ডো প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে যান। এখানে তাঁরা ৩ মাস প্রশিক্ষণ নেন। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নৌকমান্ডোদের পরে দেশের ভেতরে বিভিন্ন অপারেশনে পাঠানো শুরু হলে মো. খোরসেদ আলম ১৫ই আগস্ট পরিচালিত চট্টগ্রাম বন্দর অপারেশনে অংশ নেন। এটি ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও আলোচিত অপারেশন। এর কমান্ডার ছিলেন সাবমেরিনার আবদুল ওয়াহেদ চৌধুরী। কমান্ডারের একান্ত সহযোগী ছিলেন মো. খোরসেদ আলম। এ অপারেশনের জন্য প্রয়োজনীয় অস্ত্র, বিস্ফোরক ও অন্য সরঞ্জামাদি চট্টগ্রামে নিরাপদে আনা ও কমান্ডোদের কাছে সরবরাহে মো. খোরসেদ আলম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এ সফল অপারেশনে চট্টগ্রাম বন্দরে থাকা কয়েকটি জাহাজ, গানবোট, বার্জ ও পন্টুন ধ্বংস হয়। ২রা নভেম্বর মো. খোরসেদ আলম আবার চট্টগ্রামে আসেন। নভেম্বরের শেষের দিকে চট্টগ্রাম বন্দরে পরিচালিত আরেকটি অপারেশনে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
মহান মুক্তিযুদ্ধে সাহসিকতাপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ সরকার মো. খোরসেদ আলমকে ‘বীর প্রতীক’ খেতাবে ভূষিত করে। স্বাধীনতার পর তিনি কিছুদিন পারিবারিক ব্যবসা করেন। ১৯৭৪ সালে তিনি চাকরি নিয়ে অবুধাবি যান। আবুধাবিতে চাকরি শেষে কিছুদিন তিনি সিঙ্গাপুরে চাকরি করেন। ১৯৮৩ সালে তিনি দেশে ফিরে আসেন। তিনি ২ কন্যা ও ১ পুত্র সন্তানের জনক। তাঁর স্ত্রীর নাম সুলতান আরা বেগম। [জালাল আহমেদ]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৮ম খণ্ড