You dont have javascript enabled! Please enable it!

বীর প্রতীক মো. জহুরুল হক মুন্সী

মো. জহুরুল হক মুন্সী, বীর প্রতীক (জন্ম ১৯৫০) বীর মুক্তিযোদ্ধা ও ইন্টেলিজেন্স কমান্ডার। তিনি ১৯৫০ সালের ৩০শে সেপ্টেম্বর ময়মনসিংহ জেলার শ্রীবর্দি উপজেলার চন্দ্রাবাজ গ্রামে এক কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মো. আব্দুল গফুর মিয়া এবং মাতার নাম মোসাম্মৎ গুলেছা খাতুন। বকসীগঞ্জ এন এম উচ্চ বিদ্যালয়ে দশম শ্রেণিতে লেখাপড়া অবস্থায় একটি ঘটনায় তিনি স্কুল থেকে বহিষ্কৃত হন। স্বাধীনতার পর নারায়ণগঞ্জ বন্দর বি এম ইউনিয়ন হাইস্কুল থেকে এসএসসি পাস করেন। এরপর আর লেখাপড়ার সুযোগ হয়নি।
মো. জহুরুল হক মুন্সী বকসীগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এক ঘটনায় বহিষ্কৃত হওয়ার পর নারায়ণগঞ্জ চলে আসেন এবং সেখানে ৬০-এর দশকের শুরুতে ডকইয়ার্ডে সাধারণ শ্রমিক হিসেবে কাজ শুরু করেন। সে অবস্থায় বিনা বেতনে ছুটি নিয়ে তিনি শফিপুর আনসার একাডেমিতে ৩ মাসের প্রশিক্ষণ নেন।
তিনি স্বউদ্যোগে এক মাসের সিভিল ডিফেন্স প্রশিক্ষণও গ্রহণ করেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি ৩০৩ রাইফেল নিয়ে নারায়ণগঞ্জের নিকটবর্তী চাষাঢ়া এলাকায় অন্যান্যদের সঙ্গে পাকহানাদার বাহিনীর অনুপ্রবেশের বিরুদ্ধে প্রতিরোধযুদ্ধে অংশ নেন। প্রতিরোধ ভেঙ্গে পড়লে তিনি ১০ই এপ্রিল নারায়ণগঞ্জ ত্যাগ করে আড়াইহাজার থানা হয়ে দীর্ঘপথ পায়ে হেঁটে ১৪ই এপ্রিল ভারতের মহেন্দ্রগঞ্জ (মেঘালয়) এসে পৌছেন। সেখানে বিএসএফ-এর ক্যাপ্টেন নিয়োগীর তত্ত্বাবধানে প্রাথমিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। এরপর তুরায় উচ্চ প্রশিক্ষণ নেন। সবশেষে চেরাপুঞ্জীতে গেরিলা যুদ্ধের বিভিন্ন কৌশল, বিশেষ করে মাইন ও বিস্ফোরকের ওপর বিশেষ প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। যুদ্ধের সময় একাধিকবার বাংলাদেশের ভেতরে মাইন স্থাপন, বিস্ফোরক দিয়ে ব্রিজ, সুইসগেট ইত্যাদি ধ্বংস করতে তাঁকে পাঠানো হয়। যুদ্ধের পাশাপাশি শত্রুপক্ষের অবস্থান, চলাফেরাসহ বিভিন্ন বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ কার্যে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তিনি একবার বিক্রেতা সেজে বিষ মেশানো কলা খাইয়ে গাইবান্ধা ট্রেজারিতে অবস্থানরত পাকহানাদারদের কয়েকজনকে হত্যা করেন।
নভেম্বর মাসের প্রথম দিকে তাঁকে ১ম মারাঠা লাইট ইনফ্যান্ট্রির সঙ্গে যুক্ত করা হয়। মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অবদানের মধ্যে দুটি ঘটনা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। একটি, ১৪ই নভেম্বর ভারী অস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে সীমান্তবর্তী কামালপুরে অগ্রসরমাণ একদল পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে এম্বুশে ৪টি ভারী মর্টার ও ৬টি গাড়ি ধ্বংস, ১০ জন পাকসেনা নিহত ও একজন অফিসারসহ ৭ জন আহত হওয়ার ঘটনা। ভারতীয় সেনাদের সঙ্গে জহুরুল হক মুন্সীও ঐ এম্বুশে ছিলেন। তিনি স্থানীয় হওয়ায় এম্বুশের স্থান তাঁর পরামর্শ অনুযায়ী নির্বাচন করা হয়। অপরটি, ৯ই ডিসেম্বর ব্রিগেডিয়ার ক্লে-র নেতৃত্বে ভারতীয় আর্টিলারি রেজিমেন্ট জামালপুর পৌছার পর সেখানে শক্তিশালী প্রতিরক্ষা দুর্গ গড়ে পূর্ব থেকে অবস্থান নেয়া পাকিস্তানি কমান্ডিং অফিসার লে. কর্নেল সুলতান মাহমুদ-এর নিকট আত্মসমর্পণের আহ্বান জানিয়ে লেখা পত্র পৌছানো। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মুক্তিযোদ্ধা জহুরুল হক মুন্সীই এটি করেন। পাকিস্তানি সেনা ক্যাম্প থেকে প্রাণ নিয়ে ফিরে আসতে সক্ষম হলেও সেখানে প্রথমে তাঁকে চোখ বেঁধে অমানুষিক নির্যাতন করা হয়, যাতে তাঁর চারটি দাঁত ভেঙ্গে যায়। এরপর মিত্রবাহিনী র সেনাদের সঙ্গে জামালপুর দখলের যুদ্ধে তিনি সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। এ যুদ্ধে দুই শতাধিক পাকিস্তানি সৈন্য নিহত, অনেকে আহত ও মিত্রবাহিনীর হাতে বন্দি হয়। এভাবে ১০ই ডিসেম্বর জামালপুর হানাদার মুক্ত হয়।
মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক তিনি দুবার ‘বীর প্রতীক’ উপাধিতে ভূষিত হওয়ার বিরল গৌরব অর্জন করেন। এছাড়াও পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে সাহসী ও গুরুত্বপূর্ণ অবদানের কথা উল্লেখ করে ১ম মারাঠা লাইট ইনফ্যান্ট্রির কমান্ডিং অফিসার লে. কর্নেল কে এস ব্রারা জহুরুল হক মুন্সীকে একটি প্রশংসাপত্র দেন। [হারুন-অর-রশিদ]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৮ম খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!