বীর উত্তম মো. জালাল উদ্দিন
মো. জালাল উদ্দিন, বীর উত্তম (জন্ম ১৯৪২) বীর মুক্তিযোদ্ধা। তিনি ১৯৪২ সালের ২২শে জুন মাগুরা জেলার মহম্মদপুর উপজেলার পলাশবাড়িয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।
তাঁর পিতার নাম মো. ইসমাইল মোল্লা এবং মাতার নাম বড়ু বিবি। তিনি ১৯৫৬ সালে মাগুরা কলেজিয়েট হাই মাদ্রাসা থেকে মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ঐ বছর ২২শে জুন তিনি পাকিস্তান নৌবাহিনীতে নাবিক হিসেবে যোগ দেন। করাচির পিএনএস বাহাদুর-এ প্রাথমিক প্রশিক্ষণ গ্রহণের পর তিনি পরবর্তীতে বিভিন্ন যুদ্ধ জাহাজে মৌলিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর প্রাক্কালে জালাল উদ্দিন চট্টগ্রামে নৌবাহিনীর ঘাঁটিতে লিডিং সি ম্যান হিসেবে কর্মরত ছিলেন। মার্চের উত্তাল রাজনৈতিক আন্দোলনের সময় চট্টগ্রাম বন্দর থেকে পাকিস্তানি বাহিনী কর্তৃক এমভি সোয়াত ও এমভি রুস্তম জাহাজ থেকে অস্ত্র ও গোলাবারুদ খালাস করা তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন। ২৫শে মার্চ রাতে পাকিস্তানি বাহিনী কর্তৃক ঢাকাসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর ব্যাপক গণহত্যা শুরু করার খবর জানতে পেরে তিনি গোপনে পাকিস্তানি জাহাজ ত্যাগ করে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করার জন্য পশ্চিমবঙ্গের ২৪ পরগনা জেলার অন্তর্গত টাকী মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে যোগ দেন। ১২ই মে তাঁকে মুক্তিবাহিনীর নৌ-কমান্ডো দলে অন্তর্ভুক্ত করে প্রশিক্ষণের জন্য মুর্শিদাবাদ জেলার পলাশী নৌ-প্রশিক্ষণ ঘাঁটিতে পাঠানো হয়। প্রশিক্ষণ শেষে অপারেশন জ্যাকপট-এর আওতায় মংলা ও হিরণ পয়েন্টে নৌ অপারেশনে অংশ নেবার জন্য জালাল উদ্দিন ৬০ জনের নৌ কমান্ডো দলের সঙ্গে ৭ই আগস্ট কয়রা থানার বেদকাশী নামক স্থানে আসেন। সেখান থেকে জালাল উদ্দিনসহ ১৬ জন মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডোর হিরণ পয়েন্টের উদ্দেশে যাবার কথা থাকলেও তাঁদের নিরাপত্তা ও আশ্রয় প্রদানের দায়িত্বে থাকা ক্যাপ্টেন জিয়াউদ্দিন আহমেদ তাঁদের শরণখোলা ঘাঁটিতে নিয়ে যান। ১৪ই আগস্ট থেকে ১২ই সেপ্টেম্বর পর্যন্ত হিরণ পয়েন্ট, সুন্দরবন ও মংলা বন্দরে অপারেশন জ্যাকপট সফলভাবে পরিচালনার পর তিনি পুনরায় ভারতে ফিরে যাবার সিদ্ধান্ত নেন। ১৫ই সেপ্টেম্বর জালাল উদ্দিন ও কামান্ডো দলের ১২ জন সদস্য তাঁদের অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ভারতের উদ্দেশে রওনা হন। পথিমধ্যে ১৭ই সেপ্টেম্বর সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলার হরিনগর নামক স্থানে চুনকুড়ি নদীর বেড়িবাঁধে অবস্থান নিয়ে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার নবানদীর দলের সঙ্গে যৌথভাবে পাকিস্তানি নৌবাহিনীর একটি গানবোটের ওপর আক্রমণ করে একজন গানারকে হত্যা করেন৷ ১৮ই সেপ্টেম্বর জালাল উদ্দিন ও নৌ-কমান্ডো দলের অন্যান্য সদস্যগণ পলাশীতে ফিরে আসেন।
অক্টোবর মাসে জালাল উদ্দিন ও অন্যান্য সহ-নৌকমান্ডোগণ কলকাতার গার্ডেনরিচ ডকইয়ার্ডে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর যুদ্ধ জাহাজ বিএনএস পদ্মা ও বিএনএস পলাশ তৈরি করার কাজে নিয়োজিত হন। ১০ই নভেম্বর তাঁরা এদুটি জাহাজ নিয়ে মংলা বন্দরে প্রবেশ করে বন্দরের মুখে ৮টি মার্ক *১১ গ্রাউন্ড মাইন ফেলে রাখেন। ১১ই নভেম্বর মংলা বন্দরে প্রবেশকালে এসব মাইন বিস্ফোরণে পাকিস্তানি তিনটি বাণিজ্য জাহাজ ও একটি গানবোট ধ্বংস হয়। এ ঘটনা তদন্তের জন্য পিএনএস তোফায়েল সেখানে গেলে মার্ক ১১ গ্রাউন্ড মাইন বিস্ফোরণে জাহাজটিও ধ্বংস প্রাপ্ত হয়, নিহত হয় জাহাজে থাকা পাকিস্তান নৌবাহিনীর ৪ জন অফিসার ও ৩৬ জন নৌ-সেনা। এর ফলে মংলা সমুদ্র বন্দর কার্যত বন্ধ হয়ে যায়।
জালাল উদ্দিন আরো যেসব অপারেশনে অংশ নেন তার মধ্যে অপারেশন হট প্যান্টস- উল্লেখযোগ্য। এর আওতায় ১০ই ডিসেম্বর যৌথবাহিনীর তিনটি যুদ্ধ জাহাজ আইএনএস প্যানভেল (ভারতীয়), বিএনএস পদ্মা ও বিএনএস পলাশ (বাংলাদেশী) খুলনায় পাকিস্তানি নৌ-ঘাঁটি দখলের জন্য খুলনা শিপইয়ার্ড-এর কাছাকাছি পৌঁছলে ভুলবশত ভারতীয় বোমারু বিমান পদ্মা ও পলাশের ওপর বোমাবর্ষণ শুরু করে। এতে উভয় জাহাজই বিধ্বস্ত হয়। জালাল উদ্দিন ছিলেন বিএনএস পদ্মা জাহাজে। পায়ে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় তিনি জাহাজ থেকে লাফিয়ে পানিতে পড়ে আত্মরক্ষা করেন। উল্লেখ্য, ভারতীয় বিমান হামলায় মো. রুহুল আমিন, বীরশ্রেষ্ঠ সহ ৮ জন নৌ-কমান্ডো শহীদ এবং অনেকে আহত হন।
স্বাধীনতা যুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য মো. জালাল উদ্দিনকে বাংলাদেশ সরকার ‘বীর উত্তম’ খেতাবে ভূষিত করে (গেজেট নং ৫৮, খেতাবের সনদ নং ৫১)। এছাড়াও ২০০৮ সালের ৭ই অক্টোবর এ বীর মুক্তিযোদ্ধার স্মরণে ঢাকা শহরের বনানী কবরস্থান সংলগ্ন ৪ নম্বর সড়কটির নামকরণ করা হয় বীর উত্তম জালাল উদ্দিন সড়ক। মুক্তিযুদ্ধ শেষে জালাল উদ্দিন তাঁর কর্মস্থল বাংলাদেশ নৌবাহিনীতে যোগদান করেন এবং পদোন্নতি পেয়ে ১৯৭৫ সালে লেফটেন্যান্ট কমান্ডার পদে উন্নীত হন। ১৯৯০ সালে তিনি বাংলাদেশ নৌবাহিনী থেকে অবসর গ্রহণ করেন। তিনি তিন কন্যা ও এক পুত্র সন্তানের জনক। [সাজাহান মিয়া]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৮ম খণ্ড