বাংলার বাণী
ঢাকা: ২৫শে অক্টোবর, বৃহস্পতিবার, ৮ই কার্তিক, ১৩৮০
শান্তি, আর কতো দূর?
যুগ যুগ ধরে ইতিহাস মানুষকে শুধু এই শিক্ষাই দিয়েছে যে, যুদ্ধ ‘ধ্বংসেরই নামান্তর মাত্র’ এবং অসংযত ধ্বংস কখনোই শান্তির পথ সুগম হতে পারে না। অথচ বার বার মানুষ নিজের হাতেই আগ্রাসী উত্তেজনা শিকার হয় নানান ভাবে নিজের নির্বুদ্ধিতায় আক্কেল সেলামি দিয়েছে। তবুও মানুষের শিক্ষা হয়নি। এটা যে যুগ যুগের পরিশ্রমে নির্মিত সভ্যতার পক্ষে কতখানি ক্ষতি কারক এবং সভ্যতার একচেটিয়া দাবিদার মানুষের পক্ষে ন্যক্কারজনক তা সামান্য একটু ভাবলেই সম্যক উপলব্ধি করা যায়। অপরের ভূমি, সম্পদ বা সম্মানের অপর আগ্রাসী কোন শক্তিকে কোন সভ্য ও সুমতি সম্পন্ন দেশের মানুষ অনুমোদন জানাতে পারে না। আমরাও জানাতে পারি না। তাই বিশ্বের কোন প্রকৃত শান্তিপ্রিয় দেশই পরভূমের উপর আগ্রাসী ইসরাইলি হামলা কে কখনোই সমর্থন করেনি। সুতরাং মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধে বিশ্বজনমত ও শুভেচ্ছা একান্ত ভাবেই বীর সংগ্রামী আরবদের স্বপক্ষে ছিল।
অবশ্য, যুদ্ধ চলুক এটা বিশ্বের কোনো শান্তিপ্রিয় দেশ আশা করেনি এবং এখনও করে না। বরং, যুদ্ধ বন্ধ হয়ে একটা সম্মানজনক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হোক এবং বিদ্যমান উভয় দেশই পারস্পারিক মর্যাদার প্রতি সহনশীল হয়ে বিশ্ব শান্তি নিশ্চিত হোক এটা সারা বিশ্বের ঐক্যবদ্ধ আহ্বান।
আরব ও ইসরাইল এর মধ্যে দীর্ঘদিন যুদ্ধের পর বৃহৎ শক্তির জয় এর উদ্যোগে উভয়ের মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবার যে কোন আলোক রশ্মীটি দেখা দিয়েছিল, তা কুটিল শক্তির প্রভাবে একবারেই নিভে গেছে। আবার বিশ্বশান্তি এক দারুণ হুমকির সম্মুখীন।
১৯৬৭-র পর আরো ইসরাইলের মধ্যে এটাই সর্ব মারাত্মক সংঘর্ষ। ১৯৪৮ সনে ইসরাইলিদের জন্মের পর মুহূর্ত থেকেই উভয়ের মধ্যে বিদ্বেষ-অগ্নিশিখা জ্বলে ওঠে। বহুদিনের যুদ্ধ ও সন্ত্রাসের পর ১৯৪৮ সালের ১৫ ই মে প্যালেস্টাইনে ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রণ শেষ হয় এবং এর আগের দিন ইসরাইল নামক একটি পৃথক রাষ্ট্রের জন্ম হয়।
১৫ই মে মধ্যরাতে মিশর, সিরিয়া, জর্ডান, লেবানন ও ইরাকি বাহিনীর সঙ্গে ইসরাইলি বাহিনীর প্রথম বৃহদাকার সংঘর্ষ হয়। এ সংঘর্ষ প্রায় দু’সপ্তাহ স্থায়ী হয়েছিল। এরপর আসে যুদ্ধ বিরতি। রাষ্ট্র হিসেবে তার অস্তিত্বকে স্বীকার করে নেওয়ার জন্য ইসরাইল জোর দাবি জানায়, কিন্তু জেরুজালেমের অর্ধেক এবং অন্যান্য এলাকা আরবদের দখলে থাকে। ১৯৬৭ পর্যন্ত এই অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয়নি। ইসরাইলি অত্যাচারে নিষ্পেষিত হয়ে শত শত আরব ফিলিস্তিনি ঘরবাড়ি ছেড়ে জানের ভয়ে চারিদিকে পালাতে থাকে।
এরপর ১৯৫৬ সালে ব্রিটিশ-ফরাসি চক্রান্তে ইসরাইল মিশরের ওপর হামলা চালায়। ফ্রান্স ও ব্রিটেন মিশরের বিমানঘাঁটি গুলোর উপর তুমুল বোমা বর্ষণ করে। প্রবল বিশ্বচাপে যুদ্ধ শেষ হয়। ইসরাইল নিজের সীমান্তে সৈন্য সরিয়ে নিতে রাজি হয় এবং জাতিসংঘের একটি শান্তি রক্ষাকারী বাহিনী মোতায়েন করা হয়। সুয়েজ মিশরের নিয়ন্ত্রণে থাকে।
১৯৬৭ সালের ৫ই জুন আবার উত্তেজনা বেড়ে আরব-ইসরাইল এর মধ্যে সংঘর্ষ বাধে ছ’দিনের যুদ্ধে সিনাই, গোলাম, পার্বত্য এলাকা সমগ্র জেরুজালেম এবং সমগ্র জর্ডান নদীর পশ্চিমাঞ্চল ইসরাইলীদের দখলে চলে যায়। এরপর আর একটি যুদ্ধ বিরতি হয়।
১৯৬৭ সালের ২২শে নভেম্বর জাতিসংঘ সাধারন পরিষদে অধিকৃত এলাকাসমূহ থেকে ইসরাইল সৈন্য প্রত্যাহারের আদেশ দিয়ে একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়
ইসরাইল এ আদেশ অমান্য করে এবং আরবরা ইসরাইলের অস্তিত্বকে অস্বীকার করে। এরপর বিশ্বজোড়া সন্ত্রাস ও হুমকি চালাতে থাকে যার চরম পরিণতি এই তিয়াত্তরের সংঘর্ষ।
গত সোমবার ইসরাইল ও মিশর ১৭ দিনের মধ্যপ্রাচ্য যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবে সম্মত হয়। কিন্তু নির্ধারিত সময়সীমা পর্যন্ত যুদ্ধ চলতে থাকে। ইসরাইলি মন্ত্রিসভার বৈঠকের পর ইসরাইল যুদ্ধ বিরতি মেনে নেওয়ার কথা ঘোষণা করে। ওদিকে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডঃ হেনরি কিসিঙ্গার মস্কোয়ে সোভিয়েত নেতা লিওনিদ ব্রেঞ্জনেভ এর সাথে আলোচনার পর ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী মিসেস গোলাডমায়ার সাথে আলোচনা করতে তেলগাবিব যান।
মিশরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাতও কায়রো বেতার থেকে যুদ্ধবিরতি মেনে নেওয়ার কথা ঘোষণা করেন। ইরাক যদিও যুদ্ধ বিরতি মেনে নেয়নি এবং প্রথমদিকে সিরিয়া তার সিদ্ধান্ত দেয়নি। সারাবিশ্ব মোটামুটি আশা নিয়েই ছিল যে অশান্তির একটা সাফল্যজনক পরিসমাপ্তি ঘটবে। কিন্তু আবার জঙ্গির উৎপাত আর রণ দামামা সারা বিশ্বকে ভাবিত ও শংকিত করে তুলেছে। গতপরশু সুয়েজের দু’পাড়ে ঘোরতর আকাশ ও ট্যাংক যুদ্ধ বেধে যাওয়ায় মধ্যপ্রাচ্য যুদ্ধ বিরতি সম্পূর্ণ ভেস্তে গেছে। যুদ্ধ বিরতির ভেস্তে যাওয়ার জন্য কায়রো ও তেলআবিব পরস্পর পরস্পরকে দোষারোপ করছে। অবস্থা এখন সম্পূর্ণ অশান্ত অনিশ্চিত।
খবরে প্রকাশ যে, যুদ্ধ বিরতি সত্ত্বেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অব্যাহত গতিতে ইসরাইলকে অস্ত্র সরবরাহ করে যাচ্ছে। সাম্রাজ্যবাদী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এ ন্যাক্কারজনক ভূমিকার জন্য সমগ্র বিশ্ব আজ বিস্মিত। একদিকে যুদ্ধ বিরতির জন্য মার্কিনী কুন্তীরাশ্রু বর্ষণ অন্যদিকে যুদ্ধের লেলিহান শিখাকে প্রজ্জ্বলিত রাখার জন্য অস্ত্র সরবরাহ করা কি মার্কিনী আন্তরিকতাকে সম্পূর্ণ প্রহসনে পর্যবসিত করছে না?
আমরা কঠোর ভাষায় এর নিন্দা করছি এবং মার্কিন সরকারের প্রতি আবেদন জানাচ্ছি সামান্য কুটিল স্বার্থে উম্মাদ হয়ে বিশ্ব শান্তি নিয়ে এভাবে টালবাহানা করা উচিত হবে না। আমাদের বিশ্বাস প্রকৃত শান্তি প্রতিষ্ঠায় সোভিয়েত রাশিয়ার যথেষ্ট দায়িত্ব আছে। ১৯৬৭’র প্রস্তাব বাস্তবায়িত করে একটা সম্মানজনক ব্যবস্থা নিতে এগিয়ে আসবে এটা সবাই আজ একান্তভাবে প্রত্যাশা করছে।
কুম্ভকর্ণের নিদ্রা ভঙ্গ হবে কি?
সৈয়দপুর রেলওয়ে ওয়ার্কশপ এর মুমূর্ষ অবস্থায় সারাদেশের রেলওয়ে পরিবহন ব্যবস্থার মারাত্মক অন্তরায়ের জন্ম দিয়েছে। প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি নেই যাত্রীবাহী ও মাল পরিবহন বগি তৈরীর উপকরণাদীর দুর্ভিক্ষ এত প্রকট যে, এই রেলওয়ে ওয়ার্কশপ এর কর্তব্যরত আট হাজার শ্রমিকের মধ্যে বর্তমানে মাত্র পাঁচ হাজার শ্রমিক কর্তব্যরত রয়েছে। কিন্তু তারা হাত পা গুটিয়ে বসে আছে। কাজের উপকরণ নেই। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় যেসব রেল ইঞ্জিন এবং বগি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল সেগুলো মেরামত এখনো পর্যন্ত সম্পূর্ণ করা সম্ভব হচ্ছে না। অথচ এ সৈয়দপুর রেলওয়ে ওয়ার্কশপ একসময় উপমহাদেশের অন্যতম গৌরবের কারণ ছিল। এখান থেকে যেসব বগী তৈরি হতো তা যেকোন উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের আধুনিক ওয়ার্কশপে প্রস্তুত বগীর তুল্যমূল্য বিবেচনার দাবীদার ছিল। কিন্তু এখন সৈয়দপুর ওয়ার্কশপে শতকরা ষাট জন অদক্ষ শ্রমিক বহাল রয়েছে। অবাঙালি দক্ষ শ্রমিকরা ওয়ার্কশপে অনুপস্থিত থাকার ফলে ওয়ার্কশপটি যেমন অকেজো হয়ে পড়েছে, তেমনি রেলওয়ে পরিবহন ব্যবস্থাকে সংকটঃকীর্ণ করে তুলেছে। এবং এ কারণেই দেশের উত্তরাঞ্চলের রেল যাত্রী ও ব্যবসায়ীরা নিত্যদিন এক সীমাহীন ভোগান্তি সঙ্গে যুদ্ধ করছে। সৈয়দপুর রেলওয়ে ওয়ার্কশপ টিকে উপকরণাদিতে সজ্জিত করে পূর্ণোদ্যমে চালু করার ব্যাপারে রেলওয়ে কর্তাব্যক্তিরা কোনরকম কার্যকর ব্যবস্থা যদি না নেন, তাহলে এককালের গৌরব এর ওয়ার্কশপটি অচিরেই পঙ্গু হয়ে পড়বে। তাই আমরা সময় থাকতেই ওয়ার্কশপটি চাঙ্গা করে তোলার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে সজাগ করে দিচ্ছি। দেশের রেলযাত্রীদের অবর্ণনীয় দুর্দশার কথা নতুন করে বলার আর অপেক্ষা রাখে না। মাল পরিবহন ক্ষেত্র অচলায়তন বিরাজিত। কাজেই সুষ্ঠু পরিচালনাধীনে ওয়ার্কশপের একটি হিল্লে হওয়া দরকার। সৈয়দপুর রেলওয়ে ওয়ার্কশপে যদি আবার পূর্ণোদ্যমে কাজ চলে, তাহলে হয়তো আমাদের সীমিত ইঞ্জিন ও বগি গুলো মেরামত করে পরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়ন সাধন ত্বরান্বিত করা সম্ভব। কিন্তু রেলওয়ে কর্তাব্যক্তিদের কুম্ভকর্ণের নিদ্রা ভঙ্গ হবে কি?
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক