You dont have javascript enabled! Please enable it! বীর প্রতীক মো. ইব্রাহীম খান - সংগ্রামের নোটবুক

বীর প্রতীক মো. ইব্রাহীম খান

মো. ইব্রাহীম খান, বীর প্রতীক (১৯৪৫-১৯৯১) যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা। তিনি ১৯৪৫ সালের ১৯শে এপ্রিল মানিকগঞ্জ সদর থানার বরঙ্গাখোলা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম জমশের খান এবং মাতার নাম আমাতুন বিবি। মো. ইব্রাহীম খান খুব অল্প বয়সে পিতৃমাতৃহীন হন। তিনি বরঙ্গাখোলা প্রাইমারি স্কুলে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত অধ্যয়ন করেন। পরে নারায়ণগঞ্জ থেকে এসএসসি পাস করেন। ঢাকার সাভারস্থ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডে ফোরম্যান হিসেবে যোগদান করে তিনি কর্মজীবন শুরু করেন। তিনি একজন ক্রীড়াবিদ ছিলেন। নারায়ণগঞ্জ ও ঢাকায় ফুটলবার হিসেবে তাঁর খ্যাতি ছিল। ১৯৭৪-৭৫ সালে নারায়ণগঞ্জে আয়োজিত স্পোর্টসে তিনি চ্যাম্পিয়ন হন।
মো. ইব্রাহীম খান একজন শান্ত স্বভাবের মানুষ এবং অসম্ভব দেশপ্রেমিক ও দায়িত্বসচেতন ছিলেন। চাকরি জীবনে তিনি বাঙালিদের প্রতি পাকিস্তানিদের বৈষম্যমূলক আচরণ গভীরভাবে প্রত্যক্ষ করেন। ২৬শে মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান- স্বাধীনতা ঘোষণা করলে তিনি পাকিস্তানি হানাদারদের কবল থেকে দেশকে মুক্ত করার জন্য মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তখন তিনি সাভারের বিদ্যুৎ উন্নয়নে বোর্ডে কর্মরত ছিলেন। জুন মাসে তিনি সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে যান। ২ নম্বর সেক্টরে যোগ দিয়ে আগরতলার মেলাঘর থেকে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। বিদ্যুৎ বিভাগে কাজ করার অভিজ্ঞতা থাকায় তাঁকে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ এলাকার পাওয়ার কেন্দ্রগুলোতে অপারেশন করার বিশেষ প্রশিক্ষণ ও দায়িত্ব দেয়া হয়। তিনি ও তাঁর দলের মুক্তিযোদ্ধারা ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে কয়েকটি অপারেশন চালান। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অপারেশন করেন নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ বিদ্যুৎ কেন্দ্রে। ৩রা নভেম্বর তাঁরা এ কেন্দ্র ধ্বংস করার অপারেশনে যান। তাঁরা পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকারদের পাহারার মধ্যে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ট্রান্সফর্মার রুমে ঢুকে বিস্ফোরক স্থাপন করেন। বিস্ফোরক স্থাপন শেষে ফেরার পথে তাঁরা পাকসেনা ও রাজাকারদের দ্বারা আক্রান্ত হন। হানাদারদের গুলির মুখে তাঁরাও পাল্টা আক্রমণ করেন। দুপক্ষের মধ্যে যুদ্ধ চলাকালে মো. ইব্রাহীম খান পাকিস্তানিদের নিক্ষিপ্ত গ্রেনেডে মারাত্মকভাবে আহত হন। তাঁর ডান চোখ ও মুখে স্প্লিন্টার বিদ্ধ হয়। রক্তাক্ত অবস্থায় তাঁকে অন্য মুক্তিযোদ্ধারা উদ্ধার করেন। আক্রান্ত হলেও তাঁদের এ অপারেশন সফল হয়। বিস্ফোরণে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বেশ কয়েকটি ট্রান্সফর্মার ধ্বংস হয়। ফলে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়।
মহান মুক্তিযুদ্ধে সাহসিকতাপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ সরকার মো. ইব্রাহীম খানকে ‘বীর প্রতীক’ খেতাবে ভূষিত করে। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে তিনি সিদ্ধিরগঞ্জ বিদ্যুৎ কেন্দ্রে যোগ দেন। ১৯৮২ সালে তাঁকে মানিকগঞ্জ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডে বদলি করা হয়। ১৯৯১ সালে তিনি এখানে উপসহকারী প্রকৌশলী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। এ বছরের ৫ই মে রাতে মানিকগঞ্জ শহর ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় বিদ্যুৎ সংযোগ বিনষ্ট হলে মো. ইব্রাহীম খান উপরস্থ কর্মকর্তার নির্দেশে বিদ্যুৎ সংযোগ পুনঃস্থাপনের কাজ করার সময় দুর্ঘটনায় পতিত হন। তাঁর শরীরের প্রায় অর্ধেক অংশ পুড়ে যায়। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় ১৮ই মে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। দেশের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করে যিনি মারাত্মকভাবে আহত হন, তিনি আবার দেশের জন্য কাজ করতে গিয়ে জীবন দান করেন। এলাকার মুক্তিযোদ্ধাদের দাবিতে মানিকগঞ্জ শহরস্থ মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সামনে তাঁর মরদেহ দাফন করা হয়। তিনি ১ পুত্র ও ২ কন্যা সন্তানের জনক। তাঁর স্ত্রীর নাম খুরশিদা বেগম। [জালাল আহমেদ]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৮ম খণ্ড