You dont have javascript enabled! Please enable it!

বীর প্রতীক মো. আব্দুল হাই

মো. আব্দুল হাই, বীর প্রতীক (জন্ম ১৯৪৫) সুবেদার, পরবর্তীতে সুবেদার মেজর ও যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা। তিনি ১৯৪৫ সালের ৩০শে জুন ঢাকার খিলক্ষেত উপজেলার ডুমনি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মাহমুদুর রহমান এবং মাতার নাম মকবুলেন নেছা। মো. আব্দুল হাই ১৯৫৮ সালের ২৯শে জুন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন। ট্রেনিং শেষে তাঁর পোস্টিং হয় যশোর সেনানিবাসে ১ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে
৭১-এ মো. আব্দুল হাই পাকিস্তানের কোয়েটা সেনানিবাসে প্রশিক্ষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ-এর বিপুল বিজয়কে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে পারেনি। এ-সময় থেকে তারা সেনানিবাসে বাঙালি অফিসার ও সৈনিকদের কোণঠাসা করে রাখে। সাতই মার্চের ভাষণ-এর দুদিন আগে পাকিস্তান সেনা কর্তৃপক্ষ মো. আব্দুল হাই-এর কাছে থাকা তাঁর রেডিওটি ক্লোজ করে নেয়। তারা বেশকিছু অবাঙালি সেনা অফিসারকে পূর্ব বাংলায় পোস্টিং দেয়। তাদের এসব কর্মকাণ্ডে মো. আব্দুল হাই ভীষণ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। এর ৪-৫ দিন পর আউট পাস নিয়ে সেনানিবাসের বাইরে এসে তিনি জানতে পারেন যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান- ৭ই মার্চের ভাষণে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণের বাঙালিদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। এমতাবস্থায় তিনি কোয়েটা থেকে পালিয়ে ট্রেনযোগে করাচি এবং সেখান থেকে বিমানযোগে ঢাকায় আসেন। তবে বাড়ি না গিয়ে ১৬ই মার্চ যশোরে তাঁর প্যারেন্ট ইউনিট ১ম বেঙ্গলে চলে যান। কোয়েটা থেকে পালিয়ে আসার অপরাধে তাঁকে সেনানিবাসের গেটেই গ্রেপ্তার করে বাঙালি অফিসার লেফটেন্যান্ট কর্নেল রেজাউল জলিলের অধীনে রাখা হয়। এ-সময় অধিকাংশ বাঙালি অফিসার ও সৈনিকদের শীতকালীন ট্রেনিংয়ের জন্য চুয়াডাঙ্গা সীমান্তে চলে যাওয়ার নির্দেশ দেয়া হলে বন্দি অবস্থায় তাঁকেও সেখানে নিয়ে যাওয়া হয়। ২৫শে মার্চ হানাদার বাহিনী কর্তৃক ঢাকা ও দেশের অন্যত্র সংঘটিত গণহত্যার সংবাদ ২৭শে মার্চ স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের মাধ্যমে চুয়াডাঙ্গা সীমান্তে পৌঁছলে মো. আব্দুল হাইকে মুক্তি দেয়া হয়। অতঃপর তিনি ৩০শে মার্চ যশোর সেনানিবাসে ক্যাপ্টেন হাফিজ উদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশ নেন। কিন্তু তাদের সঙ্গে না পেরে তাঁরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যশোরের চৌগাছায় এসে সহযোদ্ধাদের সঙ্গে একত্রিত হন। যশোরের আশপাশের বেশ কয়েকটি স্থানে সম্মুখ যুদ্ধ শেষে তিনি ভারতে গিয়ে ‘জেড’ ফোর্সের অন্তর্ভুক্ত হন। জুলাই মাসে ১ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ব্যাটালিয়ান কমান্ডার মেজর মঈনুল হোসেন চৌধুরীর নেতৃত্বে তিনি কামালপুরে যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেন।
জামালপুর জেলার বকশীগঞ্জ উপজেলায় ভারতের ধানুয়া সীমান্তবর্তী এলাকা কামালপুর। এ বিওপিতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ৩১ বেলুচ রেজিমেন্টের দুই কোম্পানি সৈন্য একটি শক্তিশালী ঘাঁটি স্থাপন করে। এ কারণে মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে এ সীমাস্ত দিয়ে নির্বিঘ্নে দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ ভীষণ কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। এজন্য কামালপুর বিওপির পতন ঘটানো মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য অনিবার্য হয়ে পড়ে। কামালপুর বিওপি হানাদারমুক্ত করার দায়িত্ব অর্পিত হয় ১ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ব্যাটালিয়ান কমান্ডার মেজর মঈনুল হোসেন চৌধুরী, ক্যাপ্টেন সালাহউদ্দিন মমতাজ এবং ক্যাপ্টেন হাফিজ উদ্দিন আহমেদের ওপর। সুবেদার মো. আব্দুল হাই একজন প্লাটুন কমান্ডার হিসেবে এ যুদ্ধে অংশ নেন। ৩০শে জুলাই মধ্যরাতের পর পাকবাহিনীর ঘাঁটি কামালপুর বিওপি আক্রমণ করা হয়। এ যুদ্ধে অগ্রগামী দলে নেতৃত্ব দেন ক্যাপ্টেন সালাহউদ্দিন মমতাজ এবং তাঁর অতি নিকটবর্তী স্থানে অবস্থান নিয়ে গুলি ছুড়তে থাকেন সুবেদার মো. আব্দুল হাইসহ তাঁর প্লাটুনের মুক্তিযোদ্ধারা। উভয় পক্ষের মধ্যে তুমুল যুদ্ধ হয়। এক পর্যায়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আক্রমণের প্রচণ্ডতায় অধিকাংশ মুক্তিযোদ্ধা ছত্রভঙ্গ হয়ে যান। এমনি এক পরিস্থিতি সত্ত্বেও ক্যাপ্টেন সালাহউদ্দিন মমতাজ হ্যান্ড মাইকে মুক্তিযোদ্ধাদের সামনের দিকে অগ্রসর হতে নির্দেশ দিতে থাকেন। হঠাৎ পাকবাহিনীর ছোড়া একটি গুলি এসে সালাহউদ্দিন মমতাজের বুকে বিদ্ধ হয়। বাম পায়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারাত্মকভাবে আহত হন সুবেদার মো. আব্দুল হাই। এ যুদ্ধে ক্যাপ্টেন সালাহউদ্দিন মমতাজসহ ৩০ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ ও ৬০-৭০ জন আহত হন। আহত অবস্থায় মো. আব্দুল হাই অতি কষ্টে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে কিছুটা দূরে একটি ডোবার মধ্যে এসে আশ্রয় নেন। সকালে হায়দার আলী নামে একজন স্কুল ছাত্র ( রামরামপুর) তাঁকে সেখান থেকে উদ্ধার করে গরুর গাড়িযোগে মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে পৌঁছে দেয়। সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে তাঁকে উন্নত চিকিৎসার জন্য হেলিকপ্টারযোগে তুরা হাসপাতালে পাঠিয়ে দেয়া হয়। ২১ দিন চিকিৎসার পর সুস্থ হয়ে সুবেদার মো. আব্দুল হাই পুনরায় মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়ে ১৪ই ডিসেম্বর সিলেটের এম সি কলেজের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। মহান মুক্তিযুদ্ধে অসীম সাহসিকতা ও বীরত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ মুক্তিযোদ্ধা সুবেদার মো. আব্দুল হাইকে বাংলদেশ সরকার ‘বীর প্রতীক’ খেতাবে ভূষিত করে। তিনি ১৯৮৫ সালে সুবেদার মেজর পদে পদোন্নতি লাভ করার পর সেনাবাহিনী থেকে স্বেচ্ছায় অবসর গ্রহণ করেন। তাঁর স্ত্রীর নাম শামীমা আক্তার। এ দম্পতির ১ কন্যা ও ২ পুত্র সন্তান রয়েছে। [শফিউদ্দিন তালুকদার]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৮ম খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!