You dont have javascript enabled! Please enable it! বীর বিক্রম মো. আবু বকর - সংগ্রামের নোটবুক

বীর বিক্রম মো. আবু বকর

মো. আবু বকর, বীর বিক্রম (১৯৫০-১৯৭১) কলেজের ছাত্রাবস্থায় মুক্তিযুদ্ধে যোগদানকারী, আত্মঘাতী স্কোয়াডের সদস্য ও শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা। তিনি ১৯৫০ সালের ৫ই মে ঢাকার গুলশান এলাকায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মো. আবু জাফর এবং মাতার নাম আনোয়ারা খাতুন। মো. আবু বকর ১৯৭১ সালে ঢাকার কায়েদে আযম কলেজ (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী কলেজ)-এ বিএ প্রথম বর্ষের ছাত্র থাকাবস্থায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অফিসার্স কোর্সে যোগদানের অপেক্ষায় ছিলেন।
মে মাসে মো. আবু বকর মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের উদ্দেশ্যে ত্রিপুরার মেলাঘরে যান। সেখানে ক্যাপ্টেন হায়দারের নেতৃত্বে আত্মঘাতী স্কোয়াডের সদস্য হিসেবে গেরিলা প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। প্রশিক্ষণের পর একটি বিশেষ দলের সঙ্গে ঢাকায় এসে তিনি বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ ও দুঃসাহসিক গেরিলা অপারেশনে অংশগ্রহণ করেন। তন্মধ্যে শাহবাগস্থ হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল অপারেশন অন্যতম। এ হোটেলে তাঁরা দুবার অপারেশন চালান। প্রথম ৯ই জুন, দ্বিতীয়বার ১১ই আগস্ট।
পাকবাহিনী বিদেশী প্রতিনিধি ও সাংবাদিকদের উপস্থিতিতে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে ৯ই জুন একটি সাংবাদিক সম্মেলনের আয়োজন করে। এ সম্মেলনে আতঙ্ক সৃষ্টির লক্ষ্যে মো. আবু বকর ও তাঁর সহযোদ্ধারা ঐদিন যথাসময়ে দেয়াল টপকে হোটেলে প্রবেশ করে পরপর তিনটি গেনেডের বিস্ফোরণ ঘটিয়ে নিরাপদে বেরিয়ে আসেন। সেখান থেকে রমনা থানার কাছে এক জামাত নেতার বাড়িতে গিয়ে তিনটি গ্রেনেডের বিস্ফোরণ ঘটিয়ে চলে যান দৈনিক পাকিস্তান পত্রিকা অফিসের কাছে। সেখানে দৈনিক পাকিস্তান ও মর্নিং নিউজ পত্রিকা অফিসের সামনে আরো দুটি সফল বিস্ফোরণ ঘটিয়ে তাঁরা নিরাপদে তাঁদের গোপন আস্তানায় চলে যান। একই দিনে রাজধানী ঢাকা শহরের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থানে এরকম তিনটি অভিযানে তাঁরা যে সাফল্য ও সাহসিকতার পরিচয় দেন, তা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে স্মরণীয় ঘটনা। এতে পাকবাহিনী ও বিদেশীদের মনে প্রচণ্ড আতঙ্কের সৃষ্টি হয়।
১১ই আগস্ট দ্বিতীয় অপারেশনের মূল পরিকল্পনায় ছিলেন আবু বকর ও আব্দুস সামাদ। একদিন মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া (← আওয়ামী লীগ নেতা ও সাবেক মন্ত্রী) ও গাজী গোলাম দস্তগীরকে নিয়ে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেন আবু বকর ও আব্দুস সামাদ। কিন্তু সেখানে ৯ই জুনের অভিযানের পর কর্তৃপক্ষ কড়া নিরাপত্তার ব্যবস্থা করায় বিষয়টি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। ইতঃপূর্বে ইন্টারকন্টিনেন্টালের শপিং আর্কেডের কয়েকটি দোকানের নিয়নসাইন সংযোজনের কাজ করেছিলেন আব্দুস সামাদ। সে-সূত্রে তিনি খবর পান, সেখানে অবস্থিত থাই ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্স তাদের অফিস হোটেলের ছোট একটি কক্ষে স্থানান্তরিত করবে। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে তিনি ঐ অফিসের ডেকোরেশনের কাজে নিজেকে নিয়োজিত করেন। এ কাজের ফাঁকে তিনি হোটেলটি ভালোভাবে রেকি করেন। ১১ই আগস্ট বিকেলে একটি ব্রিফকেসে ২৮ পাউন্ড পিকে ও ৫৫ মিনিট মেয়াদি টাইমবোম সাজিয়ে আবু বকর সঙ্গীদের নিয়ে একটি প্রাইভেট কারে করে রওনা হন ইন্টারকন্টিনেন্টালের উদ্দেশে। পার্কিংয়ে পৌঁছে ব্রিফকেস নিয়ে তাঁরা নিজেদের নিরাপত্তার জন্য হোটেল লাউঞ্জের মূল দরজা দিয়ে প্রবেশ না করে ‘সুইস এয়ারের’ অফিস কক্ষের দরজা দিয়ে প্রবেশ করেন। মায়া ও গাজী গাড়িতে স্টেনগান নিয়ে তাঁদের ফেরার অপেক্ষায় বসে থাকেন।
আবু বকর সোজা প্রসাধন কক্ষের একেবারে কোনার একটি ঘরে প্রবেশ করে দরজা বন্ধ করে দেন। সামাদ বাইরে থাকেন কাভার হিসেবে। কক্ষের ভেতরে টাইম বোমা চালু করে সামাদসহ তিনি দেয়াল টপকে বেরিয়ে অপেক্ষমাণ গাড়িতে করে দ্রুত হোটেল ত্যাগ করেন। নির্দিষ্ট সময়ে বিকট শব্দে বিস্ফোরণ ঘটলে হোটেলের লাউঞ্জ, শপিং আর্কেড ও আশপাশের কক্ষের কাচ টুকরো-টুকরো হয়ে ভেঙ্গে পড়ে, ছিটকে যায় দরজা-জানালা আর ভেঙ্গে পড়ে কক্ষের ভেতর ও লাউঞ্জের লাগোয়া দেয়ালসমূহ। বেশ কয়েকজন আহত হয়। দুদিন পর বিশ্বের বিভিন্ন সংবাদপত্রে বেশ গুরুত্বসহকারে এ অপারেশনের সংবাদ প্রকাশিত হয়। এ অপারেশনই ছিল মো. আবু বকরের শেষ অভিযান ২৯শে আগস্ট পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তাঁকে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে টর্চার সেলে অমানুষিক নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করে। মুক্তিযুদ্ধে অসীম সাহসিকতা প্রদর্শনসহ জীবন উৎসর্গ ও মূল্যবান অবদানের জন্য শহীদ মো. আবু বকরকে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক ‘বীর বিক্রম’ (মরণোত্তর) খেতাবে ভূষিত করা হয়। তিনি ছিলেন অবিবাহিত। [মুহম্মদ সায়েদুর রহমান তালুকদার]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৮ম খণ্ড