মুক্তিযুদ্ধে মেহেরপুর সদর উপজেলা
মেহেরপুর সদর উপজেলা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে একটি স্বর্ণোজ্জ্বল নাম। ১৯৭১ সালে যে বৈদ্যনাথতলা গ্রামটিতে মুজিবনগর সরকার শপথ গ্রহণ করেছিল, সেটি তখন এ উপজেলার অন্তর্ভুক্ত ছিল। বর্তমানে এটি মুজিবনগর উপজেলার অন্তর্ভুক্ত। ষাটের দশক থেকে এখানে আওয়ামী লীগ, ন্যাপ (ভাসানী), কৃষক সমিতি, ছাত্রলীগ – ও ছাত্র ইউনিয়ন-এর সাংগঠনিক ভিত্তি শক্তিশালী ছিল। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে জাতীয় পরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদে আওয়ামী লীগ প্রার্থী মোহাম্মদ শাহীদ উদ্দিন এবং মো. নুরুল হক বিজয়ী হন। ১৯৭১ সালের মার্চ মাস জুড়ে মেহেরপুরের রাজপথ ছিল ছাত্র-যুবক ও কৃষক-জনতার স্বতঃস্ফূর্ত মিছিলে উত্তাল। ১লা মার্চ সরকারি দমন-পীড়ন ও হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে মেহেরপুরের ছাত্রসমাজ তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে। ২রা মার্চ মেহেরপুর শহরে ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের যৌথ উদ্যোগে বিশাল মিছিল বের হয়। ৩রা মার্চ মেহেরপুর শহরে সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়। ৪ঠা মার্চ প্রতিটি ইউনিয়নে স্বেচ্ছাসেবক ২৩°৪৮’ বাহিনী গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। ৪ঠা থেকে ৬ই মার্চ পর্যন্ত প্রতিদিন শহরে অর্ধদিবস হরতাল পালিত হয়। হরতাল চলাকালে স্কুল-কলেজ, অফিস-আদালত, দোকান-পাট, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সব বন্ধ থাকে। প্রতিদিন গ্রামগঞ্জ থেকে শহরে মিছিল আসতে থাকে।
৭ই মার্চ বিকেলে মেহেরপুর মহকুমা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোহাম্মদ শাহীদ উদ্দিন এমএনএ-এর সভাপতিত্বে এক জরুরি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনা মোতাবেক গ্রাম থেকে শুরু করে ইউনিয়ন, থানা, পৌর এলাকা, মহকুমা সদর সর্বত্র আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। এ-সময় মোহাম্মদ শাহীদ উদ্দিন এমএনএ-কে আহ্বায়ক করে মেহেরপুর মহকুমা সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়। কমিটির অন্য সদস্যরা ছিলেন- মো. নুরুল হক এমপিএ, ইসমাইল হোসেন, আব্দুল মান্নান মাস্টার, আ কা ম ইদ্রিস আলী, হিসাবউদ্দিন, জালালউদ্দিন, শাহাবাজউদ্দিন নিজু, ডা. আবু আব্দুল্লাহ, ডা. আব্দুর রশিদ, এনামুল হক, ডা. মহিউদ্দিন, খাদেমুল ইসলাম, আব্দুর রহমান, নঈমউদ্দিন প্রমুখ। ডা. আবু আব্দুল্লাহ, নঈমউদ্দিন, ফইমউদ্দিন, এ কে আশকারী পটল, আতাউল হাকিম লাল মিয়া, মানিক মিয়া ও শাজাহান খান বিশুর নেতৃত্বে মেহেরপুর শহর সংগ্রাম কমিটি গঠন করা হয়। সলেমান মিয়া (গহরপুর), ডা. আব্দুল মান্নান (টুঙ্গি) ও ফণীভূষণ সাহা (রাজনগর)-র নেতৃত্বে পিরোজপুর, আব্দুল মান্নান মাস্টার (গোপালপুর) ও আলাহামদু মাস্টার (গোপালপুর)-এর নেতৃত্বে মহাজনপুর, ডা. মহিউদ্দিন (আমঝুপি), শামসুজ্জোহা ও আব্দুস সাত্তারের নেতৃত্বে আমঝুপি, আহাম্মদ আলী (আমদহ) ও ইসমাইল হোসেন (রাইপুর)-র নেতৃত্বে আমদহ, আবুল কাশেম (গোভীপুর) ও আজিজুল হক (হরিরামপুর)-এর নেতৃত্বে বুড়িপোতা, ডা. আহসানউল্লাহ (কুলবাড়িয়া) ও গোলাম মোস্তফা (তেরঘরিয়া)-র নেতৃত্বে কুতুবপুর এবং আ কা ম ইদ্রিস আলী (দারিয়াপুর), ডা. কমরউদ্দিন (ভবানীপুর, মোনাখালী), আব্দুল মোমিন চৌধুরী ও দোয়াজ আলী মাস্টার (ভবরপাড়া)-এর নেতৃত্বে বাগোয়ান ইউনিয়ন সংগ্রাম কমিটি গঠন করা হয়। মেহেরপুর মহকুমা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোহাম্মদ শাহীদউদ্দিন এমএনএ, এ কে আনসারী পটল, রমজান আলী ও খাদেমুল ইসলাম বেতাই যুব ক্যাম্পের দায়িত্ব পালন করে। তাঁরাই ছিলেন মেহেরপুর জেলা ও সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতা ও মুক্তিযুদ্ধের মূল সংগঠক। তাঁদের নেতৃত্বে গড়ে ওঠে বিশাল এ মুক্তিবাহিনী। এছাড়া আওয়ামী লীগ নেতা আ কা মা ইদ্রিস আলী, ইসমাইল হোসেন, আব্দুল মান্নান মাস্টার, শাহাবুদ্দিন নিজ্জু, ডা. আবু আব্দুল্লাহ, ডা. মহিউদ্দিন আহমেদ, আতাউল হাকিম লাল মিয়া, আব্দুর রব, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব প্রসেনজিৎ বোস বাবুয়া, মফিজুর রহমান, হাফিজুর রহমান, কামাল আহমেদ মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালক করেন।
১৫ই মার্চ বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা মিছিল নিয়ে মেহেরপুর থানায় গিয়ে বাংলাদেশের মানচিত্র-খচিত পতাকা উত্তোলন করে এবং বিভিন্ন অফিস থেকে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর প্রতিকৃতি নামিয়ে ফেলে। সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশগ্রহণের আহ্বান জানিয়ে মোহাম্মদ শাহীদ উদ্দিন এমএনএ, আ কা ম ইদ্রিস আলী, আব্দুল মান্নান মাস্টার ও ইসমাইল হোসেনের নেতৃত্বে বিভিন্ন ইউনিয়নে জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। ২৬শে মার্চ মহকুমা প্রশাসকের কার্যালয়ে প্রতিরোধযুদ্ধ পরিচালনার জন্য কন্ট্রোল রুম স্থাপন করা হয়। কন্ট্রোল রুমে পর্যায়ক্রমে দায়িত্ব পালন করেন ইসমাইল হোসেন, এ কে আশকারী পটল, আ কা ম ইদ্রিস আলী, শাহাবাজউদ্দিন নিজ্জু, খাদেমুল ইসলাম, মেহেদী বিল্লাহ, শাহাজাহান খান বিশু প্রমুখ। পাকবাহিনীকে প্রতিরোধের উদ্দেশ্যে মেহেরপুরের অধিকাংশ বন্দুক- মালিকদের নিয়ে মুছাদ মিয়ার বাড়িতে বন্দুক-বাহিনী গঠন করা হয়। এ বাহিনী গঠনে ভূমিকা রাখেন সিরাজুল ইসলাম (পটল), প্রশান্ত ভট্টাচার্য (মানু), আবুল হাশেম, শাহাবাজউদ্দিন নিৰ্জ্জু প্রমুখ।
২৬শে মার্চ সকালে মহকুমা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে মেহেরপুরের মহকুমা প্রশাসক তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। এরপর থেকে তিনি সব সময় নিজের গাড়িতে বাংলাদেশের পতাকা ব্যবহার করতেন। যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা-শুশ্রূষা ও চিকিৎসার জন্য আওয়ামী লীগ নেতা ডা. আবু আব্দুল্লাহর নেতৃত্বে একটি মেডিকেল টিম গঠন করা হয়। ২৬শে মার্চ জেলখানা থেকে কয়েকজন দুর্ধর্ষ ডাকাত যেমন জামাত কানা, আকবর, ইদ্রিস, শক্তি দাস প্রমুখকে শর্তসাপেক্ষে মুক্তি দিয়ে ভারত থেকে বিস্ফোরক দ্রব্যাদি এনে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে শক্তিশালী বোমা তৈরির দায়িত্ব দেয়া হয়।
২৯শে মার্চ তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী ভারতের বেতাই বিওপি ক্যাম্প পরিদর্শনে যান এবং নদীয়ার জেলা প্রশাসকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। ৩০শে মার্চ তিনি এবং ঝিনাইদহের এসডিপিও মাহবুবউদ্দিন আহমেদ আওয়ামী লীগ নেতা তাজউদ্দীন আহমদ এবং ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম-কে চেংখালী সীমান্ত দিয়ে ভারতে পৌঁছে দেন। ১লা এপ্রিল মুক্তিযুদ্ধের খবারাখবর প্রচারের জন্য আলী ওবায়দুর রহমান ওরফে মিরাজ মিয়া (চুয়াডাঙ্গা; মেহেরপুর নির্বাচন অফিসে কর্মরত)-র সম্পাদনায় সাইক্লোস্টাইলে জয়বাংলা- নামে দুপাতার একটি পত্রিকা প্রকাশিত হয়। ৫ই এপ্রিল স্বাধীন বাংলাদেশের পক্ষে ভারতীয় বুদ্ধিজীবী মহলের সমর্থন ও সহযোগিতা লাভের উদ্দেশ্যে মেহেরপুর থেকে এডভোকেট আবদুর রাজ্জাকের নেতৃত্বে একটি সাংস্কৃতিক প্রতিনিধিদল কলকাতা যায়। যুদ্ধকালীন সময়ে জ্বালানি তেলের প্রায়োজনীয়তার কথা বিবেচনায় রেখে সংগ্রাম কমিটির নেতৃবৃন্দ পার্শ্ববর্তী চুয়াডাঙ্গা এবং পশ্চিমবঙ্গের করিমপুর পেট্রোল পাম্প থেকে জ্বালানি তেল সংগ্রহের ব্যবস্থা করেন।
মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকেই বিপুল সংখ্যক ছাত্র-যুবক ও কৃষক-শ্রমিক দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে যুদ্ধে অংশগ্রহণে এগিয়ে আসেন। তাদের অভ্যর্থনা ও প্রশিক্ষণের জন্য বাংলাদেশ সরকারের নেতৃবৃন্দ ভারতীয় সীমান্ত এলাকার বেশকিছু শহরে যুব-অভ্যর্থনা শিবির এবং প্রশিক্ষণ কেন্দ্র চালু করেন। দেশত্যাগী এসব ছাত্র-যুবক ও কৃষক- শ্রমিকরা প্রশিক্ষণের জন্য প্রথম দিকে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার হৃদয়পুর যুব-অভ্যর্থনা ক্যাম্প, বেতাই ক্যাম্প, শিকারপুর ক্যাম্প এবং করিমপুর ক্যাম্প বেছে নেয়। ১৯শে এপ্রিল মুজিবনগরের নিকটবর্তী পশ্চিমবঙ্গের চাপড়া থানার সীমান্তবর্তী গ্রাম হৃদয়পুরে যে ক্যাম্পটি খোলা হয়, সেখানে মূলত মেহেরপুরসহ বৃহত্তর কুষ্টিয়ার ছাত্র-যুবকরা আশ্রয় নেন। নদীয়া জেলা প্রশাসকের সার্বিক সহযোগিতায় পরিচালিত এ ক্যাম্পের ইনচার্জ ছিলেন চুয়াডাঙ্গার আওয়ামী লীগ নেতা এডভোকেট ইউনুছ আলী। মেহেরপুর মহকুমা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোহাম্মদ শাহীদ উদ্দিন এমএনএ, এ কে আশকারী পটল, রমজান আলী ও খাদেমুল ইসলাম বেতাই যুব ক্যাম্পের দায়িত্ব পালন করেন। তাঁরাই ছিলেন মেহেরপুর জেলা ও সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতা ও মুক্তিযুদ্ধের মূল সংগঠক। তাঁদের নেতৃত্বে গড়ে ওঠে বিশাল এক মুক্তিবাহিনী। এছাড়া আওয়ামী লীগ নেতা আ ক ম ইদ্রিস আলী, ইসমাইল হোসেন, আবদুল মান্নান মাস্টার, শাহাবুদ্দিন নিজু, ডা. আবু আবদুল্লাহ, ডা. মহিউদ্দিন আহমেদ, আতাউল হাকিম লাল মিয়া, আব্দুর রব, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব প্রসেনজিৎ বোস বাবুয়া, মফিজুর রহমান, হাফিজুর রহমান, কামাল আহমেদ প্রমুখ মুক্তিযুদ্ধে সংগঠক হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
মুক্তিযুদ্ধের সময় এখানে কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন বশির আহমেদ (পিতা গরীবুল্লাহ, মণ্ডলপাড়া; ৫নং ওয়ার্ড), এস এম আল-আমীন (পিতা নজর আলী, যাদবপুর) এবং আব্দুল ওয়াহাব (আমঝুপি)।
২৫শে মার্চ কালরাত্রিতে ঢাকাসহ দেশের প্রধান-প্রধান শহরে পাকবাহিনী কর্তৃক সংঘটিত গণহত্যার খবর মো. নুরুল হক এমপিএ-র মাধ্যমে মহকুমা প্রশাসক তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরীর নিকট পৌঁছায়। তিনি তৎক্ষণাৎ মোহাম্মদ শাহীদ উদ্দিন এমএনএ ও মেহেরপুরের আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দকে বিষয়টি অবহিত করেন এবং পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য বলেন। সংগ্রাম কমিটি ২৫শে মার্চ গভীর রাতে পাকবাহিনীর বর্বরতা, অগ্নিসংযোগ ও গণহত্যার খবর মাইকে প্রচার করে মেহেরপুরের জনগণকে অবহিত করে এবং প্রতিরোধ যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করতে সকলের প্রতি আহ্বান জানায়। আমঝুপি, রাজনগর, বারাদি প্রভৃতি গ্রামের আওয়ামী লীগের নেতা- কর্মীসহ মুক্তিকামী জনতা পাকবাহিনীর সম্ভাব্য আক্রমণ প্রতিরোধকল্পে ঐ রাতেই মেহেরপুর-কুষ্টিয়া সড়কের মাথাভাঙ্গা নদীর ওপর খলিশাকুন্ডি ব্রিজ ধ্বংস করে এবং মেহেরপুর-চুয়াডাঙ্গা সড়কে বড়বড় গাছের গুঁড়ি ফেলে ব্যারিকেড তৈরি করে। একইসঙ্গে সংগ্রাম কমিটি প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত আনসার, ইপিআর, মুজাহিদ ও অবসরপ্রাপ্ত সেনাসদস্যদের একত্রিত করে সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করে। প্রশিক্ষণ, সশস্ত্র প্রস্তুতি ও সামরিক আয়োজনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এস এম আল-আমীন, বশির আহমেদ, আনসার এডজুট্যান্ট হাশেম খান প্রমুখ।
কুষ্টিয়া ও চুয়াডাঙ্গা দখল করার পর ১৮ই এপ্রিল পাকবাহিনী চুয়াডাঙ্গা থেকে মেহেরপুরে অনুপ্রবেশ করে। এ-সময় তারা আমঝুপি ও শহরের ওয়াপদা মোড়ে গণহত্যা চালায় এবং সিও অফিসে (বর্তমান উপজেলা পরিষদ) ক্যাম্প স্থাপন করে। অনুপ্রবেশকালে পাকবাহিনীর অতর্কিত হামলায় ৩৮ জন মানুষ হত্যার শিকার হয় এবং সংগ্রাম কমিটির প্রতিরোধ ব্যবস্থা সম্পূর্ণরূপে ভেঙ্গে পড়ে। ১৯ ও ২০শে এপ্রিল চুয়াডাঙ্গা থেকে পাকবাহিনীর বিশাল এক বহর এসে শহরের মেহেরপুর-কুষ্টিয়া সড়ক-সংলগ্ন মেহেরপুর সরকারি কলেজে মূল ঘাঁটি স্থাপন করে। পরবর্তীতে তারা ভোকেশনাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউট, কবি নজরুল শিক্ষা মঞ্জিল, কালাচাঁদপুর ঘাট, মানিক নগর, মোনাখালী, নাটুদা এবং নূরপুরে ক্যাম্প স্থাপন করে। পাকবাহিনীকে সহযোগিতার জন্য মে মাসের প্রথমদিকে সাফদার আলী বিশ্বাসকে সভাপতি ও এডভোকেট আব্দুল মতিনকে সম্পাদক করে মেহেরপুর মহকুমা শান্তি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির অন্য সদস্যরা হলো- আওলাদ হোসেন কনট্রাক্টর, আক্তার খান, মাহাতাব আলী খান, আব্দুল কাদের বিশ্বাস (বুড়িপোতা), এলাহীদাদ ওরফে ভিখু মিয়া (চেয়ারম্যান, মেহেরপুর পৌরসভা), কাওসার মিয়া, এডভোকেট খালেদুজ্জামান, হাশেম খান, আব্দুল গনি বিশ্বাস, আদম আলী বিশ্বাস প্রমুখ। একই সময় আওলাদ হোসেন কন্ট্রাক্টরকে সভাপতি ও আক্তার খানকে সম্পাদক করে মেহেরপুর সদর থানা শান্তি কমিটি এবং মাহাতাব খানকে সভাপতি করে মেহেরপুর শহর শান্তি কমিটি গঠন করা হয়। এরা সকলে স্বাধীনতাবিরোধী মুসলিম লীগ ও জামায়াতে ইসলামী-র স্থানীয় নেতা, কর্মী ও সমর্থক ছিল। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে জাতীয় পরিষদে এডভোকেট আব্দুল মতিন জামায়াতে ইসলামী এবং এডভোকেট খালেদুজ্জামান কনভেনশন মুসলিম লীগ-এর প্রার্থী ছিল। শান্তি কমিটি গঠনের পর এডভোকেট আব্দুল মতিন হয়ে ওঠে মেহেরপুর মহকুমার সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তি। তার নেতৃত্বে মেহেরপুর সদর থানার গ্রামে-গ্রামে গড়ে ওঠে রাজাকার ও আলবদর বাহিনী।
২২শে এপ্রিল পাকবাহিনী পিরোজপুরে স্থানীয় জামায়াতে ইসলামী ও মুসলিম লীগ নেতা-কর্মীদের সহযোগিতায় ভেজাল রাজবংশী (পিতা নলীন রাজবংশী), জীবন দত্ত (পিতা কালিপদ দত্ত), বিশ্বনাথ রাজবংশী ও মাধব কুণ্ডুকে হত্যা এবং শতাধিক বাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট করে। ২৯শে এপ্রিল পাকবাহিনী স্থানীয় মুসলিম লীগ নেতা মাহাতাব খানের সহযোগিতায় ভৈরব নদের পশ্চিম তীরের যাদবপুর, গোভীপুর, কামদেবপুর প্রভৃতি গ্রামে অগ্নিসংযোগ, লুটতরাজ ও নারীনির্যাতন করে। এ-সময় পাকবাহিনী ৮ জন সাধারণ মানুষকে ধরে এনে মেহেরপুর কোর্ট বিল্ডিংয়ের সামনে হত্যা করে।
মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে পাকবাহিনী ও তাদের দোসররা পিরোজপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আওয়ামী লীগ নেতা ফণীভূষণ সাহার রাজনগরের বাড়িতে হামলা ও লুটপাট চালায়। এদিন পাকবাহিনীর হাতে রাজনগর গ্রামের দুজন নারী সম্ভ্রম হারান। ১৭ই মে পাকবাহিনী স্থানীয় রাজাকার কমান্ডার লতিফ মোল্লা, সালাউদ্দিন (ঝাউবাড়িয়া), বাদল (গোভীপুর) প্রমুখের সহায়তায় শালিকা গ্রামে হামলা চালিয়ে তিনজনকে হত্যা করে। মে মাসের শেষদিকে পাকবাহিনী লতিফ মোল্লা, আওলাদ (গোভীপুর) ও বাদলসহ কয়েকজন রাজাকারের সহযোগিতায় রাজাপুর গ্রামে হামলা চালায় এবং মুক্তিযোদ্ধাদের বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ করে। এ-সময় তারা মুক্তিযোদ্ধা বজলুর রহমানের বড়ভাই আকছেদ আলী ও চাচাত ভাই হানিফসহ পাঁচজনকে গুলি করে হত্যা করে এবং দুজন নারীর সম্ভ্রম হানি করে। ১৮ই আগস্ট মোহাম্মদ শাহীদ উদ্দিন এমএনএ এবং ৩রা সেপ্টেম্বর মো. নুরুল হক এমপিএ-কে সামরিক আদালতে হাজির হওয়ার নির্দেশ জারি করা হয়। এ সংবাদটি মুসলিম লীগ নেতা কাদের মিয়া টিনের চোঙা দিয়ে সমগ্র শহরে প্রচার করে।
যুদ্ধকালীন সময়ে মেহেরপুরে তিনটি গণহত্যা সংঘটিত হয়। সেগুলো হলো- আমঝুপি গণহত্যা-, ওয়াপদা মোড় গণহত্যা ও মেহেরপুর কোর্টবিল্ডিং গণহত্যা। ১৮ই এপ্রিল আমঝুপি গণহত্যায় ৩৮ জন, ওয়াপদা মোড় গণহত্যায় ১৭ জন এবং ২৯শে এপ্রিল মেহেরপুর কোর্টবিল্ডিং গণহত্যায় ৮ জন সাধারণ মানুষ শহীদ হন। এদিন ভৈরব নদের পশ্চিম তীরবর্তী গ্রামগুলোতে অগ্নিসংযোগ, নারীনির্যাতন ও লুটপাট চলানো হয়। এছাড়া ২২শে এপ্রিল পাকবাহিনী তাদের দোসরদের সহায়তায় পিরোজপুর গ্রামে হিন্দু সম্প্রদায়ের ৪ জন এবং সীমান্তবর্তী বুড়িপোতা গ্রামে দুজন সাধারণ মানুষকে হত্যা করে। ১৭ই মে পাকবাহিনী ও তাদের দোসররা শালিকা গ্রামে ৩ জনকে হত্যা করে। ১০ই আগস্ট পাকবাহিনী স্থানীয় রাজাকারদের সহায়তায় বাড়িবাঁকা থেকে ৪ জন গ্রামবাসীকে ধরে এনে তিনদিন নির্যাতনের পর মেহেরপুর কলেজ ক্যাম্পে হত্যা করে।
মেহেরপুর থানা পরিষদ ছিল পাকবাহিনীর প্রথম নির্যাতনকেন্দ্র আর মেহেরপুর সরকারি কলেজ ছিল জেলার সর্ববৃহৎ নির্যাতনকেন্দ্র। এছাড়া ভোকেশনাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউট (বর্তমান সরকারি টেকনিক্যাল স্কুল এন্ড কলেজ), কবি নজরুল শিক্ষা মঞ্জিল, নূরপুর, মানিকনগর, মোনাখালী ও কালাচাঁদপুর ঘাটও পাকবাহিনীর নির্যাতনকেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হতো।
মেহেরপুর সদর উপজেলায় দুটি বধ্যভূমি রয়েছে— মেহেরপুর সরকারি কলেজ মাঠ বধ্যভূমি ও কালাচাদপুর ঘাট বধ্যভূমি। আর মেহেরপুর সরকারি কলেজ মোড়, মেহেরপুর কোর্ট বিল্ডিং, কোলা ও সোনাপুর এলাকায় গণকবর রয়েছে।
২১শে এপ্রিল বুড়িপোতা পুকুরপাড়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে পাকবাহিনীর সম্মুখ যুদ্ধ হয়। এতে একজন পাকসেনা নিহত হয় এবং ইউনুছ আলী (শালিকা, আনসার সদস্য) ও আবুল কাশেম (গোভীপুর) নামে দুজন গ্রামবাসী শহীদ হন। ৩রা মে তেরঘরিয়ার রুদ্রনগরে সংঘটিত পাকবাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে শোলমারীর মহরম আলী (আনসার সদস্য) শহীদ হন। ৫ই মে আব্দুর রশিদ ও রমজান আলীর নেতৃত্বে সংঘটিত বারাদি যুদ্ধে পাকবাহিনীর মেজর মহব্বত আলী খানসহ কয়েকজন পাকসেনা নিহত হয়। ৬ই জুন নায়েক মতিনের নেতৃত্বে সংঘটিত ইছাখালি যুদ্ধে কয়েকজন পাকসেনা নিহত হয় এবং একজন সাধারণ মানুষ শহীদ হন। ২২শে জুলাই কালাচাঁদপুরে পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রচণ্ড গুলি বিনিময় হয়। মুক্তিযোদ্ধারা মেহেরপুর পাওয়ার হাউজে হামলা চালিয়ে ট্রান্সফরমারটি সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে দেন। ১২ই আগস্ট মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল যাদবপুরে পাকসেনাদের ক্যাম্পে হামলা চালায়। পরদিন পাকবাহিনীর বিশাল এক বহর এসে মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর আক্রমণ করে এবং মুক্তিযোদ্ধারাও প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। এদিনের যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা আবুল কাশেম শেখ শহীদ হন। ১৯শে সেপ্টেম্বর মুক্তিবাহিনী কামদেবপুরে একজন পাকসেনাকে হত্যা করে। ২০ ও ২১শে অক্টোবর কামদেবপুর-কালাচাঁদপুর যুদ্ধে ৬ জন পাকসেনা নিহত হয়। ২৪শে নভেম্বর মুক্তিবাহিনীর গেরিলারা মেহেরপুর শহর ঘিরে ফেললে পাকবাহিনী ভীত- সন্ত্রস্ত হয়ে পিছু হটতে থাকে এবং ৬ই ডিসেম্বর মেহেরপুর সদর উপজেলাসহ সমগ্র জেলা হানাদারমুক্ত হয়।
মেহেরপুর সদর উপজেলার শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- মো. ফজলুর রহমান (পিতা মো. নাসিরউদ্দিন, স্টেডিয়ামপাড়া), মো. মনসুর আলী (পিতা শমসের আলী, বন্দর; ১৮ই এপ্রিল মেহেরপুরে পাকবাহিনীর হাতে শহীদ), মহরম আলী (পিতা আয়েন উদ্দিন, মেহেরপুর; ৩রা মে তেরঘরিয়ার যুদ্ধে শহীদ), রফিকুল ইসলাম (পিতা মনসুর আহমেদ, গড়পাড়; ৬ই জুলাই মেহেরপুরে বিদ্যুৎ লাইন বিচ্ছিন্ন করতে গিয়ে পাকবাহিনীর হাতে শহীদ), আব্দুল জব্বার (পিতা মাহাতাব উদ্দিন বিশ্বাস, আমঝুপি; জুলাই মাসের মাঝামাঝি সময়ে নিজবাড়িতে পাকবাহিনীর হাতে শহীদ), নাসির উদ্দিন (পিতা আয়েনউদ্দিন জোয়াদ্দার, মদনাডাঙ্গা; ৮ই জুলাই ইছাখালি সীমান্তে সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ), আসগর আলী (পিতা গয়েছ উদ্দিন, আমঝুপি), মো. খয়ের উদ্দিন (পিতা মো. নছর শেখ, রাজনগর), আব্দুস সাত্তার (পিতা জিন্দার বকসো, আমঝুপি; ১৮ই এপ্রিল পাকবাহিনীর গুলিতে শহীদ), জালাল হোসেন (পিতা কালু মণ্ডল, বড়শিবাড়ি; জুলাই মাসে নিজবাড়িতে পাকবাহিনীর হাতে শহীদ), আব্দুস সালাম (পিতা আব্দুল হালিম বিশ্বাস, পিরোজপুর; সাতক্ষীরার সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ), আবু জাফর (পিতা ফজল শেখ, পিরোজপুর), কাসেদ আলী (পিতা ফজল শেখ, গোভীপুর; ১৩ই আগস্ট বুড়িপোতা যুদ্ধে শহীদ), আব্দুল মান্নান (পিতা হেকমত আলী, কুতুবপুর; ২২শে জুলাই বুড়িপোতা যুদ্ধে শহীদ), খয়ের উদ্দিন (পিতা কছিমউদ্দিন, পিরোজপুর; ১৩ই অক্টোবর আমঝুপিতে পাকবাহিনীর হাতে ধরা পড়ে শহীদ), আবুল হোসেন (পিতা পাঁচু শেখ, মেহেরপুর; ২৬শে আগস্ট মেহেরপুরে পাকবাহিনীর হাতে ধরা পড়ে শহীদ), খয়েরউদ্দিন (পিতা নছর শেখ, রাজনগর; মোহাম্মদপুরে রাজাকারের গুলিতে শহীদ), সাদেক আলী (পিতা হোসেন আলী মন্ডল, উজলপুর; কালাচাঁদপুরে সম্মুখ যুদ্ধে আহত হন, পরে ১৭ই ডিসেম্বর মারা যান), মুন্সী ঈমান আলী (পিতা মুন্সী মিনাজউদ্দিন, বুড়িপোতা; কালাচাঁদপুরে সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ), সিরাজুল ইসলাম (পিতা খেলাফত আলী, বন্দর; কালাচাঁদপুরে সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ), আরজ আলী (মেহেরপুর, মেহেরপুর কোর্ট বিল্ডিংয়ে গ্রেনেড নিক্ষেপের পর ভৈরব নদ পার হবার সময় পানিতে ডুবে শহীদ), আব্দুল হামিদ (পিতা আব্দুর রশীদ, মল্লিকপাড়া; নিজবাড়িতে পাকবাহিনীর হাতে শহীদ), লোকমান হোসেন (পিতা ইকাব মন্ডল, পিরোজপুর; শালিকার খালপাড়া যুদ্ধে শহীদ), আলাউদ্দিন (পিতা পঞ্চা শেখ, শালিকা), আফসার আলী (পিতা দেলবর মন্ডল, পিরোজপুর; ৭ই সেপ্টেম্বর বাগোয়ান যুদ্ধে শহীদ), আলিমউদ্দিন মণ্ডল (দিঘিরপাড়া; ১১ই জুন সাতক্ষীরা জেলায় সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ) এবং আবুল কাশেম শেখ (১৩ই আগস্ট যাদবপুর যুদ্ধে শহীদ)।
১৭ই এপ্রিল মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে ‘মুজিবনগর সরকার’ নামে বহুল পরিচিত বাংলাদেশের প্রথম সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ্যে শপথ গ্রহণ করে। সেদিন থেকে বৈদ্যনাথতলা গ্রামটি ‘মুজিবনগর’ নামে পরিচিতি লাভ করে। মেহেরপুর পৌরসভার অর্থায়নে শহীদদের স্মরণে মেহেরপুর-চুয়াডাঙ্গা সড়কের দক্ষিণে মেহেরপুর সরকারি কলেজ মোড়ে গণকবর স্থানে নির্মিত হয়েছে স্মৃতিস্তম্ভ ‘প্রজ্জ্বলিত দীপশিখা’। মেহেরপুর-চুয়াডাঙ্গা সড়কের ওপর নির্মাণ করা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের ‘প্রবেশ তোরণ’। জেলা পরিষদের সামনে নির্মাণ করা হয়েছে শহীদদের নামফলক। মেহেরপুর পৌর কবরস্থানের পাশে নির্মিত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিসৌধ। এছাড়া মেহেরপুর শহরে চারজন মুক্তিযোদ্ধার নামে রয়েছে শহীদ গফুর সড়ক, শহীদ হামিদ সড়ক, শহীদ আরোজ সড়ক ও শহীদ রফিক সড়ক। [আবদুল্লাহ আল আমিন]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৮ম খণ্ড