You dont have javascript enabled! Please enable it!

বীর উত্তম মো. আনোয়ার হোসেন

মো. আনোয়ার হোসেন, বীর উত্তম (১৯৪৮-১৯৭১) শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা। তিনি ১৯৪৮ সালের ৫ই মে চাঁদপুর জেলার হাজীগঞ্জ উপজেলার আলীগঞ্জ গ্রামে মাতুলালয়ে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিত্রালয় কুমিল্লা শহরের স্টেশন রোড। তাঁর পিতার নাম মো. আবদুল হক এবং মাতার নাম নূরজাহান বেগম। তিনি ১৯৬৫ সালে চট্টগ্রামের ফৌজদার হাট ক্যাডেট কলেজ থেকে মাধ্যমিক এবং একই কলেজ থেকে ১৯৬৭ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এরপর সেনাবৃত্তি নিয়ে তিনি তদানীন্তন ইস্ট পাকিস্তান ইউনিভার্সিটি অব ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড টেকনোলজিতে (বর্তমান বুয়েট) এক বছর অধ্যয়নের পর পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে ক্যাডেট হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৭০ সালের ২৯শে মার্চ তিনি পশ্চিম পাকিস্তানের কাকুল মিলিটারি একাডেমি থেকে সফলতার সঙ্গে প্রশিক্ষণ শেষে কমিশন প্রাপ্ত হন। তিনি অবিবাহিত ছিলেন।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর প্রাক্কালে আনোয়ার হোসেন যশোর সেনানিবাসে ১০৭ পদাতিক ব্রিগেডের অধীনে ১ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ২৫শে মার্চ পাকিস্তানি বাহিনী নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর ব্যাপক গণহত্যা শুরু করলে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে বাঙালি সামরিক, ইপিআর ও পুলিশ বাহিনীর সদস্যগণ বিদ্রোহ করে প্রতিরোধযুদ্ধে অংশ নেন। যশোর সেনানিবাসের ১ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈন্যরা এ-সময় চৌগাছার জগদীশপুরে জঙ্গলের মধ্যে প্রশিক্ষণে থাকার কারণে পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ড এবং প্রতিরোধ যুদ্ধের কোনো খবরই জানতে পারেননি। পাকিস্তানি বাহিনী কৌশলে ২৯শে মার্চ জরুরি বার্তা পাঠিয়ে এই রেজিমেন্টকে যশোর ব্রিগেড হেডকোয়ার্টার্সে ফিরিয়ে আনে। ৩০শে মার্চ পশ্চিম পাকিস্তানি ব্রিগেড কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার আবদুর রহিম দুররানি বাঙালি সৈন্যদের নিরস্ত্র করার নির্দেশ দেয়। ২৫ বেলুচ রেজিমেন্ট এবং ৩ ফ্রন্টিয়ার ফোর্স বেঙ্গল রেজিমেন্টকে নিরস্ত্র করতে গেলে লেফটেন্যান্ট হাফিজউদ্দিন আহমেদ এবং সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট আনোয়ার হোসেনের নেতৃত্বে বাঙালি সৈন্যরা বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। এরপর তাঁরা পাকিস্তানি সৈন্যদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। পাকিস্তানি সৈন্যরা তিনদিক থেকে আক্রমণ করলে বাঙালি সৈন্যরা দৃঢ়তার সঙ্গে তা প্রতিহত করতে থাকেন। সকাল ৮টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত বাঙালি সৈন্যরা প্রতিআক্রমণ করে পাকিস্তানিদের আক্রমণকে ব্যর্থ করে দিতে সক্ষম হন। এ পর্যায়ে পাকিস্তানি বাহিনী ভারী অস্ত্র দিয়ে আক্রমণ শুরু করলে বাঙালি সৈন্যরা কভারিং ফায়ারের সাহায্যে ছোট-ছোট দলে বিভক্ত হয়ে সেনানিবাস এলাকা ছেড়ে চৌগাছায় একত্র হবার সিদ্ধান্ত নেন। কভারিং ফায়ারের দায়িত্বে ছিলেন আনোয়ার হোসেনসহ কয়েকজন সাহসী যোদ্ধা। তাঁদের কভারিং ফায়ারের ফলে অনেক বাঙালি সৈন্য যশোর সেনানিবাস থেকে বের হয়ে যেতে সক্ষম হন। দুপক্ষের মধ্যে গোলাগুলির এক পর্যায়ে আনোয়ার হোসেন পাকিস্তানি সৈন্যদের গুলিতে শহীদ হন। সহযোদ্ধারা তাঁর মৃতদেহ উদ্ধার করে পার্শ্ববর্তী গ্রামে নিয়ে যান এবং স্থানীয় জনগণ তাঁকে নজরুল ইসলাম কলেজের সামনে সমাহিত করে।
পাকিস্তান বাহিনীর বিরুদ্ধে যশোর সেনানিবাসে প্রতিরোধ যুদ্ধে অসাধারণ বীরত্ব ও সাহসিকতার জন্য বাংলাদেশ সরকার শহীদ আনোয়ার হোসেনকে ‘বীর উত্তম’ খেতাবে ভূষিত করে (গেজেট নং-৩৪, খেতাবের সনদ নং ২৭)। এই বীর মুক্তিযোদ্ধার স্মৃতিকে ধরে রাখার জন্য ঢাকা সেনানিবাসের মডার্ন হাইস্কুলের নতুন নামকরণ করা হয় “শহীদ আনোয়ার গার্লস স্কুল’। পরবর্তীতে ১৯৯০ সালে এটি কলেজে উন্নীত করার পর এর নতুন নামকরণ করা হয় “শহীদ বীর উত্তম লেফটেন্যান্ট আনোয়ার গার্লস কলেজ’। এছাড়াও তাঁর নামে যশোর সেনানিবাসে একটি এবং চাঁদপুর জেলার শাহরাস্তিতে একটি রাস্তার নামকরণ করা হয়। [সাজাহান মিয়া]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৮ম খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!