বীর উত্তম মো. আফজাল মিয়া
মো. আফজাল মিয়া, বীর উত্তম (১৯৩৯-১৯৯১) বীর মুক্তিযোদ্ধা। তিনি ১৯৩৯ সালের ১লা জুলাই ভারতে জন্মগ্রহণ করেন। ভারতীয় সেনাবাহিনীতে তাঁর পিতার চাকরি সূত্রে তাঁর পিতামাতা ভারত বিভাগের পূর্ব পর্যন্ত ভারতে বসবাস করতেন। তাঁর পিতার নাম জমির উদ্দিন এবং মাতার নাম জোহরা খাতুন। গাজীপুর রানী বিলাশ হাইস্কুল থেকে এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবার পর ১৯৫৭ সালের ১লা ফেব্রুয়ারি আফজাল মিয়া পাকিস্তান নৌবাহিনীতে শিক্ষানবিশ হিসেবে যোগদান করেন। এরপর তিনি যুদ্ধ জাহাজ পিএনএস কারসাজ, ড্রিপরোড ও করাচি ৮-এ তিন বছর মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। প্রশিক্ষণ শেষে তিনি ১৯৬০ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত নৌ যুদ্ধজাহাজ পিএনএস বাবর, পিএনএস আলমগীর, পিএনএস টাগ রুস্তম এবং সর্বশেষ পেটি অফিসার পদে নৌঘাঁটি হিমালয়াতে চাকরি করেন।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর প্রাক্কালে আফজাল মিয়া ৬০ দিনের বাৎসরিক ছুটিতে গাজীপুর অবস্থান করছিলেন। ২৫শে মার্চ রাতে পাকিস্তানি বাহিনী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর ব্যাপক গণহত্যা ও নির্যাতন শুরু করলে তিনি কর্মস্থলে ফিরে না যাবার সিদ্ধান্ত নেন। ছুটি শেষে তাঁকে চট্টগ্রাম নৌ-ঘাঁটিতে যোগদান করার নির্দেশ দেয়া হয়। কিন্তু শারীরিক সমস্যা দেখিয়ে তিনি কর্মস্থলে যোগদান না করলে তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়। কিন্তু তিনি সব নির্দেশ অমান্য করে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের উদ্দেশ্যে আগরতলা মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে যোগদান করেন। ১২ই অক্টোবর মুক্তিবাহিনীর নৌ-উইং গঠন করা হলে তাঁকে এর অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তিনি তখন আগরতলা থেকে কলকাতা এসে বাংলাদেশের যুদ্ধ জাহাজ বিএনএস পলাশ-এ যোগদান করেন।
মুক্তিযুদ্ধের নৌ-উইংয়ে অন্তর্ভুক্ত হবার পর আফজাল মিয়া দুটি অপারেশনে অংশ নেন। ১০ই ডিসেম্বর যৌথ বাহিনীর তিনটি যুদ্ধ জাহাজ আইএনএস প্যানভেল (ভারতীয়), বিএনএস পদ্মা ও বিএনএস পলাশ (বাংলাদেশী) খুলনায় পাকিস্তানি নৌ-ঘাঁটি দখলের জন্য যাচ্ছিল। এ অপারেশনের সাংকেতিক নাম ছিল অপারেশন হট প্যান্টস্। আর্টিফিসার হিসেবে আফজাল মিয়া জাহাজের ইঞ্জিনরুমে কাজ করছিলেন। কোনো প্রতিরোধ ছাড়াই যুদ্ধ জাহাজগুলো রূপসা নদী দিয়ে যখন খুলনা শিপইয়ার্ড-এর কাছাকাছি পৌঁছে, তখন ভুলবশত ভারতীয় বোমারু বিমান পদ্মা ও পলাশের ওপর বোমা বর্ষণ করে। বোমার আঘাতে জাহাজ দুটি বিধ্বস্ত হয় এবং এতে অনেক নৌ-মুক্তিযোদ্ধা হতাহত হন। আফজাল মিয়াও মারাত্মকভাবে আহত হন। তাঁর একটি চক্ষু নষ্ট হয়ে যায় এবং ডানহাতও বোমার আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ভারতীয় গানবোট তাঁকে উদ্ধার করে চিকিৎসার জন্য কলকাতা পাঠায়। তিন মাস চিকিৎসাধীন থাকার পর দেশে ফিরে এসে তিনি ঢাকাস্থ বাংলাদেশ নৌবাহিনীর সদর দফতরে যোগদান করেন এবং পদোন্নতি পেয়ে ১৯৮৮ সালে চিফ ইআরএ (ইঞ্জিনরুম আর্টিফিসার) পদে উন্নীত হন।
মহান মুক্তিযুদ্ধে বীরত্ব ও অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ সরকার মো. আফজাল মিয়াকে ‘বীর উত্তম’ খেতাবে ভূষিত করে (গেজেট নং ৫৯, খেতাবের সনদ নং ৫২)। তিনি দুই কন্যা ও এক পুত্র সন্তানের জনক। তাঁর স্ত্রীর নাম মরিয়ম আফজাল। ১৯৯১ সালের ৩রা মার্চ এই বীর মুক্তিযোদ্ধা পরলোক গমন করেন। [সাজাহান মিয়া]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৮ম খণ্ড