You dont have javascript enabled! Please enable it!

মেজরপাড়া যুদ্ধ (লক্ষ্মীছড়ি, খাগড়াছড়ি)

মেজরপাড়া যুদ্ধ (লক্ষ্মীছড়ি, খাগড়াছড়ি) সংঘটিত হয় আগস্ট মাসে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী, তাদের দোসর মিজোবাহিনী ও রাজাকারদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের। এ যুদ্ধে একজন মুক্তিযোদ্ধা আহত হন এবং বেশকিছু পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়। শত্রুপক্ষের ভারী অস্ত্রের আক্রমণে টিকতে না পেরে এক পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যান।
পাকিস্তানি বাহিনী খাগড়াছড়ি দখলে নেয়ার পর জেলার সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। আগে থেকেই খাগড়াছড়িতে মিজোবাহিনীর উপস্থিতি ছিল। এপ্রিলের ২৭ তারিখ প্রায় ১০০০ মিজোবাহিনীর সদস্য নিয়ে পাকিস্তানি বাহিনী মহালছড়িতে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প আক্রমণ করে। মুক্তিযোদ্ধারাও পাল্টা আক্রমণ করেন। এ যুদ্ধের এক পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধদের গুলি ফুরিয়ে গেলে কমান্ডারের নির্দেশে তাঁরা নিরাপদ স্থানে সরে যান। পাকসেনারা মহালছড়ি দখলে নেয়ার পর খাগড়াছড়িতে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। স্থানীয় রাজাকার ও আগে থেকেই অবস্থান নেয়া মিজোদের সহযোগিতায় পর্যায়ক্রমে পুরো খাগড়াছড়িতেই পাকিস্তানি বাহিনী ছড়িয়ে পড়ে। খাগড়াছড়ির মং সার্কেল চিফ মং প্রু সাইন মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করতেন। তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য রাজভাণ্ডার খুলে দিয়েছিলেন। কিন্তু পাকিস্তানি বাহিনী খাগড়াছড়ি দখলে নেয়ার পর তিনি ভারতে আশ্রয় নেন। তাঁর সমস্ত সম্পদ পাকিস্তানিরা তাদের কাজে ব্যবহার করতে থাকে এবং রাজবাড়িতে ক্যাম্প করে। তাঁর হাতি দিয়ে পাকিস্তানিরা পাহাড়ি পথে অস্ত্র ও গোলাবারুদ বহন করত। লক্ষ্মীছড়ির বর্মাছড়ির বরকতুল্লাহ খামারে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি সাব-ক্যাম্প ছিল। সেখানে অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধারা ভারতের হরিণা ক্যাম্পে লোকজনদের পার করে দিতেন। আবার প্রশিক্ষণ শেষে মুক্তিযোদ্ধাদের হরিণা ক্যাম্প থেকে পাহাড়ি পথ দিয়ে বাংলাদেশের সীমান্তে প্রবেশে সহযোগিতা করতেন। অনিল মহাজন, পরিমল, বাদল সেনসহ ৮ জন মুক্তিযোদ্ধা এ ক্যাম্পে ছিলেন। এ ক্যাম্পের মুক্তিযোদ্ধাদের প্রধান কাজ ছিল প্রশিক্ষণ শেষে মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে যাঁরা অপারেশনে যেতেন, তাঁদের পথ দেখিয়ে দেয়া। এ ক্যাম্পের মুক্তিযোদ্ধারা আগস্টের দিকে একটি গ্রুপকে হরিণা ক্যাম্পে পৌঁছে দিয়ে তিনদিন পর রাঙ্গুনিয়ার প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত আরেকটি মুক্তিযোদ্ধা গ্রুপ নিয়ে ফিরছিলেন। মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার সরোয়ার কামালের নেতৃত্বে পরিমল, বাদল সেন, অনিল মহাজন, বিনয় কুসুম সাহা, কামাল উদ্দিন, রবীন্দ্র দাশ, বাদল সহ ৩২-৩৩ জন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন এ গ্রুপে। সারাদিন পাহাড়ি পথে হেঁটে বিকেলের দিকে তাঁরা মেজরপাড়ায় পৌঁছেন। তখন বিকেল ৪টা এবং বৃষ্টি হচ্ছিল। রাজবাড়ি থেকে রাজার হাতিতে করে অস্ত্র ও গোলাবারুদসহ পাকিস্তানি বাহিনী লক্ষ্মীছড়ি হয়ে মেজরপাড়ার দিকে আসছিল। তাদের সঙ্গে মিজোবাহিনী ও রাজাকাররা ছিল। মুক্তিযোদ্ধারা পাহাড়ের টিলা থেকে নামবে আর পাকিস্তানি বাহিনী ধানক্ষেত পার হয়ে টিলাতে উঠবে এমনি সময় উভয় পক্ষ মুখোমুখি হয়। মুক্তিযোদ্ধারা পাহাড়ের ওপর থেকে গুলিবর্ষণ শুরু করেন। তাঁদের সঙ্গে ছিল এলএমজি, এসএলআর ও মেশিনগান। কিছুক্ষণ পর পাকিস্তানি বাহিনীও পাল্টা গুলি ছুড়তে থাকে। শুরু হয় প্রচণ্ড গোলাগুলি। পাকিস্তানি বাহিনী মর্টার শেলিং শুরু করে। ত্রিশ মিনিট ধরে চলে গোলাগুলি। শত্রুদের মর্টার শেলিংয়ে মুক্তিযোদ্ধারা বেশিক্ষণ টিকতে পারেননি। ফলে তাঁরা ফায়ার করতে করতে পাহাড়ি পথ দিয়ে নিরাপদে মহেশকাটা ও সাঁওতাল পাড়া হয়ে সমুড়পাড়ায় গিয়ে আশ্রয় নেন। মুক্তিযোদ্ধারা পেছনে ফিরে যাওয়ার পরেও অনেকক্ষণ পর্যন্ত পাকিস্তানিরা ফায়ারিং করে। মুক্তিযোদ্ধারা সমুড়পাড়ায় চলে যাওয়ার পর দেখেন তাঁদের একজন মুক্তিযোদ্ধা নেই। পরের দিন ভোরে তাঁরা সহযোদ্ধাকে খুঁজতে বের হন। মহেশপাড়া খামারের মধ্যেই আহত হয়ে পড়েছিলেন ঐ যোদ্ধা। স্থানীয়রা তাঁকে উদ্ধার করেন। তাঁর বাম হাতের কব্জিতে গুলি লেগেছিল। পরে সেখান থেকে মুক্তিযোদ্ধারা তাঁকে কাঞ্চনপুরে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করান। এ যুদ্ধে শত্রুসৈন্যদের বেশ কয়েকজন হতাহত হয়। [ইয়াছিন রানা সোহেল]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৮ম খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!