You dont have javascript enabled! Please enable it! বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ব্রিটিশ নাগরিক মেরিয়েটা প্রকোপ - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ব্রিটিশ নাগরিক মেরিয়েটা প্রকোপ

মেরিয়েটা প্রকোপ (১৯৪২-১৯৭২) ব্রিটিশ নাগরিক, লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শন শাস্ত্রে শাস্ত্রে পোস্টগ্রাজুয়েট, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠনে বিশিষ্ট ভূমিকা পালনকারী এবং ব্রিটিশ নাগরিক পল কনেট (৩০)-এর সঙ্গে Action Bangladesh ও Operation Omega-র প্রতিষ্ঠাতা। একশন বাংলাদেশ ও অপারেশন ওমেগার সঙ্গে যুক্ত অন্যান্য ব্রিটিশ তরুণ-তরুণীর মতো মেরিয়েটাও ছিলেন অত্যন্ত সংবেদনশীল ও মানবদরদি নারী।
১৯৪২ সালের ২৯শে মে তাঁর জন্ম। বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধকালে তাঁর বয়স ছিল ২৯ বছর। বাংলাদেশে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ৭০-এর নির্বাচনের রায় বাঞ্চাল, বাঙালির মুক্তি সংগ্রামের নায়ক ও মেজরিটি পার্টির নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-কে গ্রেপ্তার ও পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি, অপারেশন সার্চলাইট নামে নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর ২৫শে মার্চের রাত থেকে পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যা চালানো, নারীদের ওপর পাশবিক নির্যাতন, অগ্নিসংযোগ করে ঘরবাড়ি ধ্বংস, এক কোটি বাঙালিকে শরণার্থী হিসেবে ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করতে বাধ্য করা, এসব শরণার্থীর দুর্বিষহ জীবন-যাপন ইত্যাদি অন্যায় ও অবিচার মেরিয়েটা প্রকোপকে ভীষণভাবে ব্যথিত করে। একজন কোমলমতি নারী হিসেবে তিনি নিজেকে নিবৃত রাখতে পারেননি। প্রধানত ব্রিটিশ নাগরিকদের মধ্যে বাংলাদেশ প্রশ্নে গণসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্য নিয়ে পল কনেটের সঙ্গে যুক্ত হয়ে ২০শে এপ্রিল লন্ডনের পিস নিউজ পত্রিকা অফিসে সমমনা আরো কয়েকটি সংগঠনের কর্মীদের নিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন একশন বাংলাদেশ নামে একটি সংগঠন, যার অধিকাংশ কর্মী ছিলেন ব্রিটিশ। এ সংগঠনের উদ্যোগে বাঙালি শরণার্থী ও বাংলাদেশের অভ্যন্তরে পাকিস্তানি সেনাদের দ্বারা অবরুদ্ধ মানুষের মধ্যে ত্রাণ তৎপরতা পরিচালনার উদ্দেশ্যে গঠন করা হয় অপারেশন ওমেগা নামে অপর একটি সংগঠন। মেরিয়েটা প্রকোপের ক্যামডেন টাউনের ৩৪ স্ট্র্যাটফোর্ডের বাড়িটি ছিল উভয় সংগঠনের কার্যালয়। তিনি তাঁর একমাত্র শয়ন কক্ষ ছাড়া সম্পূর্ণ বাড়িটি এ সংগঠনের কাজে ছেড়ে দিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন সংগঠনের নিবেদিতপ্রাণ কর্মী এবং শুরু থেকেই তিনি এর সচিবের দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। মেরিয়েটার তখন এক বাঙালি বয়ফ্রেন্ড ছিল। বাংলাদেশের প্রতি তাঁর অতিরিক্ত ভালোবাসার এটিও হয়তো একটি কারণ ছিল। তাঁর শয়ন কক্ষের দেয়ালে বাংলাদেশের একটি মানচিত্র সবসময় টানানো থাকত। বাংলাদেশের পক্ষে জনমত গঠনে তিনি প্রচারপত্র বিলি করেছেন, ব্রিটিশ পার্লামেন্ট সদস্য ও অন্যান্য স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার প্রধানদের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রেখেছেন, সভা-সমাবেশের আয়োজন ও তাতে বক্তৃতা করেছেন, র্যালিতে অংশ নিয়েছেন, পাকিস্তান ও পাকিস্তানের সমর্থক রাষ্ট্রের দূতাবাসের সামনে প্লাকার্ড হাতে অবস্থান নিয়েছেন এবং শরণার্থীদের সাহায্যার্তে অর্থ তুলেছেন। এপ্রিল মাসে প্যারিসে পাকিস্তান এইড কনসোর্টিয়ামের বৈঠককালে পাকিস্তানকে সাহায্য-সহযোগিতা না দেয়ার ব্যাপারে লবিং করেছেন, পল কনেটের সঙ্গে তিনি বাংলাদেশের পতাকা হাতে পাকিস্তান হাইকমিশনের সম্মুখে বাংলাদেশের মানুষের ওপর গণহত্যার প্রতিবাদ করেছেন। ১লা আগস্ট বাংলাদেশে গণহত্যা বন্ধ ও স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতির দাবিতে লন্ডনের ট্রাফালগার স্কোয়ারে অনুষ্ঠিত স্মরণাতীত কালের বৃহত্তম জনসমাবেশের তিনি ছিলেন অন্যতম সংগঠক। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে অপারেশন ওমেগা ত্রাণ টিম প্রেরণেও তিনি বিশেষ ভূমিকা পালন করেন।
মুক্তিযুদ্ধকালে ব্রিটেনের বিভিন্ন শহরে গঠিত একশন কমিটিসমূহের স্টিয়ারিং কমিটির উদ্যোগে মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পর ২রা জানুয়ারি ১৯৭২ হাইড পার্কে সর্বশেষ যে জনসভা অনুষ্ঠিত হয়, তাতে মেরিয়েটা প্রকোপ এক আবেগময়ী ভাষায় বক্তৃতাকালে তিনি কেঁদে ফেলেন। এরপর নিজেকে কিছুটা সামাল দিয়ে বলেন (বঙ্গানুবাদ), ‘আপনাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম সফল হয়েছে দেখে আমরা বিদেশী, যারা বাংলাদেশকে সাহায্য করেছি, তারা আপনাদের কাছ থেকে অনেক কিছু প্রত্যাশা করবো। দেশ গড়ার কাজে সর্বশক্তি নিয়োগ করুন।’
মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের পরপর মেরিয়েটা প্রকোপ বাংলাদেশে আসেন। কিছুদিন অবস্থানের পর তিনি ভগ্নহৃদয়ে স্বদেশে ফিরে যান। এরপর ৪ঠা জুন ১৯৭২ নিজ বাড়ির বাথটবের পানিতে তাঁর নিথর দেহ পড়ে থাকতে দেখা যায়। বাংলাদেশের পাশাপাশি এদেশের যে তরুণকে তিনি গভীরভাবে ভালবেসেছিলেন, তার কাছ থেকে অনুরূপ সাড়া না পাওয়া তাঁর এভাবে জীবন অবসানের কারণ হিসেবে মনে করা হয়। অত্যন্ত বেদনার্তভাবে তিনি মাত্র ৩০ বছর বয়সে পৃথিবী থেকে বিদায় নেন। ইংল্যান্ডের ইয়র্কশায়ারের সেন্ট গ্রেগরি মিনিস্টার চার্চ সেমিট্রিতে তাঁকে সমাহিত করা হয়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকা পালনের স্বীকৃতিস্বরূপ অনেক বিদেশীকে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক Friends of Liberation War সম্মাননায় ভূষিত করা হলেও মেরিয়েটা প্রকোপের নাম তালিকার বাইরে থেকে যায়। অথচ তিনি যে অসামান্য ভূমিকা পালন করেন তাতে অনেকের আগেই ঐ স্বীকৃতি তাঁর প্রাপ্য ছিল। [হারুন-অর-রশিদ]
তথ্যসূত্র: আবু সাঈদ চৌধুরী, প্রবাসে মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলি, ঢাকা, ইউপিএল ১৯৯০; আবদুল মতিন, স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রবাসী বাঙালী, লন্ডন, র্যাডিকেল এশিয়া পাবলিকেশন্স ১৯৮৯; শেখ আবদুল মান্নান, মুক্তিযুদ্ধে ‘যুক্তরাজ্যের বাঙালীর অবদান, ঢাকা, জ্যোৎস্না পাবলিশার্স, ১৯৯৮; Harun-or-Rashid, “British perspectives, pressures and publicity regarding Bangladesh, 1971″, Contemporary South Asia 1995, Oxford, 4 (2), 139-149; http://www.londoni.co/index. php/23-history-of-bangladesh/1971-muktijuddho/133- muktijuddho-bangladesh-liberation-war-1971-trafalgar-square-rally-formed-mainly-by-white-english-history-of-bangladesh;https://springingtiger.wordpress.com/tag/marietta-procope/; https://www.gravestonephotos.com/public/ gravedetails. .php?grave= 106818 & scrwidth=2400; দৈনিক জনকণ্ঠ, ২৭শে ফেব্রুয়ারি ২০১৯

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৮ম খণ্ড