You dont have javascript enabled! Please enable it!

মুক্তিযুদ্ধে মেলান্দহ উপজেলা (জামালপুর)

মেলান্দহ উপজেলা (জামালপুর) ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পর থেকেই মেলান্দহ উপজেলার জনগণ মাতৃভূমির মুক্তির জন্য সংকল্পবদ্ধ হয়। তখন ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি ছিল মেলান্দহ উপজেলার কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, শিক্ষকসহ সর্বস্তরের নারী-পুরুষের মুখে একমাত্র স্লোগান ও প্রেরণার উৎস।
উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতিপর্বে সর্বস্তরের জনগণকে উদ্বুদ্ধকরণে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ এবং ছাত্র ইউনিয়ন-এর নেতৃবৃন্দ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পর থেকেই মেলান্দহ উপজেলার ছাত্র-যুবকসহ সর্বস্তরের মানুষ মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকে। এখানকার ২০৪ জন মুক্তিযোদ্ধা ভারতের মহেন্দ্রগঞ্জ, তোরা ও তেলঢালা প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে প্রশিক্ষণ নেন। মো. আব্দুল হাই বাচ্চু মিয়া এমপিএ, ডা. নূরুল ইসলাম, ময়ান হাজারী, সামসুল চেয়ারম্যান, এডভোকেট আফতাব উদ্দিন চৌধুরী, আলহাজ মো. রবিউল আলম, মো. কাজেম পণ্ডিত প্রমুখ মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এছাড়া ছাত্রলীগের হারুন-অর- রশিদ, আনিসুর রহমান ও আব্দুল আজিজ এবং ছাত্র ইউনিয়নের মিনহাজ উদ্দিন, নবীরুল ইসলাম, মন্টু তালুকদার ও দিপেন বসাক মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতিপর্বে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।
মেলান্দহ উপজেলায় যুদ্ধকালীন কমান্ডার ছিলেন মো. আব্দুল করিম এবং তাঁর সহযোদ্ধা ছিলেন মোহাম্মদ আলী, আব্দুল জলিল, মজিবুর রহমান, হেলাল, মো. ইউসুফ আলী, আব্দুর রহিম, মো. হাবিবুর রহমান, মো. নজরুল ইসলাম, মো. জয়নাল আবেদীন, গোলাম মোস্তফা, গিয়াস উদ্দিন প্রমুখ।
২৩শে এপ্রিল মুক্তিযোদ্ধারা উপজেলার দাগি রেলওয়ে ব্রিজ ভেঙ্গে পাকবাহিনীকে প্রতিরোধ করার চেষ্টা করেন। পাকবাহিনীর প্রবল আক্রমণের মুখে তাঁরা গেরিলা যুদ্ধের কৌশল অবলম্বন করেন। কিন্তু সব প্রতিরোধ অতিক্রম করে পাকবাহিনী ২৩শে এপ্রিল মেলান্দহ উপজেলায় প্রবেশ করে এবং মেলান্দহ থানা, দাগি ভাঙ্গা ব্রিজ, জিনাই ব্রিজ ও খরাখালি ব্রিজের পাশে ক্যাম্প স্থাপন করে।
এ উপজেলায় পাকবাহিনীর সহযোগী হিসেবে শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনী গঠন করা হয়। আ. জুব্বার তালুকদারকে (বয়ড়া ডাংগা) সভাপতি ও আব্দুল গফুর মণ্ডল (মালঞ্চ)-কে সাধারণ সম্পাদক করে শান্তি কমিটি গঠিত হয়। রইচ মাস্টার (নাংলা), আব্দুস সাত্তার (বালু আটা) ও বাবর আলী (আদিপৈত, মেলান্দহ পৌরসভা) কুখ্যাত রাজাকার হিসেবে পরিচিত ছিল। পাকবাহিনীর সহযোগী ব্যক্তিবর্গের মধ্যে আব্দুল হক আকন্দ (ফুলছেন্যা, মেলান্দহ পৌরসভা), সাহাবদ্দীন (বানিপাকুরিয়া), আব্দুল ওয়াদুদ আনসারী (প্রাক্তন চেয়ারম্যান, ছবিলাপুর, ৯নং ঘোষেরপাড়া ইউনিয়ন), অধ্যক্ষ রইচ মিয়া (ঝাউগড়া), শরিফ উদ্দিন ভাড়াডুবী (আদ্রা), মোশারফ হোসেন (পশ্চিম ঝাউগড়া), সুরুজ্জামান (বজরদ্দিপাড়া), মোহাম্মদ আলী (বজরদ্দিপাড়া), নূরু সরকার (বজরদ্দিপাড়া), পিস্তল (ফুলছেন্যা, মেলান্দহ পৌরসভা), হাসেম (ফুলছেন্যা, মেলান্দহ পৌরসভা), গিয়াস উদ্দিন (ফুলছেন্যা, মেলান্দহ পৌরসভা), আতিকুর রহমান মুন্সি (ফুলছেন্যা, মেলান্দহ পৌরসভা), আব্দুল্লাহ মৌলানা (ফুলছেন্যা, মেলান্দহ পৌরসভা), আব্দুল লতিফ (জালালপুর), আব্দুল খালেক আকন্দ (ফুলছেন্যা, মেলান্দহ পৌরসভা), সমশের মৌলানা (ফুলছেন্যা, মেলান্দহ পৌরসভা), আব্দুস সালাম (ফুলছেন্যা, মেলান্দহ পৌরসভা), মোতাহার হোসেন (ফুলকোচা), মো. সামস উদ্দীন (ফুলকোচা), ওয়াজেদ আলী (ফুলকোচা), ছবর হাজী (ফুলকোচা), আলতাফুর রহমান (বানিপাকুরিয়া) প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য।
পাকবাহিনী ও তাদের এ দেশীয় সহযোগীরা উপজেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে মুক্তিকামী মানুষকে ধরে এনে হত্যা, নির্যাতন এবং বাড়িঘর, দোকানপাট ও বাজারে আগ্নিসংযোগ করে। ১০নং ঝাউগড়া ইউনিয়ন পরিষদের রাজাকার মোশারফ হোসেন, মনোয়ার হোসেন, আ. মোতালেব, সুরুজ্জামান প্রমুখ ভাবকী ও হাজরাবাড়ী বাজার লুট করে পরে আগুন দিয়ে সম্পূর্ণরূপে পুড়িয়ে দেয়। হাজরাবাড়ী বাজারে জয়নাল নামে এক ব্যক্তি অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা যায়। মালঞ্চের আজগর আলী, আব্দুল গণি ও ভাঙ্গুনি ডাংগার আব্দুল হক সরকারের বাড়ি এবং গোবিন্দগঞ্জ বাজারের মতিউর রহমানের দোকানে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। পাকবাহিনী পয়লার ব্রিজে ৮ জন নিরীহ লোককে একসঙ্গে হত্যা করে। এ ঘটনা পয়লার ব্রিজ গণহত্যা নামে পরিচিত। মেলান্দহ উপজেলার কুখ্যাত রাজাকার রইচ মাস্টার এবং আব্দুল হক আকন্দ বিভিন্ন গ্রাম থেকে মেয়েদের ধরে এনে পাকবাহিনীর হাতে তুলে দিত। রাজাকার আ. সাত্তার ও বাবর আলী এলাকায় লুটতরাজ, হত্যা ও নির্মম নির্যাতন চালায়। স্থানীয় মুসলিম লীগ-এর সহায়তায় তারা আওয়ামী লীগ ও ন্যাপ-এর সক্রিয় নেতা-কর্মীদের পাকিস্তানি ক্যাম্পে ধরে নিয়ে হত্যা করে। উপজেলা পরিষদ, দাগি ভাঙ্গা ব্রিজ, জিনাই ব্রিজ, মখরাখালি ব্রিজ ও ঢালি ভিটায় পাকবাহিনীর নির্যাতনকেন্দ্র ও বন্দিশিবির ছিল। আগস্ট মাসের দিকে হাজরাবাড়ি অপারেশন – পরিচালিত হয়। এ-সময় হানাদাররা হাজরাবাড়ি বাজারের অনেক দোকানপাট পুড়িয়ে দেয় এবং আশপাশের কয়েকজন নারীকে ধর্ষণ করে। ১৫ই অক্টোবর খাসিমারা গ্রামের
যুদ্ধ-এ দুজন কৃষক শহীদ হন। অক্টোবর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে সংঘটিত দুরমুঠ হাট যুদ্ধ-এ একজন পাকসেনা নিহত হয়, বেশকিছু রাজাকার মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে ধরা পড়ে এবং বাকি পাকসেনা ও রাজাকাররা পালিয়ে যায়। মাহমুদপুর যুদ্ধ সংঘটিত হয় নভেম্বর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে। এতে কয়েকজন সাধারণ মানুষ নিহত হন। পয়লার ব্রিজ যুদ্ধ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ১০ই নভেম্বর সংঘটিত এ যুদ্ধে ২০ জন পাকসেনা নিহত হয় এবং জয়েন উদ্দিন ও আব্দুল কুদ্দুস নামে দুজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। ৯ই ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধারা মেলান্দহের শেষ প্রান্তে মাদারগঞ্জের পাশে বিনেতটংগী হাইস্কুল মাঠে ক্যাম্প স্থাপন করে মেলান্দহ থানাস্থ পাকবাহিনীর ক্যাম্প আক্রমণ করেন। বিকেল ৩টায় কমান্ডার আব্দুল করিম মেলান্দহ হাইস্কুলের পশ্চিম পাশ থেকে এসএমজি দিয়ে ব্রাশ ফায়ার করেন। অতর্কিত এ আক্রমণে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পাকবাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকারআলবদররা (মোট ৪৬ জন) আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। ফলে এদিনই উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়। উপজেলার খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা হলেন— আমান উল্লাহ কবির, বীর বিক্রম (পিতা আহাম্মদ আলী সরকার, কুনা মালঞ্চ)।
মেলান্দহ উপজেলার শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন— আমান উল্লাহ কবির, বীর বিক্রম (ধানুয়া-কামালপুর যুদ্ধে শহীদ), সোমর উদ্দিন মোল্লা (পিতা ইন্তাজ আলী, আদিপৈত, মেলান্দহ পৌরসভা; মাহমুদপুর কয়লার ব্রিজ যুদ্ধে শহীদ), শাহজাহান (শাহজাদপুর, মেলান্দহ পৌরসভা), জয়েন উদ্দিন (পিতা আয়েতউল্লাহ মন্ডল, পশ্চিম ঘোষের পাড়া; কয়লার ব্রিজযুদ্ধে শহীদ) এবং আব্দুল কুদ্দুস (পিতা আমেজ উদ্দিন মোল্লা, রুকনাই; কয়লার ব্রিজযুদ্ধে শহীদ)। জয়েন উদ্দিনের নামে বেলতৈল বাজার হতে হাজরাবাড়ী বাজার পর্যন্ত সড়কের নামকরণ করা হয়েছে ‘শহীদ জয়েন উদ্দিন সড়ক’। [এস এম জুলফিকার আলী লেবু]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৮ম খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!