You dont have javascript enabled! Please enable it! বীর উত্তম মেহবুবুর রহমান - সংগ্রামের নোটবুক

বীর উত্তম মেহবুবুর রহমান

মেহবুবুর রহমান, বীর উত্তম (১৯৫০-১৯৮১) ক্যাপ্টেন ও বীর মুক্তিযোদ্ধা। তাঁর পিতার নাম মুস্তাফিজুর রহমান এবং মাতার নাম লুৎফুন্নাহার। পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমির ৪১তম পিএমএ লং
কোর্স সফলভাবে সম্পন্ন করে তিনি কমিশনপ্রাপ্ত হন। ২৬শে মার্চের প্রাক্কালে তিনি কুমিল্লা সেনানিবাসে
বেঙ্গলে নিয়োজিত ছিলেন। মার্চের রাজনৈতিক ঘটনাবলি, পূর্ব বাংলার জনগণকে তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করতে পাকিস্তানি জান্তার ৭০-এর নির্বাচনের রায় বাঞ্চালের ষড়যন্ত্র, বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ এবং বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে মার্চের অসহযোগ আন্দোলন- তাঁর মনে ভীষণ প্রভাব ফেলে।
২৫শে মার্চের একদিন পূর্বে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা কর্তৃক ষড়যন্ত্রমূলকভাবে মেজর খালেদ মোশাররফ, বীর উত্তম-এর সঙ্গে তাঁকেও সিলেটের শমশেরনগরে পাঠানো হয়। স্বাধীনতার চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে তিনি খালেদ মোশাররফের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। তিনি ২নং সেক্টরের একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় মেজর শাফায়াত জামিল, বীর বিক্রম তাঁর পাকিস্তানি কমান্ডিং অফিসার লে. কর্নেল খিজির হায়াত খানকে বন্দি করেন এবং তার নিকট থেকে কমান্ড গ্রহণ করেন। মেজর খালেদ মোশাররফ শমশেরনগর থেকে ২৬শে মার্চ ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় পৌছলে মেজর শাফায়াত জামিল তাঁর নিকট বাংলাদেশের পক্ষের বিদ্রোহী সেনাদলের কমান্ড হস্তান্তর করেন। এদিকে মেজর কে এম সফিউল্লাহ, বীর উত্তম জয়দেবপুরে বিদ্রোহ করে তাঁর বাহিনী নিয়ে ঢাকার দিকে অগ্রসর হওয়ার চিন্তা করেন। একই সমেয় খালেদ মোশাররফ একটি খালি রেল ইঞ্জিনে ক্যাপ্টেন মেহবুবকে কিশোরগঞ্জ পাঠান। উদ্দেশ্য, কে এম সফিউল্লাহর জন্য তাঁর পক্ষ থেকে একটি বার্তা পৌঁছানো। ঐ বার্তা পেয়ে মেজর সফিউল্লাহ সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে তাঁর বাহিনী নিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এসে মেজর খালেদ মোশাররফের সঙ্গে মিলিত হন এবং পরবর্তী কর্মকর্তা নির্ধারণের লক্ষ্যে বৈঠকে বসেন। পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের প্রাথমিক পর্যায়ে ক্যাপ্টেন মেহবুব এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে জাঙ্গালিয়ার কাছে এক বিশাল পাকিস্তানি সেনাবহরকে গেরিলা এম্বুশের মাধ্যমে আক্রমণ করে বিপর্যস্ত করেন। এ আক্রমণে প্রথমবারের মতো শত্রুপক্ষের এক বিশাল অস্ত্রভাণ্ডার মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে আসে। ২নং সেক্টরের ক্যাম্প প্রতিষ্ঠার পর কুমিল্লার বিভিন্ন এলাকার বিশেষ করে দক্ষিণে ছড়িয়ে থাকা সেনাদের একত্রিত করে নির্ভরপুরে একটি সাব-সেক্টরের হেডকোয়ার্টার্স প্রতিষ্ঠা করা হয়। এখান থেকেই ক্যাপ্টেন মেহবুব ও ক্যাপ্টেন আকবর হোসেন যুদ্ধ পরিচালনা করতে থাকেন। তাঁদের ওপর প্রধান দায়িত্ব ছিল ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কটিকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়া। ৩১শে মে ক্যাপ্টেন মেহবুব কুমিল্লার জগমোহনপুরের শত্রুঘাটিতে আক্রমণ চালান। এতে ১২ জন শত্রুসেনা হতাহত হয়। ক্যাপ্টেন মেহবুবের নেতৃত্বে ১০ই জুন মিয়াবাজারের নিকটস্থ রাঙ্গারমার দিঘি ও জগমোহনপুরের কাচারিতে শত্রু অবস্থানের ওপর মুক্তিযোদ্ধাদের এক আক্রমণ পরিচালিত হয়। এতে ৮ জন পাকসেনা নিহত ও ৫ জন আহত হয়। ১৮ই জুন ক্যাপ্টেন মেহবুবের নেতৃত্বে লাকসামের বিজয়পুর সেতু ও বাগমারা সেতু উড়িয়ে দেয়া হয়। ২৪শে জুন তাঁর নেতৃত্বে শত্রুবাহিনীর বিবির বাজার অবস্থানে হামলা চালানো হয়। এখানে ২১ জন পাকসেনা নিহত ও ৭ জন আহত হয়। মেহবুব বিজয়পুর সেতুর নিচে এম্বুশ করেন এবং ব্রিজের ওপর দিয়ে চলমান পাকসেনাদের গাড়ির ওপর আক্রমণ চালান। গাড়িগুলো নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে নদীতে পড়ে যায়। এতে ৮ জন পাকসেনা নিহত হয়। ফুলতলীর নিকট একই ধরনের আক্রমণে পাকসেনাদের একটি জিপ ও ৩ টনের একটি বড় গাড়ি বিধ্বস্ত হলে ৩ জন অফিসার ও ২৪ জন পাকসেনা নিহত হয়। একই সময়ে মুক্তিসেনারা ক্যাপ্টেন মেহবুবের পরিচালনায় বিবির বাজারের শত্রু অবস্থানে আঘাত হানেন। এতে ১১ জন পাকসেনা নিহত হয়। মুক্তিসেনারা কুমিল্লা- চাঁদপুর রাস্তায় রূপচন্দ্রপুর সেতু উড়িয়ে দেবার পর পাকসেনারা ফেরির ব্যবস্থা করে। ৬ই জুলাই ক্যাপ্টেন মেহবুবের নেতৃতে এরূপ একটি চলমান ফেরির ওপর আক্রমণ করা হয় এবং তাতে ৪ জন শত্রুসেনা নিহত হয়। আক্রান্ত পাকসেনাদের সাহায্যার্থে অপর একটি পাকসেনাদল এগিয়ে এলে তাদের ওপর আক্রমল চালিয়ে ৩১ জনকে হত্যা করা হয় এবং ৫৪ জন পাকসেনা আহত হয়। ২৬শে জুলাই ক্যাপ্টেন মেহবুবের নেতৃত্বে মিয়াবাজারের নিকট একটি কমান্ডো দল পাকসেনাদের আক্রমণ করে। এতে ২০ জন পাকসেনা নিহত ও ১০ জন আহত হয়। আশিকাটিতে কমান্ডো আক্রমণে ১০ জন পাকসেনা নিহত ও ২৫ জন আহত হয়। ১৭ই জুলাই নরসিংহপুরের পাকিস্তানি ঘাঁটিতে আক্রমণ করে ১৩ জন পাকসেনাকে হত্যা করা হয় এবং অনেকে আহত হয়। এভাবেই ১৬ই আগস্ট ও ৩০শে সেপ্টেম্বর, কংসতলায় দুবার এবং ১৭ ও ২০শে অক্টোবর মিয়াবাজারে দুবার পাকিস্তানি ঘাঁটিতে আক্রমণ চালিয়ে অসংখ্যা শত্রুসেনাকে হত্যা করা হয়। পাকহানাদাররা মন্দভাগ পুনর্দখলের চেষ্টা করলে তারা মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষ থেকে পাল্টা আক্রমণের সম্মুখীন হয় এবং বালুচ রেজিমেন্টের সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট পারভেজসহ ৮ জন পাকসেনা বন্দি হয়। ২রা ডিসেম্বর ৯ম ইস্ট বেঙ্গলের ক্যাপ্টেন আইন উদ্দিনের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা মিয়াবাজারের দিকে অগ্রসর হলে ক্যাপ্টেন মেহবুবের নেতৃত্বে ৬টি কোম্পানি তাঁদের সঙ্গে যোগ দেয়। অতঃপর পাকিস্তানি হানাদারদের সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে কুমিল্লা শহরের পতন ঘটে। সমগ্র চট্টগ্রাম অঞ্চল তখন ‘কে’ ফোর্সের নিয়ন্ত্রণে আসে।
মহান মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ক্যাপ্টেন মেহবুবুর রহমানকে বাংলাদেশ সরকার ‘বীর উত্তম’ খেতাবে ভূষিত করে। সেনাবাহিনীতে চাকরিকালে তিনি লে. কর্নেল পদে উন্নীত হন। ১৯৮১ সালের ১লা জুন তিনি মৃত্যুবরণ করেন। [শেখ সাইয়েদুল ইসলাম]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৮ম খণ্ড