You dont have javascript enabled! Please enable it! বীর বিক্রম মেহেদী আলী ইমাম - সংগ্রামের নোটবুক

বীর বিক্রম মেহেদী আলী ইমাম

মেহেদী আলী ইমাম, বীর বিক্রম (১৯৪৯-১৯৯৮) বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং নবম সেক্টরের অধীন টাকি সাব-সেক্টরের পটুয়াখালী গেরিলা বেইজের (পটুয়াখালী সাব-সেক্টর) কমান্ডার। তিনি ১৯৪৯ সালের ১২ই জুন তাঁর পিতার কর্মস্থল ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন। তবে তাঁর পৈতৃক নিবাস পিরোজপুর জেলার মঠবাড়িয়া উপজেলার দাউদখালী গ্রামে। তাঁর পিতার নাম আবু মোহাম্মদ মোদাদ্দের বিল্লাহ এবং মাতার নাম আনোয়ারা খাতুন।
মেহেদী আলী ইমামের শিক্ষা জীবন শুরু হয় ঢাকার আরমানীটোলা হাইস্কুলে। তারপর তিনি ১৯৬৪ সালে বরিশাল জেলা স্কুল থেকে এসএসসি এবং ১৯৬৬ সালে বরিশাল বিএম কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এ বছরই তিনি সামরিক বাহিনীতে ক্যাডেট হিসেবে পশ্চিম পাকিস্তানের এবোটাবাদের কাকুলে অবস্থিত পাকিস্তানি মিলিটারি-একাডেমিতে যোগদান করেন এবং ১৯৬৭ সালে কমিশনপ্রাপ্ত হন।
১৯৭১ সালে মেহেদী আলী ইমাম ক্যাপ্টেন পদে পশ্চিম পাকিস্তানে কর্মরত ছিলেন। মার্চ মাসের শুরুতে তিনি ছুটিতে নিজ বাড়ি মঠবাড়িয়ার দাউদখালীতে অবস্থান করছিলেন। ৭১-এর অসহযোগ আন্দোলন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান–এর ৭ই মার্চের নির্দেশনামূলক ভাষণসহ প্রতিটি রাজনৈতিক ঘটনার প্রতি তিনি গভীর মনোযোগ সহকারে লক্ষ রাখেন। ২৫শে মার্চ রাতে অপারেশন সার্চলাইট-এর নামে পাকিস্তানি সেনারা ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর ব্যাপক গণহত্যা ও নির্যাতন শুরু করলে তিনি ২৭শে মার্চ বরিশাল এসে মেজর জলিলের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। এদিন রাতেই তিনি থানার ওয়ারলেসের মাধ্যমে বৃহত্তর বরিশাল জেলার ছুটিতে থাকা সকল বাঙালি সৈনিক, আনসার, মুজাহিদকে সংগঠিত করে এ অঞ্চলের ছাত্র, যুবক ও সর্বস্তরের জনগণকে স্থানীয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধের জন্য সামরিক ট্রেনিং প্রদানের ব্যবস্থা করেন। তাঁর প্রত্যক্ষ পরিচালনায় বরিশাল শহরের কাছাকাছি বেলস পার্ক, সদর গার্লস হাইস্কুল, লাকুটিয়া জমিদার বাড়ি, মাধবপুর প্রভৃতি স্থানে ট্রেনিং ক্যাম্প খোলা হয়। এ সকল ক্যাম্প থেকে হাজার-হাজার যুবককে ট্রেনিং দিয়ে বিভিন্ন থানা ও মহকুমায় সংগৃহীত অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ দিয়ে বরিশাল, পটুয়াখালী, পিরোজপুর, বাগেরহাট ও খুলনা অঞ্চলে প্রতিরোধ যুদ্ধে নিয়োজিত করা হয়। এছাড়াও প্রতিরোধ যুদ্ধে ব্যবহারের জন্য বরিশাল বিএম কলেজের রসায়নের একজন শিক্ষক, বিজ্ঞান বিভাগ ও মেডিকেল কলেজের ছাত্রদের সহায়তায় হ্যান্ডগ্রেনেড, মলোটভ ককটেল ইত্যাদি হাতবোমা তৈরি করানো হতো।
মেহেদী আলী ইমামের নেতৃত্বে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল বিশেষ করে বরিশাল, পটুয়াখালী, পিরোজপুর, বাগেরহাট ও খুলনায় মুক্তিযোদ্ধারা প্রতিরোযুদ্ধে সফলতা লাভ করেন। তাঁর নেতৃত্বে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য প্রতিরোধযুদ্ধ হলো জুনাহার যুদ্ধ। মেজর জলিলের নির্দেশে বরিশাল শহর ও তার নিকটবর্তী এলাকায় যাতে পাকিস্তানি শত্রু সৈন্যরা প্রবেশ করতে না পারে তার জন্য তিনি কীর্তনখোলা নদীর দুই তীরে বাংকার খুঁড়ে তালতলী এলাকার জুনাহারে প্রবেশ পথে শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ব্যূহ্য তৈরি করেন। বরিশাল নদীপ্রধান অঞ্চল হওয়ায় শত্রুদের নদীপথে বরিশালে প্রবেশের চেষ্টা করার সম্ভাবনাই ছিল বেশি। এজন্য তিনি জুনাহারে কীর্তনখোলা নদীর দুই পাড়ে উল্লিখিত ব্যবস্থা নেন। ১৮ই এপ্রিল থেকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বরিশালে জঙ্গি বিমান থেকে শহরের বিভিন্ন স্থানে বোমা হামলার মাধ্যমে সেখানে প্রবেশের চেষ্টা চালায়। তবে ২৫শে এপ্রিল শত্রু সেনারা নৌ, সড়ক ও আকাশ পথে একযোগে বরিশালে প্রবেশের চেষ্টা চালায়। ঐদিন ৪টি গানবোট ও দুটি মোটর লঞ্চে করে বরিশালের পথে জুনাহারে পৌছে মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর আক্রমণ চালায়। মেহেদি আলী ইমামের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারাও প্রতি আক্রমণ করেন। উভয় পক্ষের মধ্যে তুমুল গোলাগুলির এক পর্যায়ে হেলিকপ্টারে করে আরো প্রায় ১০০ সৈন্য তালতলী পাড়ে নামানো হয়। পাকিস্তানি সেনাদের ভারী অস্ত্রশস্ত্রের মুখে মুক্তিযোদ্ধারা তাঁদের অবস্থান তুলে নিতে বাধ্য হন। তবে এ যুদ্ধে বেশ কিছু পাকিস্তানি সৈন্য হতাহত হয়। ২৫শে এপ্রিলই পাকিস্তানি সৈন্যরা বরিশাল শহরে প্রবেশ করে।
জুলাই মাসে মেজর জলিল ৯ নম্বর সেক্টরে তাঁর নিজ দায়িত্বে থাকা টাকি সাব-সেক্টর (ঝালকাঠি, বরিশাল, পটুয়াখালী, বরগুনা, ভোলা, পিরোজপুর, বাগেরহাট ও খুলনা)-কে পুনর্গঠন করে ৫টি যুদ্ধাঞ্চলে ভাগ করে প্রত্যেকটিতে একজন করে কমান্ডার নিয়োগ করেন। পটুয়াখালী (পটুয়াখালী, বরগুনা ও ভোলা) যুদ্ধাঞ্চলের কমান্ডিং অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পান মেহেদী আলী ইমাম। উল্লেখ্য, এই পাঁচটি যুদ্ধাঞ্চলকে সাব-সেক্টর হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে। পটুয়াখালী সাব-সেক্টরের দায়িত্ব পেয়ে তিনি মেজর জলিলের নির্দেশে তাঁর সমগ্র যুদ্ধ এলাকাকে পাঁচটি জোনে ভাগ করে ৫ জন কমান্ডারের মাধ্যমে ঐসব এলাকায় প্রশিক্ষণ, অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহ ও মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করতে থাকেন। তাঁর নেতৃত্বে চূড়ান্ত বিজয়ের পূর্ব পর্যন্ত অনেকগুলো সফল যুদ্ধ পরিচালিত হয়। তার মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখ্য হলো— আগস্ট মাসের প্রথমদিকে মির্জাগঞ্জে এম্বুশ করে পাকিস্তানি সৈন্যদের একটি লঞ্চে আক্রমণ চালিয়ে ১০ জন শত্রুসেনাকে হত্যা করা এবং আগস্ট মাসের শেষের দিকে তালতলীর নিকটবর্তী মাছিমপুর মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে পাকিস্তানি সৈন্যরা আক্রমণ করলে তাঁর নেতৃত্বে প্রতি আক্রমণ করা। উভয় পক্ষের মধ্যে তুমুল যুদ্ধ হয় এবং এতে ১১ জন পাকিস্তানি সৈন্য ও ১৪ জন রাজাকার নিহত হয়। শত্রু সেনারা প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ ফেলে পালিয়ে যায়।
মহান মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার মেহেদী আলী ইমামকে ‘বীর বিক্রম’ খেতাবে ভূষিত করে। মুক্তিযুদ্ধ শেষে তিনি সামরিক বাহিনীতে যোগদান করেন এবং পরবর্তীতে ‘মেজর’ পদে উন্নীত হন। ১৯৭৪ সালে তিনি সামরিক বাহিনী থেকে অবসর গ্রহণ করেন। এরপর তিনি বহু প্রশাসনিক পদে দায়িত্ব পালন করেন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- মুক্তিযুদ্ধ কল্যাণ ট্রাস্ট-এর চেয়ারম্যান, বিএমইডিসি-র চেয়ারম্যান, পেট্রো বাংলার চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষের পরিচালক (অর্থ)। এ বীর মুক্তিযোদ্ধা হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে জার্মানিতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১৯৯৮ সালের ২৮শে সেপ্টেম্বর মৃত্যুবরণ করেন। তিনি এক কন্যা ও এক পুত্র সন্তানের জনক ছিলেন। তাঁর স্ত্রীর নাম লায়লা আক্তার। [সাজাহান মিয়া]
তথ্য-সহযোগিতা: মেহেদী আলী ইমাম-এর কন্যা সাদিয়া ইমাম।

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৮ম খণ্ড