You dont have javascript enabled! Please enable it!

মুক্তিযুদ্ধে মুলাদী উপজেলা (বরিশাল)

মুলাদী উপজেলা (বরিশাল) বরিশাল জেলার উত্তর-পূর্ব দিকে অবস্থিত এবং ছবিপুর, বাটামারা, চরকালেখাঁ, গাছুয়া, মুলাদী, কাজিরচর ও নাজিরপুর এই ৭টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত। ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারী’ – একুশের এ অমর গানের সুরকার শহীদ আলতাফ মাহমুদের পৈতৃক বাড়ি এ উপজেলায়। অন্যান্য উপজেলার মতো মুলাদী উপজেলারও মুক্তিযুদ্ধে গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা রয়েছে। ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান- ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে যে ঐতিহাসিক ভাষণ দেন, তার প্রভাবে মুলাদী উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধের প্রাথমিক কার্যক্রম শুরু হয়। স্থানীয় আওয়ামী লীগ-এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মতিউর রহমানকে সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রাজ্জাক ভুলুকে সাধারণ সম্পাদক করে সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। পরিষদের দপ্তর সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন আব্দুল বারী (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ নেতা, বর্তমানে মুলাদী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি)। মুলাদী বন্দর এলাকা থেকে সংগ্রাম পরিষদের কার্যক্রম পরিচালনা করা হতো। এক পর্যায়ে নিরাপত্তার কারণে পরিষদের কার্যালয় খাজুরতলায় স্থানান্তরিত করা হয়।
২৫শে মার্চ রাতে ঢাকায় পাকবাহিনীর গণহত্যার খবর মুলাদীতে পৌঁছার পর জনমনে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। উপজেলার নেতৃবৃন্দ উপলব্ধি করতে পারেন যে, সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ অনিবার্য। এ উপলব্ধি থেকে যুদ্ধের প্রস্তুতি হিসেবে ছাত্র-যুবকদের প্রশিক্ষণ দেয়া শুরু হয়। আজিজুর রহমান নিলু (পরবর্তীকালে বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা) ও অবসরপ্রাপ্ত ইপিআর সদস্য শাহজাহান মাহমুদ (শহীদ আলতাফ মাহমুদের ছোটভাই)-এর নেতৃত্বে মুলাদী থানা মাঠে, শহীদুল হাসান চুন্নু ও কাজী আনোয়ারের নেতৃত্বে কাজীরচর মাধ্যমিক বিদ্যালয় মাঠে, সুবেদার তোফাজ্জল হোসেনের নেতৃত্বে সফিপুর ছোনের স্কুল প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে এবং হালিম কমান্ডারের নেতৃত্বে নাজিরপুর হাইস্কুল মাঠে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রাথমিক প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। এরপর আরো উন্নত প্রশিক্ষণের জন্য উপজেলার অনেকেই ভারতে যান।
সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দ মুলাদীতে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকের দায়িত্ব পালন করেন। আর কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন আব্দুল কুদ্দুস মোল্লা, বীর প্রতীক। বেইজ কমান্ডার ছিলেন মো. কুতুবউদ্দিন। কুদ্দুস মোল্লার সহযোগী হিসেবে যুদ্ধ পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন কাজী আনোয়ার হোসেন, আলী আজম খান, আজিজুর রহমান নিলু, সুবেদার তোফাজ্জল হোসেন, শাহজাহান মাহমুদ, খলিল কমান্ডার, রশীদ কমান্ডার প্রমুখ।
কোনোরূপ প্রতিরোধ মোকাবেলা না করেই পাকবাহিনী ২৪শে জুলাই প্রথম মুলাদীতে প্রবেশ করে। তবে এখানে তারা কোনো স্থায়ী ক্যাম্প স্থাপন করেনি। বরিশাল থেকে নদীপথে মাত্র দু-ঘণ্টায় পৌছানো যেত বলে পাকবাহিনী বরিশালের ওয়াপদা কলোনি ক্যাম্প থেকে মুলাদীতে এসে লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ ও হত্যাকাণ্ড চালাত।
মুলাদী উপজেলায় রাজাকার বাহিনী ও শান্তি কমিটি সক্রিয় ছিল। এ দু-বাহিনীর প্রায় ৭০ জন সদস্য ছিল। থানা জামায়াতে ইসলামী-র সভাপতি মজিদ মৌলভী (তেরোচর) ছিল রাজাকার বাহিনীর প্রধান। তার সহযোগীদের মধ্যে ছিল তেরোচরের আব্দুল লতিফ প্যাদা, কাজীরচরের আরজ আলী, হারুন ফরাজী, মোসলেম মীর, চরলক্ষ্মীপুরের গ্রামের মজিবর মৌলভী প্রমুখ। শান্তি কমিটির সভাপতি ও সম্পাদক ছিল যথাক্রমে আব্দুল জলিল খান ও মির্জা আব্দুল্লাহ হারুন। শান্তি কমিটির অন্য সদস্যদের মধ্যে চরকালেখাঁর শাহ আলম, কাজীরচরের ফরিদ উদ্দিন মৃধা, মুলাদী ইউনিয়ন শান্তি কমিটির সম্পাদক ছিলেন আবদুল গনি বেপারী প্রমুখ উল্লেখযোগ্য।
পাকবাহিনী ২৪শে জুলাই ভোর ৬টায় ৩টি গানবোটে করে পাতারচর গ্রামে আসে এবং পাতারচরসহ ৩টি গ্রামে গণহত্যা চালায়। পাতারচর গণহত্যা-য় বহুসংখ্যক গ্রামবাসী শহীদ হন। তাদের মধ্যে ৩২ জনের নাম জানা যায়। প্রখ্যাত সুরকার শহীদ আলতাফ মাহমুদ-এর বাড়িসহ গ্রামের বিভিন্ন বাড়ি থেকে অনেককে ধরে এনে গুলি করে হত্যা করে। সকাল সাড়ে ৭টার দিকে তারা ঢালি বাড়িতে গিয়ে ছাত্রলীগ নেতা হাবিবুর রহমান ঢালি ও তাঁর পিতা মৌলভী জয়নুল আবেদীন ঢালিকে হত্যা করে। দুপুরে শান্তি কমিটির নেতা মির্জা আব্দুল্লাহ হারুন হানাদার বাহিনীকে নিয়ে হিন্দু অধ্যুষিত দক্ষিণ তেরোচর এলাকায় যায়। এখান থেকে জ্ঞানেন্দ্র মারিককে ধরে এনে নয়াভাঙ্গুলি নদীর পাড়ে হত্যা করে। মরণ ভূঁইমালি, জগবন্ধু দত্ত ও কেস্ট দাসের বাড়ি পুড়িয়ে দেয় এবং সংগ্রাম পরিষদ ও আওয়ামী লীগের সভাপতি মতিউর রহমানের বাড়িতে লুটপাট করার পর আগুন ধরিয়ে দেয়। তাদের হাতে দুজন নারী সম্ভ্রম হারান। এর মাস খানেক পরে পাকবাহিনী কালী চরণ দাস ও হাসেম হাওলাদারকে গুলি করে হত্যা করে।
১৭ই সেপ্টেম্বর পাঁচজন মুক্তিযোদ্ধা, যথা- শহীদুল হাসান চুন্নু (ইপিআর সদস্য), শাহজাহান হাওলাদার, আমীর হোসেন (লালু পালোয়ান), মিজানুর রহমান ও জলিল সরদার পাকবাহিনীর হাতে ধরা পড়েন। নির্যাতনের পর তাঁদের রাজাকারদের হাতে তুলে দিয়ে পাকসেনারা বরিশাল ক্যাম্পে চলে যায়। রাজাকাররা তাঁদের মুলাদী ক্যাম্পে এনে আবার নির্যাতন করে। শহীদুল হাসান চুন্নু ও আমীর হোসেনকে এক রশিতে, মিজানুর রহমান খান ও জলিল সরদারকে অপর এক রশিতে এবং শাহজাহান হাওলাদারকে পৃথকভাবে বেঁধে রাখে। রাত ১১টার দিকে রাজাকাররা তাঁদের বরিশালে পাকবাহিনীর ক্যাম্পে নেয়ার কথা বলে নয়াভাঙ্গুলি নদীর পাড়ে নিয়ে যায়। সেখানে শহীদুল হাসান চুন্নু, আমীর হোসেন ও শাহজাহান হাওলাদারকে গুলি করে হত্যা করে নদীতে ফেলে দেয়। শাজাহান হাওলাদারকে হত্যার পর পেট্রল দিয়ে তাঁর সমস্ত শরীর পুড়িয়ে দেয়া হয়। মিজানুর রহমান খান ও জলিল সরদার পানি খেতে চাইলে রাজাকাররা তাঁদের লাথি মারতে থাকে। এ অবস্থায় তাঁরা হঠাৎ নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়েন এবং নদীর অপর পাড়ে মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলার ভোঙ্গা গ্রামে গিয়ে ওঠেন। স্থানীয়রা তাঁদের পরিচয় পেয়ে আশ্রয় দেয়। অপরদিকে, পরদিন শহীদুল হাসান চুন্নু ও আমীর হোসেনের জোড়াবাঁধা মৃতদেহ স্বজনরা খাসেরহাট বাজার সংলগ্ন নয়াভাঙ্গনী নদী থেকে উদ্ধার করে। আর অগ্নিদগ্ধ শাজাহান হাওলাদারের বিকৃত লাশ পানবাড়িয়ার চর থেকে তাঁর ছোটভাই নূরে আলম হাওলাদার উদ্ধার করেন। শহীদ এই তিন মুক্তিযোদ্ধাকে কাজীরচর মাধ্যমিক বিদ্যালয় সংলগ্ন স্থানে কবর দেয়া হয়।
মুলাদী উপজেলায় পাকবাহিনীর সরাসরি কোনো নির্যাতনকেন্দ্র বা বন্দিশিবির ছিল না। তবে রাজাকাররা মুলাদী থানাকে নির্যাতনকেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করত।
মুলাদী, হিজলা ও মেহেন্দিগঞ্জ এই তিন উপজেলার কমান্ডারের দায়িত্বে ছিলেন আব্দুল কুদ্দুস মোল্লা। তাঁর নেতৃত্বাধীন বাহিনী কুদ্দুস মোল্লা বাহিনী নামে পরিচিত ছিল। জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহে আজিজুর রহমান নিলু ও সাদের আলী ২৭ জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে মুলাদী থানা দখলের উদ্দেশ্যে থানায় অবস্থিত রাজাকার বাহিনীর ওপর আক্রমণ করেন। কিন্তু শত্রুপক্ষের প্রবল প্রতি-আক্রমণে তাঁদের থানা দখলের চেষ্টা ব্যর্থ হয়। ৮ই অক্টোবর সকালে বেইজ কমান্ডার কুতুব উদ্দিনের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা পুনরায় মুলাদী থানা আক্রমণ করেন এবং অনেকটা প্রতিরোধ ছাড়াই তাঁরা থানা দখল করতে সক্ষম হন।
অক্টোরর মাসের প্রথমদিকে বরিশাল (সাউথ)-এর এসডিও খাজা আহমেদ পাকসেনাদের সঙ্গে লঞ্চযোগে রসদ নিয়ে যাওয়ার সময় গৌরনদী ও মুলাদীর সীমান্তবর্তী হোসনাবাদ সাহেবের চর লঞ্চঘাটে অড়িয়াল খাঁ নদীতে জোনাল কমান্ডার নিজামউদ্দিন ও সেকেন্ড-ইন-কমান্ড কুতুব উদ্দিনের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা তাদের ওপর আক্রমণ করেন। দুই পক্ষের মধ্যে দীর্ঘক্ষণ যুদ্ধ হয়। এক পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধাদের গোলার আঘাতে লঞ্চটি ডুবে যায় এবং ১৯ জন পাকসেনা নিহত হয়। এ-যুদ্ধ হোসনাবাদ সাহেবের চর লঞ্চঘাট যুদ্ধ নামে পরিচিত।
৮ই ডিসেম্বর বরিশালে পাকবাহিনীর পরাজয় ঘটলে পাকসেনাদের অনেকে নদীপথে বিভিন্ন স্থানে যাওয়ার সময় মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ মানুষের দ্বারা আক্রান্ত হয়। মুলাদীর কাজির চর ইউনিয়নের আড়িয়াল খাঁ নদীপথে বিপর্যস্ত পাকসেনারা মুক্তিযোদ্ধা ও গ্রামবাসীদের কবলে পড়ে। সেখান থেকে চরডাকাত গ্রামের রতন মৃধার বাড়িতে ৩-৪ জন পাকসেনাকে ধরে আনা হলে রাতে ক্ষুব্ধ জনতা তাদের হত্যা করে। এদিনই মুলাদী উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়। উপজেলার খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- জাকির হোসেন, বীর প্রতীক (পিতা আক্কেল আলী, চরপদ্মা), মো. আনোয়ার হোসেন, বীর প্রতীক (পিতা আমির হোসেন, পাতারচর) ও মো. কুদ্দুস মোল্লা, বীর প্রতীক (পিতা আলহাজ্ব ফজলে আলী মোল্লা, কাইতমারা)।
মুলাদী উপজেলার ১৬ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন – ৪ জন মুলাদীতে এবং ১২ জন মুলাদীর বাইরে। মুলাদীতে শহীদ চারজন হলেন— শাহজাহান হাওলাদার (পিতা আফিজ উদ্দিন সরদার, কাজির চর), আমীর হোসেন ওরফে লালু পালোয়ান (পিতা আফাজ উদ্দিন পালোয়ান, কাজির চর), শহিদুল হক চুন্নু (পিতা বেলায়েত হোসেন মোল্লা, কাজির চর) এবং আব্দুল . জলিল সরদার (পিতা মৌলভী জয়নাল আবেদীন সরদার, বলিয়াতলি)। মুলাদীর বাইরে শহীদরা হলেন- আবুল হোসেন (পিতা মফিজ উদ্দিন সরদার, চরকালেখাঁ), এস এম আবু হানিফ মোল্লা (পিতা মো. নূরুল হক মোল্লা, লক্ষ্মীপুর), আব্দুল খালেক (পিতা মোতাহার উদ্দিন, বানিমৰ্দ্দন), আবুল কাশেম খান (পিতা আছমত আলী খান, মুলাদী পৌরসভা), মো. সোহরাব আলী (পিতা মো. রমিজ উদ্দিন সরদার, দক্ষিণ গাছুয়া), মোশারফ হোসেন (পিতা হাজী মোফাক্কর হোসেন, মুলাদী), আব্দুল জব্বার হাওলাদার (পিতা ছাদের আলী হাওলাদার, দড়িরচর লক্ষ্মীপুর), আবুল কাশেম সরদার (পিতা মুন্সি আইজ উদ্দিন সরদার, আলিমাবাদ), সামসুল হক (পিতা হাছেন আলী মল্লিক, ডুমুরীতলা), কবির উদ্দিন মানিক (পিতা খোরশেদ আলী, পাতারচর), আব্দুল জলিল (পিতা আব্দুর রশিদ ভূঁইয়া, বাটমারা) এবং আব্দুর রশীদ হাওলাদার (পিতা ফয়েজদ্দিন হাওলাদার, তেরোচর)।
কেল কাজিরচর মাধ্যমিক বিদ্যালয় সংলগ্ন স্থানে তিনজন মুক্তিযোদ্ধার বাঁধানো কবর রয়েছে। এখানে বিভিন্ন জাতীয় দিবসে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। মুলাদী পৌর এলাকায় মুক্তিযোদ্ধা আলী খানের নামে একটি সড়কের নামকরণ করা হয়েছে। শহীদ আলতাফ মাহমুদের নামে তাঁর গ্রামের বাড়ি পাতারচরে একটি হাইস্কুলের নামকরণ করা হয়েছে ‘আলতাফ মেমোরিয়াল হাইস্কুল’। [বিধান সরকার]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৮ম খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!