মুক্তিযুদ্ধে মেঘনা উপজেলা (কুমিল্লা)
মেঘনা উপজেলা (কুমিল্লা) ১৯৯৮ সালে সৃষ্টি হয়। ১৯৭১ সালে হোমনা উপজেলার অধীনে থাকায় হোমনা উপজেলাকে ঘিরেই মেঘনায় মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি রচিত হয়। ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর ভাষণের পর এম মোজাফফর আলী এমপিএ-এর নেতৃত্বে হোমনায় একটি সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়। সংগ্রাম কমিটিতে মেঘনা এলাকার অনেক নেতা অন্তর্ভুক্ত হন। তাঁদের মধ্যে সফর আলী মাস্টার (হরিপুর), সিরাজুল ইসলাম (পারারবন্দ), ডা. খোরশেদ আলম (নয়াগাঁও), ডা. আসহাবুদ্দিন (হরিয়াকান্দি), ডা. ইসাহাক আহমেদ (মানিকের চর), কালুমিয়া সরকার (বাঘাইকান্দি), আলী হোসেন (টিডির চর), শাহজাহান ভূঁইয়া (টিডিরচর), আব্বাস উদ্দিন আহেমদ (মানিকের চর), আব্দুল হামিদ (ছাত্রনেতা, রাধানগর), চৌধুরী কায়সার আহমদ (জগন্নাথ কলেজের ছাত্রনেতা; গোবিন্দপুর), আব্দুল কাইয়ুম (জগন্নাথ কলেজের ছাত্রনেতা; গোবিন্দপুর), সোলায়মান (তুলাতলি) প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য।
সংগ্রাম কমিটির সহযোগিতায় মেঘনা অঞ্চলের গ্রামে-গ্রামে যুব- স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গড়ে তোলা হয়। মুসলিম লীগ- নেতাদের রক্তচক্ষু ও ভয়ভীতি উপেক্ষা করে স্বাধিকার আন্দোলনকে চূড়ান্তভাবে সফল করার লক্ষ্যে প্রচারণা চালানো ও যে-কোনো ঝুঁকি মোকাবেলা করার প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতা ফরিদ উদ্দিন আহমেদ প্রধান (হোমনা), মতিউর রহমান হিরণ (চান্দের চর), কামাল উদ্দিন আহমেদ (ঢাকা কলেজের ছাত্রনেতা; ঘনিয়ারচর) প্রমুখ মুগারচর, রাধানগর ও চন্দনপুর ইউনিয়নের বিভিন্ন বাজার ও গ্রামে সভার মাধ্যমে জনগণের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সচেতনতা সৃষ্টি এবং ছাত্র-যুবকদের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণে উদ্বুদ্ধ করেন। মেঘনা উপজেলার বাঘাইকান্দি গ্রামের অবসরপ্রাপ্ত বাঙালি সেনাসদস্য শামসুল হুদার তত্ত্বাবধানে মানিকের চর স্কুলমাঠে বাঁশের তৈরি ডামি রাইফেল দিয়ে এলাকার ছাত্র-যুবকদের মুক্তিযুদ্ধের প্রাথমিক প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। ক্যাপ্টেন (অব.) সুজাত আলী (দেবিদ্বার থানা) এপ্রিল মাসে মেঘনা উপজেলার গোবিন্দপুর গ্রামের আব্দুল মজিদের বাড়িতে ছাত্র-যুবকদের ভারতে প্রশিক্ষণে যেতে এক উদ্বুদ্ধকরণ সভা করেন এবং তিনি ৩০ জন ছাত্র- যুবককে প্রশিক্ষণের জন্য ভারতে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। তাছাড়া স্বাধীনতাবিরোধী প্রভাবশালী নেতাদের ব্যক্তিগত আগ্নেয়াস্ত্র জব্দ করে মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ন্ত্রণে নেয়া হয়।
২৫শে মার্চ ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে ধ্বংসযজ্ঞ ও বাঙালি নিধন শুরু হলে নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য সেখানকার মানুষ মেঘনা এলাকায় আসতে থাকে। মেঘনাপাড়ের রামপুরা বাজার, চন্দনপুর বাজার ও আলীপুর বন্দরে আশ্রয়ের জন্য অসহায় মানুষজনের আগমন ঘটে। সংগ্রাম কমিটির সহযোগিতায় যুব-স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর মাধ্যমে তাদের স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয় ও গ্রামের ধনী গৃহস্থের বাড়িতে সাময়িকভাবে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। অতঃপর তাদের নদী পার করে মাথাভাঙ্গা, ট্যাকের হাট প্রভৃতি স্থানে নিরাপদে পৌঁছে দেয়া হয়। এলাকার আইন-শৃঙ্খলা বজায় রাখতে মেঘনার যুব সমাজ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
মেঘনার ছাত্র-জনতা মে মাসে পাকবাহিনীর সহযোগী গোলাম মুহাম্মদ (মানিকের চর ইউনিয়নের প্রাক্তন চেয়ারম্যান)-এর বাড়িটি পুড়িয়ে দেয়। সেপ্টেম্বর মাসে বাহরখোলা গ্রামের ওপর দিয়ে পাকবাহিনীর একটি হেলিকপ্টার উড়ে যাওয়ার সময় ভিত্তি ফৌজ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মফিজ মিয়া একটি থ্রি-নট-থ্রি রাইফেল দিয়ে তা লক্ষ করে গুলি ছোড়েন। এ ঘটনার পরদিন পাকসেনারা হেলিকপ্টার থেকে বাহরখোলা গ্রামে বোমা বর্ষণ করে। এতে অলিউল্লাহ নামে একজন গ্রামবাসী আহত হয় এবং বেশ কয়েকটি পশু মারা যায়।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে পাকিস্তানি বাহিনীর মেঘনায় অনুপ্রবেশ ঘটেনি বিধায় কোথাও তাদের ক্যাম্প স্থাপন করা হয়নি।
২৬শে মার্চের পর হোমনায় শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনী গঠিত হয়। এ কমিটিতে মেঘনা অঞ্চলের যারা অন্তর্ভুক্ত ছিল, তাদের মধ্যে আব্দুল করিম বাঘা (শান্তি কমিটির নেতা, হোমনা থানা মুসলিম লীগের সভাপতি), সোলায়মান মোল্লা (রাধানগর ইউনিয়ন কাউন্সিলের চেয়ারম্যান), সোনামিয়া, (চন্দনপুর ইউনিয়ন কাউন্সিলের চেয়ারম্যান), গোলাম মুহাম্মদ (চন্দনপুর ইউনিয়ন কাউন্সিলের প্রাক্তন চেয়ারম্যান), জাহের আলী (সোনাকান্দা ইউনিয়ন কাউন্সিলের চেয়ারম্যান), গেদুমিয়া (বড়কান্দা ইউনিয়ন কাউন্সিলের চেয়ারম্যান), আব্দুল বাতেন (গোবিন্দপুর ইউনিয়ন কাউন্সিলের প্রাক্তন চেয়ারম্যান), দৌলত হোসেন (গোবিন্দপুর), আব্দুল মজিদ (নওচর), রমিজ উদ্দিন (হরিপুর), আবু (সোনাকান্দা)-র নাম উল্লেযোগ্য।
মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর হোমনাভিত্তিক শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনী গঠিত হলেও জুন মাসে হোমনা ও দাউদকান্দিতে মুক্তিযোদ্ধরা ক্যাম্প করলে পাকবাহিনীর দোসরদের তৎপরতা সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হয়ে যায়। কাজেই তারা মেঘনায় হত্যা, গণহত্যা, নারীনির্যাতন, লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগের কোনো ঘটনা ঘটানোর সুযোগ পায়নি|
মেঘনা উপজেলার বর্তমান ভৌগোলিক সীমার ভেতরে পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের কোনো সম্মুখ যুদ্ধ হয়নি। তবে মেঘনার নিকটবর্তী পঞ্চবটিতে ৮ই নভেম্বর গজারিয়া থানার বটেরচর ব্রিজের পাশে পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মুখ যুদ্ধ হয়। ১৯শে ডিসেম্বর পাকবাহিনীর ৩ জন সদস্য পালিয়ে যাওয়ার সময় হোমনার কাছে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে আটক হয়। জনরোষের শিকার হয়ে তাদের ২ জন সেখানেই প্রাণ হারায়। আব্দুর রহমান নামে একজনকে মেঘনার মানিকের চরে স্থাপিত মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। পরবর্তীতে ঐ পাকিস্তানি সেনাকে ঢাকার কোতয়ালি থানায় পাঠানো হয়। ২৪শে ডিসেম্বর হোমনা থানা হানাদারমুক্ত হয়। ঐ দিনটিই মেঘনা হানাদার মুক্ত দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে।
উপজেলার খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা হলেন- শহীদ মো. শামসুজ্জামান, বীর উত্তম (পিতা মো. দৌলত হোসেন, সোনারচর; ৪ঠা আগস্ট ঝিনাইগাতীর নকশী বিওপি যুদ্ধে শহীদ)
গোবিন্দপুর গ্রামে মুক্তিযুদ্ধের স্মরণে মুক্তিনগর বাজার নামে একটি বাজার স্থাপিত হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধা আব্বাস উদ্দিনের উদ্যোগে গোবিন্দপুরে মুক্তিবাহিনী উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। [মো. ফরিদ উদ্দিন আহমেদ প্ৰধান]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৮ম খণ্ড