You dont have javascript enabled! Please enable it! বীর বিক্রম মেজবাহ উদ্দিন আহমেদ - সংগ্রামের নোটবুক

বীর বিক্রম মেজবাহ উদ্দিন আহমেদ

মেজবাহ উদ্দিন আহমেদ, বীর বিক্রম (জন্ম ১৯৪১) বীর মুক্তিযোদ্ধা। তিনি ১৯৪১ সালের ২৮শে নভেম্বর ঢাকা শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁদের আদি নিবাস রংপুর সদর উপজেলার স্টেশন রোডে। তাঁর পিতার নাম আইন উদ্দিন আহমেদ এবং মাতার নাম জাহানারা আহমেদ। তিনি ১৯৫৯ সালে ঢাকা তেজগাঁও পলিটেকনিক হাইস্কুল থেকে এসএসসি, ১৯৬১ সালে জগন্নাথ কলেজ থেকে এইচএসসি এবং একই কলেজ থেকে ১৯৬৩ সালে বিকম পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯৬৮ সালে তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে ক্যাডেট হিসেবে যোগদান করে পশ্চিম পাকিস্তানের এবোটাবাদের কাকুল মিলিটারি একাডেমিতে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে তাঁকে সেনাবাহিনীতে কমিশন প্রদান করা হয়নি।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত মেজবাহ উদ্দিন নিজস্ব ব্যবসা পরিচালনা করতেন। ২৫শে মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী অপারেশন সার্চলাইট-এর নামে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর ব্যাপক গণহত্যা ও নির্যাতন শুরু করলে তার প্রতিবাদে তিনি মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। এ উদ্দেশ্যে ৩০শে মার্চ তিনি হারাগাছি হয়ে ভারতের দিনহাটা পৌঁছান এবং সেখানকার ফরওয়ার্ড ব্লকের এমপি কমল বাবুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে মুক্তিযুদ্ধের সাংগঠনিক কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করেন। পরবর্তীতে তিনি ক্যাপ্টেন নওয়াজেস উদ্দিনের নেতৃত্বে ৬ নং সেক্টরের সাহেবগঞ্জ সাব-সেক্টরে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। এরপর মেজবাহ উদ্দিন কিছুকাল সাহেবগঞ্জ সাব-সেক্টরের বামুনহাট স্টেশন ট্রেনিং ক্যাম্পে প্রশিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন। আগস্ট মাসের প্রথমদিকে উইং কমান্ডার মোহাম্মদ খাদেমুল বাশার, বীর উত্তম-এর নেতৃত্বে ৬ নং সেক্টর পুনর্গঠিত হলে মেজবাহ উদ্দিন এ সেক্টরের পাটগ্রাম সাব- সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন মতিউর রহমান, বীর বিক্রমএর নেতৃত্বে বিভিন্ন যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। যেহেতু মেজবাহ উদ্দিন আহমেদ পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমি থেকে সামরিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ছিলেন, সেহেতু বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে অফিসার রিক্রুট শুরু হলে বাংলাদেশ ওয়ার ফোর্সে তিনি সরাসরি কমিশনপ্রাপ্ত হন এবং লেফটেন্যান্ট পদে নিয়োগ পান। উল্লেখ্য যে, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তিনি ‘লেফটেন্যান্ট ফারুক’ নামে যুদ্ধ পরিচালনা করেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে লালমনিরহাট জেলার হাতীবান্ধা উপজেলার বড়খাতা ও থানা সদরে পাকিস্তানি সেনারা শক্ত প্রতিরক্ষা ঘাঁটি স্থাপন করে। কৌশলগত দিক থেকে এ স্থানটি ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বুড়িমারী সীমান্ত থেকে পাটগ্রাম হয়ে রেল ও সড়ক পথ হাতীবান্ধার ওপর দিয়ে লালমনিরহাটের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। পাকিস্তানি বাহিনীর যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করার জন্য বড়খাতা রেলসেতুটি ধ্বংস করা মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য খুবই জরুরি ছিল। বেশ কয়েকবার চেষ্টা করেও তাঁরা এটি ধ্বংস করতে সক্ষম হননি। আগস্ট মাসে সেক্টর কমান্ডার এম কে বাশার সেতুটি ধ্বংস করার নির্দেশ দেন। পাটগ্রাম সাব-সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন মতিউর রহমানের নেতৃত্বে ১২ই আগস্ট মুক্তিযোদ্ধারা পুনরায় এ সেতুটি আক্রমণ করেন। এ-সময় একটি কভারিং দলের নেতৃত্ব দেন মেজবাহ উদ্দিন আহমেদ। এখানে পাকিস্তানি সৈন্যদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে ১৫ জন পাকসৈন্য নিহত হয় এবং মুক্তিযোদ্ধারা রেলসেতুটি ধ্বংস
করতে সক্ষম হন।
মেজবাহ উদ্দিনের বীরত্বপূর্ণ আরেকটি যুদ্ধ হলো হাতীবান্ধা পাকিস্তানি ক্যাম্প আক্রমণ। ২৭শে সেপ্টেম্বর ভোররাতে মুক্তিযোদ্ধারা কয়েকটি দলে বিভক্ত হয়ে ক্যাপ্টেন মতিউর রহমানের নেতৃত্বে হাতীবান্ধা ক্যাম্প আক্রমণ করেন। এ যুদ্ধে একটি কোম্পানির নেতৃত্ব দেন মেজবাহ উদ্দিন সারাদিন যুদ্ধের পর পাকিস্তানি সেনারা আর্টিলারি ফায়ার করলে মুক্তিযোদ্ধারা এক পর্যায়ে ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়েন। কিন্তু ক্যাপ্টেন মতিউর রহমান ও মেজবাহ উদ্দিনের চেষ্টায় মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল ফিরে আসে। তিনদিন প্রচণ্ড যুদ্ধের পর পাকিস্তানি সৈন্যরা পিছু হটে এবং হাতীবান্ধা মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে আসে। এ যুদ্ধে কোম্পানি কমান্ডার সুবেদার ফজলুর রহমান, বীর উত্তমসহ ৭ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন এবং আহত হন ৩০ জনেরও অধিক। অপরদিকে বহু পাকিস্তানি সৈন্য হতাহত হয় এবং নয়শরও বেশি রাজাকার আত্মসমর্পণ করে।
মুক্তিযুদ্ধে বীরত্ব ও সাহসিকতাপূর্ণ অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার মেজবাহ উদ্দিন আহমেদকে ‘বীর বিক্রম’ খেতাবে ভূষিত করে (গেজেট নং ৯৯, খেতাবের সনদ নং ২৪)। মুক্তিযুদ্ধ শেষে মেজবাহ উদ্দিন তাঁর কর্মস্থল বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন এবং ১৯৭৬ সালে মেজর পদে উন্নীত হন। ১৯৮৮ সালে তিনি সেনাবাহিনী থেকে স্বেচ্ছা অবসর গ্রহণ করেন। বর্তমানে তিনি নিজস্ব ব্যবসা পরিচালনা করছেন। ব্যক্তিজীবনে মেজবাহ উদ্দিন আহমেদ তিন কন্যা সন্তানের জনক। তাঁর স্ত্রীর নাম কানিজ লাইলা। [সাজাহান মিয়া]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৮ম খণ্ড