মুন্সিবাজার গণহত্যা (রাজনগর, মৌলভীবাজার)
মুন্সিবাজার গণহত্যা (রাজনগর, মৌলভীবাজার) সংঘটিত হয় ২৭শে নভেম্বর। এতে বহু লোক শহীদ হন। মুন্সিবাজারে ১৯৭১ সালের মার্চ থেকে শিক্ষক নজাবত আলী, ছাত্রনেতা বাদশা মিয়া, রফিক মিয়া প্রমুখ স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে স্থানীয় মানুষকে সংগঠিত করেন। তারা যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিতেও ছাত্র-যুবকদের উদ্বুদ্ধ করেন। কিন্তু স্বাধীনতাবিরোধী মুসলিম লীগ-এর নেতা-কর্মীরা নানাভাবে এ কার্যক্রম প্রতিহত করার চেষ্টা করে, যদিও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে গড়ে ওঠা ব্যাপক জনসমর্থনে তারা দাঁড়াতে পারেনি। মৌলভীবাজার সদরে পাকবাহিনীর ক্যাম্প স্থাপিত হওয়ার পর স্বাধীনতাবিরোধীরা পাকসেনাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে। মুন্সিবাজারের রাজাকার দুদু মিয়া, বারিক মিয়া, মতিউর রহমান চৌধুরী, করিমপুর চা-বাগানের বিহারি দোকানদার আলী বক্স, আলবদর- নেতা উজের মিয়া ও অন্যরা এলাকায় গণহত্যার পরিকল্পনা করে। ইতোমধ্যে বারিক মিয়াকে আহ্বায়ক করে মুন্সিবাজার ইউনিয়ন শান্তি কমিটি গঠিত হয়।
২৭শে নভেম্বর পাকবাহিনীর দোসররা মুন্সিবাজার ও আশপাশে শান্তি-শৃঙ্খলা বাজায় রাখার নামে খলা গ্রামের জমিদার সুরীতি মোহন ধরের বাড়িতে মিটিংয়ের ব্যবস্থা করে। এ বাড়ি ও আশপাশের লোকজন সরল বিশ্বাসে সকালবেলা এখানে সমবেত হয়। সকাল ৭টার দিকে মৌলভীবাজার থেকে পাকসেনারা মুন্সিবাজারে আসে। তারা তিন দলে বিভক্ত হয়ে জমিদার বাড়ি দখলে নেয়। তারা জমিদার বাড়ি, নিশি রঞ্জন ধরের বাড়ি, ঘোষের বাড়িসহ আশপাশের বাড়িগুলোতে হানা দিয়ে লোকজনকে ধরে আনে। এরপর ৩ জন ৩ জন করে বিভিন্ন ঘরে, ঘরের পেছনে, খালের পাড়ে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করে। পুরো বাড়ি সেদিন রক্তে রঞ্জিত হয়। এদিন গণহত্যার শিকার হন— শুশীতল ধর চৌধুরী, শতদল ধর চৌধুরী, শ্যামল ধর চৌধুরী, সজল ধর চৌধুরী, সুকেশ রঞ্জন ধর চৌধুরী, অখিল চন্দ্র ধর চৌধুরী, অরবিন্দ কুমার ধর চৌধুরী, যতীন্দ্র মোহন ঘোষ, প্রতাপ পুরকায়স্থ (সুরীতি ধরের শ্যালক), নরেন্দ্র দেব, খিরদ দেব প্রমুখ। বাড়ির কাজের লোক বিজয় দাস ও পরিমল দাস প্রাণ ভিক্ষা করেও রক্ষা পায়নি। তাদেরও গুলি করে হত্যা করা হয়। নরপশুরা চলে যাবার পর গ্রামের লোকেরা জমিদার বাড়ির পুকুরপাড়ে মৃতদেহগুলো এক জায়গায় সমাহিত করে। এদিন মারাত্মকভাবে গুলিবিদ্ধ বাবুল দাস কিছুদিন পর মারা যায়। গণহত্যার পর স্থানীয় দালালরা বিভিন্ন বাড়িতে লুটপাট করে। তারা সোনা-গয়না, টাকা-পয়সা, দামি আসবাবপত্র, গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি পর্যন্ত লুণ্ঠন করে। এরপর রাজাকাররা পুরো বাড়িটি জ্বালিয়ে দেয়। তারা মুন্সিবাজারের কয়েকটি দোকানেও লুটপাট চালায়। [জয়নাল আবেদীন শিবু]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৮ম খণ্ড