You dont have javascript enabled! Please enable it! মুক্তিযুদ্ধে মুজিব বাহিনী - সংগ্রামের নোটবুক

মুক্তিযুদ্ধে মুজিব বাহিনী

মুজিব বাহিনী ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের অন্যতম সংগঠন বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স, সংক্ষেপে বিএলএফ। মুজিব বাহিনী নামে সমধিক পরিচিত।
মুজিব বাহিনী রাজনৈতিক সচেতন বাহিনী। এর হাইকমান্ডে ছিলেন আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ-এর চার গুরুত্বপূর্ণ যুবনেতা— শেখ ফজলুল হক মনি, সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক ও তোফায়েল আহমেদ। চারজনই ষাটের দশকে আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন ‘পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ’-এর সভাপতি বা সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। এ চার নেতার সবাই ছিলেন বঙ্গবন্ধুর অনুগত ও ঘনিষ্ঠ। নানা সময়ে এ চার নেতার সাক্ষাৎকার থেকে জানা যায় যে, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু তাঁদের ঐক্যবদ্ধভাবে মুক্তিসংগ্রাম পরিচালনার দায়িত্ব অর্পণ করেন। তাঁর অনুপস্থিতিতে তাজউদ্দীন আহমদ এর সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন। বিষয়টি তাজউদ্দীন আহমদও অবহিত ছিলেন। এ চার যুবনেতা বঙ্গবন্ধুর পরে তাজউদ্দীন আহমদকেই নেতা মান্য করতেন। কিন্তু তাজউদ্দীনের নেতৃত্বে সরকার গঠনের প্রশ্নে তাঁদের মধ্যে ভিন্ন মত ছিল বলে জানা যায়। চার যুবনেতার কারো- কারো প্রস্তাব ছিল, ‘বাংলাদেশ লিবারেশন ফ্রন্ট’ গঠন করে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করা। যাহোক, নবগঠিত বাংলাদেশ সরকার-এর মন্ত্রিসভা ১৮ই এপ্রিল মুক্তিবাহিনীতে ছাত্র-যুবকদের অর্ন্তভুক্তির দায়িত্ব এ চার যুবনেতার ওপর অর্পণ করে।
শেখ ফজলুল হক মনি, সিরাজুল আলম খান, আব্দুর রাজ্জাক ও তোফায়েল আহমদের মধ্যে চিন্তার ভিন্নতা ছিল। তবে এ ব্যাপারে তাঁরা একমত পোষণ করতেন যে, মুক্তিবাহিনীতে নানা মতের বা আদর্শের লোকের সমাবেশ ঘটেছে, যাদের বেশির ভাগই রাজনৈতিক সচেতন নয়। অনেকেই আওয়ামী লীগ ঘরনার লোক নয়। তাছাড়া তখন দেশের ভেতরে মুক্তিবাহিনীর নামে কিছু জনবিরোধী ঘটনাও ঘটছিল।
বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্যের বাইরেও স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা গ্রুপ ছিল। তাদের কার্যক্রমের ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ ছিল না। পিকিংপন্থী কমিউনিস্ট পার্টি ‘দুই ফ্রন্টে যুদ্ধ’-এর রণনীতি গ্রহণ করেছিল, অর্থাৎ একই সঙ্গে পাকিস্তানি সেনা ও মুক্তিযোদ্ধা উভয়ের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে নিজেদের নেতৃত্ব-কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা। কোথাও-কোথাও তাদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের সংঘর্ষও হয়েছিল। তাই ৪ যুবনেতার মধ্যে ধারণা তৈরি হয় যে, মুক্তিযুদ্ধ প্রলম্বিত হলে মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে বিরোধী পক্ষ তৈরি হতে পারে; নকশালদের অনুপ্রবেশ ঘটতে পারে এবং মুক্তিযুদ্ধের ওপর আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব নিয়ন্ত্রণ হারাতে পারে। এসব দিক বিবেচনা থেকে তাঁরা রাজনৈতিক সচেতন বাহিনী গঠনে উদ্যোগী হন। তবে তা মুক্তিবাহিনীর বিকল্প শক্তি হিসেবে নয়, বরং তা হবে মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক সচেতন অগ্রণী বাহিনী। লক্ষ্য হবে মুজিব অনুসারীদের একই পতাকাতলে সংগঠিত করে মুক্তিযুদ্ধকে তাঁদের পরিকল্পনা অনুযায়ী পরিচালিত করা।
এ লক্ষ্যে তাঁরা ভারত সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করেন এবং মুজিব অনুসারীদের নিয়ে বাহিনী গঠনের প্রস্তাব দেন। ভারতীয় কর্তৃপক্ষও মুক্তিযুদ্ধের গতি-প্রকৃতি নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন। নকশালদের নিয়ে তাঁদের দুশ্চিন্তা ছিল। সম্ভবত ভারত সরকারও এসব বিবেচনায় মুজিব অনুসারীদের নিয়ে আলাদা বাহিনী গঠনে সহায়তা প্রদানে আগ্রহী হয়। এ প্রসঙ্গে মুজিব বাহিনীর প্রশিক্ষণের দায়িত্বপ্রাপ্ত ভারতীয় বাহিনীর মেজর জেনারেল সুজন সিংহ উবানের বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য: ‘গোলযোগের অশান্ত দিনগুলোতে আমরা একদল নিবেদিতপ্রাণ যুবনেতার কথা জানতে পারি, যাদের নাম বাংলাদেশে বহুল পরিচিত ছিল। তারা ছিলেন শেখ ফজলুল হক মনি (শেখ মুজিবের বোনের ছেলে), তোফায়েল আহমেদ, সিরাজ, আব্দুর রাজ্জাক। … তাদেরকে মনে হলো অত্যন্ত অনুপ্রাণিত এবং মরতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। বাংলাদেশের ভেতরে ও বাইরের মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে তাদের নেতৃত্বের গ্রহণযোগ্যতা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত ছিল। দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপার, অস্থায়ী সরকার তাদের তেমন মর্যদা দিতে প্রস্তুত ছিল না। তারা চাইছিলেন যে, এরা মুক্তিবাহিনীর নেতৃত্বে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করবে এবং যুদ্ধে অংশ নেবে। এতে যুবনেতাদের কঠোর আপত্তি ছিল। মুজিবের প্রতি তাদের গভীরতর আনুগত্য ও নৈকট্যের কারণে (তারা সকলে পাক সামরিক কর্তৃপক্ষের নির্দেশে জেল খেটেছেন মুজিবের সঙ্গে) তারা ‘মুজিব বাহিনী’ নামে অভিহিত হতে পছন্দ করলেন। তারা তাদের পুরনো সহকর্মীদের ক্যাডার হিসেবে বেছে সত্যায়িত করলেন’ (বঙ্গানুবাদ)।
ছাত্রলীগের কর্মীদের বাইরে কিছু শ্রমিক লীগের সদস্যকে প্রশিক্ষণের জন্য রিক্রুট করা হয়েছিল। ২৯শে মে ভারতের মিলিটারি একাডেমি দেরাদুনের সন্নিকটে তান্দুয়ায় মুজিব বাহিনীকে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। একটি ব্যাচের প্রশিক্ষণ মেঘালয়ের হাফলং-এ হয়েছিল।
তাজউদ্দীন আহমদ মুজিব বাহিনীর গঠন ও প্রশিক্ষণের ব্যাপারে প্রথমে অবহিত ছিলেন না। তাঁকে না জানিয়ে ভারত সরকার আলাদা বাহিনী গড়ে তুলছে, যা তাঁকে উদ্বিগ্ন করেছিল। প্রচারণা ছিল, তাজউদ্দীন সরকারের ‘বিকল্প’ হিসেবে এটি গঠিত হয়েছে। এক পর্যায়ে আলোচনার মাধ্যমে মতদ্বৈধতার অবসান ঘটে। যুবনেতারা স্পষ্ট করেন যে, তারা তাজউদ্দীনের নেতৃত্বে গঠিত সরকারকে মান্য করেন এবং সরকারের সঙ্গে সমন্বয় রেখেই মুজিব বাহিনী পরিচালনা করবেন। মুজিব বাহিনীর পক্ষে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শাজাহান সিরাজকে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষার দায়িত্ব দেয়া হয়। তিনিই প্রধানমন্ত্রীকে মুজিব বাহিনীর কার্যক্রম অবহিত করতেন। তবে মুজিব বাহিনীর চেইন অব কমান্ড ছিল না। স্বতন্ত্র বাহিনী হিসেবে চার হাইকমান্ডের নেতৃত্বে পরিচালিত হয়েছিল। চার যুবনেতা লে. জেনারেলের মর্যাদা ও প্রটোকল পেতেন।
নভেম্বর পর্যন্ত ১০ হাজার যুবককে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়। লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছিল যে, প্রশিক্ষণপ্রাপ্তরা দেশের অভ্যন্তরে প্রশিক্ষণ দিয়ে ৭০ হাজারের এক বাহিনী গড়ে তুলবে। এ লক্ষ্যে কার্যক্রমও শুরু হয়েছিল।
মুজিব বাহিনীর সদস্যদের প্রশিক্ষণ ছিল মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের থেকে আলাদা। তাঁদের জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। তাঁদের সামরিক প্রশিক্ষণের পাশাপাশি রাজনৈতিকভাবে উদ্বুদ্ধ করা হতো। তাই মুজিব বাহিনীর প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদের মধ্য থেকে প্রাথমিক পর্যায়ে ৮ জন গুরুত্বপূর্ণ ছাত্রনেতাকে প্রশিক্ষক নিয়োগ করা হয়। তাঁরা হলেন— হাসানুল হক ইনু, শরীফ নূরুল আম্বিয়া, আ ফ ম মাহবুবুল হক, রফিকুজ্জামান, মাসুদ আহমদ রুমি প্রমুখ। পরে প্রশিক্ষকের সংখ্যা বাড়িয়ে ৫২ করা হয়। মুজিব বাহিনীর সদস্যদের অত্যাধুনিক অস্ত্রও প্রদান করা হয়।
মুজিব বাহিনীর কার্যক্রম চারটি ফ্রন্টে বিভক্ত ছিল- ১. পূর্বাঞ্চল (ঢাকা, কুমিল্লা, নোয়াখালী, চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম); এর অধিনায়ক ছিলেন শেখ ফজলুল হক মনি এবং সহ-অধিনায়ক ছিলেন আ স ম আবদুর রব। সদর দফতর ছিল ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের রাজধানী আগরতলায়।
২. মধ্যাঞ্চল (ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল ও সিলেট); এর অধিনায়ক ছিলেন আবদুর রাজ্জাক এবং সহ-অধিনায়ক ছিলেন সৈয়দ আহমেদ। সদর দফতর ছিল ভারতের মেঘালয় রাজ্যের তুরায়।
৩. উত্তরাঞ্চল (রাজশাহী, রংপুর, দিনাজপুর ও পাবনার সিরাজগঞ্জ); এর অধিনায়ক ছিলেন সিরাজুল আলম খান এবং সহ-অধিনায়ক ছিলেন মনিরুল ইসলাম (মার্শাল মনি)। সদর দফতর ছিল পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ির পাঙ্গায়।
৪. দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল (যশোহর, খুলনা, ফরিদপুর, বরিশাল, কুষ্টিয়া ও পাবনা); এর অধিনায়ক ছিলেন তোফায়েল আহমেদ এবং সহ-অধিনায়ক ছিলেন নূর আলম জিকু। সদর দফতর কলকাতার ব্যারাকপুরে। কাজী আরেফ আহমেদ ছিলেন বিএলএফ-এর গোয়েন্দা প্রধান।
অক্টোবরে দেরাদুনের কালসিতে জেলা প্রতিনিধিসহ ৭৩ জন নেতার সম্মেলনে কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। সেখানে সিদ্ধান্ত হয় যে, সংগ্রামের লক্ষ্য হবে জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা কায়েম করা, যা ‘মুজিববাদ’ হিসেবে তুলে ধরতে হবে। একই সঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে বিএলএফ-এর নামকরণ করা হয় মুজিব বাহিনী।
মুজিব বাহিনীর সদস্যরা সারাদেশে তৎপর হয়ে ওঠেন তাঁরা যুদ্ধের পাশাপাশি জনগণের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর ভাবাদর্শ প্রচার এবং সংগঠিত করার কাজে উদ্যোগী হন। বেশির ভাগ স্থানেই মুজিব বাহিনী ও মুক্তিবাহিনী একযোগে কাজ করে। কোথাও-কোথাও এ দুই বাহিনীর মধ্যে সমস্যা দেখা দিলে আলোচনার মাধ্যমে তার সুরাহা হয়। তবে কোনো-কোনো স্থানে সংঘাত ও অপ্রীতিকর ঘটনাও ঘটে। খুলনা, বগুড়া, রংপুরসহ অনেক জেলায় মুজিব বাহিনীর জেলা ও মহকুমা প্রধান ছিলেন ঐসব জেলা ও মহকুমার সম্মিলিত মুক্তিযোদ্ধাদের কমান্ডার। মুক্তিযোদ্ধা গ্রুপগুলোর মধ্যে সমন্বয় ও শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে মুজিব বাহিনীর হাইকমান্ডের ভূমিকা অপরিসীম। [আবু সাঈদ খান]
তথ্যসূত্রঃ মেজর জেনারেল (অব.) এস এস উবান, ফ্যান্টমস অব চিটাগং, দি ফিফথ আর্মি ইন বাংলাদেশ, ঢাকা, ঘাস ফুল নদী ২০০৫

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৮ম খণ্ড