মুজিবনগর যুদ্ধ (মুজিবনগর, মেহেরপুর)
মুজিবনগর যুদ্ধ (মুজিবনগর, মেহেরপুর) সংঘটিত হয় তিনদিন – ২১শে এপ্রিল, ২৪শে এপ্রিল ও ৩রা জুন। এথম ও দ্বিতীয় দিনের যুদ্ধে পাকসেনারা মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাঁটি দখল করতে ব্যর্থ হয়ে ফিরে যায়। তৃতীয় দিনের প্রথম যুদ্ধে তারা ঘাঁটি দখল করে, কিন্তু দ্বিতীয় যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধারা তাঁদের ঘাঁটি পুনরুদ্ধার করেন। এ-সময় ২৮ জন পাকসেনা নিহত হয়। মুক্তিযুদ্ধকালে বাংলাদেশের প্রথম রাজধানী ছিল মুজিবনগর। কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুর মহকুমার বৈদ্যনাথতলার এরূপ নামকরণ করা হয়। এখানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-কে রাষ্ট্রপতি ও তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী করে গঠিত প্রথম বাংলাদেশ সরকার-এর শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান ১৭ই এপ্রিল অনুষ্ঠিত হয়। মুজিবনগর আম্রকুঞ্জের ইপিআর ক্যাম্পটি দখল করতে ২১শে এপ্রিল প্রথম পাকিস্তানি বাহিনী আক্রমণ করে। প্রবল ঝড়বৃষ্টি আর বজ্রপাতের কারণে তারা ব্যর্থ হয়ে ফিরে যায়। এ খবর পরের দিন ভারতীয় দৈনিক যুগান্তর পত্রিকায় ছাপা হয়। দুদিন পর ২৪শে এপ্রিল সকাল ১০টার দিকে শতাধিক পাকসেনার একটি সশস্ত্র দল আম্রকাননে প্রবেশ করে। তাদের উপস্থিতির খবর বেতাই লালবাজার সাব-সেক্টরে পৌঁছলে তাৎক্ষণিকভাবে ক্যাপ্টেন এ আর আযম চৌধুরীর নির্দেশে সুবেদার আব্দুল মতিন পাটোয়ারীর নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা প্রচণ্ড আক্রমণে পাকসেনাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। উভয় পক্ষে প্রচুর গুলি বিনিময়ের পর পাকিস্তানি বাহিনী ব্যর্থ হয়ে ফিরে যায়। ৩রা জুন মুজিবনগর আম্রকাননে পাকবাহিনী পুনরায় আক্রমণ করলে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যুদ্ধ হয়। এ- সময় সুবেদার আব্দুল মতিন পাটোয়ারী ইপিআর ও আনসার মিলিয়ে ৪৫ জন ট্রুপস নিয়ে এলাকার প্রতিরক্ষায় নিয়োজিত ছিলেন। বিকেল ৪টার দিকে পাকসেনারা প্রায় এক ব্যাটালিয়ন সৈন্য নিয়ে তাদের কিছু সংখ্যককে মূল ডিফেন্সে রেখে মুজিবনগর আম্রকাননের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। সুবেদার মতিন পাটোয়ারী পাকসেনাদের উপস্থিতি টের পেয়ে তাঁর অধীনস্থ ট্রুপসকে দুটি ভাগে ভাগ করে একটিতে নিজে এবং অপরটিতে সুবেদার তোফাজ্জল হোসেন নেতৃত্ব দিয়ে ডিফেন্স নেন। পাকসেনারা আম্রকাননের নিকটে এলে মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্রগুলো একসঙ্গে গর্জে ওঠে। পাকসেনারা খোলা মাঠে থাকায় মুক্তিযোদ্ধারা নির্দিষ্ট লক্ষ্যে গুলিবর্ষণ করতে থাকেন। পাকসেনারা মৃত্যুকে অগ্রাহ্য করে সামনে অগ্রসর হতে থাকে। তাদের তীব্র আক্রমণের মুখে মুক্তিযোদ্ধারা এক সময় পিছু হটতে থাকেন। পাকসেনারা শেষ পর্যন্ত মুজিবনগরে মুক্তিযোদ্ধাদের মূল ঘাঁটি দখল করে বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ করে। মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটে আম্রকাননের পেছনের আখক্ষেতে একত্রিত হন। সুবেদার মতিন পাটোয়ারী স্বল্প সংখ্যক মুক্তিযাদ্ধাকে বিস্তীর্ণ এলাকায় ছড়িয়ে দিয়ে পাকিস্তানি সামরিক কায়দায় বজ্রকণ্ঠে কমান্ড দেন, ‘আলফা ব্রোভো রাইট, চার্লি ডেল্টা লেফট, ইসকো ইহামে এ্যাডভান্স আওর সালে লোককো জিন্দা পাহাড় লেআও’। এর পরপরই মুক্তিযোদ্ধারা বিস্তীর্ণ এলাকা থেকে পাকবাহিনীর প্রতি গুলিবর্ষণ শুরু করেন। একই সঙ্গে বিভিন্ন দিক থেকে গুলি আসায় এবং কমান্ডের এমন দৃষ্টান্ত শুনে পাকসেনারা বিচলিত হয়ে পড়ে। মুক্তিযোদ্ধাদের বুলেট তাদের একের পর এক ধরাশায়ী করে। পাকসেনারা শেষ পর্যন্ত পিছু হটে পালিয়ে যায়। যুদ্ধে ২৮ জন পাকসেনা নিহত হয় এবং কয়েকজন আহত হয়। মুক্তিযোদ্ধারা পুনরায় তাদের মুজিবনগর ঘাঁটি পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হন। মুক্তিযোদ্ধাদের এ গ্রুপটি মুজিবনগরে পাকসেনাদের বিরুদ্ধে অনেকগুলো অপারেশনে কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছে। [মো. জামালউদ্দিন]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৮ম খণ্ড