You dont have javascript enabled! Please enable it! মুক্তিযুদ্ধের গান - সংগ্রামের নোটবুক

মুক্তিযুদ্ধের গান

বাঙালি জাতি সংগীতপ্রিয়। তাদের ভাব, ইতিহাস ও জীবনযাপন প্রণালী উঠে আসে গানে। স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় যে-সকল গান গীতিকার-সুরকারগণ রচনা করেছিলেন, তা পরবর্তীকালে মুক্তিযুদ্ধের গান হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।
৪৮ ও ৫২’র ভাষা-আন্দোলন-এর মাধ্যমে পাকিস্তান রাষ্ট্রে বাঙালির অধিকার আদায়ের সংগ্রামের সূচনা ঘটে। ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে তা চূড়ান্ত পরিণতি লাভ করে। মুক্তি সংগ্রামের উদ্দেশ্য ছিল স্বাধীনতা ও বাঙালির জন্য ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শভিত্তিক একটি স্বাধীন জাতি-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। তাই মুক্তিযুদ্ধ শুধুমাত্র একটি দেশের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা আন্দোলন ছিল না, বরং এটি ছিল একই সঙ্গে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তির সংগ্রাম। মুক্তিসংগ্রামে তাই সকল শ্রেণির মানুষকে অংশগ্রহণ করতে দেখা যায়। অস্ত্র হিসেবে শুধু বন্দুক-কামান, আগ্নেয়াস্ত্রই বিবেচ্য ছিল না – কণ্ঠ, কলম, নৃত্যভঙ্গি, বাদ্য সবকিছুই অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়। রাজপথের স্লোগান গানের ভেতর যুক্ত হয়ে অনুরণিত হয়েছে-
জয় বাংলা বাংলার জয়
হবে হবে হবে হবে নিশ্চয়।

বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামে সংগীত নানা পরিসরে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এসব সংগীতকে ৬টি প্রধান ভাগে ভাগ করা যায়, যথা—
১. স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের গান
২. যুদ্ধকালীন জাগরণী গান
৩. মুক্তিযুদ্ধকালীন দেশাত্মবোধক গান
৪. বঙ্গবন্ধুকে নিবেদিত গান
৫. শরণার্থীদের উদ্বুদ্ধকরণে গান
৬. মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বহির্দেশীয় সমর্থনমূলক গান
৭. স্বাধীনতা-উত্তর মুক্তিযুদ্ধের গান

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের গান
মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ভূমিকা ছিল অপরিসীম। এ বেতার কেন্দ্র এ দেশের আপামর জনগণকে মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণায় উজ্জীবিত করে এবং মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিকামী মানুষের প্রেরণার অন্যতম উৎসমূল হিসেবে পরিগণিত হয়। ফলে সঙ্গত কারণেই স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র- মুক্তিযুদ্ধের ‘দ্বিতীয় ফ্রন্ট’ এবং এর অনুষ্ঠানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ শব্দসৈনিক হিসেবে জনগণের শ্রদ্ধা অর্জন করে।
১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কর্তৃক বাঙালিদের ওপর ইতিহাসের মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ড শুরুর পর সাড়ে সাত কোটি বাঙালি যখন শোকাতুর, দিশেহারা ও সর্বত্র শোকের কালোছায়া, এমনি এক অবস্থায় চট্টগ্রাম বেতারের কয়েকজন কলাকুশলীর প্রচেষ্টায় কালুরঘাট থেকে সর্বপ্রথম ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্রের’ আত্মপ্রকাশ ঘটে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠা পর্যায়ের স্থিতিকাল ছিল ২৬-৩০শে মার্চ পর্যন্ত। ৩০শে মার্চ দুপুরে পাকিস্তান বিমান বাহিনী এ কেন্দ্রের ওপর বোমা বর্ষণ করে। বোমা হামলায় মূল ট্রান্সমিটারটি বিধ্বস্ত হলে দুঃসাহসী ও দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ বেতার কলাকুশলীরা কালুরঘাট থেকে এক কিলোওয়াট ট্রান্সমিটার খুলে নিয়ে ত্রিপুরা রাজ্যের সীমান্তবর্তী জঙ্গল বাগাফাতে স্থাপন করেন। এরপর ১৭ই এপ্রিল গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গঠিত হলে ৫০ কিলোওয়াট ক্ষমতা সম্পন্ন ট্রান্সমিটারের সাহায্যে ২৫শে মে (১১ই জ্যৈষ্ঠ) বিদ্রোহী কবি কাজি নজরুল ইসলামের জন্মদিনে কলকাতার বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের দ্বিতল বাড়িতে তৃতীয় পর্যায়ে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র চালু হয়। মুক্তিযুদ্ধ শেষে এ বেতার কেন্দ্রই বাংলাদেশ বেতার নামে অনুষ্ঠান সম্প্রচার করে আসছে।
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কলকাতা পর্যায়ে কোনো স্টুডিও ছিল না। তিন কামরাবিশিষ্ট দোতলার একটি ঘরে দরজা জানালা বন্ধ করে রেকর্ডিংয়ের কাজ শুরু হতো। তবে অনুষ্ঠান প্রচার ও এর মান বিবেচনায় দ্রুত স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র একটি পূর্ণাঙ্গ বেতারে রূপ নেয়। ঢাকা বেতারের কর্মী আশফাকুর রহমান, তাহের সুলতান ও টি এইচ শিকদার ঢাকা রেডিও স্টেশনের টেপ লাইব্রেরি থেকে
অসহযোগ আন্দোলন-এর (২রা-২৫শে মার্চ) সময়কার বেশ কিছু গানের টেপ সঙ্গে নিয়ে কলকাতায় এসে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে যোগ দেন। আলোচ্য টেপগুলোর জন্যই স্বাধীন বাংলা বেতার থেকে প্রচারিত বেশ কয়েকটি গান ছিল মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার অব্যবহিত পূর্বেকার। এছাড়াও কয়েকদিনের মধ্যেই ঢাকা রেডিওর অনুষ্ঠানঘোষক শহীদুল ইসলামের নেতৃত্বে একদল বেতারকর্মী আরো কিছু গানের টেপসহ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে যোগ দেন।
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সংগীত পরিচালক সমর দাস এবং অজিত রায় সীমিত সংখ্যক বাদ্যযন্ত্র ও শিল্পী নিয়ে শুধুমাত্র আন্তরিক নিষ্ঠার জোরে সংগীত অনুষ্ঠানগুলোকে সফল করে তোলেন। কোনো সাউন্ড প্রুফ রেকর্ডিং স্টুডিও ছিলো না। ছোট্ট একটা মাইক্রোফোন। টেবিলের ওপর তবলা ও মাইক্রোফোনটিকে উঠিয়ে চারদিকে শিল্পীরা দাঁড়াতেন। কোনো ব্যালেন্স করার ব্যাপার ছিল না। ছিল শুধু মনোবল আর বিজয়ের আকাঙ্ক্ষা। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কাজ। গীতিকার গান লিখছেন, সুরকার সুর তুলছেন। শিল্পীদের গান উঠিয়ে দিচ্ছেন। কোনো ক্লান্তি নেই; নেই খাওয়া-দাওয়ার সময়টুকুও।
একক ও সমবেত সংগীত পরিবেশনায় অংশগ্রহণ করেন- সমর দাস, সনজিদা খাতুন, আব্দুল জব্বার, অজিত রায়, আপেল মাহমুদ, রথীন্দ্রনাথ রায়, মান্না হক, রফিকুল আলম, হরলাল রায়, মোহাম্মদ শাহ বাঙ্গালী, এস এম আব্দুল গণি, সর্দার আলাউদ্দিন, মোশাদ আলী, অনুপ কুমার ভট্টাচার্য, এম এ মান্নান, অরূপ রতন চৌধুরী, ইন্দ্রমোহন রাজবংশী, কল্যাণী ঘোষ, মনজুর আহমদ, প্রবাল চৌধুরী, মালা খান, মনোরমা ঘোষাল, মফিজ আঙ্গুর, খাজা সুজন, সুজেয় শ্যাম, তিমির নন্দী, মলয় দাশগুপ্ত, শিলা ভদ্র, কাদেরী কিবরিয়া, ফকির আলমগীর, বুলবুল মহলানবিশ, শাহীন সামাদ, মলয় কুমার গাঙ্গুলী, রূপা ফরহাদ, উমা খান, বিপুল ভট্টাচার্য, নমিতা ঘোষ, মিতালী মুখার্জী, তপন ভট্টাচার্য, মলয় ঘোষ দস্তিদার, স্বপ্না রায়, তপন মাহমুদ, তোরাপ আলী শাহ, মাহমুদুর রহমান বেণু, ডালিয়া নওশীন, ঝর্ণা ব্যানার্জী, ফোরা আহমেদ, শুক্লা ভদ্র, বুলা মাহমুদ, লাকী আকন্দ, রমা ভৌমিক, নিতাই চন্দ্র সরকার, গীতশ্রী সেন, শাহ আলী সরকার, সরদার আলাউদ্দিন প্রমুখ।
গীতিকারদের মধ্যে ছিলেন সিকান্দার আবু জাফর, আবদুল লতিফ, হরলাল রায়, গাজী মাজহারুল আনোয়ার, নঈম গওহর, শহিদুল ইসলাম, সৈয়দ শামসুল হুদা, মোস্তাফিজুর রহমান, গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার, গোবিন্দ হালদার, সলিল চৌধুরী, শেখ লুৎফর রহমান, আলতাফ মাহমুদ, আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী, আবদুল গনি বোখারী, নাজিম মাহমুদ, ফেরদৌস হোসেন ভূঁইয়া, আবুবকর সিদ্দিক, দিলওয়ার, ফজল এ খোদা, মতলুব আলী, আখতার হোসেন, মোকসেদ আলী সাঁই, আপেল মাহমুদ, আবুল কাশেম সন্দীপ, আলী মোহসীন রেজা প্রমুখ। একশ জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে গঠিত মুক্তিযোদ্ধা শিল্পী সংস্থা ৬ মাসে ভারতের বিভিন্ন শহর ও শরণার্থী শিবিরে ২৫০টি অনুষ্ঠান করে। এসব অনুষ্ঠানের সংগঠক-পরিচালক ছিলেন ওয়াহিদুল হক, হাসান ইমাম, সন্জিদা খাতুন, মুস্তফা মনোয়ার, মাহমুদুর রহমান বেণু প্রমুখ।
যন্ত্রসংগীতে ছিলেন সুজেয় শ্যাম, কালচাঁদ ঘোষ, গোপী বল্লভ বিশ্বাস, হরেন্দ্র চন্দ্র লাহিড়ী, সুবল দত্ত, বাবুল দত্ত, অবিনাশ শীল, সুনীল গোস্বামী, তড়িৎ হোসেন খান, দিলীপ দাশ গুপ্ত, দিলীপ ঘোষ, জুলু খান, রুমু খান, জাহিদ হোসেন প্রধান, বাসুদেব দাশ, সমীর চন্দ্র, শতদল সেন প্রমুখ|
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় এবং এর আগে ও পরে অনেকে উদ্দীপনীয় গান রচনা করেছেন। তাঁদের মধ্যে আছেন জসীমউদ্দীন, মোমতাজ আলী খান, আবু হেনা মোস্তফা কামাল, নির্মলেন্দু চৌধুরী, মো. মোশাদ আলী, লোকমান হোসেন ফকির, রাহাত খান, মো. সিরাজুল ইসলাম প্রমুখ।
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, রজনীকান্ত, অতুল প্রসাদ, সুকান্ত ভট্টাচার্য প্রমুখের রচিত কালজয়ী সংগীতমালা বাংলাদেশের গায়ক-গায়িকাদের কণ্ঠে এ সময় পুনর্ধারণ করে প্রচারিত হয়েছে। এ পর্যায়ে সলিল চৌধুরী ও হেমাঙ্গ বিশ্বাসের রচিত এবং এককালে গণনাট্য সংঘ কর্তৃক পরিবেশিত গানগুলোও স্বাধীন বাংলা বেতারের শিল্পীদের কণ্ঠে নতুন করে প্রচারিত হয়েছে।
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত হয়েছে ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’, ‘দুর্গম গিরি কান্তার মরু’, ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’, ‘কেঁদো না কেঁদো না মাগো’, ‘নোঙ্গর তোল তোল, সময় যে হলো হলো’, ‘মুক্তির একই পথ সংগ্রাম’, ‘বাঁধ ভেঙ্গে দাও’, ‘জগৎবাসী বাংলাদেশকে যাও দেখিয়া’, ‘সোনায় মোড়ানো বাংলা মোদের’, ‘চল চল চল’, ‘জনতার সংগ্রাম চলবেই’, ‘পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে’, ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’, ‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে’, ‘মুক্তির মন্দির সোপান তলে’, ‘দুনিয়ার যত গরীবকে জাগিয়ে দাও’, ‘মুজিব বাইয়া যাও রে’, ‘বিচারপতি তোমার বিচার করবে যারা’ ইত্যাদি গান। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের বেশিরভাগ গানের সুর করেন সমর দাস, অজিত রায়, সুখেন্দু চক্রবর্তী, সুজেয় শ্যাম, সাধন সরকার, আনোয়ার পারভেজ প্রমুখ। সমর দাসের পরিচালনায় প্রকাশিত হয় লং প্লে ‘বাংলাদেশের হৃদয় হতে’।
উপমহাদেশের জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী ভূপেন হাজারিকার কণ্ঠে ‘জয় জয় নবজাত বাংলাদেশ জয় জয় মুক্তিবাহী’, শ্যামল মিত্রের ‘আমরা সবাই বাঙালি’, অংশুমান রায়ের ‘শোন একটি মুজিবরের থেকে’ এবং বাপ্পী লাহিড়ীর কন্ঠে ‘সাড়ে সাত কোটি মানুষের আর একটি নাম’ জনপ্রিয় এ গানগুলো স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত হয়েছে।
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রচারিত গানের সংখ্যা নির্দিষ্ট করে বলা দুরূহ। রেকর্ডপত্র, ব্যক্তিগত সাক্ষাৎকার ও তথ্য-উপাত্ত থেকে শতাধিক গানের তালিকা পাওয়া গেলেও এর সকল গানের গীতিকার, সুরকার ও কণ্ঠশিল্পীর নাম জানা যায় না। নিরাপত্তাজনিত কারণেও অনেকে নাম গোপন রেখেছেন। বিভিন্ন উৎস থেকে প্রাপ্ত স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের জন্য রচিত, সুরারোপিত ও পরিবেশিত গানের একটি সংক্ষিপ্ত তালিকা (ছকে) উল্লেখ করা হলো-
(ছকের জন্য মূল বই দেখুন)

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সংগীত শিল্পীদের অবিস্মরণীয় গান মুক্তিযুদ্ধকে বেগবান করেছে। সমগ্র বাঙালি জাতিকে যুগিয়েছে অসীম সাহস ও উদ্দীপনা। সীমিত সুযোগ-সুবিধার মধ্যে স্বাধীন বাংলা বেতারের শিল্পী, গীতিকার ও সুরকাররা অসাধ্য সাধন করেছেন। বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত উদ্দীপনামূলক গান যুদ্ধরত মুক্তিযোদ্ধাদের প্রেরণা যুগিয়েছে।

যুদ্ধকালীন জাগরণী গান
বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রত্যয় শুধুমাত্র একটি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ছিল না। পশ্চিম পাকিস্তানিদের চক্রান্ত ছিল ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখা এবং পূর্ব পাকিস্তানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর না করা। বাঙালিদের স্বাধীনতার পাশাপাশি ছিল মুক্তির তীব্র আকাঙ্ক্ষা। সে আকাঙ্ক্ষা ছিল ব্যক্তি, সংস্কৃতি- সাহিত্য, সংগীত-নৃত্য, নাটক, ক্রীড়া সর্বক্ষেত্রে পরিব্যাপ্ত। শত্রুর বিরুদ্ধে স্বাধীনতা সংগ্রামে বিজয়ে অস্ত্রের অনিবার্যতা ছিল, কিন্তু বাঙালির মনন ও চৈতন্যের বিকাশের জন্য আবশ্যক ছিল দ্বিজাতিতত্ত্বভিত্তিক পাকিস্তান আন্দোলনের সাম্প্রদায়িক ভাবনা-চিন্তার স্থলে বাঙালির শাশ্বত অসাম্প্রদায়িক সংস্কৃতির ধারা ও চৈতন্যে প্রত্যাবর্তন। ফলে মুক্তিযুদ্ধের সময় যে-সকল গান রচিত হতে দেখা যায়, কিংবা যে-সকল গান উদ্দীপনা সৃষ্টি করে, তাতে পক্ষান্তরে বাঙালি জাতিসত্ত্বার পরিচয়-গৌরব, ইতিহাস-ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য-ঐশ্বর্যের কথাই বারবার উঠে আসে। এ কারণে ৭ই মার্চ ১৯৭১ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যখন তাঁর ভাষণে স্বাধীনতা ও মুক্তির সংগ্রামের কথা বলেন, তখন তার মধ্যে বিদ্যমান ছিল রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক উভয়বিধ মুক্তির বার্তা। রাজনৈতিকভাবে স্বাধীনতা সংগ্রাম করলেই বাঙালির মুক্তি আসবে না, যদি না জাতিসত্ত্বার নিজস্বতা প্রকাশ পায়। এ কারণেই স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় যুদ্ধের সমান্তরালে সাংস্কৃতিক আন্দোলন প্রধান ভূমিকা রেখে এসেছে এবং সশস্ত্র সংগ্রামকে উদ্বুদ্ধ করেছে। ফলত, যে-সকল গানের নমুনা আমরা দেখতে পাই, তাতে যুদ্ধের শক্তি জোগানোর পাশাপাশি আত্মিক উন্নতি ও সত্যের প্রকাশ লক্ষণীয়। সৈনিক ও শিল্পী একই প্রেরণায় গেয়ে উঠেছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দেশত্মবোধক গান ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’, কিংবা সৈয়দ শামসুল হুদার কথা ও আজাদ রহমানের সুরে— ‘রক্তেই যদি ফোটে জীবনের ফুল, ফুটুক না’।
২৫শে মার্চ রাতেই অপারেশন সার্চলাইট নামে ইয়াহিয়ার সামরিক জান্তা নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়। বাঙালিদের প্রস্তুতি চলে মুক্তিযুদ্ধে যাবার। সাধারণ মানুষ জীবন ভয়ে সীমান্তের অপর পারে ছুটে যেতে থাকে। অসমশক্তির আগ্রাসনের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠে মুক্তিকামী মানুষের প্রতিরোধ। এ সময়ের গানেও জাগরণের আশার বাণী শোনা যায়। যেমন গাজী মাজহারুল আনোয়ারের লেখা এবং আনোয়ার পারভেজের সুরে ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’ গানটিতে আছে প্রতিরোধের কথা, একই সঙ্গে ভয়-সংশয়ে চরম বিপর্যস্ত মানুষকে শোনানো হয়েছে আশার বাণী-
বাংলার প্রতিঘর ভ’রে দিতে চাই মোরা অন্নে
আমাদের রক্ত টগবগ দুলছে মুক্তির দীপ্ত তারুণ্যে
নেই ভয়— হয় হউক রক্তের প্রচ্ছদপট
(তবু) করি না করি না করি না ভয়।

শিল্পী শহীদুল ইসলাম স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের জন্য উল্লেখযোগ্য সংখ্যক গান রচনা করেছেন। যুদ্ধ সময়ের পরিস্থিতির প্রতিবিম্ব চিত্রিত হতে দেখা যায় এ সকল গানে, যেমন ‘এ-ঘর দুর্গ ও-ঘর দুর্গ প্রাণে প্রাণে বহ্নি দুর্বার’ অথবা মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্বুদ্ধ করতে কলকাতার গীতিকার গোবিন্দ হালদারের লেখা এবং আপেল মাহমুদের সুরে ও কণ্ঠে কালজয়ী গান— ‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি’, পুনরায় আপেল মাহমুদের কথা ও সুরে ‘তীরহারা এই ঢেউয়ের সাগর পাড়ি দেব রে’।
মুক্তিযুদ্ধে, অগ্নিঝরা গান যুদ্ধরত গেরিলা যোদ্ধাদের এবং দেশের অভ্যন্তরে অবরুদ্ধ জনগণের মাঝে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা জাগ্রত করে রেখেছিল। সে গান ধমনীর রক্তে আগুনের স্ফুলিঙ্গ হয়ে দেহ-মনকে দেশমাতৃকার মুক্তির মন্ত্রে উজ্জীবিত করেছিল। গোবিন্দ হালদার রচিত এবং সমর দাসের সুরে অনুরূপ অবিস্মরণীয় গান— ‘পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে রক্ত লাল, রক্ত লাল, রক্ত লাল’। শহীদুল ইসলামের কথা ও সুজেয় শ্যামের সুরে – ‘মুক্তির একই পথ সংগ্রাম, অনাচার অবিচার শোষকের বিরুদ্ধে’। কার্তিক কর্মকারের লেখা গানে সাম্প্রদায়িকতার নির্মম গ্লানি ও বেদনার কথা ওঠে এসেছে। পরাধীনতা ও দুর্বিপাক থেকে বাঁচার জন্য তিনি লিখেছেন ‘ভাইরে ভাইরে ভাই, হিন্দু-মুসলমান/ পরাধীনতার শৃংখল আজি হয়ে যাক খান খান’।
আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো গ্রাম-বাংলার চারণকবিদের রচিত জাগরণী ও উদ্দীপনামূলক গান। প্রতিটি অঞ্চলের কবিয়াল, জারিয়াল, বাউল শিল্পীরা আপন দর্শন ও ভাবনায় রচনা করেন মুক্তির গান। তাঁদের গানের মধ্যে বিশেষ একটি দিক স্পষ্ট হয়, আর তা হচ্ছে ইতিহাসের পালাবদল, নীতি- নৈতিকতা, ধর্ম ও ধর্মনিরপেক্ষতা, তাৎক্ষণিক ঘটনার বিবরণ, বিশেষ ব্যক্তিত্ব প্রভৃতি বিষয়ের ওপর গুরুত্বারোপ। মুক্তিযুদ্ধকালে যাঁরা জাগরণী গান রচনা করেছেন, তাঁদের মধ্যে রয়েছেন— শাহ আব্দুল করিম, মোহাম্মদ শাহ বাঙালি (শফি বাঙালি), আব্দুল হালিম বয়াতি, সাইদুর রহমান বয়াতি, রাজ্জাক দেওয়ান (মাতাল রাজ্জাক), মোসলেম উদ্দিন প্রমুখ। এই লোকশিল্পীদের গায়নশৈলী ও দলীয় পরিবেশনা সারাবাংলার গ্রামীণ জীবনকে উদ্দীপ্ত করে রাখত। ফেনী অঞ্চলের শফি বাঙালি গ্রাম-গঞ্জ-সভাসমাবেশে গেয়ে বেড়িয়েছেন বেশ কিছু গান। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য— ‘আমরা ছাড়বো না ছাড়বো না, মুক্তিযুদ্ধের সংগ্রাম ছাড়বো না’।

মুক্তিযুদ্ধকালীন দেশাত্মবোধক গান
মুক্তিযুদ্ধের পূর্বে বাঙালিকে অসংখ্যবার মুক্তিসংগ্রাম করতে হয়েছে। তা বাঙালিকে অভিন্ন জাতিসত্ত্বায় একত্র, অধিকার আদায়ে ঐক্যবদ্ধ এবং চেতনায় স্বদেশী হতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। এর পেছনে যে সুদীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে, তার সূত্র পাওয়া যাবে বিভিন্ন সামাজিক-অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন-সংগ্রাম ও বিদ্রোহের মধ্যে। সেসব সংগ্রামের ক্ষেত্রে দেশাত্মবোধকে জাগিয়ে তুলতে সংগীত-সাহিত্য-কবিতা-নাটকের ভূমিকা ছিল অপরিসীম। অতীত অভিজ্ঞতার আলোকে মুক্তিযুদ্ধকালে অজস্র দেশাত্মবোধক গান রচনার পাশাপাশি পূর্বের যে-সকল গান বিভিন্ন সংগ্রাম-বিদ্রোহকে উজ্জিবীত করেছিল, তাও গীত হয়। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র, শরণার্থী শিবির, গেরিলা ও মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ সর্বক্ষেত্রে দেশাত্মবোধক গান স্বতঃস্ফূর্তভাবে পরিবেশিত হতে দেখা গিয়েছিল।
দেশাত্মবোধক গানের পূর্বকালে স্বদেশচেতনাকে জাগিয়ে তোলার জন্য অসংখ্য স্বদেশী গান রচিত হয়েছিল। স্বদেশী আন্দোলনের সে সমস্ত গানও মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকা রাখে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মুকুন্দ দাস, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, রজনীকান্ত সেন, অতুলপ্রসাদ সেন, কাজী নজরুল ইসলাম, অশ্বিনীকুমার দত্ত প্রমুখের গান মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে উদ্দীপনা যুগিয়েছে। যেমন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’, ‘আজি বাংলাদেশের হৃদয় হ’তে কখন আপনি’, ‘সার্থক জনম আমার জন্মেছি এই দেশে’; কাজী নজরুল ইসলামের ‘এ কী অপরূপ রূপে মা তোমায় হেরিনু পল্লী-জননী’, ‘শিকল পরা ছল মোদের এই শিকল পরা ছল’, ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’; মুকুন্দ দাসের ‘বান এসেছে মরা গাঙে খুলতে হবে নাও’, ‘ভয় কি মরণে রাখিতে সন্তানে’; দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ‘ধন ধান্য পুষ্পভরা আমাদের এই বসুন্ধরা’, ‘বঙ্গ আমার! জননী আমার! ধাত্রী আমার! আমার দেশ!’; রজনীকান্ত সেনের ‘মায়ের দেওয়া মোটা কাপড় মাথায় তুলে নেরে ভাই’; অতুল প্রসাদ সেনের ‘মোদের গরব মোদের আশা, আ মরি বাংলা ভাষা’; গুরুসদয় দত্তের ‘মানুষ হ’ মানুষ হ’ আবার তোরা মানুষ হ’, ইত্যাদি|
উনিশ ও বিশ শতকের সূচনাকালে দেশপ্রেম ও জাতীয় চেতনাভিত্তিক পূর্বোক্ত গানের সঙ্গে ভারত বিভক্তির পরবর্তী কালের অসংখ্য দেশাত্মবোধক গানের প্রচার লক্ষ করা যায়। এসকল গান পূর্ব-পাকিস্তানে অধিকার আদায়ের বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে এবং রেডিওতে প্রচারের উদ্দেশ্যে লিখিত হয়েছে। সে-সকল গানের মধ্যে মোহাম্মদ মনিরুজ্জামানের রচনা ও আব্দুল আহাদের সুরে ‘আমার দেশের মাটির গন্ধে ভরে আছে সারা মন’, খান আতাউর রহমানের কথা ও সুরে ‘হায়রে আমার মন মাতানো দেশ’, আবদুল লতিফের লেখা ও সুরারোপিত ‘সোনা সোনা সোনা লোকে বলে সোনা, সোনা নয় তত খাঁটি’, নয়ীম গওহরের লেখা ও আজাদ রহমানের সুরে দেশের গান ‘জন্ম আমার ধন্য হলো মাগো, এমন করে আকুল হয়ে আমায় তুমি ডাকো’ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
স্বাধীনতাসংগ্রাম কালে অসংখ্য দেশের গান রচিত হয়েছে। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু গান হলো- আলী মোহসীন রেজার লেখা এবং রথীন্দ্রনাথ রায় সুরারোপিত ‘চাষাদের মুটেদের মজুরের, গরীবের নিঃস্বের ফকিরের’, শহীদুল ইসলামের লেখা ‘বাংলা আমার জন্মভূমি বাংলা আমার, বাংলায় আমি’, কলকাতার গীতিকার গোবিন্দ হালদারের লেখা ‘পদ্মা-মেঘনা- যমুনা তোমার আমার ঠিকানা’, শ্যামল গুপ্তের লেখা ও অপরেশ লাহিড়ীর সুরে ‘হাজার বছর পরে আবার এসেছি ফিরে, বাংলার বুকে আছি দাঁড়িয়ে’ ইত্যাদি। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়কালে যে-সকল গীতিকার, সুরকার এবং শিল্পী বিভিন্ন পর্যায়ে অবদান রেখেছিলেন, তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন- আবদুল লতিফ, আলতাফ মাহমুদ, শেখ লুৎফর রহমান, সমর দাস, অজিত রায়, সুজেয় শ্যাম, শহীদুল ইসলাম, মোহাম্মদ আব্দুল জব্বার, আপেল মাহমুদ, রথীন্দ্রনাথ রায় প্রমুখ।
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নির্ণয়ে এ-সকল গান স্মারক হিসেবে আজো সুপরিচিত। মুক্তিযুদ্ধ ও এক সাগর রক্তের বিনিময়ে দেশ স্বাধীন হয়েছে, কিন্তু স্বাধীনতার পরাজিত শক্তি এখনো বিষবাষ্প ছড়িয়ে বাংলার সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক অঙ্গনকে বারবার ক্ষতবিক্ষত করতে চেয়েছে। এ-সকল অপচেষ্টা ও চক্রান্তের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে এ গান আজো যুগপৎ ভূমিকা রাখছে।

বঙ্গবন্ধুকে নিবেদিত গান
মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান- তাঁর ৭ই মার্চের ভাষণের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার স্বপ্ন বুনে দিয়েছিলেন প্রতিটি বাঙালির অন্তরে। তিনি ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণা ও নেতৃত্বমূলে। তাঁর নামেই শপথ নিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা রণাঙ্গনে যুদ্ধ করে। বাঙালির জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের এ দিশারির নামে মুক্তিযুদ্ধকালে একাধিক গান রচিত ও পরিবেশিত হয়। সেসব গানের বাণীতে তিনি উঠে এসেছেন বাংলাদেশের রূপকার হিসেবে, কোথাও ভাঙ্গা নৌকার দক্ষ নাবিক বা কাণ্ডারী হিসেবে, কোথাও সাড়ে সাত কোটি মানুষের একক সত্ত্বারূপে। গৌরী প্রসন্ন মজুমদারের কথা ও অংশুমান রায়ের সুর ও কণ্ঠে বিখ্যাত সেই গান শোনো একটি মুজিবরের থেকে, লক্ষ মুজিবরের কণ্ঠস্বরের ধ্বনি প্রতিধ্বনি/ আকাশে বাতাসে ওঠে রণি’। মুক্তিযুদ্ধে বাঙালির কণ্ঠে আবার ধ্বনিত হয়েছে ‘তোমার নেতা আমার
নেতা শেখ মুজিব শেখ মুজিব’। মুক্তিযুদ্ধ মানেই মুজিব, মুজিব মানেই স্বাধীনতা, মুজিব মানেই বাংলাদেশ। গৌরী প্রসন্ন মজুমদারের কথা ও সমর দাসের সুরে রচিত হয় ‘বাংলার হিন্দু, বাংলার বৌদ্ধ, বাংলার খ্রিষ্টান’ এ গান। এতে ধর্মনির্বিশেষে বাঙালির সম্প্রীতির ঐতিহ্য পরিব্যক্ত। বাংলার মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসের মহানায়কের প্রতিভূরূপে যেভাবে গানে মুজিবকে চিহ্নিত করা হয়-
এই বাংলার কথা বলতে গিয়ে বিশ্বটাকে কাঁপিয়ে দিল
কার সে কণ্ঠস্বর, মুজিবর সে যে মুজিবর
জয় বাংলা বলেরে ভাই।

মুক্তিযুদ্ধের প্রধান স্লোগান ছিল ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’। ‘মুজিবর’ ও ‘জয় বাংলা’ শব্দদুটি সে-সময় জাগরণের প্রতীক হয়ে দেখা দিয়েছিল। সামগ্রিক মূল্যবোধের প্রতিভূরূপে প্রতীয়মান হয়েছিলেন তিনি। তাই শ্যামল গুপ্তের লেখা গান ‘সাড়ে সাত কোটি মানুষের আর একটি নাম মুজিবর’; তোরাপ আলী শাহের ‘মুজিবর সত্য যুগের’; শহীদুল ইসলামের লেখা ‘মুজিব এই বাংলার উন্নত শিরে’; সরদার আলাউদ্দীনের কথা ও প্রচলিত সুরে জনপ্রিয় গান ‘মুজিব বাইয়া যাওরে’ (‘মাঝি বাইয়া যাওরে’ গানটির কথা পরিবর্তন করে মুক্তিযুদ্ধের সময় গাওয়া হয়েছে); হাফিজুর রহমানের কথা ও সুরে ‘আমার নেতা শেখ মুজিব’; আবদুল গণি বোখারীর “দিনের শোভা সুরুজ রে, রাইতের শোভা চান, ওরে বাংলার শোভা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’ (তেভাগা আন্দোলনের শিল্পী দোতারাবাদক টগর অধিকারীর ‘দিনের শোভা সুরুয রে, রাইতের (আইতের) শোভা চাঁদ’- গানটির প্রথম কলি সহযোগে রচিত); মো. সিরাজুল ইসলামের ‘হারে ও আমার বাংলার শেখ মুজিব’; মোকসেদ আলী সাঁইয়ের ‘বাংলাদেশের খাঁটি মানুষ শেখ মুজিবুর জেনো ভাই’ ইত্যাদি গানগুলো স্বাধীন বাংলা বেতারে অসংখ্যবার প্রচারিত হয়েছে। গ্রামবাংলার চারণকবি ও গীতিকারগণ মুক্তিযুদ্ধ ও মুজিবকে কেন্দ্র করে প্রায় প্রতিটি অঞ্চলে গান রচনা করেছেন। আবদুল হালিম বয়াতির গান ছিল ‘বঙ্গবন্ধুর মহান বাণী ভুলবো না, রমনা মাঠে অকপটে করেছিলে কল্পনা’।

শরণার্থীদের উদ্বুদ্ধকরণে গান
৭১-এর ২৫শে মার্চ অপারেশন সার্চলাইট নামে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা বাঙালিদের ওপর নির্বিচার গণহত্যা শুরু করে, যা মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস ধরে চলে। হত্যার পাশাপাশি তারা নারীর ওপর পাশবিক নির্যাতন চালানো, মানুষের ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে তা ভস্মীভূত করা ইত্যাদির মাধ্যমে এক ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। বঙ্গবন্ধুকে বন্দি করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়। সারা বাংলায় আতংক ছড়িয়ে পড়ে। ভীত-সন্ত্রস্ত্র মানুষ উপায়ান্তর না পেয়ে ঘর-বাড়ি সংসার-পরিজন, গোলা-মাঠ-ফসল সবকিছু ফেলে প্রাণ বাঁচাতে সীমান্তের দিকে ছুটতে থাকে। এমতাবস্থায় ভারত সরকার সীমান্ত উন্মুক্ত করে দেয়। সীমান্ত দিয়ে লক্ষলক্ষ মানুষ ভারতে প্রবেশ করে। এভাবে মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাসে ১ কোটি জীবনবিপন্ন মানুষ শরণার্থী হয়ে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, মেঘালয়, আসাম এবং বিহার রাজ্যে আশ্রয় গ্রহণ করে। তাদের জন্য খোলা হয় শরণার্থী শিবির|
শরণার্থী শিবিরে মানুষের অনাহার, অর্ধাহার, রোগ, জীর্ণতা ও মৃত্যু নিয়ে এক কঠিন ও মর্মস্পর্শী জীবন বিরাজ করছিল। এসব মানুষকে কিছুটা সান্ত্বনা দেয়ার জন্য নানান ধরনের স্কোয়াড গঠিত হয়েছিল। মুজিবনগর সরকার-এর প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ- স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পীদের বিভিন্ন স্থানে কাজ করার নির্দেশ দেন। মুক্তিযোদ্ধা শিল্পী সংস্থা, শরণার্থী শিল্পীগোষ্ঠী, বঙ্গবন্ধু শিল্পীগোষ্ঠী, বাংলাদেশ তরুণ শিল্পী গোষ্ঠী, বাংলাদেশ মুক্তিসংগ্রামী শিল্পী সংস্থা নামে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক স্কোয়াড শরণার্থী শিবিরে অনুষ্ঠান করে। সেই সঙ্গে বাংলাদেশের পক্ষে জনমত সৃষ্টি এবং শরণার্থীদের জন্য অর্থ, ওষুধপত্র, কাপড়-চোপড় সংগ্রহ করতে বিভিন্ন স্থানে তারা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। বিক্ষুব্ধ বাংলা, “রূপান্তরের গান, এক পথিকের আত্মকথা প্রভৃতি গীতিআলেখ্য এবং দেশাত্মবোধক গান, গণসংগীত এসব অনুষ্ঠানে পরিবেশিত হয়। প্রত্যেক শিল্পী, কলাকুশলী, নাট্যকার ও গীতিকারের মনে একটাই স্বপ্ন, বাংলাদেশের মুক্তি বা স্বাধীনতা।
আলোচ্য অনুষ্ঠানসমূহে বাউল কবিদের ভূমিকা ছিল খুবই প্রশংসনীয়। একটি একতারা বা দোতারা বাজিয়ে তারা মৃত্যুপথযাত্রী বা সংক্ষুব্ধ প্রাণে কিছুটা প্রশান্তি ও সাহস যুগিয়েছেন। মার্কিন কবি এ্যালেন গিন্সবার্গের সেপ্টেম্বর অন যেশোর রোড- কবিতায় শরণার্থীদের নির্মম জীবনের বর্ণনা মেলে—
Millions of babies watching the skies
Bellies swollen, with big round eyes
On Jessore Road-Long bamboo huts
No place to shit but sand channel ruts
কবিতাটিতে যুদ্ধের অমানবিক বাস্তবতা, লাখো-লাখো শিশুর আকাশ পানে অনিশ্চিত চেয়ে থাকা, লাখো-লাখো বাবা-মা- ভাই-বোনের সকরুণ চিত্র এতে ফুটে উঠেছে।
শরণার্থী শিবিরে যুদ্ধের ৯ মাস দেশাত্মবোধক, স্বদেশী, পঞ্চগীতিকবির গান ও বাংলা লোকসংগীত শরণার্থীদের উদ্ধুদ্ধকরণে নিয়মিত পরিবেশন করা হতো। মুক্তিযুদ্ধকালে মুক্তাঞ্চলে পরিবেশিত তারেক মাসুদ ও ক্যাথরিন মাসুদের ‘মুক্তির গান’ও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বহির্দেশীয় সমর্থনমূলক গান
২৫শে মার্চের কালরাত থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বর্বর পাকিস্তানি বাহিনীর নৃশংসতা বহির্বিশ্বের সচেতন মানুষের মনে গভীর রেখাপাত করে। অনেকে প্রতিবাদমুখর হয়ে ওঠেন। প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে প্রথম দিকেই বিভিন্ন নামে সহায়ক সমিতি গড়ে ওঠে, যেমন-
কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ সহায়ক সমিতি (পশ্চিমবঙ্গ), বাংলাদেশ মুক্তি সংগ্রাম সহায়ক সমিতি (পুনা), বাংলাদেশ এইড কমিটি (বোম্বে), ন্যাশনাল কো-অর্ডিনেশন কমিটি ফর বাংলাদেশ, বোম্বে ইউনিভার্সিটি কমিটি, বাংলাদেশ সংগ্রাম সহায়ক সমিতি (লেক গার্ডেন, কলকাতা), বাংলাদেশ ফ্যাকটস ফাইন্ডিং কমিটি ইত্যাদি। এছাড়া বিশ্বের অন্যান্য দেশেও বাংলাদেশকে নানাভাবে সহায়তা করার জন্য বিভিন্ন কমিটি ও সংগঠন গঠিত হতে দেখা যায়, যেমন— শিকাগোতে Friends of the Movement, লন্ডনে Friends of the Dhaka University Bangladesh Students Action Council, Bangladesh Green Cross, শ্রীলংকায় Out to the People ইত্যাদি।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের খ্যাতনামা কবি, শিল্পী, গায়ক, বিজ্ঞানী ও সংস্কৃতিসেবীগণ অবস্থান নিয়েছিলেন। বাংলাদেশের মানুষের বীরত্ব ও আত্মত্যাগ তাঁদের উদ্বেলিত করে। তাঁরা সেই দিনগুলোতে ইউরোপ-আমেরিকার রাস্তায় মিছিল করেছেন, সভা-সমাবেশে বক্তৃতা করেছেন, আবৃত্তিতে অংশ নিয়েছেন। নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কোয়ার, লন্ডনের রয়্যাল এ্যালবার্ট হল, বার্লিনের আলেকজান্ডার প্লাসা, দিল্লীর সংগীতনাটক একাডেমি ও কলকাতার রবীন্দ্রসদনে বাংলাদেশের পক্ষে অনুষ্ঠিত হয় একাধিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। সেসব অনুষ্ঠান আয়োজন ও তাতে যাঁরা সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন, তাঁদের মধ্যে ছিলেন পণ্ডিত রবিশংকর, বিটল জর্জ হ্যারিসন, মার্কিন লোক- প্রতিবাদী গানের অবিসংবাদিত রাজা বব ডিলান, যুদ্ধবিরোধী আন্দোলনের সুপরিচিত কণ্ঠশিল্পী জোয়ান ব্যেজ, বিটলসদের আরেকজন রিঙ্গো স্টার প্রমুখ শিল্পী। প্রতিবেশী ভারতের সত্যজিৎ রায়, লতা মুঙ্গেশকর, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, দেবব্ৰত বিশ্বাস, ঋত্বিক ঘটক, সুচিত্রা মিত্র, ভূপেন হাজারিকা, সলিল চৌধুরী, কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, বিষ্ণু দে, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, মুলকরাজ আনন্দ-সহ অনেকে জয়বাংলার সংগ্রামের সঙ্গে একাত্ম হয়েছিলেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে আর্জেটিনার রাজধানী বুয়েন্স আয়ার্সে এক মিছিলের অগ্রভাগে ছিলেন সে দেশের খ্যাতনামা লেখক এবং রবীন্দ্র অনুরাগী ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো। বাংলাদেশের জন্য সশস্ত্র যুদ্ধে যোগদান ও রক্তদানের অঙ্গীকার ঘোষণা করেছিলেন বিশ্বসাহিত্যের এক দিকপাল ফ্রান্সের আঁদ্রে মালরো। একাত্তরের ২০শে নভেম্বর সন্ধ্যা ৭ টায় নিউইয়র্কের সেন্ট জর্জ চার্চে বাংলাদেশের পক্ষে জনমত সৃষ্টির লক্ষ্যে সমসাময়িক বিশ্বের প্রধান দুই কবি আমেরিকার এ্যালেন গিন্সবার্গ এবং রুশ দেশের আদ্রেই ভজনেসত্রনস্কি কবিতা পাঠ করেছিলেন।
যুক্তরাজ্যের ওভালে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অনুষ্ঠিত হয় একটি চ্যারিটি কনসার্ট। এতে যুক্তরাজ্যের নামকরা রক-এন-রোল অল্টারনেটিভ, হার্ডরক ও ব্লুজ ব্যান্ড অংশগ্রহণ করে। যুক্তরাজ্যের কেনিংটন শহরের ক্রিকেট মাঠে প্রায় ৪০ হাজার দর্শকের উপস্থিতিতে এক কনসার্টে বেশ কয়েকটি স্থানীয় নামকরা ব্যান্ড অংশ নেয়। অনুষ্ঠানে জনপ্রিয় পপ গায়ক রড স্টুয়ার্ট বাঙালি জাতির প্রতি সম্মান দেখিয়ে বাঘের ডোরা কাটা স্যুট পরে দর্শকের সামনে গান পরিবেশন করেন। সারাবিশ্বে এভাবে নানা ধরনের সাহায্য- সহযোগিতা, প্রতিবাদ ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন হতে দেখা গেছে।
বহির্বিশ্বের সমর্থনমূলক যে কনসার্টটি বিশ্বনন্দিত হয়েছে, তা হলো ১লা আগস্ট আমেরিকার নিউইয়র্ক শহরের ম্যাডিসন স্কোয়ার গার্ডেনে অনুষ্ঠিত The Concert for Bangladesh। ভারতের বিখ্যাত সেতার বাদক পণ্ডিত রবিশংকর বিটলস্- এর পরিবেশনায় এ আয়োজন করেন। সেখানে বিশ্ববিখ্যাত শিল্পী জর্জ হ্যারিসন, এরিক ক্লাপটন, বব ডিলান প্রমুখ গান গেয়ে ও যন্ত্র বাজিয়ে বাংলাদেশের জন্য সাহায্য ও সমর্থন আদায় করেন। এ কনসার্টে জর্জ হ্যারিসন ‘বাংলাদেশ’ নামক তাঁর রচিত একটি অসাধারণ গান মঞ্চে গেয়ে শোনান। গানটি হলো-
My friend came to me, with sadness in his eyes
He told me that he wanted help
Before his country dies
কনসার্টে পণ্ডিত রবিশংকর সেতার এবং ওস্তাদ আলী আকবর খান সরোদে বাংলা ধুন পরিবেশন করেন। তবলায় আল্লারাখা এবং তানপুরায় কমলা চক্রবর্তী ছিলেন। এ অনুষ্ঠানে প্রায় ৪০ হাজার দর্শক-শ্রোতার সমাগম ঘটে। এ কনসার্ট থেকে আয় হয়েছিল ২,৪৩,৪১,৮৫০ ডলার। ইউনিসেফের বাংলাদেশের শিশু সাহায্য তহবিলে তা দান করা হয়। যুদ্ধবিরোধী আন্দোলনের নেত্রী কণ্ঠশিল্পী জোয়ান ব্যেজ পূর্ব নির্ধারিত অনুষ্ঠানের কারণে এতে অংশ না নিতে পারলেও লিখেছিলেন হৃদয় নিংড়ানো সংগীত আলেখ্য- ‘বাংলাদেশ… সূর্য অস্ত যায় পশ্চিম আকাশে, বাংলাদেশে লক্ষ মানুষের চিতা জ্বলে, আমরা অকর্মণ্য, সরে দাঁড়াই।’ গানটির সুরকারও ছিলেন তিনি নিজেই।

স্বাধীনতা-উত্তর মুক্তিযুদ্ধের গান
বাংলার তরুণরা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন একটি প্রত্যাশা, একটি সংকল্প নিয়ে স্বাধীনতার পতাকা নিয়ে তারা ঘরে ফেরবেন। কিন্তু সকলের ঘরে ফেরা হয়নি। কেউ-কেউ প্রবল সাহসিকতার সঙ্গে যুদ্ধ করতে-করতে রণাঙ্গনে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন। কেউ হাত, পা, চোখ হারিয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন। কেউ বীরদর্পে গৃহে ফিরে এলেও খুঁজে পাননি তাঁর মাতা-পিতা, স্ত্রী-সন্তান, ভাই- বোনকে। এ চিত্র অত্যন্ত করুণ ও মর্মবিদারক। স্বেচ্ছায় আত্মাহুতির সাহস নিয়ে বিজয়ের এমন ইতিহাস পৃথিবীতে বিরল। ফলে যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে যে-সকল গান মুক্তিযোদ্ধাদের প্রেরণা যোগানোর উদ্দেশ্যে রচিত হয়েছিল, যুদ্ধ-পরবর্তীকালে সেই গানগুলো হয় জাতির এক গৌরবময় সম্ভার। তবে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গণহত্যা, লুটপাট ও আগুন দেয়ার মতো অসংখ্য করুণ আর্তনাদের কাহিনী চাপা পড়ে যায়। মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী গানে গৌরবগাথার পাশাপাশি সকরুণ কাহিনীর বর্ণনাও উঠে আসে। যেমন খান আতাউর রহমান তাঁর গানে অতি মর্মস্পর্শী বর্ণনা তুলে ধরেন – ‘হয়তো বা ইতিহাসে তোমাদের নাম লেখা রবে না /বড় বড় লোকেদের ভিড়ে, জ্ঞানী আর গুণীদের আসরে তোমাদের কথা কেউ কবে না/তবু এই বিজয়ী বীর মুক্তিসেনা তোমাদের এই ঋণ কোনোদিন শোধ হবে না’। বাংলার আকাশে যাঁরা স্বাধীনতার সূর্য ছিনিয়ে এনেছিলেন তাঁদের যেন বাঙালি জাতি কোনোদিন ভুলতে না পারে, তারই অম্লান বাণী এ গানে বিধৃত হয়েছে। গোবিন্দ হালদারের কথা আর আপেল মাহমুদের সুরে আরো একটি গানে সেই শহীদদের ভুলে না যাবার প্রত্যয় ঘোষণা করা হয়েছে— ‘এক সাগর রক্তের বিনিময়ে বাংলার স্বাধীনতা আনল যারা, আমরা তোমাদের ভুলবো না’। বাংলা গানের বাগানকে ঢেকে দিয়েছে বীরত্বময় শোকের চাদর। নজরুল ইসলাম বাবু রচনা করেছেন – ‘সবকটা জানালা খুলে দাও না, আমি গাইব বিজয়েরই গান, ওরা আসবে চুপি চুপি, যারা এই দেশটাকে ভালোবেসে দিয়ে গেছে প্রাণ’। নাসিমা খান মুক্তিসেনাদের উদ্দেশে লিখেছেন- ‘যে মাটির বুকে ঘুমিয়ে আছে লক্ষ মুক্তিসেনা, তোরা দে না, দে না সে মাটি আমার অঙ্গে মাখিয়ে দে না’। শহীদুল ইসলাম লিখেছেন— ‘ওরা মরে না, বাংলার ঘরে ঘরে ওরা ফুটে আছে ঝরে পড়ে না। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের বুকের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে স্বাধীনতা। তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধাবনত দেশ ও জাতি। মৃত্যুহীন শহীদদের প্রতি সালাম জানিয়ে ফজল-এ-খোদা’র কথা এবং আবদুল জব্বারের সুরে বিখ্যাত গান- ‘সালাম সালাম হাজার সালাম সকল শহীদ স্মরণে, আমার হৃদয় রেখে যেতে চাই তাদের স্মৃতির চরণে’।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ হঠাৎ করে হয়নি। এর পেছনে ছিল শতশত বছরের প্রস্তুতি। পলাশির যুদ্ধে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ের মধ্য দিয়ে পরাধীনতার যে শৃঙ্খলে জাতি আবদ্ধ হয়েছিল, তা থেকে মুক্তি পেতে যে দীর্ঘ সংগ্রামের পথ জাতিকে পাড়ি দিতে হয়েছে, সে কথা প্রতিধ্বনিত হয়েছে আবদুল লতিফের একটি জনপ্রিয় গানে- ‘দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা, কারো দানে পাওয়া নয়, দাম দিছি প্রাণ লক্ষ কোটি আছে জানা জগত্ময়’। মুক্তিযুদ্ধে পাকবাহিনী পরাজিত হলো মুক্তিযোদ্ধাদের অসীম সাহস ও দেশপ্রেমের কাছে। আখতার হুসেনের কথা এবং অজিত রায়ের সুরে রচিত হলো— ‘স্বাধীন স্বাধীন দিকে দিকে, আজ জাগবে বাঙালিরা, আজ রুখবে তাদের কারা’। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে বিজয়ের শেষ গান প্রচারিত হলো শহীদুল ইসলামের কথা ও সুজেয় শ্যামের সুরে ‘বিজয় নিশান উড়ছে ঐ খুশির হাওয়ায় ঐ উড়ছে, বাংলার ঘরে ঘরে মুক্তির আলো ঐ ঝরছে’। গ্রামীণ চারণকবিদের মাঝেও বিজয়ের উদ্দীপনা জেগেছিল সমানভাবে। গ্রাম-বাংলায় সে-সময় অজস্র বিজয়ের গান ও কবিতা রচিত হয়েছে। মোসলেম উদ্দিন বয়াতির একটি গান— ‘গাওরে পাপিয়া, পিউ পিউ করিয়া, জয় মোদের জয় বাংলার জয়’।
মুক্তিযুদ্ধের গানের বৈশিষ্ট্যকে বাংলা গানের আর কোনো আঙ্গিকের প্রভাবজাত বলে নির্ণয় করা যায় না। এ গানকে যদিও স্বদেশী সংগীতের উত্তরাধিকার হিসেবে চিহ্নিত করা যায়, তা সত্ত্বেও ভাষা, সুর, প্রচারণা, শিল্পীর আবেগ ইত্যাদি মিলে একে প্রতিরোধের তীব্র প্রকাশ হিসেবেই দেখা হয়। এ কারণে মুক্তিযুদ্ধের গান যুদ্ধ শেষে থেমে থাকেনি। মুক্তিযুদ্ধের চার যুগ অতিবাহিত হলেও সময়ের প্রয়োজনে রচিত এ গানগুলো আজো সমান মর্মোপলদ্ধি সৃষ্টি করে। এ গানগুলো মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিকে, বীরত্বের শৌর্যগাথা ও শোককে স্মরণ করিয়ে ইতিহাসের স্বরূপকে উন্মোচিত করে এবং অসাম্প্রদায়িক জাতিসত্ত্বাবোধকে উর্ধ্বে তুলে ধরতে অনুপ্রেরণা যোগায়।
শরণার্থী শিবির, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র, গেরিলাদের গোপন আস্তানা, লোককবির আসর, কিংবা বিজয়ের মিছিল যেখানেই পরিবেশিত বা সমম্প্রচারিত হোক না কেন, মুক্তিযুদ্ধের গান শ্বাশত রূপ লাভ করেছে। বাঙালির যে-কোনো মুক্তির আন্দোলনের অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের গান অনবদ্য ভূমিকা রাখবে। [শাহনাজ নাসরীন ইলা]
তথ্যসূত্র: অধ্যাপক ড. শাহনাজ নাসরীন ইলা, ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের গান, পিএইচডি অভিসন্দর্ভ; ড. জাহিদ হোসেন (প্রধান সম্পাদক), স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ইতিহাস, ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশ, ২০১০; সাইম রানা, বাংলাদেশের গণসংগীত, বাংলা একাডেমী, ঢাকা ২০০৯

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৮ম খণ্ড