You dont have javascript enabled! Please enable it! মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গন (সেক্টর) - সংগ্রামের নোটবুক

মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গন (সেক্টর)

বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ বাঙালি জাতির জীবনে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ও গৌরবময় ঘটনা; আর এর পেছনে রয়েছে বাঙালির সুদীর্ঘকালের বৈষম্য, বঞ্চনা, আন্দোলন, সংগ্রাম ও ত্যাগের ইতিহাস। তবে, ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর বাঙালির মুক্তিসংগ্রাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর নেতৃত্বে রাষ্ট্র বনাম পূর্ব বাংলার জনগণ এরূপ আকার ধারণ করে। এ-সবের চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ ঘটে ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে। ২৫শে মার্চ পাকিস্তানি বাহিনী অপারেশন সার্চলাইট-এর নামে ঢাকার পিলখানা ইপিআর সদর দপ্তর, রাজারবাগ পুলিশ লাইন্স, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা, পুরাতন ঢাকার হিন্দু অধ্যুষিত এলাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ব্যাপক গণহত্যা ও নির্যাতন শুরু করলে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও ইপিআর-এর বাঙালি সৈন্যরা তাঁদের স্ব-স্ব স্থান থেকে পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। তাঁদের সঙ্গে যোগ দেয় পুলিশ, আনসার, মুজাহিদ ইত্যাদি পেশাদার বাহিনী। রাজনীতিবিদদের নেতৃত্বাধীনে পরিচালিত এ-যুদ্ধে নারী, পুরুষ, ছাত্র, জনতা, কৃষক, শ্রমিকসহ সর্বস্তরের মানুষ শামিল হলে তা জনযুদ্ধ-এ রূপ নেয়। তারা সবাই মিলে গড়ে তোলে মুক্তিবাহিনী, শুরু হয় শত্রুসেনাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ যুদ্ধ।
১৯৭০ সালে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে ৬ দফার ভিত্তিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ- জাতীয় পরিষদের মোট ৩১৩টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসনে জয়ী হয়ে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে আবির্ভূত হয়। নির্বাচনের রায় মেনে পাকিস্তানের সামরিক নেতৃত্ব পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টোর যোগসাজশে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে ষড়যন্ত্রের আশ্রয় নেয়। ৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয়ই বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট তৈরি করে। ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে ১৯৭১ সালের ১লা মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ৩রা মার্চ ঢাকায় অনুষ্ঠেয় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করে। এর বিরুদ্ধে সর্বস্তরের বাঙালি ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে; সারা দেশে বিস্ফোরণোম্মুখ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়; ঢাকা পরিণত হয় মিছিল, স্লোগান ও বিক্ষোভের নগরীতে বঙ্গবন্ধুর ডাকে শুরু হয় সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলন-। বাঙালিদের কাছে পাকিস্তানি সেনা শাসকদের অভিপ্রায় স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ২রা মার্চ ঢাকায় এবং ৩রা মার্চ সারা দেশে পূর্ণ হরতাল পালিত হয়। বঙ্গবন্ধু ৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দান (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান)-এর জনসভায় পাকিস্তানের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত লড়াই করার প্রস্তুতি গ্রহণের আহ্বান জানান। এমতাবস্থায়, আন্দোলনের তীব্রতা বৃদ্ধি পেতে থাকলে ৬ই মার্চ ইয়াহিয়া খান পুনরায় ঘোষণা করে যে, ২৫শে মার্চ ঢাকায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বসবে। তবে পরবর্তী দুই সপ্তাহের ঘটনা প্রবাহ প্রমাণ করে যে, ইয়াহিয়ার এ ঘোষণা ছিল একটি রাজনৈতিক কৌশল মাত্র; মূলত এ-সময় সে পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক প্রস্তুতি সম্পন্ন করতে থাকে।
৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণের ঘোষণা ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ মূলত বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতার বাণী পৌঁছে দেয়। আর এতে পাকিস্তানি সামরিক সরকারের নিকট বঙ্গবন্ধুর মনোভাবও স্পষ্ট হয়ে যায়। ৭ই মার্চের বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধুর আহ্বান ছিল ‘ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল’। এ আহ্বান সেনাবাহিনীর বাঙালি সৈনিক, ইপিআর, পুলিশ ও অন্যান্য আধাসামরিক বাহিনীসহ সকল শ্রেণির জনগণকে তীব্র জাতীয়তাবোধ দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করে। তাঁরা সকলেই বুঝতে পারেন যে, পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনৈতিক ও সামরিক নেতৃত্ব যদি কোনো রাজনৈতিক সমাধানে না পৌঁছায় তাহলে সম্ভাব্য সশস্ত্র প্রতিরোধযুদ্ধ অপরিহার্য হয়ে পড়বে। এ-সময় বিভিন্ন সেনানিবাসে বাঙালি সৈনিক ও অফিসারদের মধ্যে চরম উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বিরাজ করতে থাকে। পাকিস্তানের সামরিক জান্তা বাঙালিদের ওপর সামরিক অভিযানের প্রস্তুতির অংশ হিসেবে একদিকে পূর্ব পাকিস্তানে অতিরিক্ত সৈন্য মোতায়েন করতে থাকে, অন্যদিকে বাঙালিদের ওপর পাকিস্তানি সামরিক অভিযান কালে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি সৈনিকরা যাতে সংঘবদ্ধ হয়ে পরিকল্পিত প্রতিরোধ শুরু করতে না পারে এজন্য নানা অজুহাতে এ রেজিমেন্টের ব্যাটালিয়নগুলোকে সেনাবাহিনীর বাইরে পাঠিয়ে দিতে থাকে। উল্লেখ্য যে, মুক্তিযুদ্ধ শুরুর প্রাক্কালে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ৮টি ব্যাটালিয়নের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থান ছিল ৫টির। ১ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট যশোর সেনানিবাসে, ২য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ঢাকার জয়দেবপুরে, ৩য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট সৈয়দপুর সেনানিবাসে, ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট কুমিল্লা সেনানিবাসে এবং ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট চট্টগ্রাম শহরের উপকণ্ঠে হালিশহর এলাকায় অবস্থান করছিল।
যশোর সেনানিবাসে অবস্থানরত ১ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিকাংশ সেনাকে শীতকালীন মহড়ার জন্য সীমান্তবর্তী চৌগাছা এলাকায় পোস্ট করা হয়। এ ইউনিট ২৫শে মার্চ ঢাকার গণহত্যার কোনো খবরই প্রথমে জানতে পারেনি। ২৯শে মার্চ এ ইউনিটটি যশোর সেনানিবাসে পৌছানোর সঙ্গে-সঙ্গে ইউনিটের অস্ত্রাগারের চাবি পাকিস্তানি অফিসাররা জব্দ করলে বাঙালি সেনারা বিদ্রোহ করেন। এরপর তাঁরা সেনানিবাস ত্যাগ করে পুনরায় চৌগাছা পৌঁছে ক্যাপ্টেন হাফিজ উদ্দিন আহমেদ, বীর বিক্রম-এর নেতৃত্বে প্রতিরোধযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।
২য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অবস্থান ছিল জয়দেবপুর সেনানিবাসে। তবে ২৭শে ফেব্রুয়ারি অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্বের কথা বলে এ ব্যাটালিয়নের আলফা কোম্পানিকে টাঙ্গাইলে এবং চার্লি কোম্পানিকে ময়মনসিংহে ডেপ্লয় করা হয়। এ ইউনিটের বাঙালি অফিসার ছিলেন মেজর কে এম সফিউল্লাহ, বীর উত্তম, মেজর মইনুল হোসেন চৌধুরী, বীর বিক্রম, মেজর নূরুল ইসলাম শিশু, লেফটেন্যান্ট গোলাম হেলাল মোর্শেদ খান, বীর বিক্রম- এবং লেফটেন্যান্ট সৈয়দ মোহাম্মদ ইব্রাহীম, বীর প্রতীক। এ ব্যাটালিয়নের সবকটি কোম্পানি বিদ্রোহ ঘোষণা করে প্রতিরোধযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। এরপর ময়মনসিংহ হয়ে মেজর খালেদ মোশাররফ, বীর উত্তমএর নেতৃত্বাধীন বাহিনীর সঙ্গে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এসে একত্রিত হয়।
৩য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অবস্থান ছিল সৈয়দপুর সেনানিবাসে। সম্ভাব্য ভারতীয় আক্রমণের কথা বলে এর চারটি কোম্পানি ও অধিকাংশ বাঙালি অফিসারকে সেনানিবাসের বাইরে পাঠিয়ে দেয়া হয়। ব্রাভো কোম্পানিকে ঘোড়াঘাট, ডেল্টা কোম্পানিকে পলাশবাড়ী, আলফা কোম্পানিকে পার্বতীপুর এবং চার্লি কোম্পানিকে ঠাকুরগাঁও। ঢাকায় অপারেশন সার্চলাইটের খবর পেয়ে সব কোম্পানিই বিদ্রোহ ঘোষণা করে প্রতিরোধযুদ্ধ শুরু করে।
কুমিল্লায় অবস্থিত ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের চার্লি ও ডেল্টা কোম্পানিকে পূর্বেই ব্রাহ্মণবাড়িয়া ডেপ্লয় করা হয়। ২৪শে মার্চ মেজর খালেদ মোশাররফকে আলফা কোম্পানি নিয়ে সিলেটের শমসেরনগরে সম্ভাব্য নকশালপন্থীদের তৎপরতা ও ভারতীয় অনুপ্রবেশ ঠেকানোর কথা বলে সেখানে অবস্থানের নির্দেশ দেয়া হয়। এখানে উল্লেখ্য যে, মেজর খালেদ মোশাররফ সেখানে নকশালপন্থী বা ভারতীয় অনুপ্রবেশকারীদের কোনো চিহ্নই খুঁজে পাননি। খালেদ মোশাররফ ২৬শে মার্চ বিকেলে মেজর শাফায়াত জামিল, বীর বিক্রম-এর নিকট থেকে ওয়ারলেসের মাধ্যমে অপারেশন সার্চলাইট-এর নামে পাকিস্তানি সেনা কর্তৃক ঢাকায় নৃশংস গণহত্যার খবর পেয়ে তাঁর ইউনিট নিয়ে তাৎক্ষণিক বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। মেজর খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট নিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় মেজর শাফায়াত জামিলের সঙ্গে মিলিত হন এবং প্রতিরোধ যোদ্ধাদের কমান্ড গ্রহণ করেন। প্রাথমিক পর্যায়ে তাঁর নেতৃত্বাধীন বাহিনী ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে সিলেট পর্যন্ত বিশাল এলাকা শত্রুমুক্ত করে।
মুক্তিযুদ্ধ শুরুর প্রাক্কালে ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট পশ্চিম পাকিস্তানের খারিয়ান সেনানিবাসে বদলির আদেশ পেয়ে চট্টগ্রাম সেনানিবাসের বাইরে হালিশরে অবস্থান করছিল। এ রেজিমেন্টের সহ-অধিনায়কের দায়িত্বে ছিলেন মেজর জিয়াউর রহমান, বীর উত্তম। এ ইউনিটের অন্যান্য বাঙালি অফিসার ছিলেন মেজর মীর শওকত আলী, ক্যাপ্টেন অলি আহমদ, বীর বিক্রম, ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান, ক্যাপ্টেন সাদেক হোসেন, লেফটেন্যান্ট শমসের মবিন চৌধুরী, বীর বিক্রম, লেফটেন্যান্ট মাহফুজুর রহমান প্রমুখ। এ রেজিমেন্টের একটি কোম্পানিকে ফেব্রুয়ারি মাসেই খারিয়ানে পাঠিয়ে দেয়া হয়। চলমান রাজনৈতিক অচলাবস্থার মধ্যে অন্য একটি কোম্পানিকে চট্টগ্রাম বন্দর এলাকায় মোতায়েন করা হয়। রেজিমেন্টের শক্তি আরো খর্ব করার উদ্দেশ্যে শুধু নিরাপত্তার জন্য কিছু হালকা অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ রেখে এর সকল অস্ত্র ও গোলাবারুদ অন্য রেজিমেন্টে জমা দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়। ২৫শে মার্চ পাকিস্তানি সামরিক জান্তা ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ব্যাপক গণহত্যা ও নির্যাতন শুরু করলে সঙ্গে-সঙ্গে তার প্রতিক্রিয়া দেখা দেয় চট্টগ্রামে। ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ২৫শে মার্চ রাতেই পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে মেজর জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এখানে উল্লেখ্য যে, বিভিন্ন অজুহাতে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ব্যাটালিয়নগুলোকে সেনানিবাসের বাইরে পাঠিয়ে দেয়াটা যেন শাপে বর হয়ে দেখা দেয়। সেনানিবাসের বাইরে থাকার ফলে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বিদ্রোহী বাঙালি সৈন্যদের পক্ষে তাৎক্ষণিক স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করা সম্ভব হয়। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর প্রাক্কালে ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস (ইপিআর) ৬টি সেক্টর (ঢাকা, যশোর, রাজশাহী, দিনাজপুর, সিলেট ও চট্টগ্রাম) ও তার অন্তর্গত ১৭টি উইং-এ বিভক্ত ছিল। ১নং সেক্টরের (সদর দপ্তর) ৩টি উইং (১৩, ১৫ ও ১৬) ঢাকার পিলখানায় মোতায়েন ছিল। বাকি ৫টি সেক্টর এবং তার উইংগুলোর অবস্থান ছিল জেলা, মহকুমা বা সীমান্তবর্তী অঞ্চলে বর্ডার অবজারভেশন পোস্ট (বিওপি)গুলোতে। এখানে উল্লেখ্য যে, ইপিআর-এর সকল অফিসারই সেনাবাহিনী থেকে প্রেষণে নিয়োজিত হন; মুক্তিযুদ্ধের সময় এর সৈনিকদের প্রায় ৯০% ছিলেন বাঙালি।
৬নং সেক্টরের সদর দপ্তর ছিল চট্টগ্রামের হালিশহরে। এ সেক্টরের বাঙালি অফিসার ক্যাপ্টেন রফিকুল ইসলাম, বীর উত্তমএর নেতৃত্বে সৈনিকরা ২৫ তারিখ রাতেই বিদ্রোহ ঘোষণা করেন
রাজশাহীতে অবস্থানরত ইপিআর-এর ৪নং সেক্টরের অধীন সকল উইং, যশোরের ৩নং সেক্টরের সকল উইং, দিনাজপুরে অবস্থানরত ৫নং সেক্টরের সকল উইং এবং সিলেটে অবস্থারত ২নং সেক্টরের সকল উইং ২৭শে মার্চের মধ্যেই বিদ্রোহ ঘোষণা করে প্রতিরোধযুদ্ধে অংশ নেয়। এখানে উল্লেখ্য যে, মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে ইপিআর-এর ভূমিকা ছিল খুবই সাহসী। তাঁদের বিভিন্ন অপারেশনাল ইউনিট থেকে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রাথমিক প্রতিরোধ গড়ে তোলা ছাড়াও মুক্তিযুদ্ধ শুরুর প্রাক্কালে ইপিআর বাহিনীর নিকট থেকে বাংলাদেশ সরকার- প্রায় সকল অস্ত্র ও গোলাবারুদ পেয়েছিল। ইপিআর-এর ওয়ারলেস সেট ও যানবাহন মুক্তিযুদ্ধে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হয়েছে।
শুরুতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ছিল স্বতঃস্ফূর্ত। বিদ্রোহী বাঙালি সেনাসদস্য, ইপিআর, পুলিশ, আনসার, মুজাহিদ ও সর্বস্তরের জনগণ পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যার-যার অবস্থান থেকে প্রতিরোধযুদ্ধ শুরু করে। তবে চেইন-অব-কমান্ডের অভাবে এটা ছিল অনেকটাই বিক্ষিপ্ত। এমতাবস্থায় ২রা এপ্রিল ২য় এবং ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সিনিয়র অফিসার মেজর খালেদ মোশাররফ, মেজর কে এম সফিউল্লাহ এবং মেজর শাফায়াত জামিল ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী (বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স, বিএসএফ)-এর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার ভি সি পাণ্ডের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাঁর মাধ্যমে ভারতীয় সাহায্য-সহযোগিতার প্রস্তাব করেন। ব্রিগেডিয়ার পাণ্ডের নিকট থেকে তাঁরা জানতে পারেন যে, বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে পরিচিত অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল মুহাম্মদ আতাউল গনি ওসমানী- সীমান্তের ওপারে আগরতলায় আছেন এবং মেজর জিয়াউর রহমান খাগড়াছড়ির রামগড়ে অবস্থান করে প্রতিরোধযুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন। বিদ্রোহী সেনা কর্মকর্তাগণ হবিগঞ্জ মহকুমার মাধবপুর থানার তেলিয়াপাড়া চা বাগানের বাংলোতে একটি সম্মেলনের প্রস্তাব করেন এবং ব্রিগেডিয়ার পাণ্ডেকে দায়িত্ব দেন কর্নেল ওসমানী ও মেজর জিয়াসহ সীমান্ত অতিক্রমকারী সেনাকর্মকর্তাদের উপস্থিত করানোর জন্য। ৪ঠা এপ্রিল সকাল ১০টায় এখানে বেঙ্গল রেজিমেন্টের সিনিয়র অফিসারদের এক গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এ বৈঠকের উদ্দেশ্য ছিল প্রতিরোধযুদ্ধের বিভিন্ন বিষয় আলোচনা করে সমন্বিত কর্মপন্থা নির্ধারণ করা; বিদ্রোহী কমান্ডারগণ তাঁদের নিজ-নিজ অবস্থানে থেকে প্রতিরোধযুদ্ধের খণ্ডচিত্র এবং অভিজ্ঞতা সবার সঙ্গে শেয়ার করে সারা দেশের প্রতিরোধযুদ্ধ সম্পর্কে অবহিত হওয়া এবং সারা দেশের প্রতিরোধ যুদ্ধকে একটি কেন্দ্রীয় কমান্ড চ্যানেলে এনে সমন্বিতভাবে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া। এছাড়াও এ বৈঠকে সকল সেনা অফিসার সর্বসম্মতিক্রমে কর্নেল এম এ জি ওসমানীকে সমন্বয়কের দায়িত্ব দেন।
৪ঠা এপ্রিল যে-সকল সিনিয়র অফিসার তেলিয়াপাড়ার সভায় উপস্থিত ছিলেন, তাঁরা হলেন- কর্নেল (অব.) আতাউল গনি ওসমানী এমএনএ, লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) আব্দুর রব, বীর উত্তম এমএনএ, লেফটেন্যান্ট কর্নেল সালেহ্ উদ্দিন মোহাম্মদ রেজা, মেজর কে এম সফিউল্লাহ, বীর উত্তম, মেজর খালেদ মোশাররফ, মেজর জিয়াউর রহমান, বীর উত্তম, মেজর কাজী নুরুজ্জামান, বীর উত্তম, মেজর মঈনুল হোসেন চৌধুরী, মেজর নুরুল ইসলাম শিশু ও মেজর শাফায়াত জামিল। এছাড়াও উক্ত সম্মেলনে আরো যাঁরা উপস্থিত ছিলেন, তাঁরা হলেন- ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিদ্রোহী মহকুমা প্রশাসক কাজী রকীব উদ্দিন, বিএসএফ-এর পূর্বাঞ্চলীয় মহাপরিচালক বিগ্রেডিয়ার ভি সি পাণ্ডে এবং আগরতলার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ওমেস সায়গল। সমন্বিত প্রতিরোধযুদ্ধ চালিয়ে নেয়ার জন্য উক্ত সভায় সমগ্র বাংলাদেশকে নিম্নোক্ত ৪টি সামরিক অঞ্চলে ভাগ করে প্রত্যেকটিতে একজন করে অধিনায়ক নিযুক্ত করা হয়- ১নং সামরিক অঞ্চল: অধিনায়ক মেজর জিয়াউর রহমান; দায়িত্বপ্রাপ্ত এলাকা- বৃহত্তর চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও নোয়াখালী জেলার পূর্বাংশ (মুহুরী নদী পর্যন্ত); ২নং সামরিক অঞ্চল: অধিনায়ক মেজর খালেদ মোশাররফ; দায়িত্বপ্রাপ্ত এলাকা- বৃহত্তর কুমিল্লা, ঢাকা ও নোয়াখালী জেলার পশ্চিমাংশ (মুহুরী নদী পর্যন্ত); ৩নং সামরিক অঞ্চল: অধিনায়ক মেজর কে এম সফিউল্লাহ; দায়িত্বপ্রাপ্ত এলাকা- বৃহত্তর সিলেট ও ময়মনসিংহ জেলা এবং ৪নং সামরিক অঞ্চল: অধিনায়ক আবু ওসমান চৌধুরী; দায়িত্বপ্রাপ্ত এলাকা- বৃহত্তর কুষ্টিয়া, যশোর ও ফরিদপুর জেলা।
১০ই এপ্রিল তেলিয়াপাড়া চা বাগানের ডাকবাংলোতে বাঙালি সামরিক অফিসারদের আরো একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত সভায় সমগ্র বাংলাদেশ ভূখণ্ডকে ৪টির স্থলে ৬টি সামরিক অঞ্চলে বিভক্ত করা হয়। নতুন ২টি সামরিক অঞ্চলের একটি গঠিত হয় বৃহত্তর রংপুর ও দিনাজপুর জেলা নিয়ে এবং এ অঞ্চলের অধিনায়কের দায়িত্ব দেয়া হয় ক্যাপ্টেন নওয়াজেশ উদ্দিনকে; অন্যটি গঠিত হয় বৃহত্তর রাজশাহী, পাবনা ও বগুড়া জেলা নিয়ে এবং এর অধিনায়কের দায়িত্ব দেয়া হয় মেজর নাজমুল হককে।
১০ই এপ্রিল ৭০-এর নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের সমন্বয়ে মুজিবনগর সরকার (প্রথম বাংলাদেশ সরকার) গঠন করার পর প্রতিরোধযুদ্ধ নতুন মাত্রা লাভ করে আরো তীব্রতর হতে থাকে। একই দিন কর্নেল এম এ জি ওসমানীকে মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি নিযুক্ত করা হয়। পরের দিন ১১ই এপ্রিল সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে এক ভাষণে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের বীর মুক্তিযোদ্ধা যেমন সামরিক বাহিনীর ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইপিআর, পুলিশ, আনসার, মুজাহিদ, বেসামরিক প্রশাসন এবং দেশের সর্বস্তরের জনগণের পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধযুদ্ধে নিয়োজিত থাকার কথা বাঙালি জাতি এবং বিশ্ববাসীর সম্মুখে তুলে ধরেন। একই ভাষণে তিনি মুক্তিযুদ্ধকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করার জন্য সমগ্র দেশকে নিম্নোক্ত ৮টি সামরিক অঞ্চলে বিভক্ত করে ৮ জন কমান্ডার নিয়োগের ঘোষণা দেন— বৃহত্তর সিলেট ও কুমিল্লা অঞ্চল- অধিনায়ক মেজর খালেদ মোশাররফ; বৃহত্তর চট্টগ্রাম ও নোয়াখালী অঞ্চল- অধিনায়ক মেজর জিয়াউর রহমান; বৃহত্তর ময়মনসিংহ ও টাঙ্গাইল অঞ্চল- অধিনায়ক মেজর কে এম সফিউল্লাহ; বৃহত্তর কুষ্টিয়া ও যশোর অঞ্চল- অধিনায়ক মেজর আবু ওসমান চৌধুরী; বৃহত্তর ফরিদপুর, খুলনা, বরিশাল ও পটুয়াখালী অঞ্চল- অধিনায়ক মেজর এম এ জলিল; বৃহত্তর সৈয়দপুর অঞ্চল- অধিনায়ক মেজর নজরুল হক; বৃহত্তর রাজশাহী অঞ্চল- অধিনায়ক ক্যাপ্টেন গিয়াস উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী, বীর বিক্রম-; বৃহত্তর রংপুর অঞ্চল- অধিনায়ক ক্যাপ্টেন নওয়াজেশ উদ্দিন। ১৮ই এপ্রিল মুজিবনগর সরকার কর্তৃক কর্নেল ওসমানীকে প্রধান সেনাপতির অতিরিক্ত মন্ত্রীর পদমর্যাদা দেয়া হয়। ১৭ই এপ্রিল মুজিবনগর সরকারের শপথ গ্রহণের পর মুক্তিবাহিনীর সকল অসংগঠিত অংশকে কেন্দ্রীয়ভাবে বাংলাদেশ ফোর্সেস সদর দপ্তরের অধীনে নিয়ে আসা হয়।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে সেক্টরের নানাবিধ সমস্যা ও ভবিষ্যৎ সমন্বিত যুদ্ধকৌশল সম্পর্কে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য বাংলাদেশ সরকারের সদর দপ্তর কলকাতার ৮নং থিয়েটার রোডে ১১ই জুলাই থেকে ১৭ই জুলাই পর্যন্ত সেক্টর কমান্ডারদের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এ সম্মেলনে যাঁরা উপস্থিত ছিলেন, তাঁরা হলেন- প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ (সভাপতি), কর্নেল (অব.) এম এ জি ওসমানী (প্রধান সেনাপতি), লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) এম এ রব (সেনা প্রধান), মেজর (অব.) কাজী নূরুজ্জামান (সেক্টর কমান্ডার), মেজর চিত্ত রঞ্জন দত্ত, বীর উত্তম (সেক্টর কমান্ডার), মেজর জিয়াউর রহমান (সেক্টর কমান্ডার), মেজর কে এম সফিউল্লাহ (সেক্টর কমান্ডার), মেজর খালেদ মোশাররফ (সেক্টর কমান্ডার), মেজর মীর শওকত আলী (সেক্টর কমান্ডার), মেজর আবু ওসমান চৌধুরী (সেক্টর কমান্ডার), মেজর নাজমুল হক (সেক্টর কমান্ডার), মেজর এম এ জলিল (সেক্টর কমান্ডার), মেজর রফিকুল ইসলাম, বীর উত্তম (সেক্টর কমান্ডার), মেজর এ আর চৌধুরী (সেক্টর কমান্ডার), গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ কে খন্দকার (সেনা উপপ্রধান) ও উইং কমান্ডার এম কে বাশার (সেক্টর কমান্ডার)। এ সম্মেলনে সমগ্র যুদ্ধাঞ্চলকে পুনর্বিন্যাস করে ১১টি অপারেশনাল সেক্টরে বিভক্ত করে ৫, ১০ ও ১১ নম্বর সেক্টর বাদে প্রতিটি সেক্টরে একজন করে সেক্টর কমান্ডার নিয়োগ করা হয়। এছাড়া, প্রতিটি সেক্টরের সীমানা পুনর্নির্ধারণ, গেরিলা যুদ্ধের পাশাপাশি প্রচলিত যুদ্ধ চালানোর জন্য সেক্টরে নিয়োজিত নিয়মিত বাহিনী সমন্বয়ে ব্রিগেড ফোর্স গঠন, সেক্টরের জনবল, সেক্টর বাহিনী গঠন ও বিন্যাস, নিয়োগ ও প্রশিক্ষণ, যুদ্ধের কৌশল, সেক্টর বাহিনীর বেতন-ভাতা, চিকিৎসা, ইত্যাদি বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা শেষে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এ সম্মেলনে লে. কর্নেল (অব.) এম এ রবকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর চিফ অব স্টাফ এবং গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ কে খন্দকারকে ডেপুটি চিফ অব স্টাফ হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়।
প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সেক্টর কমান্ডারদের সম্মেলনে সমগ্র বাংলদেশকে ১১টি যুদ্ধাঞ্চল বা সেক্টরে ভাগ করা ছাড়াও ১১টি আঞ্চলিক প্রশাসনিক পরিষদ গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। এগুলোকে ‘জোনাল অফিস’ বলা হতো। এ পরিষদে ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে নির্বাচিত এমএনএ, এমপিএ এবং স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে সদস্য করা হয়। পরিষদের সদস্যগণ তাঁদের মধ্য থেকে একজনকে চেয়ারম্যান নির্বাচিত করেন। এছাড়াও প্রত্যেকটি অঞ্চলে একজন প্রশাসনিক কর্মকর্তা নিয়োগ করা হয়। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে নিজ-নিজ এলাকার সকল প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করা ছাড়াও এ আঞ্চলিক প্রশাসনিক পরিষদের কাজ ছিল সংশ্লিষ্ট সেক্টর কমান্ডারদের সঙ্গে তাঁদের কাজের সমন্বয় সাধন করে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনায় সার্বিক সহযোগিতা করা, মুক্তিযোদ্ধাদের নির্বাচন, প্রশিক্ষণ ও রাজনৈতিক দিকনির্দেশনা প্রদানসহ পূর্ণ সাহায্য- সহযোগিতা করা। সামরিক কৌশল হিসেবে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার সুবিধার জন্য সেক্টর কমান্ডারগণ তাঁদের নিজ-নিজ সেক্টরকে একাধিক সাব-সেক্টরে বিভক্ত করে প্রতিটির সীমানা নির্ধারণপূর্বক একজন সাব-সেক্টর কমান্ডার নিয়োগ করেন।
সেক্টর-১: মুক্তিযুদ্ধের ১নং সেক্টর গঠিত হয় বৃহত্তর চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলা এবং নোয়াখালী জেলার মুহুরী নদীর পূর্ব পর্যন্ত এলাকা নিয়ে। সেক্টর এলাকার আয়তন ছিল ১৮৬০৩.৪৭ বর্গ কিলোমিটার। এপ্রিল মাস থেকে ১০ই জুন পর্যন্ত এ সেক্টরের কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন মেজর জিয়াউর রহমান, বীর উত্তম এবং ১১ই জুন থেকে ১৬ই ডিসেম্বর পর্যন্ত মেজর মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম, বীর উত্তম। এ সেক্টরের সদর দপ্তর ছিল আগরতলার হরিনাতে। এ সেক্টর এলাকায় আঞ্চলিক প্রশাসনিক পরিষদের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন নূরুল ইসলাম চৌধুরী এমএনএ। সমন্বিত অভিযান পরিচালনার সুবিধার জন্য এ সেক্টরকে পাঁচটি সাব- সেক্টরে ভাগ করা হয়। সাব-সেক্টরসমূহ, এর কমান্ডারগণ এবং তাঁদের দায়িত্বপ্রাপ্ত এলাকা হলো:
১. ঋষিমুখ সাব-সেক্টর- ক্যাপ্টেন শামসুল হুদা বাচ্চু, এলাকা— পরশুরাম, দেবপুর, চাঁদগাজী এবং ছাগলনাইয়া। ২. শ্রীনগর সাব-সেক্টর- বিভিন্ন সময় কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন ক্যাপ্টেন অলি আহমদ, বীর বিক্রম- ক্যাপ্টেন মতিউর রহমান, বীর বিক্রম- এবং ক্যাপ্টেন এ ওয়াই এম মাহফুজুর রহমান, বীর বিক্রম ; এলাকা- চট্টগাম জেলার করেরহাট, জোরারগঞ্জ, হিঙ্গুলী, ধুম এবং কাটাছড়া।
৩. মনুঘাট সাব-সেক্টর- বিভিন্ন সময় কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন ক্যাপ্টেন মাহফুজুর রহমান, ক্যাপ্টেন মতিউর রহমান এবং ক্যাপ্টেন ফজলুর রহমান; এলাকা— পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলার রামগড়, হেঁয়াকো, মহালছড়ি এবং খাগড়াছড়ি।
৪. তবলছড়ি সাব-সেক্টর কমান্ডার সুবেদার আলী হোসেন; এলাকা- চট্টগ্রাম জেলার সীতাকুণ্ড, বাড়বকুণ্ড, কুমিরা ও মীরসরাই এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলার পানছড়ি ও লক্ষ্মীছড়ি।
৫. ডিমাগিরী সাব-সেক্টর-এর কমান্ডার ছিলেন সেনাবাহিনীর একজন সুবেদার (তাঁর পরিচয় জানা সম্ভব হয়নি); এলাকা— ফটিকছড়ি, নাজিরহাট, রাউজান, বাগানবাজার এবং হাটহাজারী।
১নং সেক্টরে ২২ হাজার ১ শত মুক্তিযোদ্ধা যুদ্ধ করেন। তাঁদের মধ্যে নিয়মিত বাহিনীর সদস্য ছিলেন ২১০০ জন (ইপিআর ১৫০০, পুলিশ ২০০, সেনাবাহিনী ৩০০, নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনীর ১০০)। এছাড়াও এ সেক্টরে কর্মরত গণবাহিনী (গেরিলা বাহিনী)-র সদস্য সংখ্যা ছিল প্রায় ২০ হাজার। গণবাহিনীর এ সকল সদস্য ১৩৭টি গ্রুপে ভাগ হয়ে দেশের অভ্যন্তরে অসংখ্য গেরিলা অপারেশন পচিালনা করেন।
৭ই জুলাই এক নম্বর সেক্টরের নিয়মিত বাহিনীর (সামরিক বাহিনী, ইপিআর, পুলিশ, আনসার বাহিনীর সদস্য) বিশেষ করে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের তিনটি ব্যাটালিয়ন (১ম, ৩য় এবং ৮ম) নিয়ে মেজর জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে প্রথম বিগ্রেড ফোর্স গঠন করা হয়। এ ফোর্সের ব্রিগেড কমান্ডার হিসেবে নিয়োগ করা হয় মেজর জিয়াউর রহমানকে এবং তাঁর নামের প্রথম অক্ষর নিয়ে এ ব্রিগেডের নামকরণ করা হয় ‘জেড-ফোর্স’ (জিয়া ফোর্স)। এ-সময় জিয়াকে লেফটেন্যান্ট কর্নেল র্যাংকে পদোন্নতি দেয়া হয়। ব্রিগেড মেজরের দায়িত্ব পালন করেন ক্যাপ্টেন অলি আহমদ।
সেক্টর-২: মুক্তিযুদ্ধের ২নং সেক্টরটি গঠিত হয় ফরিদপুর জেলার পূর্বাঞ্চল, ঢাকা শহরসহ ঢাকা জেলার দক্ষিণাংশ, কুমিল্লা জেলা (আখাউড়া-আশুগঞ্জ রেললাইনের উত্তরাংশ বাদে) এবং নোয়াখালী জেলার অংশ নিয়ে (মুহুরী নদীর পূর্বাঞ্চল বাদে)। এ সেক্টর এলাকার আয়তন ছিল ১৯৫২৬ বর্গ কিলোমিটার। এ সেক্টরের বিশেষ গুরুত্ব হলো— এ সেক্টর এলাকায় ঢাকা শহর, ঢাকা- চট্টগ্রাম মহাসড়ক, ঢাকা-
চট্টগ্রাম রেলপথ এবং ঢাকা- সিলেট সড়ক ও রেলপথ অন্তর্ভুক্ত। এপ্রিল থেকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত এর
সেক্টর কমান্ডার ছিলেন মেজর খালেদ মোশাররফ, বীর উত্তম এবং অক্টোবর থেকে ১৬ই ডিসেম্বর পর্যন্ত মেজর এ টি এম হায়দার, বীর উত্তম। এ সেক্টরের সদর দপ্তর ছিল ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের মেলাঘরে (আগরতলা থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দক্ষিণে)। ২নং সেক্টরের আঞ্চলিক প্রশাসনিক পরিষদের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন জহুর আমদ চৌধুরী এমএনএ। রণকৌশলগত দিক থেকে এ সেক্টরকে ছয়টি সাব-সেক্টরে ভাগ করা হয়। সাব-সেক্টরসমূহ, এর কমান্ডারগণ এবং তাঁদের দায়িত্বপ্রাপ্ত এলাকা হলো:
১. গঙ্গাসাগর সাব-সেক্টর-ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ আইনউদ্দিন, বীর প্রতীক; এলাকা- কসবা, আখাউড়া মুরাদনগর, নবীনগর এবং ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়া।
২. মন্দভাগ সাব-সেক্টর- ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ আব্দুল গাফফার হাওলাদার, বীর উত্তম; এলাকা- ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়া মহকুমার কসবা থানার মন্দভাগ রেল স্টেশন থেকে কুটি পর্যন্ত।
৩. শালদা নদী সাব-সেক্টর- মেজর আব্দুস সালেক চৌধুরী, বীর উত্তম; এলাকা— শালদা নদী, নয়নপুর ও বুড়িচং।
৪. মতিনগর সাব-সেক্টর- লেফটেন্যান্ট মোহাম্মদ দিদারুল আলম, বীর প্রতীক; এলাকা- গোমতীর উত্তর পাড়ের বাঁধ থেকে কোম্পানিগঞ্জ পর্যন্ত।
৫. নির্ভয়পুর সাব-সেক্টর- প্রথমে কমান্ডার ছিলেন ক্যাপ্টেন আকবর হোসেন, বীর প্রতীক এবং পরে লেফটেন্যান্ট মেহবুবুর রহমান, বীর উত্তম; এলাকা— কুমিল্লা থেকে চাঁদপুর ও লাখসাম পর্যন্ত।
৬. রাজনগর সাব-সেক্টর- বিভিন্ন সময়ে কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন ক্যাপ্টেন জাফর ইমাম, বীর বিক্রম-, ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ শহীদুল ইসলাম, বীর প্রতীক ও লেফটেন্যান্ট ইমাম উজ-জামান, বীর বিক্রম ; এলাকা— বিলোনিয়া, লাকসাম জেলার দক্ষিণ অঞ্চল থেকে নোয়াখালী পর্যন্ত।
২নং সেক্টরে ৩৪ হাজার মুক্তিযোদ্ধা যুদ্ধ করেন। তাঁদের মধ্যে নিয়মিত বাহিনীর সদস্য (ইপিআর, পুলিশ, সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনীর) ছিলেন ৪ হাজার। এছাড়াও এ সেক্টরে কর্মরত গেরিলা বাহিনী (গণবাহিনী)-র সদস্য ছিলেন প্রায় ৩০ হাজার। ১নং ও ২নং সেক্টরের বাহিনীর যৌথ অভিযানের ফলে কুমিল্লা ও ফেনীর মধ্যবর্তী ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক থেকে পাকবাহিনী সম্পূর্ণ বিতাড়িত হয় এবং মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে এ এলাকা মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে থাকে। তাঁদের যৌথ অভিযানের ফলে ২১শে জুন পর্যন্ত সেক্টর বাহিনী বিলোনিয়া সূচিব্যূহের প্রবেশপথ সম্পূর্ণ মুক্ত রাখতে সক্ষম হয়। ২ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা ঢাকা শহরসহ তাঁদের দায়িত্বপ্রাপ্ত সেক্টর এলাকায় বহু সফল গেরিলা অপারেশন পরিচালনা করেন।
অক্টোবর মাসে ২নং সেক্টরের নিয়মিত বাহিনীর ৪র্থ, ৯ম এবং ১০ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের তিনটি ব্যাটালিয়ন সমন্বয়ে মেজর খালেদ মোশাররফ-এর নেতৃত্বে ‘কে-ফোর্স’ (খালেদ ফোর্স) গঠন করা হয়। মেজর খালেদ মোশাররফ কে- ফোর্সের দায়িত্ব নেয়ার পর ২নং সেক্টরের কমান্ডারের দায়িত্ব দেয়া হয় মেজর এ টি এম হায়দারকে।
সেক্টর-৩: ৩নং সেক্টর গঠিত হয় তৎকালীন বৃহত্তর সিলেট জেলার হবিগঞ্জ মহকুমা, বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলার কিশোরগঞ্জ মহকুমা, ঢাকা জেলার নরসিংদী, গাজীপুর মহকুমা এবং নারায়ণগঞ্জের কিছু অংশ ও কুমিল্লা জেলার ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়া মহকুমার দক্ষিণে সিঙ্গারবিল পর্যন্ত এলাকা নিয়ে। এ সেক্টর এলাকার মোট আয়তন ছিল ৯৮০০ বর্গ কিলোমিটার। এপ্রিল থেকে ৩০শে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এ সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন মেজর কে এম সফিউল্লাহ, বীর উত্তম এবং পরে ১লা অক্টোবর থেকে ১৬ই ডিসেম্বর পর্যন্ত মেজর এন এম নূরুজ্জামান। এপ্রিল থেকে ১৯শে মে পর্যন্ত এ সেক্টরের সদর দফতর ছিল হবিগঞ্জ মহকুমার তেলিয়াপাড়া চা বাগানে। ১৯শে মে তেলিয়াপাড়া পতনের পর এ সেক্টরের সদর দপ্তর স্থানান্তর করা হয় ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের সিমনায়। ৩নং সেক্টরের আঞ্চলিক প্রশাসনিক পরিষদের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন কর্নেল এম এ রব এমএনএ। এ সেক্টরকে সাতটি সাব-সেক্টরে ভাগ করা হয়। উল্লেখ্য যে, মেজর কে এম সফিউল্লাহ তাঁর মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ গ্রন্থ-এ এ সেক্টরকে দশটি সাব-সেক্টরে ভাগ করার কথা বলেছেন। তবে মেজর এ এন এম নূরুজ্জামান সমন্বিত করে সাতটি সাব-সেক্টরে ভাগ করে এ সেক্টরের অপারেশন পরিচালনা করা হয়। সাব-সেক্টরসমূহ, এর কমান্ডারগণ এবং তাঁদের দায়িত্বপ্রাপ্ত এলাকা হলো:
১. আশ্রমবাড়ী/বাঘাইবাড়ী সাব-সেক্টর – কমান্ডার প্রথমে ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ আজিজুর রহমান, বীর উত্তম এবং পরে ক্যাপ্টেন এজাজ আহমেদ চৌধুরী; এলাকা- কালেঙ্গা জংগল, ধুপপাতিয়া, লালচান্দ চা বাগান, আসামপাড়া সিমান্ত এলাকা, হবিগঞ্জ মহকুমার চুনারুঘাট থানা।
২. হাতকাটা সাব-সেক্টর- কমান্ডার ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ মতিউর রহমান, বীর প্রতীক; এলাকা শায়েস্তাগঞ্জের নালুয়া চা বাগান ও তেলিয়াপাড়া।
৩. সিমনা সাব-সেক্টর- কমান্ডার ক্যাপ্টেন মো. আব্দুল মতিন, বীর প্রতীক; এলাকা- ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়া মহকুমার নাসিরনগর ও সরাইল থানার অংশবিশেষ এবং হবিগঞ্জ থেকে ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়া মহকুমার সীমান্তবর্তী এলাকার নোয়াপাড়া পর্যন্ত।
৪. পঞ্চবটী সাব-সেক্টর- কমান্ডার ক্যাপ্টেন আবু সালেহ মোহাম্মদ নাসিম, বীর বিক্রম-; এলাকা— হবিগঞ্জ মহকুমার মাধবপুর থানা, চান্দুরা থেকে সরাইল, ইসলামপুর ও তিতাস নদীর পাড় ঘেঁষে শাহবাজপুর পর্যন্ত।
৫ মনতলা/ বিজয়নগর সাব-সেক্টর- কামন্ডার ক্যাপ্টেন এম সুবিদ আলী ভূঁইয়া; এলাকা- হবিগঞ্জ মহকুমার ধর্মগড়, চৌমুহনী, বাহারা, আদাইর এবং মাধবপুর থানার অংশবিশেষ নিয়ে।
৬ কালাছড়া সাব-সেক্টর- লেফটেন্যান্ট মনসুরুল ইসলাম মজুমদার; এলাকা- ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়া মহকুমার আখাউড়া থান। ৭ কলকলিয়া/বামুটিয়া সাব-সেক্টর কমান্ডার লেফটেন্যান্ট গোলাম হেলাল মোরশেদ, বীর বিক্রম-; এলাকা- হবিগঞ্জ মহকুমার মাধবপুর থানার িিকছু অংশ, ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়া-সিলেট সড়ক, মুকুন্দপুর ও কলকলিয়া।
৩ নং সেক্টরে ৩১৬৯৩ জন মুক্তিযোদ্ধা যুদ্ধ করেন। তাঁদের মধ্যে নিয়মিত বাহিনীর সদস্য ছিলেন ৬৬৯৩ জন এবং গেরিলা বাহিনীর সদস্য ছিলেন ২৫০০০ জন। তাঁরা এ সেক্টরের অধীনে ১৯টি গেরিলা ঘাঁটি গড়ে তোলেন এবং অসংখ্য গেরিলা অপারেশন পরিচালনা করেন।
১৪ই সেপ্টেম্বর ৩নং সেক্টরের অধীন ২য় এবং ১১তম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের নিয়মিত বাহিনীর দুটি ব্যাটালিয়ন নিয়ে ‘এস-ফোর্স’ নামে একটি নতুন ব্রিগেড গঠন করা হয়। ‘এস- ফোর্স’ গঠনের পর ৩নং সেক্টরকে নতুন করে পুনর্বিন্যাস করা হয়। মেজর সফিউল্লাহ ‘এস-ফোর্সের’ দায়িত্ব গ্রহণ করার পর ৩নং সেক্টরের অধিনায়কের দায়িত্ব দেয়া হয় মেজর নূরুজ্জামানকে। এস-ফোর্সের ব্রিগেড মেজরের দায়িত্ব দেয়া হয় ক্যাপ্টেন আজিজুর রহমানকে।
সেক্টর-৪: মুক্তিযুদ্ধের ৪নং সেক্টর গঠিত হয় বৃহত্তর সিলেট জেলার মৌলভীবাজার মহকুমা, সিলেট জেলা সদরের প্রায় অর্ধেকাংশ এবং সুনামগঞ্জ মহকুমার অংশবিশেষ নিয়ে। ৪ নং সেক্টর এলাকার মোট আয়তন ছিল ৫৯০০ বর্গ কিলোমিটার। ৪নং সেক্টরের আঞ্চলিক প্রশাসনিক পরিষদের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন দেওয়ান ফরিদ গাজী – এমএনএ। এর সেক্টর কমান্ডার ছিলেন মেজর চিত্ত রঞ্জন দত্ত, বীর উত্তম (মে মাস হতে ১৬ই ডিসেম্বর পর্যন্ত)। এ সেক্টরের হেডকোয়ার্টার্স ছিল প্রথমে আসামের করিমগঞ্জ এবং পরে মাসিমপুরে। ৪নং সেক্টরের ভারতীয় সীমানা মেঘালয়ের ডাউকি থেকে আগরতলার খোয়াই পর্যন্ত ৫৪৮ কিমি এলাকা। সেক্টরের আঞ্চলিক
প্রশাসনিক পরিষদের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন দেওয়ান ফরিদ গাজী এমএনএ। এ সেক্টরকে ৬টি সাব-সেক্টরে ভাগ করা হয়। সাব-সেক্টরসমূহ, এর কমান্ডারগণ এবং তাঁদের দায়িত্বপ্রাপ্ত এলাকা হলো:
১. জালালপুর সাব-সেক্টর- মাহবুবুর রব সাদী, বীর প্রতীক ; এলাকা— আটগ্রাম, জকিগঞ্জ, লুবাছড়া ও কানাইঘাট।
২. বড়পুঞ্জী সাব-সেক্টর- ক্যাপ্টেন আবদুর রউফ, বীর বিক্রম-; এলাকা— লাতু, বিয়ানীবাজার, শারোপার, বড়গ্রাম, জকিগঞ্জের অংশবিশেষ, আটগ্রাম, চিকনাগুল এবং শাহবাজপুর।
৩. আমলাসিদ সাব-সেক্টর- লেফটেন্যান্ট জহিরুল হক খান, বীর প্রতীক ; এলাকা- কানাইঘাট এলাকা।
৪. কুকিল সাব-সেক্টর- প্রথম দিকে এ সাব-সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট নূরুল কাদের এবং পরে ক্যাপ্টেন শরিফুল হক ডালিম; এলাকা- বড়লেখা থানার দিলকুশা চা বাগান, জুড়ি চা বাগান ও কুলাউড়া থানা।
৫. কৈলাশ শহর সাব-সেক্টর- লেফটেন্যান্ট ওয়াকিউজ্জামান ; এলাকা— ‘ন’ মৌজা, শমসেরনগর, চাতালপুর বর্ডার আউট পোস্ট (বিওপি), মৌলভীবাজার।
৬. কমলপুর সাব-সেক্টর- ক্যাপ্টেন খায়রুল এনাম; এলাকা- ধলাই চা বাগান, রাজঘাট চা বাগান এবং কমলগঞ্জ থানার অন্যান্য চা বাগান। ৪নং সেক্টরে নিয়মিত বাহিনীর সদস্য সংখ্যা ছিল ৯৭৫ এবং গেরিলা বাহিনীর সদস্য সংখ্যা ছিল ৯ হাজার।
সেক্টর-৫: ৫নং সেক্টর গঠিত হয় সিলেট জেলা সদর, জৈন্তাপুর, গোয়াইনঘাট, কোম্পানীগঞ্জ, সুনামগঞ্জ মহকুমা সদর, ছাতক, দোয়ারা বাজার, ধীরাই, বিশ্বম্ভরপুর, জামালগঞ্জ থানা, তাহিরপুর, ধর্মশালা, সুনামগঞ্জ ও ছাতকের অধিকাংশ জলাভূমি নিয়ে। সেক্টর কমান্ডার ছিলেন মেজর মীর শওকত আলী, বীর উত্তম (আগস্ট থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত)। এর সদর দপ্তর ছিল বাংলাদেশ ভূখণ্ডে, ছাতকের উত্তরে বাঁশতলা। তবে এর রিয়ার সদর দপ্তর ছিল মেঘালয়ের তুরায়। উল্লেখ্য যে, এ সেক্টরের অধিকংশ এলাকাই ছিল হাওর, বাওর ও বিল বেষ্টিত জলাভূমি। সেদিক বিবেচনা করে এ সেক্টরের রণকৌশল নির্ধারণ করা হয়। এ সেক্টরের আঞ্চলিক প্রশাসনিক পরিষদের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন দেওয়ান ফরিদ গাজী এমএনএ। এ সেক্টরকে ছয়টি সাব-সেক্টরে ভাগ করা হয়। সাব-সেক্টরসমূহ, এর কমান্ডারগণ এবং তাঁদের দায়িত্বপ্রাপ্ত এলাকা হলো: ১. ডাউকি সাব-সেক্টর- সুবেদার মেজর বি আর চৌধুরী; এলাকা- জাফলং, তামাবিল এবং জৈন্তাপুর।
২. শেলা সাব-সেক্টর- ক্যাপ্টেন এ এস হেলাল উদ্দিন; এলাকা— দোয়ারাবাজার, ছাতক এবং সুনামগঞ্জ-সিলেট সড়ক এলাকা।
৩. ভোলাগঞ্জ সাব-সেক্টর- লেফটেন্যান্ট তাহের উদ্দিন; এলাকা- রামানগাঁও, সালুটিকর ও তুয়াকীবাজার।
৪. বালাট সাব-সেক্টর- এ সাব-সেক্টরে বিভিন্ন সময়ে কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন সুবেদার গনি, ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন মমতাজ, বীর উত্তম ও মুক্তিযোদ্ধা এনামুল হক চৌধুরী); এলাকা— সুনামগঞ্জ মহকুমা সদর এলাকা। ৫. বড়ছড়া সাব-সেক্টর- প্রথমে ক্যাপ্টেন মাহফুজুর রহমান ভূঁইয়া এবং পরে ক্যাপ্টেন মুসলিম উদ্দিন; এলাকা- জামালগঞ্জ ও সাচনা।
৬. মুক্তাপুর সাব-সেক্টর- সুবেদার নাজির হোসেন; এলাকা- জৈন্তাপুর ডিবি হাওর, রামাখান ও রাধানগর।
এ সেক্টরে ১০৯৩৬ জন মুক্তিযোদ্ধা যুদ্ধ করেন। তাঁদের মধ্যে নিয়মিত বাহিনীর সদস্য ছিলেন ১৯৩৬ জন এবং গেরিলা বাহিনীর সদস্য ছিলেন ৯০০০ জন।
সেক্টর-৬: মুক্তিযুদ্ধের ৬নং সেক্টরটি গঠিত হয় বৃহত্তর রংপুর এবং দিনাজপুর জেলার দক্ষিণাঞ্চলের কিছু অংশ বাদে বাকি অংশ নিয়ে, যেমন- রংপুর, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, নীলফামারী, পঞ্চগড় মহকুমা এবং গাইবান্ধা মহকুমার সাঘাটা-গোবিন্দগঞ্জ সড়ক, দিনাজপুর জেলার নবাবগঞ্জ থেকে পার্বতীপুর, চিরিরবন্দর, খানসামা, বীরগঞ্জ, কাহারোল ও বোচাগঞ্জ থানা সড়ক এবং ঠাকুরগাঁও মহকুমার পীরগঞ্জ থেকে রাণীশংকৈল হয়ে হরিপুর থানা সড়কের দক্ষিণাঞ্চল বাদে বাকি সকল অংশ নিয়ে। সেক্টর এলাকার মোট আয়তন ছিল ৯৫৫৫.৫৬ বর্গ কিলোমিটার। এ সেক্টরের কমান্ডারের দায়িত্বে ছিলেন উইং কমান্ডার এম খাদেমুল বাশার, বীর উত্তম (জুন থেকে ১৬ই ডিসেম্বর পর্যন্ত)। এ সেক্টরের সদর দপ্তর ছিল লালমনিরহাট মহকুমার পাটগ্রাম থানার বুড়িমারী। উল্লেখ্য যে, এটিই ছিল একমাত্র সেক্টর যার সদর দপ্তর ছিল মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে। এ সেক্টরের
আঞ্চলিক প্রশাসনিক পরিষদের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন মতিউর রহমান এমএনএ। এ সেক্টরকে পাঁচটি সাব- সেক্টরে ভাগ করা হয়। সাব-সেক্টরসমূহ, এর কমান্ডারগণ এবং তাঁদের দায়িত্বপ্রাপ্ত এলাকা হলো:
১. ভজনপুর সাব-সেক্টর- এ সাব-সেক্টরে বিভিন্ন সময়ে কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন ক্যাপ্টেন নজরুল ইসলাম, বীর প্রতীক, স্কোয়াড্রন লীডার সদর উদ্দিন, বীর প্রতীক ও ক্যাপ্টেন শাহরিয়ার; এলাকা— ময়নাগড়, জগদলহাট, চাওয়াই নদী, বোদা, অমরখানা এবং তেঁতুলিয়া।
২. পাটগ্রাম সাব-সেক্টর- ক্যাপ্টেন মো. মতিউর রহমান, বীর বিক্রম-; এলাকা— সমগ্র বড়খাতা ও হাতীবান্ধা থানা।
৩. সাহেবগঞ্জ সাব-সেক্টর- ক্যাপ্টেন নওয়াজেশ উদ্দিন); এলাকা— ফুলবাড়ী, ভুরুঙ্গামারী ও উলিপুর থানা।
৪. মোগলহাট সাব-সেক্টর- ক্যাপ্টেন দেলওয়ার হোসেন, বীর প্রতীক ; এলাকা- লালমনিরহাট মহকুমা সদর ও রায়গঞ্জ থানা।
৫. চিলাহাটি সাব-সেক্টর- ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট ইকবাল; এলাকা- ডিমলা ও নীলফামারী সদর থানা।
এ সেক্টরে ১৩৩১০ জন মুক্তিযোদ্ধা (নিয়মিত বাহিনী ২৩১০ এবং গেরিলা বাহিনী ১১০০০) যুদ্ধ করে বৃহত্তর রংপুর জেলার উত্তরাঞ্চল নিজেদের দখলে রাখেন ৷

সেক্টর-৭: মুক্তিযুদ্ধের ৭নং সেক্টর গঠিত হয় বৃহত্তর রাজশাহী, পাবনা ও বগুড়া জেলা এবং দিনাজপুর জেলার দক্ষিণাংশের যে-সকল এলাকা নিয়ে তা হলো: রাজশাহী সদর, নাটোর, নওগাঁ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, পাবনা, সিরাজগঞ্জ, জয়পুরহাট মহকুমা, বগুড়া জেলা এবং দিনাজপুর জেলার ঘোড়াঘাট, নবাবগঞ্জ, বিরামপুর, ফুলবাড়ী, দিনাজপুর সদর এবং বিরল- বোচাগঞ্জ থানা বরাবর সড়কের দক্ষিণাংশ এবং গাইবান্ধা মহকুমার সাঘাটা, গোবিন্দগঞ্জ থানা বরাবর দক্ষিণাঞ্চল। এ সেক্টর এলাকার মোট আয়তন ছিল ১৯১৯৭ বর্গ কিলোমিটার। এপ্রিল থেকে ২৮শে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এ সেক্টরের কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন মেজর খন্দকার নাজমুল হক এবং ১লা অক্টোবর থেকে ১৬ই ডিসেম্বর পর্যন্ত মেজর বীর কাজী নূরুজ্জামান, প্রতীক। ৭নং সেক্টরের আঞ্চলিক প্রশাসনিক পরিষদের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন ৩ জন। তাঁরা হলেন- আশরাফুল ইসলাম মিয়া এমএনএ (রাজশাহী অঞ্চল), এম এ রউফ চৌধুরী এমপিএ (পাবনা অঞ্চল) এবং আব্দুর রহিম (দিনাজপুর ও বগুড়া অঞ্চল)। এ সেক্টরের সদর দফতর ছিল পশ্চিমবঙ্গের তরঙ্গপুরে। এ সেক্টরকে ৯টি সাব-সেক্টরে ভাগ করা হয়। সাব-সেক্টরসমূহ, এর কমান্ডারগণ এবং তাঁদের দায়িত্বপ্রাপ্ত এলাকা হলো:
১. মালঞ্চ সাব-সেক্টর- সুবেদার মেজর মুজিব; এলাকা— পীরগঞ্জ, হরিপুর ও রাণীশংকৈল থানা।
২. তপন সাব-সেক্টর- প্রথমে মেজর নজমুল হক এবং পরে মেজর কাজী নূরুজ্জামান; এলাকা- দিনাজপুর সদরসহ কাঞ্চনপুর সেতুর পূর্ব পর্যন্ত।
৩. মেহেদীপুর সাব-সেক্টর- ক্যাপ্টেন মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীর, বীরশ্রেষ্ঠ এবং পরে সুবেদার ইলিয়াছ; এলাকা— চাঁপাইনবাবগঞ্জ মহকুমা, শিবপুর, কলাবাড়ী, ছোবড়া, কানসাট ও বারঘরিয়া।
৪. হামজাপুর সাব-সেক্টর- ক্যাপ্টেন ইদ্রিস আলী খান; এলাকা— কানসাটের কিছু অংশ, শিবগঞ্জ ও বিনোদপুর।
৫. ভোলাহাট সাব-সেক্টর- লেফটেন্যান্ট মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম, বীর উত্তম; এলাকা— নবাবগঞ্জ মহকুমার রহনপুরের পশ্চিমে মহনন্দা নদীর তীর পর্যন্ত এবং আলীনগর মকরমপুর থেকে শাহপুরগড় পর্যন্ত।
৬. আঙ্গিনাবাদ সাব-সেক্টর- ভারতীয় সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন থাপাই; এলাকা— খঞ্জনপুর, ধামইরহাট, গোদাগাড়ী, চারঘাট, সারদা, পুঠিয়া, দুর্গাপুর এবং কাঁটাখালীI
৭. শেখপাড়া সাব-সেক্টর- ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ আব্দুর রশীদ, বীর প্রতীক; এলাকা— তাহেরপুর, রাজশাহী মহকুমার পুঠিয়া থানার ঝলমলিয়া সেতু পর্যন্ত, দুর্গাপুর ও চারঘাট থানার মীরগঞ্জ।
৮. ঠোকরাবাড়ি সাব-সেক্টর- সুবেদার মোয়াজ্জেম ; এলাকা— নাচোল থানা, গোমস্তাপুর ও মহানন্দা নদীর পূর্বদিক পর্যন্ত|
৯. লালগোলা সাব-সেক্টর- ক্যাপ্টেন গিয়াস উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী, বীর বিক্রম-; এলাকা- রাধাকান্তপুর, ইসলামপুর এবং দেবীনগর।
১৪৮১০ জন মুক্তিযোদ্ধা (নিয়মিত বাহিনীর সদস্য ২৩১০ জন এবং গেরিলা বাহিনীর সদস্য ১২৫০০ জন) এ সেক্টরে যুদ্ধ করেন। উল্লেখ্য যে, এ সেক্টরের নিয়মিত বাহিনীর অধিকাংশ সদস্যই ছিলেন মুক্তিযুদ্ধপূর্ব কালে রংপুর ও দিনাজপুরের ইপিআর বাহিনীতে কর্মরত।
সেক্টর-৮: মুক্তিযুদ্ধের প্রথম পর্যায়ে ৮নং সেক্টরটি ‘দক্ষিণ-পশ্চিম রণাঙ্গন’ নামে পদ্মা ও মেঘনার দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত সমগ্র এলাকা (কুষ্টিয়া, যশোর, খুলনা, বরিশাল, ফরিদপুর ও পটুয়াখালী মহকুমা) নিয়ে গঠিত হয়। তবে মে মাসের শুরুতে এ সেক্টরের অপারেশন এলাকা সঙ্কুচিত করে বৃহত্তর কুষ্টিয়া ও যশোর জেলা, খুলনা জেলা সদর ও সাতক্ষীরা মহকুমার দৌলতপুর-সাতক্ষীরা সড়ক এবং বৃহত্তর ফরিদপুর জেলার উত্তরাংশ অর্থাৎ গোপালগঞ্জ ও মাদারীপুর মহকুমাসহ ফরিদপুর জেলার মধুখালী, বোয়ালমারী, আলফাডাঙ্গা ও নগরকান্দা থানাসহ ফরিদপুর সদরের অংশবিশেষ নিয়ে পুনর্গঠিত
করা হয়। এপ্রিল থেকে ১৭ই আগস্ট পর্যন্ত এ সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন মেজর আবু ওসমান চৌধুরী এবং তার পরে মেজর মোহাম্মদ আবুল মঞ্জুর, বীর উত্তম। এ সেক্টরের সদর দপ্তর ছিল বেনাপোল, তবে এর রিয়ার সদর দপ্তর ছিল পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার কল্যাণীতে। ৮নং সেক্টরের আঞ্চলিক প্রশাসনিক পরিষদের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন ফণী ভূষণ মজুমদার- এমপিএ। সমন্বিত রণকৌশল হিসেবে এ সেক্টরকে সাতটি সাব- সেক্টরে ভাগ করা হয়। সাব- সেক্টরসমূহ, এর কমান্ডারগণ এবং তাঁদের দায়িত্বপ্রাপ্ত এলাকা হলো:
১. বয়রা সাব-সেক্টর- ক্যাপ্টেন খোন্দকার নজমুল হুদা, বীর বিক্রম ; এলাকা— দক্ষিণে যশোর-বেনাপোল সড়ক, উত্তরে মহেশপুর, জীবননগর থানার কিছু অংশ এবং ঝিকরগাছা থেকে রাধানগর পর্যন্ত।
২. হাকিমপুর সাব-সেক্টর- ক্যাপ্টেন মো. সফিক উল্লাহ, বীর প্রতীক; এলাকা- সাতক্ষীরা মহকুমার কলারোয়া থানার বালিয়াডাঙ্গা ও ঝাউডাঙ্গা।
৩. ভোমরা সাব-সেক্টর- প্রথম দিকে ক্যাপ্টেন আবু তাহের সালাহউদ্দিন, বীর প্রতীক এবং পরবর্তীতে ক্যাপ্টেন মাহবুব উদ্দিন আহমদ, বীর বিক্রম-; এলাকা- সাতক্ষীরার ভোমরা স্থলবন্দর থেকে বেনাপোল পর্যস্ত।
৪. লালবাজার সাব-সেক্টর- ক্যাপ্টেন এ আর আযম চৌধুরী, বীর প্রতীক; এলাকা- বাগুয়ান, মুনাখালী ও মেহেরপুর থানা।
৫. বানপুর সাব-সেক্টর- ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ মুস্তাফিজুর রহমান, বীর বিক্রম-; এলাকা— গয়েসপুর, ধোপাখালী, চুয়াডাঙ্গা, জীবননগর থানার খালিসপুর, কোটচাদপুর ও কালীগঞ্জ।
৬. বেনাপোল সাব-সেক্টর- প্রথমে ক্যাপ্টেন আবদুল হালিম এবং পরে (অনারারি) ক্যাপ্টেন তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী, বীর বিক্রম-; এলাকা- বেনাপোল।
৭. শিকারপুর সাব-সেক্টর- বিভিন্ন সময়ে এ সাব-সেক্টরের কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী, লেফটেন্যান্ট জাহাঙ্গীর এবং ক্যাপ্টেন আবদুল হালিম। এলাকা— সাহেবনগর, কাজিপুর ও গাংনী থানা। এ সেক্টরে সর্বমোট ১১৩১১ জন মুক্তিযোদ্ধা (নিয়মিত বাহিনীর সদস্য ৩৩১১ জন এবং গেরিলা বাহিনীর সদস্য ৮০০০ জন) মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।
সেক্টর-৯: মুক্তিযুদ্ধের ৯নং সেক্টর বৃহত্তর বরিশাল, পটুয়াখালি ও খুলনা জেলার যে-সকল এলাকা নিয়ে গঠিত হয়, তা হলো- বরিশাল সদর, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, ভোলা, বরগুনা ও পটুয়াখালি সদর মহকুমা, এবং খুলনা জেলার খুলনা-সাতক্ষীরা সড়কের দক্ষিণাঞ্চল ও বৃহত্তর ফরিদপুর জেলার অংশবিশেষ। এ সেক্টরের মোট আয়তন ছিল ২৫২০০ বর্গ কিলোমিটার। এ সেক্টরের সদর দপ্তর ছিল প্রথমে পশ্চিমবঙ্গের ২৪ পরগণা জেলার হাসনাবাদে এবং পরে সেখান থেকে ৪.৪ কিমি দূরে টাকিতে সেক্টর কমান্ডার ছিলেন মেজর এম এ জলিল (এপ্রিল থেকে ডিসেম্বরের প্ৰথম দিক পর্যন্ত) উল্লেখ্য, ডিসেম্বর মাসে চূড়ান্ত আক্রমণের পূর্বে এ সেক্টরকে ৮নং সেক্টরের সঙ্গে একীভূত করা হয় এবং এর কমান্ডারের দায়িত্ব দেয়া হয় মেজর মঞ্জুরের ওপর। ৯নং সেক্টরের আঞ্চলিক প্রশাসনিক পরিষদের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন আব্দুর রব সেরনিয়াবাত এমএনএ। সমন্বিত যুদ্ধ কৌশলের কথা বিবেচনা করে এ সেক্টরকে তিনটি সাব- সেক্টরে বিভক্ত করা হয়। সাব-সেক্টরসমূহ, এর কমান্ডারগণ ও তাঁদের দায়িত্বপ্রপ্ত এলাকা হলো:
১. টাকি সাব-সেক্টর- সেক্টর কমান্ডার মেজর এম এ জলিল এ সাব-সেক্টরের কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন। এলাকা- ঝালকাঠি, বরিশাল, পটুয়াখালি, বরগুনা, ভোলা, পিরোজপুর, বাগেরহাট ও সুন্দরবন অঞ্চল।
২. শমসেরনগর সাব-সেক্টর- প্রথমে ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট সলিম উল্লাহ এবং পরে ক্যাপ্টেন মাহফুজ আলম; এলাকা— সমগ্র সাতক্ষীরা অঞ্চল।
৩. হিংগলগঞ্জ সাব-সেক্টর- ক্যাপ্টেন নূরুল হুদা; এলাকা- খুলনা অঞ্চল।
এ সেক্টরে ১১৩১১ জন মুক্তিযোদ্ধা (নিয়তি বাহিনীর ৩৩১১ জন এবং গেরিলা বাহিনীর ৮০০০ জন) যুদ্ধ করেন। উল্লেখ্য যে, মেজর জলিল টাকি সাব-সেক্টর এলাকাকে আবার ৫টি যুদ্ধাঞ্চলে ভাগ করে প্রত্যেকটিতে একজন করে কমান্ডিং অফিসার নিয়োগ করেন। এ সকল অফিসার কখনো-কখনো নিজেদের অঞ্চলকে সাব-সেক্টর হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। টাকি সাব-সেক্টরভুক্ত যুদ্ধাঞ্চলগুলো হলো:
ক) বরিশাল, ঝালকাঠি; কমান্ডিং অফিসার- ক্যাপ্টেন শাহজাহান ওমর, বীর উত্তম।
খ) পটুয়াখালী, বরগুনা, ভোলা; কমান্ডিং অফিসার- ক্যাপ্টেন মেহেদী আলী ইমাম, বীর বিক্রম-।
গ) পিরোজপুর; কমান্ডিং অফিসার- সুবেদার তাজুল ইসলাম।
ঘ) বাগেরহাট, পিরোজপুরের অংশবিশেষ, কমান্ডিং অফিসার- সুবেদার নোমান উল্লাহ।
ঙ) সুন্দরবন অঞ্চল, কমান্ডিং অফিসার লেফটেন্যান্ট জিয়া উদ্দিন।
৯নং সেক্টরে ক্যাপ্টেন শাহজাহান ওমরের নেতৃত্বে এক বিশাল গেরিলা বাহিনী বরিশাল ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকায় অনেকগুলো সফল অপারেশন পরিচালনা করে। পটুয়াখালিতে একটি স্থায়ী ঘাঁটি স্থাপন করে সেখান থেকে ক্যাপ্টেন মেহদী আলী ইমাম পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে আক্রমণ পরিচালনা করেন। লেফটেন্যান্ট জিয়া উদ্দিন সুন্দরবন এলাকায় এক বিশাল বাহিনী গড়ে তোলেন এবং সেখান থেকে শত্রুসেনাদের বিরুদ্ধে অক্রমণ পরিচালনা করেন।

সেক্টর-১০: মুক্তিযুদ্ধের ১০নং সেক্টর গঠিত হয় ১১ থেকে ১৭ই জুলাই অনুষ্ঠিত সেক্টর কমান্ডারদের সম্মেলনে। মুক্তিযুদ্ধের ১১টি সেক্টরের অন্যান্য সেক্টরগুলো দেশের স্থলভাগ নিয়ে গঠিত হয় বলে এগুলোর সীমানা নির্ধারণ করা সম্ভব হলেও ১০নং সেক্টরের কোনো নির্দষ্ট সীমানা ছিল না। এমনকি এর কোনো সাব- সেক্টর ও ছিল না। এর অপারেশন এলাকা ছিল চট্টগ্রাম ও চালনা সমুদ্র বন্দরসহ দেশের অভ্যন্তরীণ সকল নদীপথ নিয়ে; তাই এ সেক্টরকে বলা যায় নৌ-সেক্টর। এ সেক্টরের সদর দপ্তর ছিল পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার পলাশীতে। ১০নং সেক্টরটি গঠিত হয়েছিল শুধুমাত্র বিশেষভাবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নৌ-কমান্ডো বাহিনী নিয়ে; তাঁদের সংখ্যা ছিল ৫১৫ জন। মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়া নৌবাহিনীর কোনো সিনিয়র অফিসার না থাকায় এ সেক্টরে কোনো সেক্টর কমান্ডার ছিলেন না। এটি পরিচালিত হতো মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি কর্নেল এম এ জি ওসমানীর নির্দেশে; নৌ- কমান্ডোগণ তাঁর স্পেশাল ট্রুপস হিসেবে দায়িত্ব পালন করতেন। প্রকৃতপক্ষে নৌ-কমান্ডো বাহিনী গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন ফ্রান্স থেকে প্রশিক্ষণরত অবস্থায় পালিয়ে এসে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়া পাকিস্তান নৌবাহিনীর ৮ জন বাঙালি নাবিক। তাঁরা হলেন- মো. আব্দুল ওয়াহেদ চৌধুরী, বীর উত্তম – (রেডিও অপারেটর), মো. আহসানউল্লাহ, বীর প্রতীক (ইঞ্জিনিয়ারিং মেকানিক্যাল), -মো. আবদুর রকিব মিয়া, বীর বিক্রম- (ইলেকট্রিক্যাল মেকানিক), মো. আবিদুর রহমান, বীর বিক্রম- (স্টুয়ার্ড, সাপ্লাই এন্ড সেক্রেটারিয়েট বিভাগ), মো. বদিউল আলম, বীর উত্তম (ইঞ্জিনিয়ারিং মেকানিক্যাল), মো আমানউল্লাহ শেখ, বীর বিক্রম- (ইলেকট্রিক্যাল আর্টিফিসার), সৈয়দ মোশাররফ হোসেন (ইঞ্জিনরুম আর্টিফিসার) এবং গাজী মোহাম্মদ রহমতউল্লাহ, বীর প্রতীক (চিফ রেডিও আর্টিফিসার)। এ ৮ জন বাঙালি নাবিককে ভারতীয় নৌবাহিনীর ব্যবস্থাপনায় প্রথমে দিল্লির পার্শ্ববর্তী যমুনা নদীতে বিশেষ নৌ-প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। পরবর্তীতে তাঁদের সঙ্গে যোগ দেন পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগকারী নৌ-বাহিনীর কিছুসংখ্যক বাঙালি নৌসেনা। ভারতীয় নৌবাহিনীর সহযোগিতায় মুর্শিদাবাদ জেলার ভাগীরথী নদীর তীরবর্তী নির্জন স্থানে ক্যাম্প স্থাপন করে আড়াই মাসব্যাপী নৌ- কমান্ডোদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। প্রশিক্ষণ শেষে এঁদের নিয়ে পলাশিতে গঠিত হয় নৌ-কমান্ডো বাহিনী। দেশের সকল সমুদ্র ও নদী বন্দরে পাকিস্তানি নৌযানে অপারেশন চালানোর জন্য তাঁদের বিশেষভাবে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়।
পলাশি থেকে প্রশিক্ষণ শেষে আগস্টের প্রথম সপ্তাহে প্রশিক্ষণার্থীদের মধ্য থেকে ১৬০ জন নৌ-কমান্ডোকে নিয়ে অপারেশন জ্যাকপট- বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ছয়টি দলে বিভক্ত করে বাংলাদেশের অভ্যান্তরে পাঠানো হয়। প্রথম দলটি গঠিত হয় সাবমেরিনার আব্দুল ওয়াহেদ চৌধুরীর নেতৃত্বে চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দর অপারেশনের জন্য। দ্বিতীয় দলটি গঠিত হয় সাবমেরিনার মো. বদিউল আলমের নেতৃত্বে চাঁদপুর নদীবন্দর অপারেশনের জন্য। তৃতীয় দলটি গঠিত হয় সাবমেরিনার মো. আবিদুর রহমানের নেতৃত্বে নারায়ণগঞ্জ নদীবন্দর অপারেশনের জন্য। চতুর্থ দলটি গঠিত হয় সাবমেরিনার মো. আহসানউল্লাহর নেতৃত্বে মংলা সমুদ্র বন্দর অপারেশনের জন্য। পঞ্চম দলটি গঠিত হয় নেভাল কমান্ডো মো. শাহজাহান সিদ্দিকী, বীর বিক্রম-এর নেতৃত্বে দাউদকান্দি ফেরিঘাট অপারেশনের জন্য এবং ৬ষ্ঠ দলটি গঠিত হয় নেভাল কমান্ডো হুমায়ূন কবিরের নেতৃত্বে হিরন পয়েন্ট অপারেশনের জন্য। আগস্ট মাস থেকে ১৬ই ডিসেম্বর চূড়ান্ত বিজয় অর্জন পর্যন্ত এ সেক্টরের অধীনে নৌ- কমান্ডো অপারেশন অব্যাহত থাকে।

সেক্টর-১১: মুক্তিযুদ্ধের ১১নং সেক্টরটি কিশোরগঞ্জ মহকুমা ব্যতীত সমগ্র বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলা, টাঙ্গাইল জেলা, বৃহত্তর সিলেট জেলার সুনামগঞ্জ মহকুমার দক্ষিণাঞ্চল এবং বৃহত্তর রংপুর জেলার কুড়িগ্রাম মহকুমার কিছু অংশ নিয়ে গঠিত হয়। ১১নং সেক্টর এলাকার মোট আয়তন ছিল ১৫৯২২ বর্গ কিলোমিটার। ১০ই জুন থেকে ১২ই আগস্ট পর্যন্ত ১, ৩ এবং ৮ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট নিয়ে গঠিত ব্রিগেড ‘জেড ফোর্স’-এর অধিনায়কের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি এ সেক্টরের কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন মেজর জিয়াউর রহমান। ১২ই আগস্ট থেকে ১৪ই নভেম্বর পর্যন্ত কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন মেজর মোহাম্মদ আবু তাহের, বীর উত্তম। তবে ১৪ই নভেম্বর কামালপুর যুদ্ধে মেজর তাহের গুরুতর আহত হলে ১৫ই নভেম্বর থেকে ১৬ই ডিসেম্বর পর্যন্ত এ সেক্টরের কমান্ডারের দায়িত্ব দেয়া হয় স্কোয়াড্রন লিডার এম হামিদুল্লাহ খান, বীর প্রতীককে। এ সেক্টরের সদর দপ্তর ছিল কুড়িগ্রাম মহকুমার রৌমারীর সীমান্তবর্তী মহেন্দ্ৰগঞ্জে। ১১নং সেক্টরের আঞ্চলিক প্রশাসনিক পরিষদের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন শামসুর রহমান খান এমএনএ। এ সেক্টরকে আটটি সাব-সেক্টরে ভাগ করা হয়। সাব-সেক্টরসমূহ, এর কমান্ডারগণ ও তাঁদের দায়িত্বপ্রাপ্ত এলাকা হলো:
১. মহেশখোলা সাব-সেক্টর- ক্যাপ্টেন মতিউর রহমান; এলাকা— সমগ্র নেত্রকোনা মহকুমা।
২. মহেন্দ্রগঞ্জ সাব-সেক্টর- লেফটেন্যান্ট আব্দুল মান্নান; এলাকা— কামালপুর, ঝগড়ারচর, ব্রহ্মপুত্র নদের উভয় তীর ধরে জামালপুর শহর পর্যন্ত
৩. রংড়া সাব-সেক্টর- নাজমুল আহসান (গণবাহিনী); এলাকা— মুক্তাগাছা থানা, নলিতাবাড়ী থানার কিছু অংশ এবং ফুলবাড়ীয়া থানা।
৪. ঢালু সাব-সেক্টর- ডা. আবদুল্লাহ আল মাহমুদ, বীর প্রতীক ; এলাকা— হালুয়াঘাট, ঢালু, ময়মনসিংহ সড়ক পর্যন্ত।
৫. বাগমারা সাব-সেক্টর- লেফটেন্যান্ট আসাদুজ্জামান এবং ইপিআর-এর কয়েকজন জুনিয়র অফিসার; এলাকা- হালুয়াঘাটের পশ্চিমে ভারতীয় এফ জে সেক্টরের উত্তর- পূর্ব থেকে ময়মনসিংহ শহর পর্যন্ত।
৬. পুরাখাসিয়া সাব-সেক্টর- লেফটেন্যান্ট মো. শামসুল আলম, বীর প্রতীক ; এলাকা— শেরপুর মহকুমা সদর, ঝিনাইগাতি, শ্রীবর্দি ও নালিতাবাড়ী থানার কিছু অংশ, জামালপুর মহকুমা সদর ও সরিষাবাড়ী থানা।
৭. মাইনকারচর সাব-সেক্টর- স্কোয়াড্রন লিডার এম হামিদুল্লাহ খান, বীর প্রতীক ; এলাকা – কুড়িগ্রাম মহকুমার রৌমারী ও চর রাজীবপুর থানা।
এ সেক্টরে প্রায় ২৭৩১০ জন মুক্তিযোদ্ধা (নিয়মিত বাহিনীর ২৩১০ জন এবং গেরিলা বাহিনীর ২৫০০০ জন) যুদ্ধ করেছেন। এছাড়া এ সেক্টর এলাকায় টাঙ্গাইলের বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী, বীর উত্তম ১৭০০০ গেরিলা বাহিনীর সদস্য সংগঠিত করে সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি সফল অপারেশন পরিচালনা করেন।
২১শে নভেম্বর মুক্তিযুদ্ধকালে গঠিত বাংলাদেশ সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনী যৌথভাবে পাকিস্তানি হানাদারবাহিনীর বিরুদ্ধে সর্বাত্মক আক্রমণে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তাই ২১শে নভেম্বর বাংলাদেশে ‘সশস্ত্র বাহিনী দিবস’ হিসেবে পালিত হয়। ৩রা ডিসেম্বর পাকিস্তানি জঙ্গি বিমান ভারতের পশ্চিম সীমান্তবর্তী বিভিন্ন বিমান ঘাঁটিতে আক্রমণ চালালে ভারত সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। এমতাবস্থায় বাংলাদেশ সরকার ও ভারত সরকারের যৌথ সিদ্ধান্তে মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর সমন্বয়ে মিত্রবাহিনীর যৌথ কমান্ড গঠন করা হয়। যৌথ কমান্ড পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন ভারতীয় ইস্টার্ন কমান্ডের জিওসি লে. জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা। যৌথ কমান্ড পরিচালনার সুবিধার জন্য মুক্তিযুদ্ধের ১১টি সেক্টর ও ৩টি ব্রিগেড ফোর্সকে পুনর্বিন্যাস করে মোট ৪টি যুদ্ধাঞ্চলে বিভক্ত করা হয়। মুক্তিবাহিনীর ১১টি সেক্টর ও নিয়মিত বাহিনীর ৩টি ব্রিগেডকে এ ৪টি অঞ্চলের যৌথ কমান্ডে সমন্বিত করা হয়। তবে এখানে উল্লেখ্য যে, ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনী যৌথ বাহিনীর অংশ হিসেবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে ৩রা ডিসেম্বর থেকে, যখন পাকিস্তান ও ভারত আনুষ্ঠানিকভাবে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। ৩রা ডিসেম্বরের আগ পর্যন্ত নিয়মিত বাহিনী এবং গণবাহিনী সামগ্রিকভাবে মুক্তিবাহিনী পরিচয়ে সমন্বিত পরিকল্পনামতে ১১টি সেক্টর ও ৩টি ব্রিগেড থেকে অত্যন্ত বীরত্বের সঙ্গে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধে লিপ্ত থাকে। ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর পাকিস্তান বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে চূড়ান্ত বিজয় অর্জন পর্যন্ত এ যৌথ কমান্ড কার্যকর থাকে। [সাজাহান মিয়া]
তথ্যসূত্র: হাসান হাফিজুর রহমান (সম্পা:), বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র, তৃতীয় খণ্ড, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার, তথ্য মন্ত্রণালয়, ১৯৮২; KM Safiulla, Bangladesh at War, Agamee Prakashani, revised edn., 2005; বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ : সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়, ১১ খণ্ড; এ এস এম সামসুল আরেফিন, মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ব্যক্তির অবস্থান, সময় প্রকাশন, ২০১২; এইচ টি ইমাম, বাংলাদেশ সরকার ১৯৭১, বাংলা একাডেমী, ২০১২

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৮ম খণ্ড