মুক্ষাইট-কান্দাপাড়া যুদ্ধ (বাগেরহাট সদর)
মুক্ষাইট-কান্দাপাড়া যুদ্ধ (বাগেরহাট সদর) সংঘটিত হয় ২৯ ও ৩০শে অক্টোবর। পাকবাহিনী ও রাজাকারদের বিরুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের এ যুদ্ধে ৮ জন পাকসেনা ও রাজাকার নিহত হয়।
২১শে অক্টোবর তিন শতাধিক মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে কমান্ডার তাজুল ইসলাম এবং অধ্যাপক মোয়াজ্জেম হোসেন বাগেরহাটের বাদোখালী গ্রামে পৌঁছান। এখানে প্রতিষ্ঠা করা হয় মুক্তিযোদ্ধাদের বাগেরহাট সাবসেক্টর। কিন্তু ২৮শে অক্টোবর এখানে আততায়ীদের হাতে গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন সাবসেক্টরের বেসামরিক প্রধান অধ্যাপক মোয়াজ্জেম হোসেন। একই সঙ্গে বাগেরহাটে অবস্থিত পাকবাহিনী ও রাজাকার বাহিনীর কাছে খবর পৌঁছায় যে, এখানে বিপুলসংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা একত্র হয়েছেন। এ অবস্থায় সাবসেক্টর কমান্ডার তাজুল ইসলাম বাদোখালী গ্রাম থেকে সন্তোষপুর তহশিল অফিসে তাঁদের ক্যাম্পের সদর দফতর সরিয়ে নেন। বাদোখালী ছিল বাগেরহাট থানার একটি গ্রাম, অন্যদিকে সন্তোষপুর ছিল কচুয়া থানার (বর্তমানে চিতলমারী থানার) অন্তর্ভুক্ত। ২৯শে অক্টোবর পাকবাহিনী ও রাজাকাররা একত্রে সন্তোষপুর ক্যাম্প আক্রমণ করে। এর ফলে বাগেরহাট-চিতলমারী রাস্তার বিভিন্ন স্থানে ২ দিনব্যাপী হানাদার বাহিনী ও মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে যুদ্ধ হয়।
হানাদার বাহিনী যাতে সন্তোষপুরের দিকে অগ্রসর হতে না পারে সেজন্য প্রথমদিন কমান্ডার জবেদ আলীর নেতৃত্বে একদল মুক্তিযোদ্ধা মুক্ষাইট কালভার্টের কাছে পজিশন নেন।
পজিশন গ্রহণের পর জবেদ আলী মুক্তিযোদ্ধাদের বেশরগাঁতি ক্যাম্প থেকে আরো কিছু কার্তুজ আনার জন্য মোশাররফ হোসেন মোশা নামে একজন মুক্তিযোদ্ধাকে দায়িত্ব দেন। মোশা কার্তুজ আনার জন্য যাওয়ার পরপর বাগেরহাট থেকে আসা হানাদার বাহিনী মুক্ষাইটের কাছে চলে আসে। তাদের শক্তি বুঝতে পেরে জবেদ আলী তাঁর দল নিয়ে পশ্চাদপসরণ করেন এবং উত্তরমুখী হয়ে কান্দাপাড়ার দিকে এগিয়ে যান। ইতোমধ্যে কার্তুজ নিয়ে মোশা যথাসময়ে মুক্ষাইটে এলে হানাদার বাহিনীর হাতে ধরা পড়েন। হানাদাররা তাঁকে নিয়ে বেশরগাঁতি ক্যাম্পে নিয়ে যায়। সেখানে তারা বহু ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। তারা কান্দারপাড়ায় গণহত্যা চালায় হানাদার বাহিনী যখন মোশাকে নিয়ে কান্দাপাড়ার ওপর দিয়ে বাগেরহাটে ফিরছিল, তখন কান্দাপাড়ার উত্তর দিক দিয়ে কাজী আমজাদুল হকের দল, দক্ষিণ-পশ্চিম দিক থেকে রফিকুল ইসলামের দল এবং উত্তর-পশ্চিম দিক দিয়ে জবেদ আলীর দল হানাদারদের আক্রমণ করে। আক্রান্ত হয়ে হানাদার বাহিনী দ্রুত বাগেরহাটে ফিরে যায়। কিন্তু মোশাকে সঙ্গে নিয়ে যায় এবং পরে তাঁকে বেয়নেট খুঁচিয়ে হত্যা করে। মুক্তিযোদ্ধাদের শক্ত অবস্থান বুঝতে পেরে হানাদার বাহিনী দ্বিতীয় দিন আরো বেশি শক্তি নিয়ে সন্তোষপুরের দিকে অগ্রসর হয়। পরিকল্পনা অনুযায়ী এদিন পশ্চিমভাগ ব্রিজের কাছে রফিকুল ইসলামের দল, মুক্ষাইট ব্রিজের কাছে মোহাম্মদ জবেদ আলীর দল এবং কান্দাপাড়ার কাছে কাজী আমজাদুল হকের দল এম্বুশ করে। হানাদার বাহিনী পশ্চিমভাগ ব্রিজের কাছে আসতেই মুক্তিযোদ্ধা বিজয় পাল বাংকার থেকে গুলি ছোড়েন। তাতে পাকবাহিনীর এক অফিসার গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায়। কিন্তু নিশানা অব্যর্থ হয়েছে কিনা তা দেখতে মাথা উঁচু করা মাত্র বিজয় পাল গুলিবিদ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলে শহীদ হন। হানাদার বাহিনী এরপর মুক্ষাইট অতিক্রম করে পশ্চিমভাগের দিকে অগ্রসর হয়। তখন রফিকুল ইসলাম, জবেদ আলী এবং কাজী আমজাদুল হকের দল একযোগে হানাদার বাহিনীকে প্রতিহত করে। ফলে উভয় পক্ষের মধ্যে তীব্র গুলি বিনিময় হয়। এ সময় ৩ জন পাকসেনা এবং ৫ জন রাজাকার নিহত হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধের মুখে হানাদার বাহিনী এক পর্যায়ে একটি হেভি মেশিনগান ও প্রচুর গোলাবারুদ রেখে বাগেরহাটের দিকে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। যুদ্ধে পাকবাহিনী ও রাজাকাররা পরাজিত ও বিপর্যস্ত হয়। এক পর্যায়ে মুজাহিদ বাহিনীর এক সদস্যকে মুক্তিযোদ্ধারা আহত অবস্থায় আটক করে চিতলমারী ক্যাম্পে নিয়ে যান।
এ যুদ্ধে কমান্ডারদের পাশাপাশি তৈয়বুর রহমান, লোকমান হোসেন, আবদুল জব্বার, হেমায়েত উদ্দিন, আবদুর রহমান, শামসুর রহমান সরদার, ডা. সোহরাব হোসেন, ইসমাইল হোসেন মেঝে, সুশান্ত মজুমদার (পরে কথাসাহিত্যিক) প্রমুখ বিশেষ বীরত্ব প্রদর্শন করেন। ১২ই নভেম্বর এ যুদ্ধের খবর মুজিবনগর ওয়ার বুলেটিন-এ প্রকাশিত হয়। মুক্ষাইট যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের বিজয়ে সেখানে একটি বিজয়স্তম্ভ এবং কান্দাপাড়ায় হানাদার বাহিনীর গণহত্যার একটি স্মারক নির্মিত হয়েছে। [স্বরোচিষ সরকার]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৮ম খণ্ড