মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় মিত্রবাহিনী
একটি দেশ বা জাতির মুক্তিযুদ্ধে বিদেশী মিত্রদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। অভিন্ন শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ অবস্থান নতুন কোনো ঘটনা নয়। যেমন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে জার্মানি, ইতালি ও জাপানের অক্ষশক্তির বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত ত্রি-পক্ষীয় জোট বা আঁতাতের কথা সকলেরই জানা। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এদেশের সর্বস্তরের জনগণের যুদ্ধ বা জনযুদ্ধ-এ রূপ নিয়েছিল বটে, তবে এটি একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক রূপ লাভ করেছিল। বলা যেতে পারে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বিশ্ব সম্প্রদায় এবং বিশ্বের প্রায় সকল দেশ কোনো-না- কোনোভাবে যুক্ত হয়ে পড়েছিল। তবে বহির্দেশীয় মিত্রদের মধ্যে ভারতের অবস্থান ছিল সর্বশীর্ষে। ভারত শুধু আমাদের প্রধান মিত্রই ছিল না, মুক্তিযুদ্ধের এক পর্যায়ে সরাসরি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। ৩রা ডিসেম্বর পেশোয়ার বিমানঘাঁটি থেকে পাকিস্তানি বিমানবাহিনীর ৬০টি বিমান অতর্কিতে ভারতের শ্রীনগর, পাঠানকোট, অমৃতসর, উত্তরলাই, অবন্তিপুর, আম্বালা, আগ্রা, আগরতলা, জামনগর ও জোধপুর বিমানঘাঁটিতে আক্রমণ করে। পাকিস্তান কর্তৃক এ অপারেশনের নাম দেয়া হয় ‘অপারেশন চেঙ্গিস খান’। এ ব্যাপক আক্রমণের ফলে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী- সেদিনই পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। এর পরপর ভারতীয় মিত্রবাহিনী ও বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনী নিয়ে গঠিত হয় যৌথবাহিনী। ১৩ দিনের যুদ্ধ শেষে ঐ যৌথবাহিনীর নিকট পূর্ব বাংলায় মোতায়েনকৃত পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ৯৩ হাজার সৈন্য আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। এভাবে হানাদারমুক্ত হয়ে বিশ্বের বুকে অভ্যুদয় ঘটে নতুন রাষ্ট্র, স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সক্রিয়ভাবে যুক্ত হওয়ার নানাবিধ কারণ ছিল। ভারত বাংলাদেশের প্রতিবেশী রাষ্ট্র। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের রয়েছে তিনদিক থেকে পরিবেষ্টিত দীর্ঘ ভৌগোলিক সীমান্ত। দক্ষিণ-পূর্বে বঙ্গোপসাগর। পাকিস্তানি সামরিক জান্তা ১৯৭০ সালে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে বাঙালিদের বিজয়কে নস্যাৎ করতে কেবল ষড়যন্ত্রেরই আশ্রয় গ্রহণ করেনি, তারা ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ রাতে অপারেশন সার্চলাইট নামে বাঙালিদের ওপর নির্বিচার গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ, নারীর ওপর পাশবিক নির্যাতন, মানুষজনকে দেশত্যাগে বাধ্য করা ইত্যাদির মাধ্যমে এক তাণ্ডবলীলা চালায়। জীবনভয়ে ভীত, স্বজনহারা ও নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ দলে-দলে শরণার্থী হিসেবে ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করতে থাকে। মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাসে ভারতে আশ্রয় নেয়া বাঙালি শরণার্থীর সংখ্যা ছিল ১ কোটির মতো (মোট জনসংখ্যার প্রায় এক-সপ্তমাংশ)। এত বিপুল সংখ্যক শরণার্থী ভারতের বিশেষ করে সীমান্তবর্তী রাজ্যসমূহের সমাজ-রাজনীতি-অর্থনীতি ও আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির ওপর মারাত্মক বিরূপ প্রভাব ফেলে। অন্যদিকে শরণার্থীদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ ছিল হিন্দু সম্প্রদায়ভুক্ত। ধর্মনির্বিশেষে বাঙালিদের ওপর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী গণহত্যা পরিচালনার পাশাপাশি দেশের পূর্বাংশকে ‘হিন্দুমুক্ত করার’ বিশেষ নীতি গ্রহণ করেছিল বলে শরণার্থীদের ঐ ধর্ম পরিচয় দ্বারা তা প্রমাণিত। বর্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর এধরনের আচরণ হিন্দু প্রধান দেশ ভারতের জনগণের মধ্যে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। ৪৭ সালে দেশ বিভাগের সময় থেকেই পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে চরম বৈরী অবস্থা চলে আসছিল। ৭১-এর পূর্বে ১৯৪৮ ও ১৯৬৫ সালে দুবার রাষ্ট্র দুটি পরস্পরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। সার্বিক বিবেচনায় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রশ্নে ভারতের কোনো অবস্থায়ই নির্বিকার বা নির্লিপ্ত থাকার কোনো অবকাশ ছিল না।
তাই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধরত বাঙালিরা মুক্তিযুদ্ধ শুরুর ক্ষণ থেকেই ভারতকে বাংলাদেশের প্রধান মিত্র এবং সে দেশের সশস্ত্র বাহিনীকে মিত্রবাহিনী হিসেবে দেখে আসে। ভারতের অবস্থান ও ভূমিকাও ছিল অনুরূপ। বাঙালি শরণার্থীদের জন্য ভারত শুধু বাংলাদেশ সংলগ্ন রাজ্যসমূহের সীমান্তই খুলে দেয়নি, অসংখ্য শরণার্থী শিবির-এ তাদের আশ্রয় দান ও খাদ্যের ব্যবস্থা করেছে, মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য ১০ই এপ্রিল গঠিত মুজিবনগর সরকার নামে পরিচিত বাংলাদেশ সরকার-কে স্থান দিয়েছে, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র- স্থাপনের সুযোগ দিয়েছে, মুক্তিযুদ্ধে যোগদানে ইচ্ছুক তরুণদের জন্য অভ্যর্থনা কেন্দ্র ও যুবশিবির প্রতিষ্ঠার অনুমতি দিয়েছে, বাছাইকৃত তরুণদের যুদ্ধের ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করেছে, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের সে দেশের হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা দিয়েছে, নৌকমান্ডো বাহিনী ও বিমানবাহিনী গঠনে সক্রিয় সহায়তা দিয়েছে, বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের পক্ষে বিশ্ব জনমত গঠনে বিশিষ্ট ভূমিকা পালন করেছে ইত্যাদি|
মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকেই প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বাধীন ভারত সরকার বাংলাদেশের জনগণের মুক্তি সংগ্রামের প্রতি সর্বপ্রকার সহানুভূতি ব্যক্ত করে পাকিস্তানি সামরিক জান্তার উদ্দেশে উদ্ভূত সংকটের দ্রুত নিরসনে জনগণের নির্বাচিত মেজরিটি পার্টির নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর সঙ্গে রাজনৈতিক সমাধানের ওপর গুরুত্বারোপ করে পার্লামেন্টে প্রস্তাব গ্রহণ করে। একই প্রস্তাবে অবিলম্বে বাঙালিদের ওপর নির্বিচার গণহত্যা বন্ধ ও শরণার্থীরা যাতে নির্ভয়ে দেশে ফিরে যেতে পারে তার অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টির আহ্বান জানানো হয়।
মুক্তিযুদ্ধের একেবারে শুরুতে বাংলাদেশকে ৪টি সামরিক অঞ্চল, পরে ৬টি এবং আরো পরে ১১টি সেক্টরে ভাগ করে প্রত্যেকটি সেক্টর একজন কমান্ডারের অধীনে ন্যস্ত করা হয়। পুনরায় প্রত্যেকটি সেক্টর (১০ নম্বর ব্যতীত)-কে কয়েকটি সাব-সেক্টরে বিভক্ত করা হয়। এক পর্যায়ে ‘জেড’ ফোর্স, ‘এস’ ফোর্স ও ‘কে ‘ ফোর্স নামে ৩টি নিয়মিত ব্রিগেড গঠন করা হয় (দেখুন মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গন )। সীমিত আকারে হলেও যুদ্ধকালে নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনী প্রতিষ্ঠা লাভ করে। ২৯ হাজারের মতো নিয়মিত/পেশাদার বাহিনীর সদস্য এবং ১ লক্ষ ৫৭ হাজার গণবাহিনীর সদস্য মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে এম্বুশ, গেরিলা অপারেশন ও সম্মুখ যুদ্ধে ক্রমান্বয়ে বীরত্বের পরিচয় দিতে থাকেন। হাজার- হাজার তরুণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে মুক্তিযুদ্ধে যোগদানে এগিয়ে আসে। ভারতীয় বাহিনীর সহায়তায় সীমান্তবর্তী অনেক এলাকা যুদ্ধের ৯ মাস হানাদারদের দখল থেকে মুক্ত রাখা সম্ভব হয়।
এদিকে সামরিক ক্ষেত্রে ৩০শে এপ্রিল পর্যন্ত ভারতের সীমান্তবর্তী রাজ্যসমূহের বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স (বিএসএফ) বা সীমান্তরক্ষী বাহিনী মুক্তিবাহিনীকে সীমিত আকারে সহযোগিতা প্রদান করে। এরপর ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনী মুক্তিবাহিনীকে অস্ত্র ও গোলাবারুদ সরবরাহ এবং প্রশিক্ষণ প্রদান করতে থাকে। অপারেশন পরিচালনায় পরামর্শ ও প্রশিক্ষণ প্রদানের জন্য মুক্তিবাহিনীর ১০টি সেক্টরকে বিবেচনায় রেখে সীমান্তবর্তী এলাকায় ভারতীয় সেনাবাহিনীকে ৬টি সেক্টরে মোতায়েন করা হয়, যথা— ক. দক্ষিণ-পশ্চিম সেক্টর, খ. উত্তর-পশ্চিম সেক্টর, গ. উত্তর সেক্টর, ঘ. উত্তর-পূর্ব সেক্টর, ঙ. পূর্ব সেক্টর এবং চ. দক্ষিণ- পূর্ব সেক্টর।
এপ্রিল মাসের পর থেকে ভারতীয় ও পাকিস্তানি বাহিনীর মধ্যে সীমান্ত এলাকায় প্রায়শ সংঘর্ষ হয়। অক্টোবরের পর থেকে এ সংঘর্ষ ব্যাপক আকার ধারণ করে। ইতোমধ্যে উভয় দেশই যুদ্ধের পরিকল্পনা প্রস্তুত করেছিল। বিরাজমান পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে তারা সীমান্ত এলাকায় সেনা মোতায়েন শুরু করে। পাকিস্তানি বাহিনীর ক্রমাগত আক্রমণাত্মক কার্যক্রম এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের তীব্রতা বৃদ্ধির ফলে পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে দেখা দিলে আগস্টের শুরু থেকেই ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনী ‘অপারেশন ক্যাকটাস লিলি’র যুদ্ধ পরিকল্পনা প্রস্তুত করে।
পূর্বাঞ্চলে পাকিস্তানের সামরিক প্রস্তুতি: মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তানের ৪টি পদাতিক ব্রিগেডের (১৪টি ব্যাটালিয়ন) সমন্বয়ে ১টি ডিভিশন মোতায়েন ছিল। ১৭ই জানুয়ারি লারকানায় জেনারেল ইয়াহিয়া খান, পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও গোয়েন্দা বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, জুলফিকার আলি ভুট্টো ও তাঁর কয়েকজন রাজনৈতিক অনুসারীদের উপস্থিতিতে এক গোপন বৈঠকে বাঙালিদের সামরিক শক্তি প্রয়োগ করে দমন করার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ নৌ ও বিমানপথে বাংলাদেশে সশস্ত্র বাহিনী এনে নিজেদের শক্তি বৃদ্ধি করতে থাকে। পরবর্তীকালে ১৩টি ব্রিগেড ও ৩৫টি নিয়মিত পদাতিক ব্যাটালিয়ন, আর্টিলারি রেজিমেন্ট, মর্টার ব্যাটারি, ইঞ্জিনিয়ার রেজিমেন্ট ও অন্যান্য সহযোগী বাহিনীর সমন্বয়ে এ বাহিনীকে ৩টি পূর্ণ ও ২টি এডহক পদাতিক ডিভিশনে উন্নীত করা হয়। উপরন্তু তারা লক্ষাধিক প্যারামিলিটারি সদস্য নিয়োগ করে ইস্ট পাকিস্তান সিভিল আর্মড ফোর্সেস (ইপিসিএএফ), মুজাহিদ, রাজাকার -আলবদর, আলশামস- প্রভৃতি বাহিনী গঠন করে। তাছাড়া পাকিস্তান তাদের ইস্টার্ন কমান্ডে ১৯টি এফ-৮৬-ই স্যাবর জেট, ৩টি আরটি-৩৩ বিমান, কয়েকটি হালকা বিমান, পরিবহণ বিমান, ১৬টি হেলিকপ্টার ও বিপুল সংখ্যক গানবোটসহ ৪টি সমুদ্রগামী নৌ-জাহাজ জড়ো করে। পূর্বাঞ্চলে ভারতের সামরিক প্রস্তুতি: পাকিস্তানি বাহিনীকে প্রতিহত করতে আগস্ট থেকে নভেম্বরের মধ্যে ভারতীয় ফরমেশন ও ইউনিটগুলো কলকাতায় অবস্থিত ইস্টার্ন কমান্ড সদর দপ্তরের অধীনে জড়ো হতে থাকে। বিপুল সংখ্যক ফরমেশন সদর দপ্তর, ইউনিট ও সাব-ইউনিটকে অক্টোবরের প্রথম থেকে কৃষ্ণনগরে (নদিয়া, পশ্চিমবঙ্গ) স্থাপিত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নম্বর ২ কোর সদর দপ্তরে সংগঠিত করা হয়। তাছাড়া নম্বর ৪ কোরকে আসামের তেজপুর কেন্দ্রিক রিয়ার কোর সদর দপ্তর ও আগরতলার (ত্রিপুরা) নিকটবর্তী তেলিয়ামুড়া কেন্দ্রিক মূল কোর সদর দপ্তরে বিভক্ত করা হয়। চীনের দিক থেকে ভারতের সিকিম ও নর্থ-ইস্ট ফ্রন্ট এরিয়ার (এনইএফএ) প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা বজায় এবং নাগাল্যান্ড, মণিপুর ও মিজো পাহাড়ের বিদ্রোহ দমনে প্রয়োজনীয় সংখ্যক সৈন্য মোতায়েন রেখে বাংলাদেশে অবস্থানরত পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর মুখোমুখি হতে ভারতীয় সেনাবাহিনীকে নিম্নরূপভাবে সংগঠিত করা হয়-
ক. ভারতীয় সেনাবাহিনী
১. উত্তর-পশ্চিম সেক্টর (পদ্মার উত্তরাঞ্চল ও ব্রহ্মপুত্রের পশ্চিমাঞ্চল – দিনাজপুর, রংপুর, বগুড়া ও রাজশাহী): ৩৩ কোরের সঙ্গে ৬ মাউন্টেন ডিভিশন ও ২০ মাউন্টেন ডিভিশন এবং অধিভুক্ত সমস্ত ব্রিগেড ও রেজিমেন্ট; অধিনায়ক লে. জেনারেল এম এল থাপান;
২. দক্ষিণ-পূর্ব সেক্টর (মেঘনা নদীর পূর্বাঞ্চল জুড়ে – সিলেট, কুমিল্লা, নোয়াখালী ও চট্টগ্রাম): ৮ মাউন্টেন ডিভিশন, ৫৭ মাউন্টেন ডিভিশন এবং অধিভুক্ত ব্রিগেড ও রেজিমেন্টের সমন্বয়ে গঠিত ৪ কোর; অধিনায়ক লে. জেনারেল সগত সিং;
৩. দক্ষিণ-পশ্চিম সেক্টর (পদ্মার দক্ষিণ ও পশ্চিমাঞ্চল যশোর, কুষ্টিয়া, ফরিদপুর, বরিশাল, পটুয়াখালী ও খুলনা): ৪ মাউন্টেন ডিভিশন, ৯ পদাতিক ডিভিশন এবং অধিভুক্ত ব্রিগেড ও রেজিমেন্টের সমন্বয়ে গঠিত ২ কোর; অধিনায়ক লে. জেনারেল টি এন রায়না।
এসব বাহিনীর পাশাপাশি ইস্টার্ন কমান্ডের অধীনে অতিরিক্ত বাহিনী হিসেবে ছিল আসাম রাইফেলসের ১৪টি ব্যাটালিয়ন, টেরিটোরিয়াল আর্মির (টিএ) ৭টি ব্যাটালিয়ন, স্পেশাল ফোর্সের (এসএফ) ২৩টি ব্যাটালিয়ন, সেন্ট্রাল রিজার্ভ পুলিশ ফোর্সের (সিআরপিএফ) ৪টি ব্যাটালিয়ন ও আর্মড পুলিশের ৩টি ব্যাটালিয়ন।
খ. ভারতীয় নৌবাহিনী
নৌবাহিনীর জাহাজ বিক্রান্ত, খান্ডেরি (সাবমেরিন), কামোর্তা, ব্রহ্মপুত্র, বিয়াস, কভরত্তি, রাজপুত, মগর, ঘড়িয়াল, গুলদার ও দেশদ্বীপ সমন্বয়ে গঠিত ইস্টার্ন ফ্লিট; বঙ্গোপসাগরে মোতায়েন।
গ. ভারতীয় বিমানবাহিনী
ইস্টার্ন কমান্ডাধীনে দুই স্কোয়াড্রন হান্টার, দুই স্কোয়াড্রন মিগ, এক স্কোয়াড্রন এসইউ, এক স্কোয়াড্রন এমআই-৪ হেলিকপটার ও কিছু সংখ্যক পরিবহণ বিমান। তাছাড়া ইস্টার্ন এয়ার কমান্ডের অগ্রবর্তী সদর দপ্তর কলকাতায় গঠন করে সেখানে জয়েন্ট আর্মি এয়ার অপারেশন সেন্টার (জেএএওসি) স্থাপন।
ভারতীয় বাহিনীর পরিকল্পনা: ভারতীয় সেনাবাহিনীর সদর দপ্তর কর্তৃক অপারেশন আদেশ (নম্বর ৫৩, তারিখ ১৬ই আগস্ট) অনুযায়ী ভারতীয় বাহিনীর কর্মপরিকল্পনা ছিল নিম্নরূপ-
ক. চীনের সম্ভাব্য হামলা থেকে সিকিম এবং এনইএফএ- এর নিরাপত্তা বিধান;
খ. নাগাল্যান্ড, মণিপুর ও মিজো পাহাড়ে বিদ্রোহ নিয়ন্ত্রণ;
গ. প্রাথমিকভাবে পূর্ব রণাঙ্গনে অবস্থানরত পাকিস্তানি মূল বাহিনীকে ধ্বংস করা, চট্টগ্রাম ও চালনা সমুদ্রবন্দরসহ বাংলাদেশের একটি বড়ো অংশ দখল করা এবং সেখানে পাকিস্তানি বাহিনীর প্রবেশ প্রতিহত করা।
যুদ্ধ শুরুর পূর্বে ভারতীয় বাহিনীর ইস্টার্ন কমান্ড সদর দপ্তরে এ পরিকল্পনা নিয়ে বেশ কয়েকটি যুদ্ধের খেলা (war game) অনুষ্ঠিত হয়। পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে পরিচালিত বেশকিছু অপারেশনের অভিজ্ঞতা ও মুক্তিবাহিনীর কাছ থেকে প্রাপ্ত অসংখ্য তথ্যের ভিত্তিতে ভারতীয় বাহিনীর পরিকল্পনা পরিবর্তিত হয়। সুরক্ষিত পথ, গুরুত্বপূর্ণ শহর ও যোগাযোগ কেন্দ্র বিবেচনায় রেখে তাঁদের পরিকল্পনা ছিল নিম্নরূপ-
ক. পূর্বে প্রদত্ত ৩৩ কোরের দায়িত্বে কিছুটা পরিবর্তন করে রংপুর ও দিনাজপুরকে নিয়ন্ত্রণে রাখা; পীরগঞ্জ হয়ে গাইবান্ধা ও বগুড়া শহর দখল করা এবং পদ্মা নদীর সীমানা পর্যন্ত নিজেদের অবস্থান সুদৃঢ় করা;
খ. ১০১ কমিউনিকেশন জোনের দায়িত্ব ছিল ময়মনসিংহকে বিচ্ছিন্ন ও হুমকির মধ্যে রেখে কামালপুর-জামালপুরের রুট ধরে ঢাকায় আক্রমণের পথ সুগম করা;
গ. ৪ কোরকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল চাঁদপুর ও দাউদকান্দি দখল করা; কুমিল্লা ও লালমাই পাহাড় নিয়ন্ত্রণে রাখা; ফেনীকে বিচ্ছিন্ন করা এবং শমসেরনগর ও মৌলভীবাজার দখল করা;
ঘ. ২ কোরের ওপর দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছিল যশোর শহর দখলের পাশাপাশি কোটচাঁদপুর এলাকা হয়ে ঝিনাইদহ ও মাগুরা দখল করা; মধুমতি ও পদ্মা নদীর ফরিদপুর ও গোয়ালন্দ ঘাট এলাকা দখল করে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।
২. কোরের অপারেশন পরিকল্পনা: ৪ মাউন্টেন ডিভিশন ও ৯ পদাতিক ডিভিশনের সমন্বয়ে গঠিত ছিল ভারতীয় বাহিনীর ২ কোর। এর চূড়ান্ত দল বিন্যাস ছিল নিম্নরূপ-
ক. ২ কোর: অধিনায়ক লে. জেনারেল টি এন রায়না;
খ. ৪ মাউন্টেন ডিভিশন সদর দপ্তর: অধিনায়ক মেজর জেনারেল এম এস বারার
১. ৭ মাউন্টেন ব্রিগেড সদর দপ্তর (অধিনায়ক ব্রিগেডিয়ার জেইল সিং)-এর সঙ্গে ২২ রাজপুত রেজিমেন্ট, ৫ জাট রেজিমেন্ট ও নাগা রেজিমেন্ট;
২. ৪১ মাউন্টেন ব্রিগেড সদর দপ্তর (অধিনায়ক ব্রিগেডিয়ার এ এইচ ই মিশিগান)-এর সঙ্গে ৫ গার্ডস রেজিমেন্ট, ৯ ডোগরা রেজিমেন্ট ও ৫/১ গোর্খা রাইফেলস;
৩. ৬২ মাউন্টেন ব্রিগেড সদর দপ্তর (অধিনায়ক ব্রিগেডিয়ার রাজেন্দর নাথ)-এর সঙ্গে ৫ মারাঠা লাইট ইনফ্যান্ট্রি, 8 শিখ লাইট ইনফ্যান্ট্রি ও ২/৯ গোর্খা রাইফেলস
৪. আর্মার: ৪৫ ক্যাভালরির ১টি স্কোয়াড্রন;
৫. আর্টিলারি: ৪ মাউন্টেন আর্টিলারি ব্রিগেড সদর দপ্তর (অধিনায়ক ব্রিগেডিয়ার বলজিৎ সিং)-এর সঙ্গে ২২ মাউন্টেন রেজিমেন্ট (৭৬ মিমি), ১৯৪ মাউন্টেন রেজিমেন্ট (৭৬ মিমি), ৭ ফিল্ড রেজিমেন্ট (২৫ পিআর), ১৮১ লাইট রেজিমেন্ট (প্যাক) (১২০ টেম্পিল্লা) ও ব্যাটারি ৭৮ মিডিয়াম রেজিমেন্ট (১৩০ মিমি);
৬ . ইঞ্জিনিয়ার: ৬৩ ইঞ্জিনিয়ার রেজিমেন্ট।
গ. ৯ পদাতিক ডিভিশন সদর দপ্তর: অধিনায়ক মেজর জেনারেল দলবীর সিং
১. ৩২ পদাতিক ব্রিগেড সদর দপ্তর (অধিনায়ক ব্রিগেডিয়ার কে কে তিওয়ারি)-এর সঙ্গে ৭ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট, ৮ মাদ্রাজ রেজিমেন্ট ও ১৩ ডোগরা রেজিমেন্ট;
২. ৪২ পদাতিক ব্রিগেড সদর দপ্তর (অধিনায়ক ব্রিগেডিয়ার জে এস ঘরায়া, ৮ ডিসেম্বর থেকে ব্রিগেডিয়ার কে এল কোচার)-এর সঙ্গে ১৪ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট, ১৯ মারাঠা লাইট ইনফ্যান্ট্রি ও ২ শিখ লাইট ইনফ্যান্ট্রি;
৩. ৩৫০ পদাতিক ব্রিগেড সদর দপ্তর (অধিনায়ক ব্রিগেডিয়ার এইচ এস সান্ধু)-এর সঙ্গে ২৬ মাদ্রাজ রেজিমেন্ট, ৪ শিখ লাইট ইনফ্যান্ট্রি ও ১ জম্মু এন্ড কাশ্মীর রাইফেলস;
৪. আর্মার: ৪৫ ক্যাভালরি (১ স্কোয়াড্রন ব্যতীত) ও ৬৩ ক্যাভালরির ১টি স্কোয়াড্রন।
ঘ. মুক্তিবাহিনী: ৮ ও ৯ নম্বর সেক্টরের সেনাসদস্য।
৩৩ কোরের অপারেশন পরিকল্পনা: উত্তর-পশ্চিম সেক্টরে ভারতীয় বাহিনীর ৩৩ কোরকে নিম্নরূপভাবে মোতায়েন করা হয়-
সদর দপ্তর শিলিগুড়ি (অধিনায়ক লে. জেনারেল এম এল থাপান)-এর সঙ্গে ৭১ মাউন্টেন ব্রিগেড সদর দপ্তর (অধিনায়ক ব্রিগেডিয়ার পি এন কাথপালিয়া) :
১. ২০ মাউন্টেন ডিভিশন সদর দপ্তর বালুরঘাট (অধিনায়ক
মেজর জেনারেল লছমন সিং লেহেল)-এর সঙ্গে ২০২ মাউন্টেন ব্রিগেড সদর দপ্তর (অধিনায়ক ব্রিগেডিয়ার এফ ভাট্টি), ১৬৫ মাউন্টেন ব্রিগেড সদর দপ্তর (অধিনায়ক ব্রিগেডিয়ার আর এস পান্নু), ৬৬ মাউন্টেন ব্রিগেড সদর দপ্তর (অধিনায়ক ব্রিগেডিয়ার জি এস শর্মা) ও ৩৪০ মাউন্টেন ব্রিগেড সদর দপ্তর গ্রুপ (অধিনায়ক ব্রিগেডিয়ার জে এস বকশি);
২. ৬ মাউন্টেন ডিভিশন সদর দপ্তর বিনাগুরি (সীমিত ব্যবহারের জন্য; অধিনায়ক মেজর জেনারেল পি সি রেড্ডি) ও ৯ মাউন্টেন ব্রিগেড সদর দপ্তর (অধিনায়ক ব্রিগেডিয়ার টি এস ভার্মা)-এর সঙ্গে দুটি ব্যাটালিয়ন।
৩৩ কোরের অধীনে নিম্নবর্ণিত সহায়তাকারী অংশ নিয়েছিল:
ক. পিটি-৭৬ ট্যাংকের ১টি রেজিমেন্ট, টি-৫৫ ট্যাংকের ১টি রেজিমেন্ট (১ স্কোয়াড্রন ব্যতীত) ও পিটি-৭৬ ট্যাংকের ১টি এডহক স্কোয়াড্রন;
খ. ১টি এপিসি ব্যাটালিয়ন (এসকেওটি);
গ. বিএসএফ-এর ৭টি ব্যাটালিয়ন (২ কোম্পানি ব্যতীত);
ঘ. ১টি ইঞ্জিনিয়ার ব্রিগেড ও ১টি ইঞ্জিনিয়ার রেজিমেন্ট;
ঙ. মুক্তিবাহিনীর ৬ ও ৭ নম্বর সেক্টরের সেনাসদস্য। ৪ কোরের অপারেশন পরিকল্পনা
ক. পার্বত্য চট্টগ্রামের বিপরীতে অবস্থিত আসামের বদরপুর, ত্রিপুরা সীমান্তের উত্তর ও মিজোরামের দক্ষিণের ভারতীয় ভূখণ্ড রক্ষার জন্য প্রতিরক্ষার দায়িত্ব মোতাবেক ৪ কোরকে মেঘনা নদীর পূর্বাঞ্চলে অবস্থানরত পাকিস্তানি বাহিনীকে ধ্বংস করে কুমিল্লা, চাঁদপুর, ফেনী ও চট্টগ্রাম দখল করার নির্দেশ দান। ভারতীয় বাহিনীর মূল উদ্দেশ্য ছিল মেঘনা নদী দ্রুত অতিক্রম করে কুমিল্লা-লালমাই এলাকায় পাকিস্তানি বাহিনীকে ভারসাম্যহীন ও বিচ্ছিন্ন করে রাখা। এ কাজ সম্পন্ন করতে ভারতীয় বাহিনীর ৪ কোরের পরিকল্পনা ছিল ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় পাকিস্তানি ব্রিগেডকে বাধা প্রদানের জন্য প্রথমে আখাউড়া দখল করা, সড়ক পথের যোগাযোগ নিশ্চিত করতে লালমাই পাহাড়ের দক্ষিণ অংশ দখল করা, পাকিস্তানি
৫৩ পদাতিক ব্রিগেডকে ফেনী ও রামগড়ে ব্যস্ত রাখা, ময়নামতিতে ১১৭ পদাতিক ব্রিগেডকে নিয়ন্ত্রণে রাখা, অতঃপর চাঁদপুর ও দাউদকান্দি নদীবন্দর দখলের জন্য অগ্রসর হওয়া এবং মৌলভীবাজার শহর, শেরপুর ও সাদিপুর ফেরি দখল করে সিলেটকে বিচ্ছিন্ন করা। এসব কার্যক্রম সম্পন্ন করতে ৩টি মাউন্টেন ডিভিশনকে পৃথক-পৃথক দায়িত্ব প্রদান করে মোতায়েন করা হয়।
খ. পাকিস্তানি বাহিনীকে প্রতিহত করতে ভারতীয় সেনাবাহিনীর ৪ কোরের মোতায়েন ছিল নিম্নরূপ-
১. ৪ কোর সদর দপ্তর আগরতলার নিকটবর্তী তেলিয়ামুড়া (অধিনায়ক লে. জেনারেল সগত সিং)-এর সঙ্গে আর্টিলারি, ইঞ্জিনিয়ার, সিগন্যাল, আর্মি সার্ভিস কোর (এএসসি), মেডিক্যাল, অর্ডন্যান্স, ইলেক্ট্রিক্যাল এন্ড মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার (ইএমই) ইত্যাদির অংশবিশেষ;
২. বদরপুর-করিমগঞ্জ-ধর্মনগর এলাকায় ৮ মাউন্টেন ডিভিশন সদর দপ্তর (অধিনায়ক মেজর জেনারেল কৃষ্ণ রাও)-
ক. ৫৯ মাউন্টেন ব্রিগেড সদর দপ্তর (অধিনায়ক ব্রিগেডিয়ার কুইন)-এর সঙ্গে ৪/৫ গোর্খা রাইফেলস (এফএফ), ৯ গার্ডস রেজিমেন্ট ও ৬ রাজপুত রেজিমেন্ট;
খ. ৮১ মাউন্টেন ব্রিগেড সদর দপ্তর (অধিনায়ক ব্রিগেডিয়ার আপটে)-এর সঙ্গে ৩ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট, ৪ কুমাউন রেজিমেন্ট ও ১০ মাহার রেজিমেন্ট
৩. ৮ মাউন্টেন ডিভিশনের অধীনে – বিএসএফ-এর ৮৪
ব্যাটালিয়ন, ৮৬ ব্যাটালিয়ন, ৮৭ ব্যাটালিয়ন (২ কোম্পানি ব্যতীত), ৯৩ ব্যাটালিয়ন ও ১০৪ ব্যাটালিয়ন (২ কোম্পানি ব্যতীত);
৪. কমলপুর-ময়নামতি এলাকায় ২৩ মাউন্টেন ডিভিশন সদর দপ্তর (অধিনায়ক মেজর জেনারেল আর ডি হীরা)- ক. ৮৩ মাউন্টেন ব্রিগেড সদর দপ্তর (অধিনায়ক ব্রিগেডিয়ার বি এস সান্ধু)-এর সঙ্গে ২ রাজপুত রেজিমেন্ট, ৩ ডোগরা রেজিমেন্ট ও ৮ বিহার রেজিমেন্ট;
খ. ১৮১ মাউন্টেন ব্রিগেড সদর দপ্তর (অধিনায়ক ব্রিগেডিয়ার ওয়াই পি বকশি)-এর সঙ্গে ৬ জাট রেজিমেন্ট, ৯ কুমাউন রেজিমেন্ট ও ১৪ কুমাউন রেজিমেন্ট
গ. ৩০১ মাউন্টেন ব্রিগেড সদর দপ্তর (অধিনায়ক ব্রিগেডিয়ার এইচ এস সোধি)-এর সঙ্গে ১৪ জাট রেজিমেন্ট, ৩ কুমাউন রেজিমেন্ট ও ১/১১ গোর্খা রাইফেলস।
৫. ২৩ মাউন্টেন ডিভিশনের অধীনে বিএসএফ-এর ৯০ ব্যাটালিয়ন (কোম্পানি), ২ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট (ইবিআর) ও ৯ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এবং মুক্তিফৌজের ৪টি কোম্পানি;
৬. ৫৭ মাউন্টেন ডিভিশন সদর দপ্তর ত্রিপুরা-মিজো পাহাড় (অধিনায়ক মেজর জেনারেল গঞ্জালভেজ)—
ক. ৬১ মাউন্টেন ব্রিগেড সদর দপ্তর (অধিনায়ক ব্রিগেডিয়ার কে পি টম পাণ্ডে)-এর সঙ্গে ২ জাট রেজিমেন্ট, ৭ রাজপুতনা রাইফেলস ও ১২ কুমাউন রেজিমেন্ট; খ. ৭৩ মাউন্টেন ব্রিগেড সদর দপ্তর (অধিনায়ক ব্রিগেডিয়ার তুলি)-এর সঙ্গে ১৪ গার্ডস রেজিমেন্ট, ১৯ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট ও ১৯ রাজপুতনা রাইফেলস;
গ. ৩১১ মাউন্টেন ব্রিগেড সদর দপ্তর (অধিনায়ক ব্রিগেডিয়ার আর এন মিশ্রা)-এর সঙ্গে ৪ গার্ডস রেজিমেন্ট, ১৮ রাজপুতনা রাইফেলস ও ১০ বিহার রেজিমেন্ট।
৭. সদর দপ্তর ৫৭ মাউন্টেন ডিভিশনের অধীনে বিএসএফ- এর ৯০ ব্যাটালিয়ন (কোম্পানি), ৯১ ব্যাটালিয়ন ও ১০৪ ব্যাটালিয়ন (দুই কোম্পানি);
৮. ইয়াঙ্কি ফোর্স হিসেবে ৩১ জাট রেজিমেন্ট, ৩২ মাহার রেজিমেন্ট (১ কোম্পানি ব্যতীত), বিএসএফ-এর ৯২ ব্যাটালিয়ন ও ৩৮ সেন্ট্রাল রিজার্ভ পুলিশ ফোর্স (সিআরপিএফ);
৯. মুক্তিবাহিনীর সেনাসদস্য
ক. ১ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ৩ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও ৮ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সমন্বয়ে গঠিত পদাতিক ব্রিগেড (জেড ফোর্স);
খ. ২ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও ৪ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সমন্বয়ে গঠিত পদাতিক ব্রিগেড (কে ফোর্স);
গ. ৯ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও ১০ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সমন্বয়ে গঠিত পদাতিক ব্রিগেড (এস
ফোর্স);
ঘ. ১, ২, ৩, ৪ ও ৫ নম্বর সেক্টরের সেনাসদস্য;
ঙ. আর্টিলারি ব্যাটারি (১ ফিল্ড মুজিব ব্যাটারি-);
চ. আর্টিলারি ব্যাটারি (২ ফিল্ড ব্যাটারি)।
১০১ কমিউনিকেশন জোন এরিয়ার অপারেশন ১০১ কমিউনিকেশন জোন এরিয়া ছিল একটি সম্মিলিত বাহিনী, বিভিন্ন ফরমেশন ও ইউনিট থেকে এনে মেঘালয় রাজ্যের তুরায় এডহক ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠা করা হয়। অপারেশন চলাকালীন এর সৈন্য সংখ্যা ও সংস্থানের শক্তি প্রায় দ্বিগুণ করা হয়।
ক. ৪ঠা ডিসেম্বর ভারতীয় বাহিনীর ১০১ কমিউনিকেশন জোন এরিয়া সদর দপ্তর (তুরায় অবস্থিত; অধিনায়ক মেজর জেনারেল জি এস গিল)-এর দলবিন্যাস ছিল নিম্নরূপ- ১. ৯৫ মাউন্টেন ব্রিগেড সদর দপ্তর (তুরা; অধিনায়ক ব্রিগেডিয়ার এইচ এস ক্লের)-এর সঙ্গে ৫৬ মাউন্টেন রেজিমেন্ট, ৮৫২ লাইট ব্যাটারি, ১৩ গার্ডস রেজিমেন্ট, ১ মারাঠা লাইট ইনফ্যান্ট্রি, ১৩ রাজপুতনা রাইফেলস ও ৯৪ ফিল্ড কোম্পানি;
২. এফ জে সেক্টর (তুরা; অধিনায়ক ব্রিগেডিয়ার সান্ত সিং মহাবীরচক্র)-এর সঙ্গে ৮৫১ লাইট ব্যাটারি, ৬ বিহার রেজিমেন্ট, বিএসএফ ৮৩-এর ব্যাটালিয়ন, ২ প্যারা ব্যাটালিয়ন ও মুক্তিবাহিনীর ১১ নম্বর সেক্টরের সেনাসদস্য।
যুদ্ধের সময় এ জোনের ফরমেশনকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল আক্রমণ অভিযান পরিচালনা করে বাংলাদেশের টাঙ্গাইল ও ময়মনসিংহ জেলায় অবস্থানরত পাকিস্তানি বাহিনীকে ধ্বংস করা, সে-সঙ্গে যোগাযোগ রেখার (এলওসি) দায়িত্ব ও প্রতিরক্ষামূলক ভূমিকা পালন করা।
খ. তুরা থেকে বাংলাদেশে অগ্রসর হওয়ার জন্য ৯৫ মাউন্টেন ব্রিগেডের নির্ধারিত সময়সূচি ছিল নিম্নরূপ-
১. ডি প্লাস ২-এর মধ্যে কামালপুর দখল করা;
২. ডি প্লাস ৩-এর মধ্যে বকশীগঞ্জ দখল করা;
৩. ডি প্লাস ৬/৭-এর মধ্যে জামালপুর দখল করা;
৪. ডি প্লাস ৭-এর মধ্যে টাঙ্গাইলের উত্তরে ২ প্যারা ব্যাটালিয়ন কর্তৃক ছত্রীসেনা অবতরণ ও পুংলী সেতুর নিরাপত্তা প্রদান করা;
৫. ডি প্লাস ৮-এর মধ্যে টাঙ্গাইল দখল করা;
৬. ডি প্লাস ১২/১৩-এর মধ্যে ঢাকার প্রতিরক্ষা বলয়ে আঘাত হানা।
গ. এফ জে সেক্টরের ময়মনসিংহ এলাকায় শত্রু অবস্থানে প্রবেশের পরিকল্পনা ছিল নিম্নরূপ-
১. ৬ বিহার রেজিমেন্ট গ্রুপের ডালু রাজো-হালুয়াঘাট- ফুলপুর-ময়মনসিংহ অক্ষে অভিযান পরিচালনা করা;
২. বিএসএফ-এর ৮৩ ব্যাটালিয়ন (৪ কোম্পানি ব্যতীত)- এর বাঘমারা-দুর্গাপুর-জারিয়া ঝাঞ্জাইল-ময়মনসিংহ অক্ষে অভিযান পরিচালনা করা।
ছত্রীসেনা অবতরণ: টাঙ্গাইল এলাকায় বিমান আক্রমণের জন্য ভারতীয় পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের পক্ষ থেকে ২ প্যারা ব্যাটালিয়নকে পূর্বেই প্রস্তুত রাখা হয়েছিল। উদ্দেশ্য ছিল, জামালপুর ও ময়মনসিংহ থেকে পাকিস্তানি বাহিনী পশ্চাদপসরণ করে ঢাকায় যাতে শক্তি বৃদ্ধি করতে না পারে এজন্য তাদের পথরোধ ও সেতু ধ্বংস করে জামালপুর- টাঙ্গাইল-ঢাকা সড়কে অবস্থিত পুংলী সেতু ও পুংলী সেতুর পূর্ব পাশে লৌহজং নদীর ফেরি এলাকা দখল করা। ১১ই ডিসেম্বর বিকেল ৫ ঘটিকার দিকে ২ প্যারা ব্যাটালিয়নের ৭৫০ জন সৈন্য তাঁদের যানবাহন ও রসদসামগ্রী নিয়ে টাঙ্গাইলের উত্তরে পুংলী সেতুর কাছে অবতরণ করেন। এর পরপর ১৪ জন ছত্রীসেনা গোলাবারুদ নিয়ে একই এলাকায় অবতরণ করেন। কয়েকজন ছত্রীসেনা পলায়নরত পাকিস্তানি সৈন্যদের নিকটবর্তী স্থানে অবতরণ করলে উভয় পক্ষের মধ্যে গোলাগুলিতে তাঁদের কয়েকজন হতাহত হন। ছত্রীসেনা অবতরণ সম্পন্ন হওয়ার পর ২ প্যারা ব্যাটালিয়ন (‘ডি’ কোম্পানি ব্যতীত) আক্রমণ করে পুংলী সেতু দখল করে নেয়।
মার্কিনী প্রচেষ্টা: বাংলাদেশ প্রশ্নে ৩রা ডিসেম্বর ভারত ও পাকিস্তান পরস্পরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হলে এবং দ্রুত পাকিস্তানি বাহিনীর পরাজয় অনিবার্য হয়ে উঠলে পাকিস্তানের সমর্থনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিক্সন প্রশাসন প্রথমে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে একাধিক যুদ্ধ বিরতি প্রস্তাব উত্থাপন করে এবং তা নিষ্ফল হলে পরবর্তী পদক্ষেপ হিসেবে বঙ্গোপসাগরে ৭ম নৌবহর প্রেরণের নির্দেশ দেয়। এর বিপরীতে ভারত/বাংলাদেশের সমর্থনে পূর্ব থেকে সেখানে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের ৬ষ্ঠ নৌবহর অবস্থান করছিল। ভারতের উত্তরাঞ্চলের দিক থেকে চীনের আক্রমণ বা মার্কিনী হস্তক্ষেপ পাকিস্তানের পক্ষে এর কোনোটিই কাজ করেনি। সবই শুধু স্বপ্ন থেকে যায়। নিক্সন প্রশাসন যতটুকু এগিয়ে এসেছে, তা ছিল মূলত বাহ্যিক, অর্থবোধক তেমন কিছু নয়।
ঢাকায় আত্মসমর্পণ বাংলাদেশে পাকিস্তানি বাহিনীর সামরিক পরিস্থিতির খুব দ্রুত অবনতি হচ্ছিল। যুদ্ধ পরিস্থিতির ওপর সামরিক অধিনায়করা তাদের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। যুদ্ধের শুরুতেই উপর্যুপরি ভারতীয় বিমান আক্রমণে পাকিস্তান তার আকাশ শক্তি সম্পূর্ণ হারিয়ে ফলে। নৌশক্তির অবস্থাও দাঁড়ায় অনুরূপ। ভারতীয় বাহিনীর অগ্রযাত্রা ও তাদের মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ পাকিস্তানি বাহিনীকে সম্পূর্ণ অসহায় করে দেয়। একের পর এক শহর ও তাদের ঘাঁটির পতন ঘটতে থাকে, যেমন ৩রা ডিসেম্বর দিনাজপুরের ঠাকুরগাঁ, সিলেটের শমসের নগর, ৪ঠা ডিসেম্বর ময়মনসিংহের কামালপুর, ৫ই ডিসেম্বর বকশীগঞ্জ, ৬ই ডিসেম্বর আখাউড়া, ফেনী, যশোর, মাগুরা, ঝিনাইদহ, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, ৭ই ডিসেম্বর গাইবান্ধা, হালুয়াঘাট, সাতক্ষীরা, গোপালগঞ্জ, নোয়াখালী, পীরগঞ্জ, শেরপুর, ৮ই ডিসেম্বর মৌলভীবাজার, কুমিল্লা, চাঁদপুর, বরিশাল, পটুয়াখালী, ৯ই ডিসেম্বর দাউদকান্দি, ১০ই ডিসেম্বর সিলেটের গোয়াইনঘাট, ময়মনসিংহ, জামালপুর, ১১ই ডিসেম্বর লাকসাম, টাঙ্গাইল, কুষ্টিয়া, ১২ই ডিসেম্বর নরসিংদী, গাজীপুরের কালিয়াকৈর, গোবিন্ধগঞ্জ, ১৩ই ডিসেম্বর বগুড়া, চট্টগ্রামের হাটহাজারী, ১৪ই ডিসেম্বর সিরাজগঞ্জ, নীলফামারী প্রভৃতি।
এমনি অবস্থায় ৯ই ডিসেম্বর পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ডা. এ এম মালিক জরুরি ভিত্তিতে যুদ্ধবিরতির আবশ্যকতা তুলে ধরে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে এক বার্তা পাঠায়। ইয়াহিয়া খান বিষয়টি গভর্নর ও ইস্টার্ন কমান্ডের কমান্ডার লে. জেনারেল নিয়াজীর ওপর ছেড়ে দেয়। ১৪ই ডিসেম্বর গভর্নর ডা. এ এম মালিক তার সরকারের সদস্য, উচ্চপদস্থ সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তাদের নিয়ে গভর্নর হাউজ (বর্তমান বঙ্গভবন)-এ উচ্চ পর্যায়ের এক বৈঠক চলাকালে সেখানে ভারতীয় বিমান থেকে হামলা চালানো হয়। সঙ্গে-সঙ্গে সভা পণ্ড হয়ে যায়। ভীত-সন্ত্রস্ত ডা. মালিক তৎক্ষণাৎ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের উদ্দেশে পদত্যাগপত্র লিখে তার সরকারের সকল সদস্য ও বেসামরিক কর্মকর্তাদের নিয়ে রেডক্রস কর্তৃক ঘোষিত নিরপেক্ষ জোন হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে গিয়ে আশ্রয় নেয়।
১৪ই ডিসেম্বর ২ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট উত্তরদিক দিয়ে শীতলক্ষ্যা নদী অতিক্রম করে রূপগঞ্জকে শত্রুমুক্ত করে। ১৫ই ডিসেম্বর ৪ কোরের সৈন্যদল, ৭৩ মাউন্টেন ব্রিগেডের ১৯ রাজপুতানা রাইফেলস পুবাইলকে মুক্ত করে। ভারতীয় সেনাবাহিনীর কমপক্ষে ৫টি ব্রিগেড ঢাকাকে ঘিরে পশ্চিম, উত্তর, পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব দিক দিয়ে আক্রমণের জন্য প্রস্তুত থাকে। ১৫ই ডিসেম্বর বিকেল ৫টা থেকে পরবর্তী দিন সকাল ১০টা পর্যন্ত যুদ্ধ বিরতিতে ভারত ও পাকিস্তান উভয় পক্ষ সম্মত হয়। এদিকে ভারতীয় মানেক শ’র পক্ষ থেকে পাকিস্তানের ইস্টার্ন কমান্ডের ওপর আত্মসমর্পণের জন্য ক্রমাগত চাপ অব্যাহত রাখা হয়। ১৬ই ডিসেম্বর ১০১ কমিউনিকেশন জোনের ১ মারাঠা রেজিমেন্ট ও ১৩ রাজপুতানা রাইফেলস উত্তরে টঙ্গী হয়ে ঢাকার উপকণ্ঠে পৌঁছে। একই দিন খুব ভোরে মেজর জেনারেল নাগরার নেতৃত্বে ভারতীয় কমান্ডো বাহিনী ঢাকার প্রবেশ পথ মিরপুর ব্রিজের অপর পাড়ে এসে উপস্থিত হয়। তিনি নিয়াজীর উদ্দেশে এক টুকরো চিরকুটে লেখেন, ‘প্রিয় আবদুল্লাহ, আমি মিরপুর ব্রিজের কাছে আছি। তুমি তোমার প্রতিনিধি পাঠাও। একই সময় বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বাধীন মুক্তিবাহিনীর একটি বড় অংশ এবং ২ নম্বর সেক্টরের শতশত গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা চারদিক দিয়ে ঢাকায় প্রবেশ করেন। এমনি পরিস্থিতিতে পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণ করা ছাড়া আর কোনো বিকল্প ছিল না। ১৬ই ডিসেম্বর বিকেল ৪টায় (ভারতীয় সময় ৪:৩০টা) ভারতীয় ইস্টার্ন কমান্ডের কমান্ডার ও যৌথবাহিনীর প্রধান লে. জেনারেল অরোরার হাতে পাকিস্তানি ইস্টার্ন কমান্ডের কমান্ডার লে. জেনারেল নিয়াজী তার ব্যাজ ও অন্যান্য সামগ্রী এবং কোমরের রিভলভার তুলে দিয়ে ৯৩ হাজার পাকিস্তানি সৈন্য নিয়ে আত্মসমর্পণ করে (দ্রষ্টব্য পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণ)। আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে মুক্তিবাহিনীর ডেপুটি চিফ অব স্টাফ গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ কে খন্দকার উপস্থিত ছিলেন।
কিছু সংখ্যক পাকিস্তানি দুর্গ, যথা সিলেট, চট্টগ্রাম, ময়নামতি, ফরিদপুর, খুলনা, রংপুর, সৈয়দপুর, রাজশাহী, দিনাজপুর, পাবনা ইত্যাদি তখন পর্যন্ত পাকিস্তানিদের পক্ষে ধরে রাখা সম্ভব হয়েছিল, যদিও পাকিস্তানি সৈন্যরা সেখানে অবরুদ্ধ অবস্থায় ছিল। ঢাকায় পশ্চাদপসরণ অথবা অন্যত্র পালিয়ে যাওয়ার মতো কোনো অবস্থা তাদের ছিল না। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর পূর্ববঙ্গে অবস্থানরত পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর সদস্যদের মনোবল বহুলাংশে ভেঙ্গে পড়েছিল। মাসের পর মাস নারীনির্যাতনের মতো গণহত্যা, লুটপাট ও পৈশাচিক ঘটনায় জড়িত থাকায় তাদের অনেকেই যুদ্ধ করার মনোবল হারিয়ে ফেলে। ১৬ই ডিসেম্বর ভারতীয় ইস্টার্ন কমান্ডের কমান্ডার দিনাজপুর, চট্টগ্রাম, কুমিল্লার ময়নামতি, ১৭ই ডিসেম্বর রংপুর, সিলেট, ফরিদপুর, খুলনা, ১৮ই ডিসেম্বর বগুড়া, সৈয়দপুর, পাবনা, রাজশাহীর পতন ঘটে এবং সেখানকার পাকিস্তানি বাহিনী যৌথবাহিনীর নিকট আত্মসমর্পণ করে।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালে বিশ্বজুড়ে বিরাজ করছিল স্নায়ুযুদ্ধকালীন পরিস্থিতি। বাঙালির এ মুক্তিযুদ্ধ ন্যায় সঙ্গত, গণতান্ত্রিক ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত ও এর সঙ্গে একটি জাতি- জনগোষ্ঠীর আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের প্রশ্ন সরাসরি যুক্ত থাকা সত্ত্বেও, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীন এর বিরুদ্ধে পাকিস্তানের পক্ষ অবলম্বন করে। প্রতিপক্ষ পাকিস্তানি বাহিনী বিশ্বের একটি সেরা যোদ্ধা জাতি হিসেবে স্বীকৃত ছিল। আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত প্রচুর সংখ্যক সৈন্যের সমাবেশ ঘটিয়ে তারা বাংলাদেশের সকল শহর ও কৌশলগত স্থানসমূহে শক্তিশালী ঘাঁটি গেড়ে বসেছিল। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার পূর্বে ভারতকে এসকল বিষয় বিবেচনায় নিতে হয়। তাই ভারত যেসব কৌশলের আশ্রয় গ্রহণ করে, তার মধ্যে পাকিস্তানি বাহিনীর বাঙালিদের ওপর নির্বিচার গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ ও নারীদের ওপর পাশবিক নির্যাতনের পাশাপাশি বিপুল সংখ্যক বাঙালি শরণার্থীর বিষয়টি সম্মুখে এনে বিশ্বজনমতের সহানুভূতি অর্জনের প্রচেষ্টা, চীনের সম্ভাব্য আক্রমণ মোকাবেলায় শীত মৌসুম পর্যন্ত অপেক্ষা (হিমালয় যখন প্রচণ্ড বরফাচ্ছন্ন থাকে), মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মোকাবেলায় ৯ই আগস্ট সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে পারস্পরিক নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট ‘মৈত্রী চুক্তি’ সম্পাদন, পাকিস্তানিদের প্রতিরক্ষাব্যূহ যথাসম্ভব এড়িয়ে ভিন্ন পথে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন লক্ষ্যস্থলের দিকে অগ্রসর হওয়া, অস্ত্র ও জনবলের ক্ষতি যত সীমিত রাখা যায় সে লক্ষ্যে সরাসরি যুদ্ধ এড়িয়ে চতুর্দিক থেকে পাকিস্তানি ঘাঁটি ঘিরে রেখে তাদেরকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করা, ন্যূনতম সময়ের মধ্যে পাকিস্তানিদের পরাজয় নিশ্চিত করতে চতুর্দিক থেকে ঢাকা অভিমুখে অগ্রসর হওয়া ইত্যাদি।
উল্লিখিত সতর্কতামূলক অবস্থা গ্রহণ করা সত্ত্বেও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় মিত্রবাহিনীর অনেক সদস্যকে প্রাণ দিতে হয়েছে এবং বেশকিছু যুদ্ধ সরঞ্জাম ক্ষতিগ্রস্ত বা হারাতে হয়েছে। এর মধ্যে খুলনার শিরমণি যুদ্ধ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এখানে পাকিস্তানি সেনারা প্রতি ১৫-২০ গজ অন্তর বাঙ্কার তৈরি এবং বিপুল সংখ্যক অস্ত্র ও সৈন্যের সমাবেশ ঘটিয়ে এক দুর্ভেদ্য প্রতিরক্ষাব্যূহ গড়ে তোলে। ১৩ই ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত এখানকার প্রথম যুদ্ধে মিত্রবাহিনীর ট্যাংকসহ ২৬টি যুদ্ধযান এবং মেজর জ্ঞানীসহ প্রায় ২শ ৫০ জন সেনা শহীদ হন। ১৪ই ডিসেম্বর চট্টগ্রামের কুমিরা দখল যুদ্ধে মিত্রবাহিনীর প্রায় ৫০ জন সৈন্য শহীদ হন। ২৫শে নভেম্বর সিলেটের রাধানগরে অপর একটি ভয়াবহ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। লে. কর্নেল রাও-এর নেতৃত্বে ১২ জন অফিসার ও ৪শ গুর্খা সৈন্যের একটি ব্যাটালিয়ন এখানে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। মিত্রবাহিনীর জন্য এ-যুদ্ধ ছিল খুবই বিপর্যয়কর। ৮ জন অফিসার ও ৫৭ জন গুর্খা সৈন্য এখানে শহীদ এবং শতাধিক সৈন্য আহত হন। এছাড়া ময়মনসিংহের জামালপুর, সিলেটের জকিগঞ্জসহ দেশের অন্যত্রও পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে মিত্রবাহিনীর বেশকিছু সেনাসদস্য হতাহত হয়।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য ভারতের সাহায্য-সহযোগিতা ছিল একান্ত অপরিহার্য। এক পর্যায়ে ভারতীয় মিত্রবাহিনী সরাসরি যুদ্ধে লিপ্ত না হলে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ আর যাই হোক তা যে প্রলম্বিত হতো, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বাংলাদেশকে পাকিস্তানি দখলদারমুক্ত তথা স্বাধীন করতে ৩০ লক্ষ বাঙালিকে যেমন জীবন দিতে হয়েছে, অনুরূপভাবে ভারতীয় মিত্রবাহিনীর অনেক সদস্যকেও প্রাণ বিসর্জন দিতে এবং ক্ষয়-ক্ষতির শিকার হতে হয়েছে। উভয় দেশের মাটিতে রয়েছে বাঙালি মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্রবাহিনীর সৈন্যদের রক্ত ও সমাধি। রক্তের আখরে লেখা দুটি প্রতিবেশী রাষ্ট্রের মৈত্রীর বন্ধন। তবে মুক্তিযুদ্ধে শাহাদাতবরণকারী ভারতীয় মিত্রবাহিনীর শহীদদের স্মরণে এখন পর্যন্ত কোনো স্মৃতিসৌধ নির্মিত হয়নি। [কাজী সাজ্জাদ আলী জহির ও হারুন-অর-রশিদ]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৮ম খণ্ড