মুক্তিযুদ্ধে বৃহৎ শক্তির ভূমিকা
ভৌগোলিক নিরিখে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ছিল সীমিত পরিসরের। কারণ, যুদ্ধটি হয়েছিল ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের একটি ভূখণ্ডে। কিন্তু বিশ্ব পরিসরে যুদ্ধটির প্রভাব ছড়িয়ে পড়েছিল, যাতে সম্পৃক্ত হয়েছিল চারটি বড় শক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন, গণপ্রজাতন্ত্রী চীন এবং যুক্তরাজ্য। ফলে ছোট এ-যুদ্ধের প্রভাব বৈশ্বিকভাবে অনুভূত হয়েছিল। তবে সাধারণভাবে এসব শক্তির দক্ষিণ এশিয়ায় এবং বিশেষ করে বাংলাদেশে ভূ-রাজনৈতিক এবং ভূ-অর্থনৈতিক স্বার্থ ছিল।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশবিরোধী ও পাকিস্তানপন্থী নীতি অনুসরণ করে। এ নীতির চারটি সুনির্দিষ্ট নির্ধারক ছিল। প্রথমত, ১৯৫০-এর দশক থেকে পাকিস্তান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ মিত্র ছিল। ১৯৭১-এ এ সম্পর্ক অন্যরকম হবার কোনো কারণ ছিল না। দ্বিতীয়ত, পাকিস্তান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যপ্রাচ্য নীতির নির্ভরযোগ্য মিত্র ছিল। তৃতীয়ত, ৭১-এ চীন-মার্কিন বন্ধুত্বের সম্পর্ক তৈরিতে যে গোপন কূটনৈতিক প্রক্রিয়া সূচিত হয়েছিল, তার মাধ্যম ছিল পাকিস্তান। কারণ পাকিস্তান উভয় রাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ মিত্র ছিল। সুতরাং প্রক্রিয়াটি চলমান থাকা অবস্থায় আকস্মিক বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ যেন এ ক্ষেত্রে একটি অনাকাঙ্ক্ষিত ঝামেলার মতো মনে হয়েছিল। চতুর্থত, মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সন ব্যক্তিগতভাবে কিছুটা ভারতবিদ্বেষী ছিলেন। এর পেছনে অবশ্য ব্যক্তিগত কারণও ছিল। ১৯৬৯-এ যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট থাকাকালে তিনি দক্ষিণ এশিয়া সফরে আসেন। পাকিস্তানে সৌজন্য ও আতিথেয়তার আড়ম্বর থাকলেও ভারতে তা ছিল ম্রিয়মাণ। অর্থাৎ ভারতে নিক্সন সাদরে গৃহীত হননি। সে-কারণে ভারতের প্রতি তার মধ্যে জন্ম নিয়েছিল এক ধরনের অনীহা। প্রশ্ন হলো, নীতিনির্ধারণে প্রাতিষ্ঠানিক প্রক্রিয়ার বাইরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একজন প্রেসিডেন্টের ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দ কতটুকু প্রভাব ফেলতে পারে? প্রশ্নের যৌক্তিকতা সত্ত্বেও এটা অনস্বীকার্য যে, মুক্তিযুদ্ধের সময় নিক্সন প্রশাসন ভারতীয় স্বার্থের প্রতিকূলে এবং পাকিস্তানি স্বার্থের অনকূলে কাজ করেছে। সুতরাং নিক্সনের ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দ ও তার প্রভাবকে একেবারে উড়িয়ে দেয়া যায় না।
মার্কিননীতির তিনটি পর্যায় ছিল। প্রথমত, জুলাই পর্যন্ত দৃশ্যমান ছিল কৌশলগত নিরপেক্ষতা। এ-সময় একাধারে রাজনৈতিক সমাধানের ওপর গুরুত্বারোপ করা এবং ভারতে আশ্রিত শরণার্থীদের জন্য সাহায্য চলমান ছিল। দ্বিতীয়ত, জুলাই থেকে ডিসেম্বর মাসের মধ্যবর্তী সময়ে ওয়াশিংটনের নীতি ছিল সম্পূর্ণ পাকিস্তানপন্থী। কিন্তু তবুও লক্ষ্য ছিল যেন পূর্ণ যুদ্ধ না বেঁধে যায়। উল্লেখ্য, এ পর্যায়ে ওয়াশিংটনের পরিপূর্ণ দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিল চীনের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের পিং-পং কূটনীতির ওপর। ফলে দক্ষিণ এশীয় নীতি হয়ে পড়ে অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ। ফল যা হবার তা-ই হয়; দক্ষিণ এশিয়ায় কূটনৈতিক ব্যর্থতা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ইতিহাস হয়ে থাকে। তৃতীয়ত, মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে ৩-১৬ই ডিসেম্বরের পাক-ভারত যুদ্ধের সময় ওয়াশিংটনের নীতি ছিল প্রকাশ্যে পাকিস্তানের প্রতি ঝুঁকে পড়ার, যা অভিহিত হয়েছে ‘policy of tilt’ হিসেবে। যুদ্ধ-প্রান্তিকে যখন পাকিস্তানের পরাজয় অনিবার্য হয়ে ওঠে, তখন মিত্র পাকিস্তানের শেষ রক্ষায় ওয়াশিংটন যেন মরণ কামড় দেয়। প্রথমত, পারমাণবিক শক্তিসম্পন্ন সপ্তম নৌবহরের একাংশকে বঙ্গোপসাগরের দিকে পাঠিয়ে দেয়া হয় (যার সাঙ্কেতিক নাম ছিল টাস্ক ফোর্স-৭৪)। উদ্দেশ্য ছিল, ভারতকে ভীত-সন্ত্রস্ত করা। দ্বিতীয় উদ্যোগ ছিল, নিরাপত্তা পরিষদে একটি অস্ত্রবিরতি প্রস্তাব গ্রহণ করা। কিন্তু উভয় পদক্ষেপই ব্যর্থ হয়। প্রথমটি ব্যর্থ হয় কারণ মার্কিন নৌবহরের মুখোমুখি অবস্থান নেয় সোভিয়েত ভূমধ্যসাগর বহর, যা পারমাণবিক শক্তিধর ছিল। অর্থাৎ দুই পরা নৌবহরের মধ্যে একটি অনিবার্য পারমাণবিক সংঘাতের আশঙ্কা তৈরি হয়েছিল, যদিও শেষমেশ তা হয়নি। তবে ওয়াশিংটন তার অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জন করতে পারেনি। দ্বিতীয় উদ্যোগেরও পরিণতি অভিন্ন হয়। কারণ সোভিয়েত ভেটোর ফলে নিরাপত্তা পরিষদে মার্কিন প্রস্তাব নাকচ হয়ে যায়। বলা বাহুল্য, উভয় ক্ষেত্রেই সোভিয়েত ইউনিয়ন সুদৃঢ় অবস্থান নিয়ে ওয়াশিংটনের নীতিকে সম্পূর্ণ ব্যর্থ করে দেয়। অবশ্য সরকারের বৈরী ভূমিকা সত্ত্বেও মার্কিন জনগণ, বিশেষ করে বহুসংখ্যক রাজনীতিবিদ, সিনেট সদস্য, কংগ্রেসম্যান, বুদ্ধিজীবী এবং গণমাধ্যম বাংলাদেশের পক্ষে জোরালো অবস্থান গ্রহণ করে। রাজনীতিবিদদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখ্য ছিলেন সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডী, যিনি প্রকাশ্যেই সরকারি নীতির কট্টর সমালোচক ছিলেন।
নিকট অতীতে জনসম্মুখে উন্মোচিত ৭১-সংক্রান্ত কিছু মার্কিন দলিলের ভিত্তিতে বোঝা যায় যে, শুরু থেকেই নীতিনির্ধারকদের অনুমান ছিল পাকিস্তানের নিশ্চিত বিপর্যয় সম্পর্কে। এমনকি ৬ই মার্চ সিনিয়র রিভিউ গ্রুপের (এসআরজি) এক সভায় ড. হেনরী কিসিঞ্জারকে অবহিত করা হয় যে, পাকিস্তানের যে পরিমাণ সৈন্য পূর্ব পাকিস্তানে মোতায়েন রয়েছে, তাতে পূর্ব পাকিস্তানের বৈরী সাড়ে সাত কোটি মানুষের সঙ্গে রক্তক্ষয়ী সংঘাত অনিবার্য এবং এর ফলে পূর্ব পাকিস্তানের ওপর পশ্চিম পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার কোনো আশা নেই। শুরু থেকেই এমন ধারণা থেকে থাকলে ওয়াশিংটনের আগাগোড়া পাকিস্তানপন্থী নীতির ব্যাখ্যা কী? ব্যাখ্যাটি পাওয়া যাবে চীন-নীতির মধ্যে। ওয়াশিংটনের প্রথম ও প্রধান লক্ষ্য ছিল চীনের সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপন করা এবং যতক্ষণ তা না হচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত দক্ষিণ এশিয়ায় যেন স্থিতাবস্থা বজায় থাকে। চূড়ান্ত পর্যায়ে দেখা যায়, চীনের সঙ্গে নতুন সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ঠিকই; কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ এশীয় কূটনীতি মুখ থুবড়ে পড়েছিল। আসলে ওয়াশিংটন দুটি করণীয়ের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছিল।
সোভিয়েত ইউনিয়ন
সোভিয়েত নীতির প্রধান নির্ধারক ছিল পাকিস্তানের তীব্র ভারতবিরোধিতা ও অতিমাত্রায় চীনের ওপর নির্ভরতাজনিত কারণে এক ধরনের বিরক্ত মানসিকতা। উল্লেখ্য, ভারত ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের ঘনিষ্ঠ মিত্র, আর চীন শত্রু। ১৯৭০- এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ-এর নিরঙ্কুশ বিজয়ের ফলে মস্কোর ধারণা ছিল যে, নতুন সরকারের অধীনে মস্কো- ইসলামাবাদ সম্পর্ক উন্নত হবে। কিন্তু পাকিস্তানি সামরিক আগ্রাসন সব হিসেব-নিকেশ ভণ্ডুল করে দেয়। এমন পরিস্থিতিতে উপায়ান্তর না দেখে মস্কোকে বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের প্রতি সহানুভূতিশীল হতে হয়েছিল। অন্যদিকে মস্কো উদ্বিগ্ন ছিল যে, মুক্তিযুদ্ধ প্রলম্বিত হলে মিত্র রাষ্ট্র ভারতের জন্য সৃষ্ট পরিস্থিতি হুমকির কারণ হবে। সুতরাং মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে মস্কোর নীতি ছিল দ্রুত রাজনৈতিক সমাধানের লক্ষ্যে পাকিস্তানের ওপর চাপ অব্যাহত রাখা। মস্কোর ধারণা ছিল, রাজনৈতিক সমাধান হলে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যেতে পারবে; আর এতে মস্কোর আগের হিসেব ঠিক থাকবে।
এপ্রিল থেকে জুলাইয়ের মধ্যে সোভিয়েত নীতিকে সতর্ক ও কিছুটা দুকূল রক্ষাকারী বলা যায়। ৩০শে মার্চ কমিউনিস্ট পার্টির ২৪তম কংগ্রেসে ব্রেজনেভ যা বলেছিলেন, তা থেকে মুক্তিযুদ্ধের প্রতি সোভিয়েত নীতির আভাস পাওয়া যায়। তিনি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্য থেকে সব সঙ্কটের সমাধানের আহ্বান জানিয়েছিলেন। তিনি উল্লেখ করেছিলেন, সমাধানের ভিত্তি হবে রাষ্ট্রের বৈধ অধিকার এবং আগ্রাসনের শিকার মানুষের মুক্তি। তিনি অবশ্য এমন সব সমাধানে জাতিসংঘ-প্রক্রিয়ার পরিপূর্ণ সদ্ব্যবহারের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। উপরন্তু, তাঁর আবেদন ছিল, যেন হুমকি ও শক্তি প্রয়োগ ব্যতিরেকে বিরাজমান সব সঙ্কটের সমাধান আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে স্বীকৃত হয়।
তবে, শুরু থেকেই এটা প্রতীয়মান হয়েছিল যে, পাকিস্তানের ভাঙ্গন মস্কোর খুব একটা কাঙ্ক্ষিত ছিল বলে মনে হয় না। কারণ, এমন একটি ধারণা ছিল যে, পাকিস্তানের ভাঙ্গন মানে যুদ্ধবিধ্বস্ত ও দুর্বল বাংলাদেশের অভ্যুদয়। সুতরাং ২রা এপ্রিল এক চিঠিতে সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট পদগর্নী ইয়াহিয়া খানকে আহ্বান জানান রক্তপাত বন্ধ করে দ্রুত রাজনৈতিক সমাধান খুঁজে বের করার জন্য। লক্ষণীয়, চিঠিটিতে ‘বাংলাদেশ” শব্দটি উল্লেখ না করে বলা হয়েছিল ‘পূর্ব পাকিস্তান’; আরো উল্লেখ করা হয়েছিল ‘পাকিস্তানের আমজনতা’। জুন মাসে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং সফরে গিয়ে মস্কোতে সোভিয়েত নেতৃবৃন্দকে অনুরোধ করেছিলেন, বাংলাদেশের পক্ষে স্পষ্ট অবস্থান ঘোষণা করার; কিন্তু তদ্রূপ কাজ হয়নি। মস্কো তার মধ্যপন্থী অবস্থান ধরে থাকে একটি সময় পর্যন্ত|
জুলাই থেকে ডিসেম্বর সময়কে সোভিয়েত নীতির দ্বিতীয় পর্যায় হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। এ পর্যায়ে লক্ষণীয় ছিল। মস্কোর বাংলাদেশের কাছাকাছি সরে আসা। অবশ্য তাও সতর্কতার সঙ্গে। তবে এটা ঠিক যে, ৯ই আগস্ট ভারত- সোভিয়েত মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষরিত হবার পর মস্কোর অবস্থান ও নীতিতে দৃশ্যমান পরিবর্তন সূচিত হয়।
সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বরের মধ্যে সোভিয়েত নীতিতে তিনটি দৃশ্যমান বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়েছিল। এক, মস্কো ভারতের সঙ্গে একমত হয়েছিল যে, বাংলাদেশ সঙ্কটে জাতিসংঘের করণীয় কিছু নেই। দুই, মস্কোর আকাঙ্ক্ষা ছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সোভিয়েত আদর্শের অনুসারী হোক। তিন, মস্কো ওয়াশিংটনের সঙ্গে একমত ছিল যে, দক্ষিণ এশিয়ায় একটি পূর্ণাঙ্গ ও বড় যুদ্ধ কাঙ্ক্ষিত নয়।
কিন্তু যুদ্ধ এড়ানো সম্ভব হয়নি। ভারতীয় পশ্চিম সীমান্তে পাকিস্তানের আকাশ-যুদ্ধের কারণে ৩রা ডিসেম্বর দুদেশের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়, যা ১৬ই ডিসেম্বর ঢাকার পতন পর্যন্ত চলমান থাকে। এ-সময়ে মস্কোর ভূমিকা ছিল পাকিস্তানের শেষ রক্ষায় ওয়াশিংটনের দুটি (যা ওপরে উল্লেখ করা হয়েছে) উদ্যোগকে নস্যাৎ করা। উল্লেখ্য, মস্কো নিরাপত্তা পরিষদে ৬ ও ৭ই ডিসেম্বর পরপর দুটি প্রস্তাব উন্থাপন করে বাংলাদেশ সংকটের রাজনৈতিক সমাধানের লক্ষ্যে, কিন্তু তা নকচ হয়ে যায়। কাজেই এটা বলা সমীচীন হবে যে, সোভিয়েত নীতি কখনই খোলামেলাভাবে পাকিস্তানবিরোধী বা বাংলাদেশপন্থী ছিল না। পরাশক্তি হিসেবে সোভিয়েত ইউনিয়ন দায়িত্বশীল অবস্থান নিয়েছিল, যদিও সোভিয়েত নীতির ‘টিল্ট’ ছিল ভারত/বাংলাদেশের পক্ষে। সামগ্রিক বিচারে সোভিয়েত নীতি ও অবস্থান বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পক্ষে সহায়ক হয়েছিল; আর সে কারণেই সাধারণ্যে প্রচলিত ধারণা যে, দেশটি বরাবরই বাংলাদেশের পক্ষে ছিল।
চীন
চৈনিক নীতির দুটি মোটা দাগের বৈশিষ্ট্য ছিল। প্রথমত, চীন সুচিন্তিতভাবে বাংলাদেশকে সমর্থন করা থেকে বিরত ছিল। দ্বিতীয়ত, পাকিস্তানের সামরিক শাসনের প্রতি তার ছিল শর্তহীন অকুণ্ঠ সমর্থন। চীনের ঘনিষ্ঠ মিত্র হিসেবে বিবেচিত মওলানা ভাসানীর উপর্যুপরি বার্তায় সমর্থন প্রত্যাশায় অনুরোধ জানানো সত্ত্বেও চীনের এমন নীতিতে কোনো পরিবর্তন দৃশ্যমান হয়নি। কালিক প্রেক্ষাপটে চীনের নীতিতে দুটি পর্যায় ছিল। ৩রা ডিসেম্বর পর্যন্ত চীনের নীতি ছিল মার্কিন নীতির অনুরূপ। অবশ্য চীন তার কর্মকাণ্ডে বাংলাদেশবিরোধী হলেও, বক্তব্য-মন্তব্যে কোনো বাঙালিবিরোধী উপাদান ছিল না। কিন্তু ৩রা থেকে ১৬ই ডিসেম্বরের মধ্যে বেইজিং কথা ও কাজে তুমুলভাবে বাংলাদেশবিরোধী অবস্থান নেয়। যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে গুজব ছিল, চীন পাকিস্তানের পক্ষে সামরিক সহায়তা দেবে, কিন্তু তেমন কিছু ঘটেনি এবং পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে তা ঘটাও সম্ভব ছিল না।
আসলে বাংলাদেশ প্রশ্নে চীনের বেশ অন্তর্দ্বন্দ্ব্ব ছিল। একদিকে সমাজতান্ত্রিক আদর্শ অনুযায়ী বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন দেয়া নৈতিক দায়িত্ব ছিল। অন্যদিকে চীনের জাতীয় ও কৌশলগত স্বার্থ ছিল, যা মুক্তিযুদ্ধের প্রতি নৈতিক সমর্থন দেয়ার পথে ছিল বাধা। বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে জাতীয় স্বার্থ-সংক্রান্ত বিবেচনার কাছে নীতি-আদর্শের তাগিদ বড় হয় না।
চৈনিক নীতি বিশ্লেষণে দুটি উৎস প্রাসঙ্গিক। প্রথমটি ১১ই এপ্রিলের সরকারি মুখপত্র দ্য পিপল্স ডেইলি। পত্রিকাটিতে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করার জন্য মস্কোকে অভিযুক্ত করা হয়। দ্বিতীয় উৎস ছিল, ইয়াহিয়ার কাছে চৌ এন-লাই-এর ১৩ই এপ্রিলের চিঠি, যাতে পাকিস্তানের ‘জাতীয় স্বাধীনতা’ ও ‘রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব’ সুরক্ষার প্রশ্নে চীনের সমর্থন ব্যক্ত করা হয়।
পেছন ফিরে তাকিয়ে পর্যবেক্ষণ করলে চীনের নীতির অন্তত পাঁচটি নির্ধারক উল্লেখ করা যায়। প্রথমত, চীন নিজেই একটি বহুজাতিক রাষ্ট্র এবং সে-কারণে অন্য একটি বহুজাতিক রাষ্ট্রে কোনো বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগ্রামকে সে সমর্থন দিতে পারে না (উল্লেখ্য, চীন মুক্তিযুদ্ধকে বাঙালির ‘বিচ্ছিনতাবাদী’ প্রয়াস হিসেবে অভিহিত করেছিল)। দ্বিতীয়ত, চীনের দৃষ্টিতে মুক্তিযুদ্ধ কোনো স্বতঃস্ফূর্ত সংগ্রাম ছিল না; সেটি ছিল ভারত- সোভিয়েত প্ররোচিত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে এক হীন চক্রান্ত। তৃতীয়ত, চীনের দৃষ্টিতে মুক্তিযুদ্ধ ছিল বাঙালি বুর্জোয়াদের একটি যুদ্ধ, যা শ্রমিক- –কৃষকের ভাগ্য ফেরাবে না। চতুর্থত, মুক্তিযোদ্ধারা যে মাও-সে-তুং-এর লালবই দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিল এমন কোনো প্রমাণ চীনের কাছে ছিল না। কাজেই এমন একটি যুদ্ধকে সমর্থন করার প্রশ্নই ওঠে না। পঞ্চমত, মুজিবনগর সরকার- ছিল ভারতের মাটিতে এবং তার ওপর ভারতের বড় রকমের প্রভাব ছিল। সুতরাং বেইজিং ধারণা করেছিল, বাংলাদেশ শেষমেশ ভারত-সোভিয়েতের একটি তাঁবেদার রাষ্ট্রে পরিণত হবে। দক্ষিণ সীমান্তে এমন একটি রাষ্ট্র তার নিরাপত্তার জন্য ঝুঁকি হবে এমন চিন্তায় বেইজিংকে পেয়ে বসেছিল।
ব্রিটেন
শুরুতে ব্রিটেন বাংলাদেশকে সমর্থন বা বিরোধিতা কোনোটিই করেনি এবং যে নীতির বহিঃপ্রকাশ ক্রমান্বয়ে হয়েছিল তাকে বলা যায় সতর্ক নিরপেক্ষতা। এতদ্সত্ত্বেও প্রথম থেকেই বাঙালিদের প্রতি এক ধরনের সহানুভূতি ছিল, যা আগস্টের মধ্যে আরো স্পষ্ট রূপ পায়। তবে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত মৌলনীতি অপরিবর্তিত ছিল। শ্রমিক দলের পার্লামেন্ট সদস্য এবং মুক্তিযুদ্ধের খোলাখুলি সমর্থক গণমাধ্যমের চাপেও সরকার তার নীতি থেকে এক চুলও নড়েনি। এর একমাত্র ও প্রধান নির্ধারক ছিল, যে-কোনো পরিস্থিতিতে দক্ষিণ-এশিয়ায় ব্রিটিশ স্বার্থ রক্ষা করা। ফলে, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের শ্যেন দৃষ্টি ছিল দক্ষিণ এশিয়ার ঘটনাবলির আবর্তন-বিবর্তনের ওপর। ব্রিটিশ কূটনীতি কোনো সময়েই কোনো পরিস্থিতিতেই হার মানতে রাজি থাকেনি। ব্রিটেনের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে এটা ছিল যেন এক বাস্তববাদী কূটনীতি।
২৯শে মার্চ পররাষ্ট্র ও কমনওয়েলথ বিষয়ক মন্ত্রী এ্যালেক ডগলাস-হিউম এক বিবৃতিতে বাংলাদেশ সঙ্কটকে ‘পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার’ হিসেবে অভিহিত করেন। অবশ্য ‘পূর্ব পাকিস্তানে জীবননাশের’ ঘটনায় তিনি দুঃখ প্রকাশ করেন। উপরন্তু, তিনি পাকিস্তানের রাজনৈতিক বিষয় সম্পর্কে মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকেন। তবে ব্রিটিশ নীতির সারাৎসার তুলে ধরে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের একজন কর্মকর্তা বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে বলেছিলেন, “ব্রিটিশ সরকার বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে সমর্থন বা বিরোধিতা কোনোটিই করে না।’
সব মত ও পথের ৩০০ সংসদ সদস্যের চাপে পড়ে ব্রিটেনের কমন্সসভা ১৪ই মে একটি পূর্ণাঙ্গ অধিবেশন আহ্বান করে। সব সদস্যই দাবি করেন যে, পূর্ব পাকিস্তানে রক্তপাত বন্ধ করার জন্য সরকার ইসলামাবাদের ওপর চাপ প্রায়োগ করুক। তবে তাঁদের মধ্যে শ্রমিক দলের সংসদ সদস্য ব্রুস ডগলাস-ম্যান বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে একটি প্রস্তাব উত্থাপন করেছিলেন। সর্বসম্মত চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে উল্লেখ করা হয় যে, সরকার ‘রাজনৈতিক সমাধানের’ জন্য প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখবে।
আগস্টের মধ্যে সরকার মনে করে যে, যুদ্ধ অনিবার্য হলে ব্রিটিশ স্বার্থ রক্ষার তাগিদে ভারত ও বাংলাদেশের মতো বিজয়ী পক্ষকে সমর্থন জানানো উচিত, তবে তাও আবার বেশ সতর্কতার সঙ্গে। নীতির বৈশিষ্ট্যগত মাত্রায় পরিবর্তন স্পষ্ট হয় ২৭শে আগস্ট, যখন অভিবাসী বাঙালিদের অনুমতি দেয়া হয় লন্ডনে বাংলাদেশ হাইকমিশন প্রতিষ্ঠার এবং তা পাকিস্তানের প্রতিবাদ সত্ত্বেও। নীতিতে দৃশ্যমান পরিববর্তন সত্ত্বেও নির্ধারক থাকল অপরিবর্তিত।
অবশ্য অক্টোবর পর্যন্ত ব্রিটিশ নীতির বৈশিষ্ট্য ছিল ‘সংযম ও সমঝোতা’ এবং তা দক্ষিণ এশিয়ায় সুদূর প্রসারী স্বার্থ রক্ষার জন্য। এমনকি পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধ শুরু হবার পরদিন ৪ঠা ডিসেম্বর ব্রিটেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উত্থাপিত নিরাপত্তা পরিষদের একটি প্রস্তাবের ওপর ভোটদানে বিরত থাকে। উদ্দেশ্য ছিল, ব্রিটেনের পক্ষপাতহীন অবস্থান বজায় রাখা। অবশ্য যুদ্ধে পাকিস্তানের অবমাননাকর পরাজয়ের পর বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানি বন্দিদশা থেকে মুক্ত হলে তাঁকে রাষ্ট্র প্রধানের মর্যাদায় আতিথেয়তা দেয়া প্রথম রাষ্ট্র ছিল ব্রিটেন।
সরকার দোটানায় বা বাংলাদেশের পক্ষে প্রকাশ্য অবস্থান নিতে না পারলেও ব্রিটেনের গণমাধ্যম বাংলাদেশের পক্ষে জোরালো ভূমিকা পালন করেছিল। দ্য টাইম্স, দ্য সানডে টাইম্স, দ্য গার্ডিয়ান, দ্য সানডে অবজার্ভার, দ্য ডেইলী মিরর, দ্য ডেইলী টেলিগ্রাফ, দ্য ডেইলী মেইল ও বিবিসি- গণহত্যার খবর সারাবিশ্বে ছড়িয়ে দিয়েছিল এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে বাংলাদেশের পাশে দাঁড়ানোর জন্য অনুপ্রাণিত করেছিল।
উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, নানাবিধ বাচনিকতা সত্ত্বেও বাংলাদেশের পক্ষে-বিপক্ষে বৃহৎ শক্তিবর্গের যে নীতি ছিল তার ভিত্তি কোনো আদর্শ নয়, বরং তাদের কৌশলগত স্বার্থ। ব্রিটেনের অবস্থান ছিল ভিন্নতর। বড় তিন শক্তির ক্ষমতার দ্বন্দ্বে বৃটেনের কোনো অংশগ্রহণ বা পক্ষাবলম্বন ছিল না; তার একমাত্র লক্ষ্য ছিল, নিজের স্বার্থ উদ্ধারে অবিচল থাকা, যার জন্য দেশটি মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সচেষ্ট ছিল এবং সফলও হয়। [সৈয়দ আনোয়ার হোসেন]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৮ম খণ্ড