You dont have javascript enabled! Please enable it!

মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ব্যক্তি, দল ও সংগঠন

১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস পাকিস্তানি দখলদার সশস্ত্র বাহিনী বাংলাদেশের শহর-নগর ও গ্রাম-গঞ্জে জাতি-সম্প্রদায়-গোষ্ঠী ও দল-মত নির্বিশেষে গণহত্যা, লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগ, নির্যাতন ও ধর্ষণের পাশাপাশি মানবতাবিরোধী সব ধরনের অপরাধ সংঘটিত করে। এ সময় ধর্ম ও ইসলাম রক্ষার দোহাই দিয়ে উল্লিখিত জঘন্য অপরাধ সংঘটনে জামায়াতে ইসলামী, মুসলিম লীগের অংশ, নেজামে ইসলামী ও পাকিস্তান ডেমোক্রাটিক পার্টি (পিডিপি) এবং তাদের নেতা ও কর্মীবৃন্দ সামিল হয়। পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী ও তাদের দোসররা মিলে গঠন করে তথাকথিত শান্তি কমিটি, রাজাকার, আলবদর, আলশামস-সহ নানা নামের সশস্ত্র বেসামরিক বাহিনী। এ অপশক্তি মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী আওয়ামী লীগ ও এতে অংশগ্রহণকারী অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী, মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক ও সংখ্যালঘুদের হানাদারদের চিনিয়ে দেয়, নিজেরা হত্যা করে, তাদের বাড়িঘরে হামলা ও অগ্নিসংযোগ করে, সারাদেশে বুদ্ধিজীবী নিধনে মুখ্য ভূমিকা নেয়, হানাদার বাহিনীর নির্বিচার গণহত্যাকে সমর্থন ও সেক্ষেত্রে সহযোগিতা করে। অবরুদ্ধ বাংলাদেশের নারীদের ‘গনিমতের মাল’ হিসেবে চিহ্নিত করে তাদের ওপর পাশবিক নির্যাতন চালানোকে জায়েজ করার অপচেষ্টা করে। তারা মুক্তিযোদ্ধাদের ‘ভারতীয় দালাল’ হিসেবে চিহ্নিত করে অনেককে হত্যা বা ধরিয়ে দেয়। অবরুদ্ধ বাংলাদেশের ‘পরিস্থিতি স্বাভাবিক’ বলে দেশে-বিদেশে প্রচারণা চালায়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে ‘বিচ্ছিন্নতাবাদ’ হিসেবে আখ্যায়িত করে পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর হত্যাযজ্ঞকে বৈধতা দেয়ার অপচেষ্টা চালায়। এসবের ফলে সরকারি হিসেবে মহান মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লক্ষ নর-নারী শহীদ হন, ২ লক্ষ (বেসরকারি হিসেবে প্রায় ৫ লক্ষ) মা-বোন পাশবিক নির্যাতনের শিকার হন, অগ্নিসংযোগের ফলে লক্ষলক্ষ ঘরবাড়ি পুড়ে ভস্মীভূত হয়, লাখলাখ মানুষ নির্যাতিত হন, শরণার্থী হিসেবে দেশান্তরিত হয়ে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতে প্রায় ১ কোটি মানুষ আশ্রয় নেয় এবং তখনকার সাড়ে সাত কোটি জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেকাংশ অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তুতে পরিণত হয়। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকজনকে জোর করে ধর্মান্তরিত করা হয়। এর বিপরীতে রাজধানী ঢাকা-সহ বাংলাদেশের প্রতিটি জেলা ও মহকুমা শহর, থানা, গঞ্জ, বন্দর, এমনকি গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে মুক্তিসংগ্রাম ছড়িয়ে পড়ে এবং নারী-পুরুষ, কৃষক, বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ, ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে সর্বস্তরের বাঙালির প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ সত্যিকার জনযুদ্ধ-এ রূপ নেয়।
পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর প্রতি শুরু থেকেই এ দেশীয় যেসব শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তি সর্বপ্রকার সাহায্য-সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়, তাদের মধ্যে জামায়াতে ইসলামীর গোলাম আযম, আব্বাস আলী খান, মওলানা আব্দুস সোবহান, ইসলামী ছাত্র সংঘের মতিউর রহমান নিজামি, আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ, কামারুজ্জামান, মীর কাশেম আলী, এ টি এম আজহারুল ইসলাম, আব্দুল কাদের মোল্লা, নেজামে ইসলামী/পিডিপি-র মৌলভী ফরিদ আহমেদ, কাউন্সিল মুসলিম লীগের খাজা খয়েরউদ্দিন, কনভেনশন মুসলিম লীগের ফজলুল কাদের চৌধুরী, কাইয়ুম মুসলিম লীগের খান এ সবুর, পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টির নুরুল আমিন, মুসলিম লীগের শাহ আজিজুর রহমান, আবদুল আলীম, ফজলুল কাদের চৌধুরীর পুত্র সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী, চাকমা রাজা ত্রিদিব রায়, জমিয়তে মোদার্রেসিন-এর মওলানা আব্দুল মান্নান প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। এদের মধ্যে সিনিয়র নেতৃবৃন্দ সম্মিলিতভাবে শান্তি কমিটি, রাজাকার ও অন্যান্য বাহিনী এবং জামায়াতে ইসলামী এককভাবে আলবদর ও আলশামস বাহিনী গঠন করে। এসব ব্যক্তি, ও বাহিনীর মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার বিরোধী ভূমিকার কারণে স্বাধীনতোত্তর বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীনে প্রণীত ৭২-এর সংবিধানে ধর্মভিত্তিক বা যে-কোনো সাম্প্রদায়িক দল গঠন নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয় (অনুচ্ছেদ ৩৮)। মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শীর্ষ ব্যক্তিবর্গ, রাজনৈতিক দল ও সংগঠনসমূহের ভূমিকা ছিল নিম্নরূপ:
মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ব্যক্তি

গোলাম আযম (১৯২২-২০১৪)
মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতাবিরোধী, ১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর আমীর ও এর তাত্ত্বিক, মুক্তিযুদ্ধকে প্রতিহত করা ও পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর প্রতি সর্বাত্মক সমর্থন-সহযোগিতা দানের লক্ষ্যে রাজাকার, আলবদর, আলশামস, শান্তি কমিটি ইত্যাদি বেসামরিক সশস্ত্র বাহিনী গঠনের অন্যতম উদ্যোক্তা, হানাদার বাহিনীর গণহত্যায় মদদদানকারী, মুক্তিযুদ্ধে পাকহানাদার বাহিনীর পরাজয়ের কিছু পূর্বে পাকিস্তানে পলায়নকারী এবং সে দেশে থেকে ও অন্যান্য মুসলিম দেশ ভ্রমণ করে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে তৎপরতা পরিচালনাকারী, লন্ডনে ‘পূর্ব পাকিস্তান পুনরুদ্ধার কমিটি’র প্রতিষ্ঠাতা, ১৯৭৮ সালে জেনারেল জিয়ার শাসনামলে পাকিস্তানি পাসপোর্টে বাংলাদেশে আগমন ও স্থায়ীভাবে বসবাসকারী, ১৯৯২ সালে গণআদালতে বিচারের সম্মুখীন, জামায়াতে ইসলামী বাংলদেশের পুনরুজ্জীবনের পর এর আমীর পদে অধিষ্ঠিত, যুদ্ধাপরাধ ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়ে আমৃত্যু কারাদণ্ড সাজাপ্রাপ্ত শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযম।
১৯২২ সালে ঢাকার লক্ষ্মীবাজারে মাতুলালয়ে গোলাম আযমের জন্ম। তার পিতার নাম গোলাম কবির। তার গ্রামের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিরগাও-এ। মাদ্রাসায় তার প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ। এরপর জেনারেল লাইনে লেখাপড়া করে। সে মওদুদীর মতাদর্শ দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়ে ১৯৫৪ সালে জামায়াতে ইসলামীতে যোগ দেয়।
জামায়াতে ইসলামীর নেতা গোলাম আযম পাকিস্তান রক্ষার নামে পাকিস্তানপন্থী অন্যান্য দলকে সঙ্গে নিয়ে শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনী গঠন করে। এছাড়া বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তিক জগতের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের নির্মমভাবে হত্যা করার পরিকল্পনা প্রণয়ন করে তা বাস্তবায়নের জন্য নিজ দলের বাছাই করা নেতা-কর্মীদের নিয়ে আলবদর বাহিনী গঠন করে এবং পাকিস্তানি মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীর সঙ্গে মিলে তা কার্যকর করে। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর প্রতিটি মানবতাবিরোধী কর্মে সে পূর্ণ সমর্থন দেয় ও সহযোগিতা করে। এ ব্যাপারে ৪ঠা এপ্রিল সে একটি প্রতিনিধি দল নিয়ে টিক্কা খানসহ উচ্চপদস্থ সামরিক জান্তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে। গোলাম আযম মুক্তিযোদ্ধাদের ‘দেশদ্রোহী’ ও ‘ভারতীয় চর’ আখ্যা দিয়ে তাদের সমূলে ধ্বংস করার আহ্বান জানায় এবং রাজাকারদের উন্নত মানের স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রে সজ্জিত করতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সহযোগিতা নেয়।
জেনারেল ইয়াহিয়া খানের নেতৃত্বাধীন পাকিস্তানি জান্তা সরকার ১৯৭১ সালে অধিকৃত বাংলাদেশে যে নারকীয় গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছিল, তাতে এদেশীয় সহযোগীদের মধ্যে প্রধান ভূমিকা পালন করেছিল গোলাম আযম। উল্লেখ্য, ৭১-এর ১৭ই সেপ্টেম্বর গোলাম আজম মোহাম্মদপুর ফিজিক্যাল ট্রেনিং সেন্টারে অবস্থিত আলবদর হেডকোয়ার্টার্স পরিদর্শন করে। আলবদর বাহিনীর সদস্যরা ঢাকায় অবস্থানরত বুদ্ধিজীবীদের অনেককে ধরে চোখ বেঁধে প্রথমে এখানে নিয়ে আসে। অমানুষিক নির্যাতনের পর তাঁদের রায়েরবাজার ও মিরপুরের শিয়ালবাড়িসহ অন্যান্য বধ্যভূমিতে নিয়ে নৃশংসভাবে তারা হত্যা করে। ১৯৭২ সালের ১২ই জানুয়ারি দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায় প্রকাশিত এক রিপোর্ট থেকে জানা যায় যে, রাজাকার ও আলবদর বাহিনী যে-সমস্ত বুদ্ধিজীবীকে অপহরণ ও হত্যা করে, তাঁদের মধ্যে কয়েকজনের মৃতদেহ হরিরামপুর গোরস্থানের নিকটবর্তী ও মিরপুর পুরান বাজার সংলগ্ন দুটি কুয়াতে রয়েছে। গোলাম আযমের বাঙালি বুদ্ধিজীবী হত্যার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে রাজাকার বাহিনীর প্রধান মোহাম্মদ ইউনুস ও শান্তি কমিটির লিয়াজোঁ অফিসার মাহবুবুর রহমান এবং আলবদরের দুই কমান্ডার চৌধুরী মঈনউদ্দিন ও আশরাফুজ্জামান খান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জন ও পাকহানাদার বাহিনী পরায়জয়ের আগে-পরে গোলাম আযম-সহ প্রধান যুদ্ধাপরাধীদের অনেকে বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে প্রধানত পাকিস্তানে চলে যায়। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-কে হত্যার পর জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে ১৯৭৮ সালে শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী জামায়াত নেতা গোলাম আযমকে পাকিস্তানি পাসপোর্টে বাংলাদেশে ফিরে আসার অনুমতি দেয়। তখন থেকে বাংলাদেশে অবস্থান করে সে নেপথ্যে জামায়াতে ইসলামীকে পুনরুজ্জীবিত করে। ১৯৯১ সালে সে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের আমীর নির্বাচিত হয়। ১৯৯২ সালে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে তাকে গ্রেপ্তার ও যুদ্ধাপরাধের দায়ে বিচারের দাবিতে দুর্বার গণআন্দোলন গড়ে ওঠে। একই বছর রেসকোর্স ময়দানে হাজার-হাজার জনতার উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত গণআদালতে এক প্রতীকী বিচারে তার অপরাধ মৃত্যুদণ্ডতুল্য বলে ঘোষণা করা হয়।
২০১২ সালের ১১ই জানুয়ারি যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে গোলাম আযমকে গ্রেপ্তার করা হয়। এরপর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচারের রায়ে তার অপরাধ মৃত্যুদণ্ডযোগ্য উল্লেখ করে বয়স বিবেচনায় (তখন ৯২ বছর) তাকে মৃত্যুদণ্ডের পরিবর্তে ৯০ বছরের কারাদণ্ড প্রদান করা হয়। ২০১৪ সালের ২৩শে অক্টোবর দণ্ড ভোগরত অবস্থায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে এ শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীর মৃত্যু হয়।

খাজা খয়েরউদ্দিন (১৯২১-১৯৯৩)
ঢাকার নবাব পরিবারের সন্তান, স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধবিরোধী, মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে সহায়তাদানে গঠিত তথাকথিত শান্তি কমিটির আহ্বায়ক খাজা খয়েরউদ্দিন।
খাজা খয়েরউদ্দিন ১৯২১ সালে ঢাকার নবাব পরিবারে জন্মগ্রহণ করে। তার পিতার নাম সৈয়দ খাজা আলাউদ্দিন। মুক্তিযুদ্ধকালে সে পাকিস্তান মুসলিম লীগ (কাউন্সিল)-এর সভাপতি ছিল। ১৯৭০ সালে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের নির্বাচনে পুরান ঢাকা থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নিকট শোচনীয় পরাজয় বরণ করে। অবাঙালি পরিবারের সন্তান খাজা খয়েরউদ্দিন এক ও ঐক্যবদ্ধ পাকিস্তানে বিশ্বাসী ছিল। মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকেই সে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর প্রতি সর্বাত্মক সহযোগিতা ও সমর্থন ঘোষণা করে। সে-লক্ষ্যে এপ্রিল মাসের প্রথমদিকে ১৪০ সদস্যবিশিষ্ট তথাকথিত যে নাগরিক শান্তি কমিটি গঠিত হয়েছিল, সে ছিল তার আহ্বায়ক। মুক্তিযুদ্ধকালে একাধিকবার পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক গভর্নর টিক্কা খানের সঙ্গে প্রতিনিধি দল নিয়ে সে সাক্ষাৎ করে। পাকিস্তানি সামরিক জান্তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রেখে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী তৎপরতায় লিপ্ত থাকে। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর চূড়ান্ত পরাজয়ের পর সে পাকিস্তানে চলে যায় এবং সেখান থেকে বাংলাদেশবিরোধী তৎপরতা চালাতে থাকে। সে পাকিস্তান মুসলিম লীগের সিনিয়র ভাইস-প্রেসিডেন্ট হয়েছিল। ১৯৯৩ সালের ৩রা অক্টোবর পাকিস্তানের করাচিতে তার মৃত্যু হয়।

ফজলুল কাদের চৌধুরী (১৯১৯-১৯৭৩)
মুসলিম লীগ নেতা, পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের স্পিকার, ষাটের দশকে আইয়ুব সরকারের মন্ত্রী, ৭০-এর জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর নিকট পরাজয়বরণকারী, স্বাধীনতাবিরোধী, মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকেই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর প্রতি সর্বপ্রকার সমর্থন ও সহযোগিতাদানকারী, অধ্যক্ষ নূতন চন্দ্ৰ সিংহ-সহ অনেকের হত্যার সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত, চট্টগ্রাম ‘গুডস হিল’ (মুক্তিযুদ্ধকালে চট্টগ্রামের প্রধান নির্যাতনকেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত) ভবনের মালিক ও যুদ্ধাপরাধী ফজলুল কাদের চৌধুরী।
১৯১৯ সালে চট্টগ্রাম জেলাধীন রাউজান উপজেলার গহিরা গ্রামে ফজলুল কাদের চৌধুরীর জন্ম। তার পিতার নাম আব্দুল জব্বার চৌধুরী। পাকিস্তান আন্দোলনে তার সক্রিয় ভূমিকা ছিল। সে বঙ্গবন্ধুর ৬-দফা কর্মসূচি (১৯৬৬)-র ঘোর বিরোধিতা করে ঐক্যবদ্ধ পাকিস্তানের পক্ষে অবস্থান নেয়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষ বিরোধিতাকারীদের মধ্যে অন্যতম ছিল ফজলুল কাদের চৌধুরী (ফ কা চৌধুরী নামে অধিক পরিচিতি)। চট্টগ্রাম শহরের পাহাড়ে তার ‘গুডস হিল’ নামের বাসভবনটি মুক্তিযুদ্ধকালে পরিণত হয়েছিল এক ভয়াবহ নির্যাতনকেন্দ্রে। ফজলুল কাদের চৌধুরী, তার দুই পুত্র সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও গিয়াসউদ্দিন কাদের চৌধুরীর অমানুষিক নির্যাতন আর অত্যাচারে সে-সময় অসংখ্য মানুষ প্রাণ হারায়। ফজলুল কাদের চৌধুরী দীর্ঘদিন পর্যন্ত মুসলিম লীগ চট্টগ্রাম জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক এবং সভাপতি ছিল। ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে পূর্ববঙ্গ আইনসভার সদস্য নির্বাচিত হয়ে ফ কা চৌধুরী পুনরায় মুসলিম লীগে প্রত্যাবর্তন করে। আইয়ুব খান ক্ষমতা দখলের পর এক পর্যায়ে মুসলিম লীগ (কনভেনশন)- এর দায়িত্ব গ্রহণ করলে ফ কা চৌধুরী তার দলে যোগ দেয়। ১৯৫৯ সালে আইয়ুব প্রবর্তিত পরোক্ষ নির্বাচনভিত্তিক তথাকথিত ‘মৌলিক গণতন্ত্র’ ব্যবস্থাধীনে সে ১৯৬২ সালে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়। সে স্বৈরশাসক প্রেসিডেন্ট জেনারেল আইয়ুব খানের পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকারের মন্ত্রী হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়। পরবর্তীতে ফ কা চৌধুরী জাতীয় পরিষদের স্পিকার হয়। ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানে আইয়ুব সরকারের পতন হলে কনভেশন মুসলিম লীগ দ্বিধা বিভক্ত হয়ে পড়ে এবং সে এক অংশের সভাপতি নির্বাচিত হয়। ১৯৭০ সালে অনুষ্ঠিত পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ-এর কাছে তার শোচনীয় পরাজয় ঘটে। ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকেই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে হাত মিলিয়ে ফ কা চৌধুরী শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনী গঠন করে মুক্তিযুদ্ধের পুরো ৯ মাস চট্টগ্রামে ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ ও নির্যাতন চালায়। তার নিরাপত্তার জন্য ২৫শে মার্চ থেকে ১৬ই ডিসেম্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের পূর্ব পর্যন্ত তার গুডস হিলের বাসায় পাকিস্তানি বাহিনীর এক প্লাটুন সৈন্য মোতায়েন ছিল। ফ কা চৌধুরী ও তার দুই পুত্রের নেতৃত্বাধীন বাহিনী রাউজানে ব্যাপকভাবে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট করে। অধ্যক্ষ নূতন চন্দ্র সিংহ, আবদুল মান্নান, পঙ্কজ বড়ুয়া, জাফর আলম চৌধুরী, বিকাশ বড়ুয়া, শামসুল আলম, মুসা খান, শফিকুল আলম, রুহুল আমিন, সুবেদার আবুল বাশার, এজাহার মিয়াসহ অসংখ্য মানুষকে তারা হত্যা করে। ১৬ই ডিসেম্বর দেশ শত্রুমুক্ত হলে মুক্তিযোদ্ধাদের ভয়ে সপরিবারে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাবার সময় ফ কা চৌধুরী ধরা পড়ে এবং কারাবন্দি হয়। সে অবস্থায় ১৯৭৩ সালের ১৭ই জুলাই ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারে তার মৃত্যু ঘটে।

মতিউর রহমান নিজামী (১৯৪৩-২০১৬)
স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধবিরোধী, ষাটের দশকে জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘের পূর্ব পাকিস্তান শাখার সভাপতি, পরবর্তীতে পাকিস্তান ইসলামী ছাত্র সংঘের দুবার কেন্দ্রীয় সভাপতি, মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সমর্থনে আলবদর নামে আধাসামরিক বাহিনীর সংগঠক ও শীর্ষ নেতা, হানাদার বাহিনীর গণহত্যা, নারীনির্যাতন, অগ্নিসংযোগ ইত্যাদি কর্মকাণ্ডে সক্রিয় অংশগ্রহণকারী, মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর পরাজয়ের প্রাক্কালে বুদ্ধিজীবীদের হত্যাকাণ্ডে অন্যতম প্রধান ভূমিকাপালন ও পরাজয়ের পর বিদেশে পলায়নকারী, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর জিয়ার শাসনামলে বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন ও গোলাম আযমের নেতৃত্বে জামায়াতে ইসলামীর পুনরুজ্জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনকারী, বেগম খালেদা জিয়ার বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে মন্ত্রী, শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে যুদ্ধাপরাধের বিচারে গঠিত ট্রাইব্যুনালের রায়ে মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত ও ফাঁসিতে ঝুলিয়ে ঐ রায় কার্যকর হওয়া অন্যতম যুদ্ধাপরাধী, জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের আমীর মতিউর রহমান নিজামী|
জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় নেতা মতিউর রহমান নিজামী ১৯৬১ সালে তৎকালীন পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘ (স্বাধীনতাপরবর্তীকালে নতুন নামকরণ হয় ইসলামী ছাত্র শিবির)-এর সঙ্গে যুক্ত হয়। পরপর তিন বছর (১৯৬৬- ১৯৬৯) সে পূর্ব পাকিস্তান ইসলামী ছাত্র সংঘের সভাপতি ছিল। এরপর দুবার সমগ্র পাকিস্তানের ইসলামী ছাত্র সংঘের কেন্দ্রীয় সভাপতির দায়িত্ব পালন করে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় সে আলবদর বাহিনীর সভাপতি ছিল। তার প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে মুক্তিযুদ্ধকে প্রতিহত ও মুক্তিযোদ্ধাদের নির্মূল করার জন্য আলবদর বাহিনী গঠন করা হয়। সে ছিল আলবদর বাহিনীর প্রধান। বুদ্ধিজীবী হত্যার নীলনকশা তৈরি এবং ঢাকাসহ সারাদেশে অসংখ্য বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের পেছনে মতিউর রহমান নিজামীর প্রধান ভূমিকা ছিল। নিজামীর বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে হত্যা, লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণ ও নির্যাতনের অভিযোগ তার এলাকা সাথিয়া-বেড়াবাসীরও রয়েছে। পাবনার বেড়া থানার বৃশালিকা গ্রামের সোহরাব আলী ও মুক্তিযোদ্ধা বটেশ্বরকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করা হয় নিজামীর প্রত্যক্ষ নির্দেশে।
প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের আনুকূল্যে ১৯৭৮ সালে গোলাম আযম ও মতিউর রহমান নিজামী বাংলাদেশে ফিরে আসার সুযোগ লাভের পর তারা জামায়াতে ইসলামীকে পুনরুজ্জীবিত করতে নিজেদের নিয়োজিত করে। মতিউর রহমান নিজামী ১৯৮৩-১৯৮৮ পর্যন্ত জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব পালন করে। ১৯৮৮ সালের ডিসেম্বরে দলের সেক্রেটারি জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব পায় এবং ২০০০ সালে আমীর নির্বাচিত হয়।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকালে নিজামী দেশের বিভিন্ন স্থানে দলীয় ক্যাডারদের একাধিক সমাবেশে ভারতের বিরুদ্ধে উস্কানিমূলক ও সাম্প্রদায়িক বক্তব্য দেয়। ৮ই সেপ্টেম্বর পাকিস্তান প্রতিরক্ষা দিবস উপলক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের সামনে ছাত্র সংঘের সভায় নিজামী ঘোষণা করে, “হিন্দুস্তানের মূল ভূখণ্ডে আঘাত হানতে রাজাকার ও আলবদররা প্রস্তুত’। ১০ই সেপ্টেম্বর যশোরে রাজাকারদের প্রধান কার্যালয়ে এক সমাবেশে নিজামী প্রত্যেক রাজাকারকে ইমানদারির সঙ্গে দায়িত্ব পালনের আহ্বান জানায়। ২০১০ সালের ২৯শে জুন একটি মামলায় মতিউর রহমান নিজামীকে গ্রেপ্তার করে একই বছর ২রা আগস্ট মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচারের সম্মুখীন করা হয়। তার বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে বুদ্ধিজীবীদের হত্যাকাণ্ডে সরাসরি সংশ্লিষ্টতা, গণহত্যা, হত্যা, নির্যাতন, মানবতাবিরোধী অপরাধের ষড়যন্ত্র করাসহ মোট ১৬টি অভিযোগ উত্থাপিত হয়, যার মধ্যে ৮টি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়। সেগুলোর মধ্যে পাবনা জেলা স্কুলের প্রধান শিক্ষক মাওলানা কাছিম উদ্দিন (যিনি স্বাধীনতার পক্ষে সর্বদা প্রচার চালাতেন)-কে নির্মমভাবে নির্যাতন করে হত্যা; একাত্তরের মে মাসে তার ইন্ধনে পাবনার সাঁথিয়া উপজেলার বাউশগাড়িসহ দুটি গ্রামে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর প্রায় সাড়ে ৪শ মানুষকে হত্যা আর ৩০-৪০ জন নারীকে ধর্ষণ; একাত্তরের মে মাসের শুরু থেকে ১৬ই ডিসেম্বর পর্যন্ত মোহাম্মদপুরের ফিজিক্যাল ট্রেনিং কলেজ আলবদর বাহিনীর ক্যাম্পে নিজামীর নিয়মিত যাতায়াত মানবতাবিরোধী অপরাধের ষড়যন্ত্র করা; একাত্তরের ১৬ই এপ্রিল তার সহযোগিতায় পাকিস্তানি সেনাদের ঈশ্বরদী উপজেলার আড়পাড়া ও ভূতেরবাড়ি গ্রামে হামলা চালিয়ে বাড়িঘরে লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ এবং ২১ জন নিরস্ত্র মানুষকে হত্যা; ৩০শে আগস্ট ঢাকার নাখালপাড়ায় অবস্থিত পুরনো এমপি হোস্টেলের নিকটবর্তী হানাদার বাহিনীর নির্যাতনকেন্দ্রে গিয়ে সেখানে আটক “ক্র্যাক প্লাটুন-এর মুক্তিযোদ্ধা রুমী, বদি, জালাল প্রমুখকে হত্যার জন্য পাকিস্তানি সেনাদের প্ররোচিত করা; পাবনার সোনাতলা গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা অনিল চন্দ্র কুণ্ডু ট্রেনিংয়ের জন্য ভারতে গেলে তাঁর বাড়ি নিজামীর নির্দেশে রাজারকারদের দ্বারা আগুনে পুড়িয়ে দেয়া; মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনে পাকহানাদার বাহিনী ও বেসামরিক বিভিন্ন সশস্ত্র বহিনীকে উস্কিয়ে দেয়া ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। ইসলামী ছাত্র সংঘ ও আলবদর বাহিনীর প্রধান হিসেবে ঐসব অপরাধের দায় থেকে তার পরিত্রাণের কোনো উপায় ছিল না। তাই ট্রাইব্যুনাল উল্লিখিত অপরাধের দায়ে ২০১৪ সালের ২৯শে অক্টোবর নিজামীকে দোষী সাব্যস্ত করে তার বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডাদেশ রায় ঘোষণা করে। সকল বিচারিক প্রক্রিয়া শেষ করে ২০১৬ সালের ১০ই মে রাত ১২টা ১০ মিনিটে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।

শাহ আজিজুর রহমান (১৯২৫-১৯৮৮)
মুক্তিযুদ্ধ বিরোধিতাকারীদের মধ্যে অন্যতম রাজনৈতিক নেতা। ১৯২৫ সালে পশ্চিম বাংলার নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগরে শাহ আজিজুর রহমানের জন্ম। পিতা মৌলভী শাহ মোহম্মদ সিদ্দিক। তিনি ছিলেন মাদ্রাসার হেড মওলানা। সাধারণ লাইনে লেখাপড়া ছাড়াও শাহ আজিজ মাদ্রাসা থেকে টাইটেল পাস করে। ভারত বিভাগের পর তাদের পরিবার কুষ্টিয়ায় চলে আসে।
১৯৪৪ থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত শাহ আজিজুর রহমান নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্র লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে পাকিস্তান আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। মুসলিম লীগের নাজিমুদ্দীন-আকরম খাঁ গ্রুপ বা প্রতিক্রিয়াশীল ধারার সে সমর্থক ছিল। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর মুসলিম লীগের বিভিন্ন পদে সে আসীন হয়। ১৯৫২ সালে ভাষা- আন্দোলন-এর সে বিরোধিতা করে। মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দের সঙ্গে মতবিরোধের কারণে একাধিকবার শাহ আজিজ দল বদল করে। ১৯৬৪ সালে সে আওয়ামী লীগে যোগদান করে এর অন্যতম সহসভাপতি হয়েছিল, তবে পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কৃত হয়। ১৯৭০ সালে খান আতাউর রহমানের নেতৃত্বাধীন জাতীয় লীগে যোগ দিয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে এবং হেরে যায়।
৭১-এ পাকিস্তানি প্রতিনিধি দলের সদস্য হিসেবে শাহ আজিজ জাতিসংঘে মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে বক্তব্য দেয়। আন্তর্জাতিকভাবে সে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে প্রচারাভিযান চালায়। ২৫শে মার্চ পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গণহত্যার কথা অস্বীকার করে স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি না দিতে বিভিন্ন মুসলিম দেশের প্রতি সে আহ্বান জানায়। দেশ স্বাধীন হলে দালাল আইনে শাহ আজিজ গ্রেপ্তার হয়। পরবর্তীতে মুক্তি লাভ করে কিছুদিন রাজনৈতিকভাবে নিষ্ক্রিয় থাকে। জেনারেল জিয়াউর রহমানের শাসনকালে ১৯৭৯ থেকে ১৯৮২ সময়ে শাহ আজিজ সরকারের প্রধানমন্ত্রী ছিল। সে জেনারেল জিয়া প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের সিনিয়র ভাইস-প্রেসিডেন্ট ছিল। ১৯৮৮ সালে তার মৃত্যু হয়।

আব্দুল আলীম (১৯৩০-১৯১৪)
কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী, মুক্তিযুদ্ধবিরোধী, নারী-পুরুষ-শিশু হত্যাকারী ও পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ঘনিষ্ঠ সহযোগী আব্দুল আলীম মুক্তিযুদ্ধকালে জয়পুরহাট মহকুমার শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান ছিল। তার মুক্তিযুদ্ধবিরোধী তৎপরতা ও যুদ্ধাপরাধের কাহিনী তৎকালীন পত্রপত্রিকা, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গ্রন্থ ও যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল-এর রায়ে জানা যায়। সে সময়কার তার লোমহর্ষক যুদ্ধাপরাধের ঘটনা স্মরণে আজো জয়পুরহাটবাসী শিহরিত হয়ে ওঠে।
আব্দুল আলীমের জন্ম ১৯৩০ সালে। তার পিতার নাম আব্দুল ওয়াহেদ। আব্দুল আলীম প্রেসিডেন্ট আইয়ুবের কনভেনশন মুসলিম লীগের দায়িত্বশীল পদে ছিল। ৭১-এ মুক্তিযুদ্ধকালে তার প্রত্যক্ষ নির্দেশে জয়পুরহাটের বিভিন্ন স্থানে বর্বরোচিত গণহত্যা সংঘটিত হয়। ২৬শে এপ্রিল কড়ই কাদিপুর গ্রামে ৩৭১ জন হিন্দু ধর্মাবলম্বী নারী-পুরুষকে দাঁড় করিয়ে তার নির্দেশে হত্যা করা হয়। বাবুপাড়ার অনেককে জয়পুরহাট কলেজে এনে অনুরূপভাবে হত্যা করা হয়। মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাসে তার প্রত্যক্ষ ইন্ধনে পাগলা দেওয়ান গ্রামের হাজার-হাজার নারী-পুরুষ ও শিশুকে হত্যা করে মাটিচাপা দেয়া হয়। এছাড়া তার নির্দেশে বহু বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট করা হয় এবং নারীদের ওপর পাশবিক নির্যাতন চালানো হয়। এমনকি সে নিজের হাতে গ্রামের সাধারণ মানুষদের লাইনে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করে। বেয়নেট চার্জ করে বহু মানুষকে হত্যার অভিযোগও তার বিরুদ্ধে রয়েছে।
৭১-এ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী জয়পুরহাটে বেশকিছু সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধাকে গ্রেপ্তার করে চোখ বেঁধে সারা শহর ঘুরিয়ে পরে তাঁদের হত্যা করে। এতে নেতৃত্বদানকারী পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর মেজর আফজালের পাশে আব্দুল আলীমকে হাস্যোজ্জ্বল ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়।
জয়পুরহাট হানাদারমুক্ত হওয়ার পর আব্দুল আলীমকে বিক্ষুব্ধ জনতা ও মুক্তিযোদ্ধারা বেশ কয়েকদিন খাঁচায় পুরে রাখে। স্বাধীনতোত্তর জয়পুরহাট থানায় দালাল আইনে তার বিরুদ্ধে একাধিক মামলা দায়ের হয়। তদন্ত শেষে তার বিরুদ্ধে অভিযোগপত্রও দাখিল করা হয়। মামলার বিচারের জন্য বগুড়া সেশন জজ আদালতে তা প্রেরণ করা হয়। দীর্ঘদিন পলাতক থাকার পর ১৯৭২ সালের শেষদিকে জয়পুহাট আদালতে আত্মসমর্পণ করলে আদালত তাকে বগুড়া জেল হাজতে প্রেরণ করে। জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে এক পর্যায়ে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) প্রতিষ্ঠা করলে আব্দুল আলীম তাতে যোগ দেয়। সে জিয়ার বিএনপি সরকারের সময়ে মন্ত্রী ছিল। ২০১০ সালে শেখ হাসিনার ২য় সরকারের সময় যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের লক্ষ্যে ট্রাইব্যুনাল গঠিত হলে পরের বছর আব্দুল আলীমকে গ্রেপ্তার করা হয়। তার বিরুদ্ধে ১৭টি মানবতাবিরোধী ও যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ আনা হয়। তার মধ্যে ৯টি ঘটনার সঙ্গে তার সরাসরি সংশ্লিষ্টতা প্রমাণিত হয়। ৪টি গণহত্যা ও হত্যাকাণ্ডে তার ভূমিকাকে যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল ‘অত্যন্ত জঘন্য অপরাধ’ বলে উল্লেখ করে। সে ফাঁসিতে ঝোলানোর মতো অপরাধ সংঘটিত করা সত্ত্বেও বার্ধক্য ও পঙ্গুত্বের কথা বিবেচনা করে ট্রাইব্যুনাল তাকে আমৃত্যু কারাদণ্ড প্রদান করে। ২০১৪ সালের ৩০শে আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আব্দুল আলিম মারা যায়।

নুরুল আমিন (১৮৯৩-১৯৭৪)
মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতাবিরোধী, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ঘনিষ্ঠ দোসর নুরুল আমিন শুরু থেকেই পাকিস্তানের প্রতি পূর্ণ সমর্থন জ্ঞাপন এবং মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতায় তৎপর হয়ে ওঠে। হানাদার বাহিনীর সমর্থনে গঠিত তথাকথিত শান্তি কমিটির সে ছিল অন্যতম উদ্যোক্তা।
নুরুল আমিনের জন্ম ১৮৯৩ সালে এ বর্ষিয়ান রাজনীতিবিদের স্থায়ী নিবাস ছিল ময়মনসিংহের নান্দাইলে। সে ১৯৪৬ সালে বঙ্গীয় প্রাদেশিক আইন সভার স্পিকার পদে অধিষ্ঠিত ছিল। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর ১৯৪৮ থেকে ১৯৫৪ পর্যন্ত নুরুল আমিন পূর্ব পাকিস্তানে মুসলিম লীগ সরকারের মুখ্যমন্ত্রী ছিল। তার সময়ে ভাষা আন্দোলন ও ৫২-র একুশে ফেব্রুয়ারির ছাত্র হত্যার ঘটনা ঘটে। তখন থেকে সে ‘খুনী নুরুল আমিন নামে’ এক গণধিকৃত রাজনৈতিক ব্যক্তি হিসেবে চিহ্নিত হয়। ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে ছাত্রনেতা খালেক নেওয়াজ খানের নিকট তার শোচনীয় পরাজয় ঘটে। নুরুল আমিন বঙ্গবন্ধুর ছয়দফা কর্মসূচির (১৯৬৬) বিরোধী ছিল। এর বিপরীতে তারা ৮-দফা ভিত্তিক পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক মুভমেন্ট (পিডিএম) গড়ে তুলেছিল। ১৯৭০ সালের নির্বাচনের পূর্বে তার নেতৃত্বে পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টি (পিডিপি) গঠিত হয়। সে ছিল এ দলের সভাপতি। ঐ নির্বাচনে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে পূর্ব বাংলা থেকে আওয়ামী লীগের বাইরে নির্বাচিত দুজন প্রতিনিধির মধ্যে নুরুল আমিন ছিল অন্যতম।
৭১-এর ২৫শে মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী পূর্ব বাংলায় সশস্ত্র গণহত্যা শুরুর পরপরই তার নেতৃত্বে ১২ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল ৪ঠা এপ্রিল লে. জেনারেল টিক্কা খানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে এবং পাকিস্তানকে টিকিয়ে রাখার জন্য সেনাবাহিনীকে সবধরনের সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দেয়। যুদ্ধের শেষদিকে নুরুল আমিন পাকিস্তানে চলে যায় এবং পাকিস্তানি নাগরিক হিসেবে সেখানে আমৃত্যু অবস্থান করে। নুরুল আমিন ১৯৭২-৭৩ সময়ে পাকিস্তানের ভাইস- প্রেসিডেন্ট হয়েছিল। ১৯৭৪ সালের ২রা অক্টোবর রাওয়ালপিন্ডিতে তার মৃত্যু হয়।

আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ (১৯৪৮-২০১৫)
স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধবিরোধী, যুদ্ধাপরাধী, ৭১-এ আলবদর বাহিনীর সেকেন্ড ইন কমান্ড, পূর্ব পাকিস্তান ইসলামী ছাত্র সংঘের সভাপতি, বুদ্ধিজীবী হত্যায় অন্যতম নেতৃত্বদানকারী, গণহত্যা, হিন্দু সংখ্যালঘু হত্যা, নারীনির্যাতন, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে সহযোগিতাদানকারী, যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত ও তা কার্যকর হওয়া জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ। ১৯৪৮ সালে ফরিদপুর জেলায় তার জন্ম। পিতার নাম মওলানা মোহাম্মদ আলী। পিতা ফরিদপুরে পাকহানাদারদের সমর্থনে গঠিত শান্তি কমিটির সদস্য ছিল।
মুজাহিদ ছিল চরম ভারত ও হিন্দু বিদ্বেষী। মুক্তিযুদ্ধকালে মে মাসে তার নেতৃত্বে ফরিদপুরে ৩০০-৩৫০ হিন্দু বাড়িতে লুটতরাজ এবং ৫০-৬০ জন হিন্দুকে হত্যা করা হয়। সে পৃথিবীর মানচিত্র থেকে হিন্দুস্থানকে মুছে ফেলার ঘোষণা দেয়। হিন্দু লেখকদের কোনো লেখা বা বইপত্র প্রকাশ, বিক্রি ও সংগ্রহ করাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। জিয়াউর রহমানের শাসন আমলে সাম্প্রদায়িক সংগঠন প্রতিষ্ঠার ওপর থেকে সাংবিধানিক বিধি-নিষেধ তুলে দেয়া হলে, গোলাম আযম-নিজামী গংদের সঙ্গে মিলে জামায়াতে ইসলামীকে পুনরুজ্জীবিত করতে সে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। ২০০১ সালের নির্বাচনের পূর্বে বিএনপি-র সঙ্গে সম্মিলিতভাবে জামায়াতে ইসলামী চার দলীয় ঐক্যজোট গঠন করে জোটগতভাবে নির্বাচনে অংশ নেয়। নির্বাচনের পর বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার গঠিত হলে মুজাহিদ ঐ সরকারে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হয়। যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ২০১০ সালে তাকে গ্রেপ্তার করে ট্রাইব্যুনালে বিচারের সম্মুখীন করা হয়। সাংবাদিক সিরাজ উদ্দিন হোসেনকে অপহরণ ও হত্যা, বুদ্ধিজীবী হত্যা, সংখ্যালঘু হিন্দুদের ওপর নির্যাতন ও হত্যা, পুরাতন সংসদ ভবন সংলগ্ন নাখালপাড়ার নির্যাতনকেন্দ্রে একুশের গানের কালজয়ী সুরস্রষ্টা আলতাফ মাহমুদ ও ঢাকা ক্র্যাক প্লাটুনের মুক্তিযোদ্ধা বদি-রুমী- জুয়েল-আজাদকে হত্যা, বাঙালি নিধনের পরিকল্পনা ও বাংলাদেশবিরোধী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হওয়া ইত্যাদি অভিযোগ ট্রাইব্যুনালে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়। ফলে ২০১৩ সালে যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল উল্লিখিত অপরাধের দায়ে তার মৃত্যুদণ্ডের রায় দেয়। সকল বিচারিক প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে ২১শে নভেম্বর ২০১৫ মধ্যরাতে ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।

আবদুল কাদের মোল্লা (১৯৪৮-২০১৩)
স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধবিরোধী, যুদ্ধাপরাধী, ৭১-এ আলবদর বাহিনীর সদস্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘের শহীদুল্লাহ হল শাখার সভাপতি, মিরপুরের ‘কসাই’ নামে কুখ্যাত, গণহত্যা, সংখ্যালঘু হত্যা, নারীর ওপর পাশবিক নির্যাতন, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটে অংশগ্রহণ ও পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে সহযোগিতাদানকারী, যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে প্রথমে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড, পরে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত ও তা কার্যকর হওয়া জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লা। ১৯৪৮ সালে ফরিদপুর জেলার আমিরাবাদ গ্রামে তার জন্ম।
৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ঢাকার মিরপুরে কাদের মোল্লা ও তার বিহারি সঙ্গীরা শিয়ালবাড়ী-রূপনগর এলাকায় অসংখ্য মানুষকে হত্যা করে। আবদুল কাদের মোল্লা ও তার সহযোগী রাজাকার এবং বিহারিরা মনিপুর, শেওড়াপাড়া, কাজীপাড়া এলাকায় প্রচুর সংখ্যক মানুষকে নির্যাতন ও নিপীড়ন করে হত্যার পর মিরপুরের বিভিন্ন জায়গায় মাটিচাপা দেয়। কবি মেহেরুননিসা ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের হত্যায় তার প্রত্যক্ষ ভূমিকা ছিল।
যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ২০১০ সালের ১৩ই জুলাই তাকে গ্রেপ্তার করে ট্রাইব্যুনালে বিচারের সম্মুখীন করা হয়। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুন্যালে তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের মধ্যে বাংলা কলেজের ছাত্র পল্লবকে গুলি করে হত্যা, কবি মেহেরুননিসা, তাঁর মা ও দুই ভাইকে তাদের নিজ বাসায় পৈশাচিকভাবে হত্যা, সাংবাদিক খন্দকার আবু তালেবকে অপহরণ করে নিয়ে মিরপুরের পাম্প হাউজ জল্লাদ খানায় জবাই করে হত্যা, তার নেতৃত্বে মিরপুরের ১২ নম্বর সেকশনে হযরত আলী লস্করের বাসায় তাঁর স্ত্রী, দুকন্যা ও দুবছরের এক পুত্র সন্তানকে হত্যা ও ১১ বছরের এক কন্যা সন্তানের ওপর পাশবিক নির্যাতন, মিরপুরের আলুব্দী গ্রামে তিন শতাধিক মানুষকে হত্যা ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। তবে ট্রাইব্যুনাল শুনানি শেষে রায়ে প্রথমে আবদুল কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রদান করে। এ রায়ের বিরুদ্ধে সারাদেশে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয় এবং কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবিতে ঢাকার শাহবাগে ছাত্র ও তরুণ সমাজের উদ্যোগে গড়ে ওঠে গণজাগরণ মঞ্চ। উদ্ভূত পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে সরকার ট্রাইব্যুনালের আইন সংশোধন করে রাষ্ট্র এবং আসামি পক্ষ উভয়ের উচ্চ আদালতে আপিল শুনানির বিধান করে সংসদে আইন পাস করে। এরই ধারাবাহিকতায় কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে ওপরে উল্লিখিত অভিযোগসমূহ উচ্চ আদালতে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়। ফলে ১৭ই সেপ্টেম্বর ২০১৩ আপিল বিভাগ কাদের মোল্লার মামলার বিচারে ফাঁসির রায় দেয়, যা ১২ই ডিসেম্বর রাতে ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে কার্যকর করা হয়। এটি ছিল মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলায় প্রথম কারো মৃত্যুদণ্ডের রায় কার্যকর হওয়া।

সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী (১৯৪৯-২০১৫)
স্বাধীনতাবিরোধী ও যুদ্ধাপরাধী চট্টগ্রামের মুসলিম লীগ নেতা ফজলুল কাদের চৌধুরীর জ্যেষ্ঠ পুত্র, মুক্তিযুদ্ধকালে চট্টগ্রাম নগরী ও রাউজানে রাজাকার, আলবদর ও আলশামস বাহিনীর অন্যতম সংগঠক, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর দোসর হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোকজনদের ধরে এনে নির্যাতন ও অনেককে হত্যা, নারীনির্যাতন, সংখ্যালঘু হত্যা ও তাদের ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগকারী, যুদ্ধাপরাধের দায়ে ট্রাইবুনালের বিচারে ফাঁসির দণ্ডাদেশ কার্যকরী হওয়া বিএনপি-র স্থায়ী কমিটির অন্যতম সদস্য সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী। ১৯৪৯ সালে চট্টগ্রাম জেলার রাউজান উপজেলার গহিরা গ্রামে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর জন্ম।
সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী (সা কা চৌধুরী নামে অধিক পরিচিত) মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে খোকন রাজাকার নামে পরিচিত ছিল। ১৯৭১ সালে সে চট্টগ্রাম নগরী এবং রাউজানে রাজাকার, আলবদর ও আলশামস বাহিনী সংগঠিত করে। বৃটিশবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনে চট্টগ্রামের সক্রিয় সংগঠক জহিরুদ্দিন আহমদের দ্বিতীয় পুত্র নিজামুদ্দিন আহমদকে ধরে এনে ‘গুডস হিলে’র নির্যাতনকেন্দ্রে ৮ দিন ধরে তার ওপর চরম নির্যাতন চালায়। সা কা চৌধুরী এবং তার পিতা ফ কা চৌধুরী চট্টগ্রামের বিশিষ্ট ব্যক্তি ও অন্যান্যদের তাদের বাসায় ধরে এনে নির্মমভাবে নির্যাতন শেষে অনেককে হত্যা করে। সা কা চৌধুরী গোটা চট্টগ্রাম জুড়ে হত্যাযজ্ঞ চালালেও বেশিরভাগ হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করে নিজস্ব এলাকা রাউজানে। চট্টগ্রামের কৃতী সন্তান, দানবীর ও কুন্ডেশ্বরী ঔষধালয়ের প্রতিষ্ঠাতা নূতন চন্দ্র সিংহ, নগর আওয়ামী লীগের নেতা শেখ মোজাফফর আহমদ, ব্যবসায়ী ফজলুল হক সওদাগর, মুক্তিযোদ্ধা ওমর ফারুক, ছাত্র দয়ালহরি বিশ্বাস প্রমুখকে হত্যা এবং চট্টগ্রামে অগ্নিসংযোগ, বুদ্ধিজীবী হত্যা ও লুটপাটের অভিযোগে সা কা চৌধুরীর বিরুদ্ধে স্বাধীনতোত্তরকালে ৪টি মামলা দায়ের করা হয়। তখন সে লন্ডনে পালিয়ে যায়। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর দেশের পরিবর্তিত রাজনৈতিক অবস্থায় সে খন্দকার মোশতাক-জিয়ার সহায়তায় বাংলাদেশে ফিরে আসে। ২০১০ সালে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে ট্রাইব্যুনাল গঠিত হওয়ার পর একই বছর ১৬ই ডিসেম্বর তাকে গ্রেপ্তার করে বিচারের সম্মুখীন করা হয়। তার বিরুদ্ধে প্রসিকিউশনের আনীত ২৩টি অভিযোগের মধ্যে ৯টি অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়। ঐ ৯টি অভিযোগের মধ্যে ৪-৫ই এপ্রিল হিন্দু সম্প্রদায়ের ৭ জনকে অপহরণ ও তাদের ৬ জনকে হত্যা, ১৩ই এপ্রিল রাউজানের গহিরার হিন্দুপাড়ায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গণহত্যায় সক্রিয় অংশগ্রহণ, একই দিন কুণ্ডেশ্বরী ঔষধালয়ের মালিক নূতন চন্দ্র সিংহকে হত্যা, হিন্দু পরিবারের সদস্যদের ধর্মান্তরিত হতে বাধ্য করা, পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সঙ্গে মিলে একদিনে ৭৬ জনকে হত্যা ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ২০১৩ সালের ১লা অক্টোবর প্রদত্ত রায়ে মানবতাবিরোধী এসব অপরাধের দায়ে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করে। আপিল বিভাগেও তার মৃত্যুদণ্ডাদেশ বহাল থাকে। অতঃপর ২০১৫ সালের ২২শে নভেম্বর রাত ১২.৫৫ মিনিটে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ফাঁসিতে তার মৃত্যুদণ্ডাদেশ কার্যকর করা হয়। মৃত্যুকালে সে বিএনপি-র স্ট্যান্ডিং কমিটির সদস্য ছিল।

মীর কাসেম আলী (১৯৫২-২০১৬)
স্বাধীনতাবিরোধী, যুদ্ধাপরাধী, জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘের চট্টগ্রামের সভাপতি (ডিসেম্বরে পূর্ব পাকিস্তান ইসলামী ছাত্র সংঘের সেক্রেটারি জেনারেল), চট্টগ্রামে আলবদর বাহিনী প্রধান ও সেখানে ডালিম হোটেল নির্যাতনকেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা, বহু মানুষ ও মুক্তিযোদ্ধাকে নির্যাতন শেষে হত্যাকারী, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচারের রায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ও তা কার্যকর হওয়া জামায়াতে ইসলামীর অন্যতম নেতা ও অর্থ যোগানদাতা মীর কাসেম আলী।
মানিকগঞ্জ জেলার হরিরামপুর উপজেলার চালা গ্রামে ১৯৫২ সালে মীর কাসেম আলীর জন্ম। তার পিতার নাম তৈয়ব আলী। চট্টগ্রাম কলেজের ইন্টারমিডিয়েটের ছাত্র থাকাকালে সে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতায় লিপ্ত হয় এবং এ ব্যাপারে পাকহানাদার বাহিনীকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করে। সে নিজে একাত্তরে চট্টগ্রাম শহরের নন্দনকানন টিএন্ডটি অফিসের পেছনের সড়কে এক হিন্দু পরিবারের মালিকানাধীন ‘মহামায়া’ ভবনটি দখল করে ‘ডালিম হোটেল’ নাম দিয়ে সেটিকে আলবদররাজাকার বাহিনীর অন্যতম বন্দিশিবির ও নির্যাতনকেন্দ্রে পরিণত করে। ডালিম হোটেলে সারাক্ষণ চলত বন্দিদের ওপর নির্যাতন আর নির্যাতিতদের চিৎকার ও কান্নাকাটি। এখানে মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের অনেককে ধরে এনে নির্যাতন শেষে হত্যা করা হয়। ঐ সময় তার নেতৃত্বাধীন আলবদররাজাকার বাহিনীর নির্যাতনের কথা স্মরণ করে আজো শিউরে ওঠেন চট্টগ্রামের অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধা ও তাঁদের পরিবারের সদস্যরা।
জেনারেল জিয়া, এরশাদ, বেগম খালেদা জিয়ার সরকার (১৯৯১-৯৬) ও বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে (২০০১-২০০৬) মীর কাসেম আলীর ব্যবসায়িক উত্থান ঘটে। সে ইসলামী ব্যাংকের পরিচালক, দিগন্ত টেলিভিশন ও নয়া দিগন্ত পত্রিকাসহ দিগন্ত মিডিয়া গ্রুপের চেয়ারম্যান, ইবনে সিনা ট্রাস্টের প্রতিষ্ঠাতা, রাবিতা আল-ইসলাম নামক এনজিও-র পরিচালক, ইসলামিক ইউনির্ভাসিটি অব চিটাগং ও দারুল ইহসান ইউনির্ভাসিটির পরিচালনা পর্ষদের সদস্যসহ বিভিন্ন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের মালিক হয়।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে তার বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধকালে পবিত্র ঈদুল ফিতরের পরদিন মুক্তিযোদ্ধা জসিমকে ডালিম হোটেলে আটক করে দিনের পর দিন নির্মম নির্যাতন শেষে তাকে হত্যা, নিহত আরো পাঁচজনের সঙ্গে জসিমের মৃতদেহ কর্ণফুলী নদীতে ফেলে দেয়ার অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়। এছাড়াও ডালিম হোটেলে নভেম্বর মাসে হাজারী লেনের বাসা থেকে জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী, রঞ্জিত দাস, টুন্টু সেনকে মীর কাসেমের নেতৃত্বাধীন আলবদররাজাকার বাহিনী আটক করে নির্যাতন শেষে এদের মধ্যে রঞ্জিত ও টুন্টুকে হত্যার অভিযোগও আদালতে প্রমাণিত হয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ হাজারী লেনের ২৫০ থেকে ৩০০ ঘরে আগুন দেয়ার অভিযোগও মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে উত্থাপিত হয় এবং এজন্য সে দোষী সাব্যস্ত হয়। বিশেষ করে মুক্তিযোদ্ধা জসিম ও অপর কয়েকজনকে নৃশংসভাবে হত্যার দায়ে ট্রাইব্যুনাল ২০১৪ সালের ২রা নভেম্বর তাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার রায় দেন। বিচারিক প্রক্রিয়া সম্পন্ন শেষে ২০১৬ সালের ৩রা সেপ্টেম্বর কাশিমপুর কারাগারে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে তার মৃত্যুদণ্ডের রায় কার্যকর করা হয়।

দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী (জন্ম ১৯৪০) স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধবিরোধী, যুদ্ধাপরাধী, ‘দেলু’ বা ‘দেইল্যা’ রাজাকার নামে পরিচিত, চরম হিন্দু ও ভারত বিদ্বেষী, মানুষ হত্যা, সংখ্যালঘু হত্যা, নারীনির্যাতন, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটে নিজে অংশগ্রহণ ও পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে সহযোগিতাদানকারী, মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে প্রথমে যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত, পরে আপিল বিভাগের রায়ে আমৃত্যু কারাদণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমীর দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী।
সাঈদী ১৯৪০ সালে পিরোজপুর জেলার ইন্দুরকানী গ্রামে জন্মগ্রহণ করে। তার পিতার নাম ইউসুফ সাঈদী। পিতার প্রতিষ্ঠিত স্থানীয় মাদ্রাসায় সাঈদী প্রাথমিক ধর্মীয় শিক্ষা গ্রহণ করে। এরপর ছারছিনা ও খুলনা আলিয়া মাদ্রাসায় পড়াশুনা শেষে নিজ এলাকায় বসবাস ও ক্ষুদ্র ব্যবসা শুরু করে। সে বাংলা ভাষা ছাড়াও উর্দু, আরবি ও পাঞ্জাবি ভাষায় পারদর্শী।
৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে সাঈদী পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর প্রতি সর্বাত্মক সমর্থন ও সহযোগিতা ঘোষণা করে। সে নিজে স্থানীয়ভাবে রাজাকার বাহিনী সংগঠিত করে হত্যা, লুটপাট, নির্যাতন ও জোড়পূর্বক সংখ্যালঘু হিন্দুদের ধর্মান্তরিত করা ইত্যাদি অপতৎপরতায় লিপ্ত হয়। মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধপরবর্তী সময়ে এলাকায় তার পরিচয় হয় ‘দেলু’ বা ‘দেইল্যা রাজাকার’ নামে।
মুক্তিযুদ্ধকালে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী হিন্দুদের সম্পদকে ‘গনিমতের মাল’ হিসেবে আখ্যায়িত করে তাদের বাড়িঘর লুটপাট করে এবং লুটপাট শেষে তাতে অগ্নিসংযোগ ঘটায়। লুটপাটের মালামাল সে পাড়েরহাট বন্দরে বিক্রি করে অর্থের মালিক হয়। স্বাধীনতার পরপর সে আত্মগোপন করে এবং কয়েক বছর পর ওয়াজ- মাহফিলের নামে ধর্ম ব্যবসায় নামে। আশির দশকের শুরুতে সে জামায়াতে ইসলামীতে যোগ দেয় এবং পরবর্তীতে দলের নায়েবে আমীর নির্বাচিত হয়। সে জেনারেল জিয়া, এরশাদ ও খালেদা জিয়ার শাসনামলে ধর্মীয় অনুষ্ঠানে যোগদান ও বক্তব্য রাখার নামে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করে এবং সেখান থেকে অঢেল অর্থ সংগ্রহ করে। দেশের ভেতরে এবং বাইরে চরম সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ছড়ানোর অভিযোগে ২০০৯ সালে তার বিদেশ ভ্রমণের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। একই বছর পিরোজপুরে মানিক পাশারী নামে এক ব্যক্তি সাঈদীসহ ৪ জনের বিরুদ্ধে তার বাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও বাড়ির তত্ত্বাবধায়ককে হত্যার অভিযোগ এনে মামলা দায়ের করে। ওয়াজ-মাহফিলের নামে চরম সাম্প্রদায়িক বক্তব্য দিয়ে মানুষের ধর্মীয় বিশ্বাস ও অনুভূতিকে আহত করার অভিযোগ এনে ২০১০ সালে সাঈদীর বিরুদ্ধে অপর একটি মামলা দায়ের হয়। তার পরিপ্রেক্ষিতে একই বছর সাঈদীকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো হয়। এরপর যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম শুরু হলে সাঈদীকে আসামি হিসেবে ট্রাইব্যুনালের বিচারের সম্মুখীন করা হয়। তার বিরুদ্ধে পিরোজপুরের সাবডিভিশনাল পুলিশ অফিসার ফাইজুর রহমান (হুমায়ুন আহমেদ ও জাফর ইকবালের পিতা)-সহ একাধিক হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকা, অপহরণ, নির্যাতন, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, লুণ্ঠন, হিন্দুদের ধর্মান্তরিত করা ইত্যাদি ২০টি অভিযোগ আনা হয় এবং এর মধ্যে ৮টি অভিযোগ সুনির্দিষ্টভাবে প্রমাণিত হয়। ২০১৩ সালের ২৮শে ফেব্রুয়ারি ট্রাইব্যুনাল ২টি গুরুতর অভিযোগে তাকে সর্বোচ্চ শাস্তি ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ডাদেশ কার্যকর করার আদেশ দেয়, কিন্তু আপিল বিভাগের বিচারের রায় (১৭ই সেপ্টেম্বর ২০১৪)-এ সাঈদীর মৃত্যুদণ্ডাদেশের পরিবর্তে তাকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেয়া হয়। বর্তমানে সে ঐ দণ্ডাদেশ ভোগ করছে।

মওলানা আবদুল মান্নান (১৯৩৫-২০০৬)
স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধবিরোধী, যুদ্ধাপরাধী, রাজাকার, আলবদর বাহিনী ও শান্তি কমিটির সংগঠক, বুদ্ধিজীবী হত্যায় সক্রিয় সহযোগিতাকারী, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গণহত্যা, সংখ্যালঘু হত্যা, নারীধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটে মদদদান ও নিজে এরূপ কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণকারী, মাদ্রাসা শিক্ষকদের সংগঠন জমিয়াতে মুদার্রেসিন-এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মওলানা আবদুল মান্নান। ১৯৩৫ সালে চাঁদপুর জেলার ফরিদগঞ্জ উপজেলার ইসলামপুর গ্রামে তার জন্ম।
৭১-এ মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মওলানা আবদুল মান্নান স্বাধীনতাবিরোধী তৎপরতায় সক্রিয়ভাবে নিজেকে জড়িত করে এবং পাকহানাদার বাহিনীর সহযোগীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। মুক্তিযুদ্ধের শুরুর দিকে সে রাজাকারদের সঙ্গে নিয়ে নিজ এলাকা ফরিদগঞ্জে সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। অনেক নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করে, বহু ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয় এবং সম্পত্তি লুটপাট করে। এসব ঘৃণ্য কর্মের প্রতিশোধ নিতে মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা তার ঘরবাড়ি আগুনে পুড়িয়ে দেয়। ফলে সে ফরিদগঞ্জ ছেড়ে জুলাই মাসের শেষদিকে ঢাকায় আসে। নিজের পরিচয় গোপন করে ডা. আব্দুল আলীম চৌধুরীর এক প্রতিবেশীর মাধ্যমে মওলানা মান্নান সপরিবারে তাঁর (ডা. আলীম চৌধুরী) ২৯/১ পুরানা পল্টনের বাসার নিচতলায় এসে ওঠে। সেখান থেকে গোপনে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী তৎপরতা চালাতে থাকে। সে পাকহানাদার বাহিনীর চূড়ান্ত পরাজয়ের একদিন পূর্বে অর্থাৎ ১৫ই ডিসেম্বর ডা. আব্দুল আলীম চৌধুরীকে রাজাকারআলবদরদের হাতে তুলে দেয়। ঘাতকরা তাঁকে প্রথমে মোহাম্মদপুর শারীরিক শিক্ষা কলেজ নির্যাতনকেন্দ্রে নিয়ে হাত-পা ও চোখ বেঁধে অন্ধকার কুঠরিতে ফেলে সারারাত অমানবিক নির্যাতন চালায়। পরের দিন ১৬ই ডিসেম্বর খুব ভোরে রায়ের বাজার বধ্যভূমিতে নিয়ে গুলি ও বেয়নেট চার্জ করে অত্যন্ত নৃশংসভাবে তাঁকে হত্যা করে।
এদিকে পাকহানাদার বাহিনীর পরাজয়ের সঙ্গে-সঙ্গে মওলানা মান্নান আজিমপুরে এক বাসায় আত্মগোপন করে। সেখান থেকে ডা. আলীম চৌধুরীর এক ভাই কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাসহ মান্নানকে ধরে এনে তার কাছ থেকে বুদ্ধিজীবী হত্যাসহ অন্যান্য তথ্য জানতে হত্যা না করে বাঁচিয়ে রাখার সিদ্ধান্ত নেয় এবং রমনা থানায় সোপর্দ করে। এভাবে সে প্রাণে রক্ষা পায়। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর জিয়ার শাসন আমলে মওলানা মান্নান রাজনীতিতে সক্রিয় হয় এবং মন্ত্রীর মর্যাদায় উপদেষ্টা নিযুক্ত হয়। জেনারেল এরশাদ সরকারের আমলে সে ধর্ম, ত্রাণ ও পুনর্বাসন প্রতিমন্ত্রী ছিল। একই সময়ে মওলানা মান্নান মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী দৈনিক ইনকিলাব পত্রিকা প্রতিষ্ঠা করে। ২০০৬ সালের ৬ই ফেব্রুয়ারি মওলানা মান্নানের মৃত্যু ঘটে।

কামারুজ্জামান (১৯৫২-২০১৫)
স্বাধীনতাবিরোধী, যুদ্ধাপরাধী, ৭১-এ বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলের আলবদর বাহিনীর কমান্ডার ও প্রধান সংগঠক, গণহত্যা, সংখ্যালঘু হত্যা, নারীনির্যাতন, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর অন্যতম সহযোগী, স্বাধীনতোত্তর জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র সংগঠন ছাত্র শিবিরের প্রতিষ্ঠাতা সেক্রেটারি ও দুবার সভাপতি, জামায়াতের মুখপত্র দৈনিক সংগ্রাম-এর নির্বাহী সম্পাদক ও সাপ্তাহিক সোনার বাংলার সম্পাদক, যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত ও তা কার্যকর হওয়া জামায়াতে ইসলামীর সিনিয়র সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল কামারুজ্জামান।
১৯৫২ সালে বর্তমান শেরপুর জেলার বাজিতখিলা গ্রামে কামারুজ্জামানের জন্ম। পিতার নাম মৌলভী ইনসান আলী সরকার। মুক্তিযুদ্ধকালে কামারুজ্জামানের নেতৃত্বে আলবদর বাহিনী বৃহত্তর ময়মনসিংহের বিভিন্ন এলাকা থেকে মানুষজনকে ধরে এনে শেরপুরের বধ্যভূমিগুলোতে নৃশংসভাবে হত্যা করে। শেরপুরে কামারুজ্জামানের সঙ্গী কয়েকজন দুর্ধর্ষ ঘাতকের মধ্যে কামরান, জয়নাল আবেদীন, সুজা তালুকদার, হযরত আলী, আব্দুল বাকের, হবিবর রহমান, সুরুজ্জামান প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য।
যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ২০১০ সালের ১৩ই জুলাই কামারুজ্জামানকে গ্রেপ্তার করে ট্রাইব্যুনালে বিচারের সম্মুখীন করা হয়। তার বিরুদ্ধে আনীত ৭টি প্রধান অভিযোগের মধ্যে ছিল বদিউজ্জামানকে হত্যা, প্রভাষক আবদুল হান্নানের ওপর অমানবিক নির্যাতন, শেরপুর জেলার নলিতাবাড়ি উপজেলার সোহাগপুর গ্রামে আলবদর-রাজাকার ও পাকিস্তানি সেনাদের নিয়ে দেড় শতাধিক পুরুষকে হত্যা ও নারীধর্ষণ, গোলাম মোস্তাফা ও শেরপুরের চকবাজারে ৮ জনকে হত্যা, দিদার ও অন্যান্যদের ওপর চরম নির্যাতন, রমজান মাসে ৫ জনকে হত্যা ইত্যাদি। এর মধ্যে সোহাগপুর গণহত্যা ছিল সবচেয়ে ভয়াবহ ও মর্মস্পর্শী। সেখানে কামারুজ্জামানের নেতৃত্বাধীন রাজাকারআলবদর এবং পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী সম্মিলিতভাবে উল্লিখিত হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে গ্রামটিকে পুরুষশূন্য করে। তখন থেকে সোহাগপুরের নাম হয় ‘বিধবাপল্লী’৷ ট্রাইব্যুনালে তার বিরুদ্ধে উত্থাপিত সকল অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়। ফলে ২০১৩ সালে ট্রাইব্যুনাল উল্লিখিত মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে তার বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডের রায় দেয় এবং ২০১৫ সালের ১১ই এপ্রিল রাত ১০:৩০ মিনিটে ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারে ফাঁসিতে ঝুঁলিয়ে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।

আব্বাস আলী খান (১৯১৪-১৯৯৯)
মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতাবিরোধী, জামায়াতে ইসলামীর সিনিয়র নেতা, মুক্তিযুদ্ধকে প্রতিহত করতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সমর্থনে শান্তি কমিটি, রাজাকার, আলবদর ও আলশামস বাহিনী গঠনের অন্যতম উদ্যোক্তা, মুক্তিযুদ্ধকালে ইয়াহিয়া সরকার কর্তৃক আয়োজিত তথাকথিত উপনির্বাচনে অংশগ্রহণকারী, ডা. আবদুল মোতালিব মালিকের নেতৃত্বে পূর্ব পাকিস্তানে গঠিত বেসামরিক সরকারের শিক্ষামন্ত্রী আব্বাস আলী খান। ১৯১৪ সালে জয়পুরহাট জেলায় তার জন্ম।
১৯৭১ সালে আব্বাস আলী খান জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ছিল। মুক্তিযুদ্ধকে প্রতিহত করার লক্ষ্যে গঠিত শান্তি কমিটি, রাজাকার, আলবদর ও আলশামস বাহিনীতে সে নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালন করে। সে বহু সভা-সমাবেশ, মিছিল, পত্র-পত্রিকায় বিবৃতি এবং নিবন্ধ রচনা করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞের প্রতি সমর্থন জানায় এবং ইসলাম রক্ষার নামে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে ঐসব মানবতাবিরোধী কর্মে প্ররোচিত করে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে আব্বাস আলী খান ইয়াহিয়া সরকার আয়োজিত তথাকথিত উপনির্বাচনে অংশগ্রহণ করে এবং ডা. আবদুল মোতালিব মালিক-এর নেতৃত্বে গঠিত পূর্ব বাংলার প্রাদেশিক সরকারের মন্ত্রিসভায় শিক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করে। মুক্তিযুদ্ধের অব্যবহিত পরেই সে গ্রেপ্তার হয়। জেনারেল জিয়ার শাসন আমলে ১৯৮০ সালে জামায়াতে ইসলামীর পক্ষে প্রথম সাংবাদিক সম্মেলনে একাত্তরে তাদের ঘৃণ্য কর্মকাণ্ডের সমর্থনে সে প্রকাশ্য অবস্থান নেয়। আব্বাস আলী খান জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের সিনিয়র নায়েবে আমীর ছিল। গোলাম আযমকে প্রকাশ্যে আমীর ঘোষণা করার পূর্ব পর্যন্ত সে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত আমীরের দায়িত্ব পালন করে। যুদ্ধাপরাধের দায়ে বিচার শুরুর আগেই ১৯৯৯ সালে সে ঢাকায় মারা যায়।

এ টি এম আজহারুল ইসলাম (জন্ম ১৯৫২)
স্বাধীনতাবিরোধী, যুদ্ধাপরাধী, জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘের রংপুর জেলা শাখার সভাপতি, রংপুর জেলা আলবদর বাহিনীর কমান্ডার, বহু মানুষ ও মুক্তিযোদ্ধাকে নির্যাতন শেষে হত্যাকারী, গণহত্যা, সংখ্যালঘু হত্যা, অপহরণ, নারীনির্যাতন, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটে অংশগ্রহণ, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে সর্বাত্মক সহযোগিতাদানকারী, মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডপ্রাপ্ত ও আপিল বিভাগ কর্তৃক ট্রাইব্যুনালের ঐ রায় বহাল থাকা জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এ টি এম আজহারুল ইসলাম।
১৯৫২ সালে রংপুর জেলার বদরগঞ্জ থানার বাতাসন লোহানীপাড়া গ্রামে এ টি এম আজহারুল ইসলামের জন্ম। তার পিতার নাম ডা. নাজির হোসেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় সে রংপুর কারমাইকেল কলেজে উচ্চ মাধ্যমিকের ছাত্র ছিল। ৭০-এর জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে আজহারুল ইসলাম রংপুরে জামায়াতের প্রার্থীদের পক্ষে নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নেয়। মুক্তিযুদ্ধকালে সে ইসলামী ছাত্র সংঘের রংপুর জেলা শাখার সভাপতির পাশাপাশি জেলা আলবদর বাহিনীর কমান্ডার ছিল। ৭০ জন আলবদর সদস্য নিয়ে সে একটি বাহিনী গঠন করে। ১৬ই ডিসেম্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের পর সে অনেক দিন পলাতক ছিল। ৭৫-এর ১৫ই আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর জেনারেল জিয়ার শাসনামলে জামায়াতে ইসলামীর পুনরুজ্জীবন শুরু হলে আজহারুল ইসলাম সংগঠনে সক্রিয় হয় এবং দলের কেন্দ্রীয় গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত হয়।
যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ২০১২ সালের ২২শে আগস্ট এ টি এম আজহারুল ইসলামকে গ্রেপ্তার করে ট্রাইব্যুনালে বিচারের সম্মুখীন করা হয়। ট্রাইব্যুনালে তার বিরুদ্ধে হত্যা, ধর্ষণ, অপহরণ, আটক, নির্যাতন ও অগ্নিসংযোগ ইত্যাদি ৬ ধরনের অভিযোগ আনা হয়। এর মধ্যে ৫টি অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়। তার মধ্যে প্রধান ৩টি অভিযোগ হলো— তার নেতৃত্বাধীন রাজাকারআলবদর ও পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কর্তৃক ১৬ই এপ্রিল রংপুরের বদরগঞ্জ উপজেলার ধাপপাড়ার ১৫ জন নিরস্ত্র মানুষকে হত্যা, ১৭ই এপ্রিল বদরগঞ্জের ঝাড়ুয়ারবিল এলাকার আশপাশের গ্রামের দেড় হাজারের মতো সাধারণ মানুষকে নিমর্মভাবে হত্যা (যাদের অধিকাংশ সংখ্যালঘু হিন্দু পরিবারভুক্ত) এবং সে হত্যাকাণ্ডে আজহারুল ইসলামের সক্রিয় অংশগ্রহণ, পাকিস্তানি হানাদারবাহিনীর সঙ্গে সম্মিলিতভাবে কারমাইকেল কলেজের ৪ শিক্ষক যথা— কালাচাঁদ রায়, সুনীল বরণ চক্রবর্তী, রামকৃষ্ণ অধিকারী ও চিত্তরঞ্জন এবং কালাচাঁদের স্ত্রী মঞ্জুশ্রী রায়কে কলেজ ক্যাম্পাস থেকে অপহরণ করে দমদম সেতুর কাছে নিয়ে গুলি করে হত্যা। এ তিন অভিযোগের দায়ে যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল ২০১৪ সালের ৩০শে ডিসেম্বর তাকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেয়। ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে তার পক্ষ থেকে উচ্চ আদালতে আপিল করা হলে দীর্ঘ শুনানি শেষে আপিল বিভাগ ৩১শে অক্টোবর ২০১৯ ট্রাইব্যুনালের পূর্বের মৃত্যুদণ্ডাদেশ রায় বহাল রাখে। তার দণ্ডাদেশ কার্যকর করার প্রক্রিয়া চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে।
আবুল কালাম আজাদ ওরফে বাচ্চু রাজাকার (জন্ম ১৯৪৭) স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধবিরোধী, মানুষ হত্যা, সংখ্যালঘু হিন্দুদের হত্যা, বাড়িঘর লুটপাট, দখল ও অগ্নিসংযোগকারী, নারীধর্ষক, পাকিস্তানিদের দোসর, রাজাকার বাহিনীর স্থানীয় নেতা, বেসামরিক সশস্ত্র সংগঠন ‘খারদিয়ার মিলিটারি বাহিনী’ গঠন ও এর প্রধান, মানবতাবিরোধী অপরাধে যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচারে মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত পলাতক জামায়াতে ইসলামীর রুকন আবুল কালাম আজাদ।
মুক্তিযুদ্ধকালে ‘বাচ্চু রাজাকার’ নামে পরিচিত আবুল কালাম আজাদ ১৯৪৭ সালে ফরিদপুর জেলার নগরকান্দা উপজেলার খাড়দিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করে। প্রাথমিক পর্যায়ে মাদ্রাসায় শিক্ষা শেষ করে মুক্তিযুদ্ধের সময় ফরিদপুর রাজেন্দ্র কলেজে ইন্টারমেডিয়েটে ভর্তি হয় এবং সে অবস্থায় মুক্তিযুদ্ধবিরোধী তৎপরতায় লিপ্ত হয়। নিজ এলাকা খাড়দিয়ায় পাকহানাদার বাহিনীর পৃষ্ঠপোষকতায় প্রায় শতাধিক যুবককে নিয়ে সে একটি প্রাইভেট সশস্ত্র সংগঠন গড়ে তোলে, যা ‘খাড়দিয়ার মিলিটারি বাহিনী’ নামে পরিচিতি পায়। মুক্তিযুদ্ধকালে নিজ বাহিনী নিয়ে হত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, ঘরবাড়ি দখলের পাশাপাশি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে মেয়েদের তুলে দেয়া, মুক্তিযোদ্ধাদের ধরিয়ে দেয়াসহ এমন কোনো মানবতাবিরোধী অপরাধ ছিল না যা তার দ্বারা সংঘটিত হয়নি। হাসামদিয়ার হরিপদ সাহা, সুরেশ পোদ্দার, মল্লিক চক্রবর্তী, সুবল কয়াল, শরৎ সাহা; শ্রীনগরের প্রবীর সাহা, যতীন্দ্রনাথ সাহা, জিন্নাত আলী বেপারী; ময়েনদিয়ার শান্তিরাম বিশ্বাস; কলারনের সুধাংশু রায়; পুরুরার জ্ঞানেন, মাধব চন্দ্র বিশ্বাসসহ অত্র অঞ্চলের প্রায় ৫০টি গ্রামে বহু লোকজনকে হত্যার মাধ্যমে সে এক ভয়াবহ ত্রাসরূপে আবির্ভূত হয়। নগরকান্দা উপজেলার দাদপুর গ্রামের শোভা রানী বিশ্বাস একই গ্রামের নগেন বিশ্বাসের স্ত্রী দেবী বিশ্বাসসহ অনেক নারীর ওপর বাচ্চু রাজাকার পাশবিক নির্যাতন চালায়। স্বাধীনতোত্তরকালে বোয়ালখালী থানায় এবং ফরিদপুরে ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে তার বিরুদ্ধে একাধিক মামলা হয় এবং গ্রেফতার হয়ে বন্দি জীবন কাটায়। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর মোশতাক-জিয়ার শাসনকালে মুক্তিলাভ করে।
২০১০ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠনের পর তার বিরুদ্ধে ৮টি মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আনা হয়। এর মধ্যে ৭টি অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত হয় এবং হত্যা, ধর্ষণসহ ৩টি গুরুতর অপরাধের জন্য বিচারিক প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে ২০১৩ সালের ২১শে জানুয়ারি ট্রাইব্যুনাল তাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার রায় দেয়। তার বিচার প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার প্রাক্কালে ২০১২ সালের মার্চ মাসে সে গোপনে দেশ ত্যাগ করে। তাই তার অনুপস্থিতিতেই বিচার কার্য সম্পন্ন হয় এবং পলাতক থাকায় বিচারের রায় কার্যকর এখনো করা সম্ভব হয়নি। উল্লেখ্য, যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে এটাই ছিল প্রথম কোনো রায়।

মওলানা আবদুস সোবহান (জন্ম ১৯২৯)
স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধবিরোধী, যুদ্ধাপরাধী, ৭১-এ পাবনা জেলা জামায়াতে ইসলামীর ভারপ্রাপ্ত আমীর, পাবনায় শান্তি কমিটির ভাইস-প্রেসিডেন্ট, পাকহানাদার বাহিনীর গণহত্যায় সক্রিয় অংশগ্রহণ ও সহযোগিতাদানকারী, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়ে মৃত্যুদণ্ডাদেশ প্রাপ্ত যুদ্ধাপরাধী মওলানা আবদুস সোবহান।
পাবনা জেলার সুজানগর থানার মোমিনপাড়া গ্রামে ১৯২৯ সালে মওলানা আবদুস সোবহানের জন্ম। তার পিতার নাম মুন্সী নাঈম উদ্দিন আহমেদ। ১৯৬৫ সালে তাদের পরিবার পাবনা নগরীর গোপালপুরের পাথরটোলা চলে আসে এবং সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে। মওলানা আবদুস সোবহানের লেখাপড়া মাদ্রাসায় এবং সে ফাজিল ও কামিল “ডিগ্রি অর্জন করে। বেশ কয়েক বছর সে বিভিন্ন মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করে। ১৯৫১ সালে সে জামায়াতে ইসলামীতে যোগ দেয়। পাবনা জেলা শাখার আমীর হওয়া ছাড়াও সে পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামের কেন্দ্রীয় মজলিসের শূরা ও কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য ছিল। পরবর্তীতে সে জামায়াতের নায়েবে আমীর হয়।
মুক্তিযুদ্ধের সময় পাবনার আলবদর, রাজাকার ও শান্তি কমিটির সদস্য সংগ্রহে মাওলানা সোবহান উদ্যোগ নেয়। মে মাসে পাবনা জেলার ফরিদপুর থানার ডেমরাতে পাকিস্তানি হানাদারদের সঙ্গে মিলিত হয়ে সে মাওলানা ইসহাক, টেগার ও আরো কয়েকজন দালালের একটি শক্তিশালী দল নিয়ে ব্যাপক গণহত্যা চালায়। ঐ গণহত্যায় এক হাজারের মতো মানুষ নিহত হয়। এছাড়াও তার মদদে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোকজনের ঘরবাড়ি লুণ্ঠন এবং নারীদের ওপর নির্যাতন করা হয়। পাবনার দ্বিতীয় বৃহত্তম গণহত্যাটি সংঘটিত হয় সুজানগর থানায়। মে মাসের প্রথম দিকে এক ভোরে তার প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় নাজিরগঞ্জ-সাতবাড়িয়া ইউনিয়নে এক হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়, যাতে প্রায় ৪০০ মানুষ প্রাণ হারায়। পাবনায় হানাদার বাহিনী ও তাদের সহযোগীদের অপারেশনের পূর্বে মওলানা সোবহানের বাসায় এর পরিকল্পনা করা হয়। একাত্তরে গণহত্যা ও হানাদার বাহিনীকে সহায়তা করার অভিযোগে ১৯৭২ সালে তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়। সে-সময় সে পালিয়ে পাকিস্তানে চলে যায়। পরবর্তীতে দেশে ফিরে এসে পুনরায় জামায়াতের সঙ্গে যুক্ত হয়ে রাজনীতিতে সক্রিয় হয়। ২০১২ সালে মওলানা আবদুস সোবহানকে এক মামলায় গ্রেপ্তার করে মুক্তিযুদ্ধকালে তার নেতৃত্ব ও সহযোগিতায় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচারের জন্য বন্দি দেখানো হয়। ২০১৫ সালের ২৮শে ফেব্রুয়ারি ট্রাইব্যুনাল যুদ্ধাপরাধ ও মাবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে তাকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেয়। এ দণ্ডাদেশ কার্যকর করার প্রক্রিয়া চূড়ান্ত পর্যায়ে থাকা অবস্থায় ২০২০ সালের ১৪ই ফেব্রুয়ারি সে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করে।

চৌধুরী মঈনুদ্দীন (জন্ম ১৯৪৮)
যুদ্ধাপরাধী, ৭১-এ আলবদর বাহিনীর অন্যতম ঘাতক, বুদ্ধিজীবী হত্যার পরিকল্পনা ও বাস্তাবায়নকারীদের অন্যতম, যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত পলাতক আসামী চৌধুরী মঈনুদ্দীন। ১৯৪৮ সালে ঢাকায় তার জন্ম।
ডিসেম্বরে মুক্তিযুদ্ধে পাকহানাদার বাহিনীর চূড়ান্ত পরাজয় যখন নিশ্চিত হয়ে ওঠে, ঠিক সে মুহূর্তে চৌধুরী মঈনুদ্দীন ও তার সহযোগীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথিতযশা শিক্ষক, দেশবরেণ্য সাংবাদিক, বিশিষ্ট চিকিৎসক ও অন্যান্য বুদ্ধিজীবীদের তাঁদের বাসভবন থেকে ধরে নিয়ে রায়েরবাজার ও মিরপুরের বধ্যভূমিতে অত্যন্ত নৃশংসভাবে হত্যা করে। অপারেশনইন-চার্জ হিসেবে অনেক বুদ্ধিজীবীকে সে নিজ হাতে হত্যা করে। ১৬ই ডিসেম্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের পরপর সে হত্যা-পরিকল্পনার কাগজপত্র নিয়ে দেশ থেকে লন্ডনে পালিয়ে যায়। তার বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে ১৮ জন বুদ্ধিজীবীকে অপহরণের পর হত্যার দায়ে আনীত ১১টি অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হওয়ায় ট্রাইব্যুনাল ২০১৩ সালের ৩রা নভেম্বর তার অনুপস্থিতিতে তাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ডাদেশের রায় ঘোষণা করে। প্রত্যেকটি অভিযোগের জন্যই ট্রাইব্যুনাল তাকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেয়। সে বর্তমানে পলাতক রয়েছে।

আশরাফুজ্জামান খান (জন্ম ১৯৪৮)
যুদ্ধাপরাধী, ৭১-এ আলবদর বাহিনীর শীর্ষ নেতা, ইসলামী ছাত্র সংঘের কেন্দ্রীয় সদস্য, ঘাতক-খুনি, বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা ও বাস্তাবায়নকারীদের অন্যতম, যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত পলাতক আসামী আশরাফুজ্জামান খান। ১৯৪৮ সালে ফরিদপুর জেলায় তার জন্ম।
৭১-এর ডিসেম্বরের শেষদিকে আশরাফুজ্জামান খানের ৩৫০, নাখালপাড়ার বাড়ি থেকে তার ব্যক্তিগত একটি ডায়েরি উদ্ধার করা হয়। ঐ ডায়েরিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যেসব শিক্ষককে হত্যার তালিকা তৈরি করা হয় এমন ২০ জনের নাম লেখা ছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৯ জন বিশিষ্ট শিক্ষক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান চিকিৎসক ডা. গোলাম মোর্তজার নাম এবং তাঁদের কোয়ার্টার্স ও নিজ-নিজ বাসার নম্বর ডায়েরিতে পাওয়া যায়। আশরাফুজ্জামান খানের গাড়ির ড্রাইভার মফিজুদ্দিনের স্বীকারোক্তি থেকে জানা যায় যে, ৭১- এর ডিসেম্বরে আশরাফুজ্জামান ও তার বাহিনী মিরপুরে ড. মুনীর চৌধুরী, ড. আবুল খায়ের, গিয়াসউদ্দীন আহমদ, রাশিদুল হাসান, ড. ফয়জুল মহী এবং ডা. গোলাম মোর্তজাসহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য শিক্ষকদের গুলি করে হত্যা করে। মফিজুদ্দিনের স্বীকারোক্তির ভিক্তিতে রায়েরবাজারের বিল এবং মিরপুরের শিয়ালবাড়ী বধ্যভূমি থেকে শহীদ অধ্যাপকদের গলিত ও বিকৃত লাশ উদ্ধার করা হয়। ডায়েরিতে এছাড়াও হত্যার তালিকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের আরো কিছু শিক্ষকের নাম ছিল। তার বিরুদ্ধে বুদ্ধিজীবীদের অপহরণের পর হত্যার দায়ে আনীত ১১টি অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়। ফলে যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল ২০১৩ সালের ৩রা নভেম্বর মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ঘাতক আশরাফুজ্জামান খানকে ফাঁসিতে ঝুঁলিয়ে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার রায় ঘোষণা করে। প্রত্যেকটি অভিযোগের জন্য তাকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেয় ট্রাইব্যুনাল। স্বাধীনতার পরপরই আশরাফুজ্জামান খান বিদেশে পালিয়ে যায়। এম এ জাহিদ হোসেন ওরফে খোকন রাজাকার স্বাধীনতাবিরোধী ও যুদ্ধাপরাধী হিসেবে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচারের রায়ে মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত এম এ জাহিদ হোসেন ওরফে খোকন রাজাকার। ফরিদপুরের নগরকান্দায় তার জন্ম। পিতার নাম মোতালিব মিয়া। তাদের এ পরিবার ছিল মুক্তিযুদ্ধবিরোধী। খোকন রাজাকার ও তার বড় ভাই জাফর উভয়ই ১৯৭০ সালের নির্বাচনে জামায়াতের প্রার্থীর পক্ষে কাজ করে। মুক্তিযুদ্ধকালে খোকন রাজাকারের বড় ভাই জাফর হোসেনও রাজাকার কমান্ডার ছিল। মে মাসে চাঁদহাটের যুদ্ধে সে ধরা পড়ে জনতা ও মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে নিহত হয়। মুক্তিযুদ্ধকালে নগরকান্দায় বাচ্চু রাজাকারের মতো খোকন রাজাকারও একটি সশস্ত্র বাহিনী গঠন করে অত্র এলাকায় হত্যা, অপহরণ, ধর্ষণ, নির্যাতন, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, হিন্দুদের ধর্মান্তরিত ও দেশান্তরে বাধ্য করা ইত্যাদি কর্মকাণ্ডে নেতৃত্ব দেয়। স্বাধীনতার পর সে আত্মগোপনে যায় এবং ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর এলাকায় ফিরে আসে। উল্লেখ্য, ১৯৭২ সালে দালাল আইনে তার বিরুদ্ধে ফরিদপুরে একটি মামলা দায়ের করা হয়েছিল। জিয়াউর রহমানের শাসনামলে সে জামায়াত ছেড়ে বিএনপি- তে যোগ দেয় এবং নগরকান্দা পৌর বিএনপি-র সহ- সভাপতি হয়।
২০১০ সালে আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া শুরুর প্রাক্কালে খোকন রাজাকার নিরুদ্দেশ হয়। ২০১২ সালে তার বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের তদন্ত শুরু হয় এবং তদন্ত কর্মকর্তা কর্তৃক প্রতিবেদন জমা দেয়ার পর জুলাই মাসে ট্রাইব্যুনাল বিএনপি-র এ নেতার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে। পলাতক অবস্থায় তার বিচারকার্য শুরু হয়। তার বিরুদ্ধে আনা ১১টি অভিযোগের মধ্যে ১০টি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়। এর মধ্যে অপহরণ, আটক, নির্যাতন, হত্যা, গণহত্যা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের দায়ে ট্রাইব্যুনাল ২০১৪ সালের ১৩ই নভেম্বর তার বিরুদ্ধে ফাঁসিতে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার রায় দেয়। পলাতক থাকায় এ রায় এখন পর্যন্ত কার্যকর করা সম্ভব হয়নি।

আব্দুল মোনায়েম খান (১৮৯৯-১৯৭১)
পাকিস্তানের কট্টর সমর্থক, স্বৈরশাসক আইয়ুব খানের অত্যন্ত অনুগত ও বিশ্বস্ত দোসর মোনায়েম খান ১৮৯৯ সালে কিশোরগঞ্জ জেলার বাজিতপুর উপজেলায় জন্মগ্রহণ করে। তার পিতার নাম মৌলভী কমর আলী খান। মোনায়েম খান ময়মনসিংহ জেলা বারে যোগ দিয়ে আইনজীবী হিসেবে তার কর্মজীবন শুরু করে। সে ছিল ময়মনসিংহ জেলা মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠাতা সেক্রেটারি।
আইয়ুব শাসন আমলে মোনায়েম খান দীর্ঘ সময় ধরে (১৯৬২-৬৯) পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ছিল। সে গভর্নর থাকাকালে পূর্ব বাংলায় ৬২ ও ৬৪-র শিক্ষা আন্দোলন, ৬৬ সালের ছয়দফা আন্দোলন ও ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান সংঘটিত হয়। ১৯৬৪ সালে তার উপস্থিতিতে কার্জন হলে আয়োজিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কনভোকেশন ছাত্ররা ভণ্ডুল করে দেয়। সে কার্যত আইয়ুব খানের সেবাদাসে পরিণত হয়েছিল। এ কারণে বঙ্গবন্ধু ১৯৬৬ সালে ‘বাঙালির মুক্তির সনদ’ ছয়দফা কর্মসূচি ঘোষণা করলে একদিকে এর সমর্থকদের বিরুদ্ধে আইয়ুব অস্ত্রের ভাষা প্রয়োগের হুমকি দেয়, অপরদিকে মোনায়েম খান ঘোষণা করে, ‘যতদিন সে গভর্নর পদে আসীন আছে, ততদিন শেখ মুজিবকে জেলে থাকতে হবে’। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়েরের পেছনে তার ভূমিকা ছিল বলে মনে করা হয়। পাকিস্তানের প্রতি তার কট্টর সমর্থন, পাকহানাদার বাহিনীর কার্যকলাপের প্রতি সর্বাত্মক সহযোগিতা প্রদান ও মুক্তিযুদ্ধবিরোধী অবস্থানের জন্য ১৯৭১ সালের ১৩ই অক্টোবর কিশোর মুক্তিযোদ্ধা মোজাম্মেল হক মোনায়েম খানকে তার গুলশানের নিজ বাসভবনে গুলি করে হত্যা করে। তার মৃত্যুতে গোলাম আযম মুক্তিযোদ্ধাদের ‘দুষ্কৃতিকারী’ আখ্যা দিয়ে শোক প্রকাশ করে।

খান এ সবুর (১৯০৮-১৯৮২)
স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে বিরোধিতাকারীদের মধ্যে অন্যতম খুলনার মুসলিম লীগ নেতা খান এ সবুর। ৭১ সালে রাজাকার বাহিনী গঠনে সে একজন উদ্যোক্তা ছিল। মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর প্রতি শুরু থেকেই সে পূর্ণ সমর্থন ব্যক্ত এবং নানাভাবে তাদের সহযোগিতা করে।
বর্ষিয়ান রাজনীতিবিদ, পাকিস্তান আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালনকারী খান এ সবুর ১৯০৮ সালে খুলনায় জন্মগ্রহণ করে। তার পিতার নাম নাজমুল হোসেন খান। ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগ থেকে সে আইন সভার সদস্য নির্বাচিত হয়। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর সবুর পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগের প্রচার সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করে। ১৯৬২ সালে জেনালে আইয়ুব খানের কনভেনশন মুসলিম লীগে যোগ দিয়ে একই বছর পরোক্ষ নির্বাচনভিত্তিক তথাকথিত মৌলিক গণতন্ত্র ব্যবস্থায় পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়। সবুর খান প্রেসিডেন্ট জেনারেল আইয়ুবের কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় যোগাযোগ মন্ত্রী ছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময় সে মুসলিম লীগ (কাইয়ূম) গ্রুপের সেক্রেটারি জেনারেল-এর দায়িত্ব পালন করে।
খান এ সবুর মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ও প্রচারণা চালায় এবং জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে নিয়ে মুক্তিবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে তার অনুসারীদের নির্দেশ দেয়। ১৯৭১ সালে ঢাকায় পাকিস্তান প্রতিরক্ষা দিবস উপলক্ষে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে সবুর ঘোষণা করে, ‘পাক-ভারত যুদ্ধ বাধলে তা বিশ্বযুদ্ধে রূপ নেবে। ভারত পাকিস্তানের দুর্ধর্ষ সেনাবাহিনীকে মোকাবেলা করতে পারবে না বলেই পূর্ব পাকিস্তানে মুক্তিবাহিনী নামে পঞ্চম বাহিনী গড়ে তুলেছে।’ পাকহানাদার বাহিনীর সমর্থনে গঠিত তথাকথিত শান্তি কমিটির উদ্যোগে ২রা মে খুলনার এক সভায় সে বলে, ‘কতিপয় ব্যক্তি ব্যতীত বাঙালি জাতীয়তাবাদ পাকিস্তানিরা প্রত্যাখ্যান করেছে। এটা কোনো মতবাদই নয়। বহু ত্যাগ ও রক্তের বিনিময়ে পাকিস্তানের জন্ম হয়েছে। পাকিস্তানকে আমরা ধ্বংস হতে দিতে পারি না। আমরা সবাই পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদের পক্ষে। জীবন দিয়ে হলেও আমরা পাকিস্তানকে রক্ষা করবো।’
৭ই জুন মুসলিম লীগ নেতা খান এ সবুর ঢাকায় এক বিবৃতিতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ক্লাস শুরুর আগে পাকিস্তানি পতাকা ও সঙ্গীত পরিবেশনের দাবি জনায়। ১৬ই ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জিত হলে সবুর খান আত্মহত্যার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। ১৯৭২ সালের দালাল আইনে গ্রেপ্তার হয়ে অনেকদিন বন্দি জীবন কাটায়। জেনারেল জিয়া ক্ষমতাসীন হয়ে অন্যান্য যুদ্ধাপরাধীর মতো সুবর খানকেও রাজনৈতিকভাবে পুনর্বাসিত করে। ১৯৭৬ সালে সবুর খান মুসলিম লীগকে পুনরুজ্জীবিত করে এবং দলের সভাপতি নির্বাচিত হয়। ১৯৮২ সালের ২৫শে জানুয়ারি তার মৃত্যু হয়।

গিয়াসউদ্দীন কাদের চৌধুরী
চট্টগ্রামের মুসলিম লীগ নেতা, মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতাবিরোধী, যুদ্ধাপরাধী ফজলুল কাদের চৌধুরীর পুত্র গিয়াসউদ্দীন কাদের চৌধুরী। ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধকালে চট্টগ্রাম নগরী এবং রাউজানে রাজাকার, আলবদর এবং আলশামস বাহিনীর গণহত্যা, নারীনির্যাতন, স্বাধীনতার পক্ষের লোকজন বিশেষ করে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর নির্যাতন, বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ ইত্যাদি কর্মকাণ্ডে সে সক্রিয় সহযোগিতা করে। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিহত করার লক্ষ্যে সে নিজেই রাজাকার বাহিনীতে সক্রিয় হয় এবং পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সহযোগী হিসেবে চট্টগ্রামে তাদের ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ, হিন্দুদের ঘরবাড়ি পোড়ানো ও অন্যান্য অপতৎপরতায় অংশ নেয়। গিয়াস কাদের চৌধুরী বিএনপি-র একজন কেন্দ্রীয় নেতা।

এ বি এম খালেক মজুমদার
স্বাধীনতাবিরোধী, যুদ্ধাপরাধী, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সহযোগী, আলবদর বাহিনীর অন্যতম কমান্ডার, বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের অন্যতম পরিকল্পনাকারী ও হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে জড়িত, পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর ঢাকা নগর শাখার অফিস সেক্রেটারি এ বি এম খালেক মজুমদার।
কুমিল্লা জেলার হাজিগঞ্জ উপজেলার দোহাড্ডা গ্রামে তার জন্ম। পিতার নাম আব্দুল মজিদ মজুমদার। সে ঢাকার আগামসি লেনে বসবাস করত। ৭১-এর ১৪ই ডিসেম্বর পুরান ঢাকা থেকে লেখক, সাংবাদিক ও সাহিত্যিক শহীদুল্লাহ কায়সারকে আলবদর বাহিনী কর্তৃক ধরে নেয়ার সময় খালেক মজুমদার মুখোশ পড়ে ঘাতক চক্রের সঙ্গে ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিল বলে তার বিরুদ্ধে পরিবারের পক্ষ থেকে অভিযোগ রয়েছে। উল্লেখ্য, শহীদুল্লাহ কায়সারকে অন্যান্য বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে মিরপুর বধ্যভূমিতে আলবদর বাহিনী কর্তৃক নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। ১৬ই ডিসেম্বরের পর খালেক মজুমদার মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে গ্রেপ্তার হয়, তবে পরবর্তীতে ছাড়া পায়। জেনারেল জিয়ার শাসনামলে জামায়াতে ইসলামী পুনরুজ্জীবিত হলে সে প্রথমে এর রুকন ও পড়ে কেন্দ্রীয় মজলিশে শূরার সদস্য হয়। ২০১৪ সালের ২৪শে জুলাই তার মৃত্যু হয়।

ত্রিদিব রায় (১৯৩৩-২০১২)
স্বাধীনতাবিরোধী, পাকিস্তানের একনিষ্ঠ সমর্থক, মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকেই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর প্রতি সর্বপ্রকার সমর্থন ও সহযোগিতা প্রদানকারী, মুক্তিযুদ্ধে হানাদার বাহিনীর চূড়ান্ত পরাজয় ও আত্মসমর্পণের সময় বিদেশে অবস্থানরত অবস্থায় সেখান থেকে পাকিস্তানে গিয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস, সরকারের মন্ত্রিত্ব গ্রহণ এবং মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত পাকিস্তানি কূটনীতিক হিসেবে বিভিন্ন দেশে দায়িত্ব পালন ও অন্যান্য পদমর্যাদায় অধিষ্ঠিত থাকা চাকমা রাজা ত্রিদিব রায়।
পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙ্গামাটিতে চাকমা রাজপ্রাসাদে ১৯৩৩ সালে ত্রিদিব রায়ের জন্ম। তার পিতার নাম নলিনাক্ষ রায় এবং মাতা বিনীতা রায় (জিয়ার শাসনামলে তার উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য)। ১৯৫৩ সালে সে চাকমা সার্কেলের রাজা হিসেবে অভিষিক্ত হয়। ভারতে লেখাপড়া শেষে ১৯৫৩ সালে লিঙ্কনস-ইন থেকে ত্রিদিব রায় ব্যারিস্টার-এট-ল হয়।
ত্রিদিব রায় পাকিস্তানি রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও সামরিক কর্মকর্তাদের নিকট খুবই প্রিয় ছিল। ১৯৫৩ সালে পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবসে সরকার কর্তৃক তাকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে সম্মানসূচক কমিশন প্রদান করা হয়। ত্রিদিব রায় বঙ্গবন্ধুর ৬-দফা কর্মসূচির বিরোধী ছিল। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে পার্বত্য অঞ্চল থেকে সে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে নির্বাচিত হয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি শীর্ষ সেনাকর্মকর্তাদের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। পাকিস্তানের পক্ষে এবং মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করে সে রাঙ্গামাটিতে একাধিক সভায় বক্তব্য রাখে এবং হানাদার বাহিনীকে সর্বাত্মক সহযোগিতাদানে তার সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানায়। চাকমা সম্প্রদায়ের রাজা হিসেবে পাকিস্তানের পক্ষ অবলম্বন করায় অনিচ্ছা সত্ত্বেও বেশকিছু সংখ্যক চাকমা তরুণ রাজাকার বাহিনীতে ভর্তি হয়ে ট্রেনিং নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধাচরণ করে। মুক্তিযুদ্ধকালে ত্রিদিব রায় পাকিস্তান সরকারের পক্ষে সমর্থন আদায়ে বৌদ্ধ প্রধান বিভিন্ন রাষ্ট্র, যথা থাইল্যান্ড, শ্রীলংকা ও বার্মা ভ্রমণ করে। মুক্তিযুদ্ধের শেষের দিকে জেনারেল ইয়াহিয়া খান তাকে বিশেষ দূত হিসেবে নিয়োগ দেয়। ডিসেম্বর মাসে থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককে থাকাকালে হানাদার বাহিনীর চূড়ান্ত পরাজয় ঘটে। বাংলাদেশে ফিরে না এসে সেখান থেকে সে পাকিস্তানে চলে যায়। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ সরকার প্রণীত দালাল আইনে তালিকাভুক্তদের মধ্যে তার নাম অন্তর্ভুক্ত ছিল।

এদিকে মুক্তিযুদ্ধে পরাজয়ের পর জেনারেল ইয়াহিয়ার স্থলে জুলফিকার আলী ভুট্টো পাকিস্তানে সরকর গঠন করলে ত্রিদিব রায় ঐ সরকারে মন্ত্রী হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৯৭৭ সালে এক সামরিক অভ্যুত্থানে ভুট্টোর পতনের পূর্ব পর্যন্ত সে মন্ত্রিপদে আসীন ছিল। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরও ত্রিদিব রায় পাকিস্তানের পক্ষে ও বাংলাদেশের বিরোধিতা করে বিভিন্ন সময়ে প্রতিনিধি দলের সদস্য হয়ে বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থায় যোগ দেয়। জেনারেল জিয়াউল হকের সামরিক সরকারের সময় সে বিশ্বের একাধিক দেশে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করে। ২০১২ সালের ১৭ই সেপ্টেম্বর পাকিস্তানের ইসলামাবাদে ত্রিদিব রায়ের মৃত্যু হয় এবং সেদেশে তার অন্ত্যেস্টিক্রিয়া সম্পন্ন হয়। উল্লেখ্য, ত্রিদিব রায়ের পুত্র ব্যারিস্টার দেবাশিষ রায় বর্তমানে বাংলাদেশে চাকমা সার্কেলের রাজা।

মুক্তিযুদ্ধবিরোধী রাজনৈতিক দল ও সংগঠন

জামায়াতে ইসলামী
মওদুদীর ভাবাদর্শে গড়া, কট্টরপন্থী, ক্যাডারভিত্তিক, ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক, মুক্তিযুদ্ধবিরোধী প্রধান রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামী।
১৯৪১ সালে ব্রিটিশ ভারতে মওলানা আবুল আলা মওদুদীর নেতৃত্বে এ দলের প্রতিষ্ঠা। তখন এর নাম ছিল জামায়াতে ইসলামী হিন্দ। দলটি ভারত বিভক্তি ও পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার বিপক্ষে ছিল। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর এ দলের নামকরণ করা হয় জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তান। জামায়াতে ইসলামী ভৌগোলিক বা ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী নয়। এ দলের বিশ্বাস বিশ্ব ইসলামি ভ্রাতিত্বে।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর জামায়াতে ইসলামী রাষ্ট্রের অখণ্ডত্ব বজায় রাখার পক্ষে দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করে। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে অধিকাংশ আসনে জামায়াতের প্রার্থীরা আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের নিকট শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়ে জামানত হারায়। মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকেই এ দল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর প্রতি সর্বাত্মক সহযোগিতা ও সমর্থন ব্যক্ত করে। তখন পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর আমীর ছিল গোলাম আযম। সে একাধিকবার পাকিস্তানমনা বিভিন্ন দলের প্রতিনিধিদের নিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক গভর্নর লে. জেনারেল টিক্কা খানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে। হানাদার বাহিনীর গণহত্যায় জামায়াতে ইসলামী সর্বপ্রকার মদদ যোগায়। মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা ও বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে প্রতিহত করতে দলটি রাজাকার, আলবদর, আলশামস, শান্তি কমিটি ইত্যাদি আধাসামরিক বাহিনী গঠনে প্রধান ভূমিকা পালন করে। ৩রা সেপ্টেম্বর ডা. আবদুল মোতালিব মালিক-কে গভর্নর করে তার নেতৃত্বে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য একটি বেসামরিক সরকার গঠিত হলে, ঐ সরকারে জামায়াতের ২ জন প্রতিনিধি অন্তর্ভুক্ত হয়। মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী পরাজয়ের প্রাক্কালে এ দেশের শ্রেষ্ঠ বুদ্ধিজীবীদের হত্যার নীলনকশা প্রণয়ন ও তা কার্যকর করার ক্ষেত্রে জামায়াতের ক্যাডাররা মুখ্য ভূমিকা পালন করে।
স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু সরকার প্রণীত ৭২-এর সংবিধানে ধর্মভিত্তিক সাম্প্রদায়িক দল গঠন নিষিদ্ধ করা হয়। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর জেনারেল জিয়াউর রহমানের সরকারের আমলে সংবিধানের ঐ বিধিনিষেধ (অনুচ্ছেদ ৩৮) তুলে দেয়া হয়। তার শাসনামলেই ১৯৭৯ সালে জামায়াত স্বনামে আত্মপ্রকাশ করে।
যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে জামায়াতে ইসলামীর একাধিক শীর্ষ স্থানীয় নেতার ৭১-এ মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ইতোমধ্যে ফাঁসির রায় কার্যকর হয়েছে এবং আরো অনেকের বিচার প্রক্রিয়াধীন। ট্রাইব্যুনাল সংশ্লিষ্ট যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে রায় প্রদানকালে জামায়াতে ইসলামীকে ‘সন্ত্রাসী দল’ হিসেবে ঘোষণা করে।

মুসলিম লীগ
অবিভক্ত ভারতের মুসলমানদের সর্বপ্রাচীন, পাকিস্তান আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার অন্যতম বিরোধী রাজনৈতিক দল মুসলিম লীগ। মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠা ১৯০৬ সালে ঢাকার শাহবাগে। পাকিস্তান আন্দোলনে সফল নেতৃত্বদানের পর নেতৃত্বের কোন্দল, প্রতিক্রিয়াশীল ভাবাদর্শ, সরকার পরিচালনায় চরম ব্যর্থতা ও বাস্তবমুখী আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক কর্মসূচির অবর্তমানে দলটি দ্রুত জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। ফলে দলে দেখা দেয় ভাঙ্গন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পূর্বেই দলটি বহু গ্রুপে বিভক্ত হয়ে পড়ে, যথা- খাজা খয়েরউদ্দিনের নেতৃত্বাধীন মুসলিম লীগ (কাউন্সিল), ফজলুল কাদের চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন মুসলিম লীগ (কনভেনশন), কাজী আবদুল কাদের ও সবুর খানের নেতৃত্বাধীন মুসলিম লীগ (কাইয়ুম) ইত্যাদি। দল হিসেবে মুসলিম লীগ শক্তিহীন হয়ে পড়লেও পুরাতন ধ্যান-ধারণার অনুসারী ও সুবিধাভোগী এর এক শ্রেণির সমর্থক সারাদেশ জুড়ে ছিল। মুক্তিযুদ্ধকালে মুসলিম লীগের বিভিন্ন গ্রুপের নেতৃবৃন্দ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর প্রতি সর্বপ্রকার সমর্থন ও সহযোগিতা প্রদান করে। তারা মুক্তিযুদ্ধকে ‘বিচ্ছিন্নতাবাদ’ ও ‘ভারত দ্বারা প্ররোচিত’ বলে আখ্যায়িত করে। মুসলিম লীগের সমর্থকরা অধিকাংশ শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত হয়ে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী তৎপরতায় নিজেদের নিয়োজিত করে। ৭১- এর সেপ্টেম্বর মাসে ডা. আবদুল মোতালিব মালিককে প্রধান করে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য যে বেসামরিক সরকার গঠিত হয়েছিল, তাতে কাউন্সিল মুসলিম থেকে দুজন এবং কনভেনশন মুসলিম লীগের একজন অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর জিয়ার শাসনামলে প্রথমে সবুর খানের নেতৃত্বে মুসলিম লীগকে পুনরুজ্জীবিত করা হয়। এরপর ১৯৭৮ সালে জেনারেল জিয়ার নেতৃত্বে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল গঠিত হলে মুসলিম লীগের নেতৃবৃন্দ এ দলে একীভূত হয়। মুসলিম লীগ বর্তমানে বাংলাদেশে অস্তিত্বশূন্য।

নেজামে ইসলামী
স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধবিরোধী পাকিস্তানপন্থী ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল নেজামে ইসলামী। ১৯৫৩ সালে এ দলের প্রতিষ্ঠা। এর প্রধান ছিল মওলানা আতাহার আলী (বিয়ানীবাজার, সিলেট)। কুমিল্লার আশরাফ উদ্দিন চৌধুরী ছিল এর সেক্রেটারি জেনারেল। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে সেপ্টেম্বর মাসে ডা. আবদুল মোতালিব মালিকের নেতৃত্বে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য যে বেসামরিক সরকার গঠিত হয়, সে সরকারে নেজামে ইসলামী থেকে একজন প্রতিনিধি অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। মুসলিম লীগের মতো এদলও এখন অস্তিত্বশূন্য।

পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টি (পিডিপি)
স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধবিরোধী, অখণ্ড পাকিস্তানে বিশ্বাসী, সাবেক মুসলিম লীগার এবং কৃষক-শ্রমিক পার্টি, নেজামে ইসলামী ইত্যাদি দলের নেতৃবৃন্দকে নিয়ে প্ৰবীণ রাজনীতিবিদ নুরুল আমীনের নেতৃত্বে গঠিত দল পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টি (পিডিপি)।
১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ‘আমাদের বাঁচার দাবী’ নামে খ্যাত তাঁর ঐতিহাসিক ৬-দফা কর্মসূচিভিত্তিক আইয়ুববিরোধী আন্দোলন নতুন করে শুরু করলে, এর বিপরীতে ১৯৬৭ সালে আওয়ামী লীগের কিছু প্রবীণ নেতা ও দক্ষিণপন্থী কতিপয় রাজনৈতিক দল নিয়ে নওয়াবজাদা নসরুল্লাহ খানের নেতৃত্বে ৮-দফাভিত্তিক আইয়ুববিরোধী আন্দোলনের মঞ্চ পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক মুভমেন্ট (পিডিএম) গঠিত হয়েছিল। এ পিডিএম-এর নেতৃবৃন্দের এক অংশ ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানে আইয়ুব খানের পতনের পর নতুন সামরিক শাসক জেনারেল ইয়াহিয়া খানের অধীনে পাকিস্তানের প্রথম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের সম্ভাবনা উজ্জ্বল হয়ে উঠলে পিডিএম নেতা নুরুল আমীন, আব্দুস সালাম খান, নওয়াবজাদা নসরুল্লাহ খান প্রমুখের নেতৃত্বে ২৪শে জুন ১৯৬৯ ঢাকায় পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টি (পিডিপি) গঠিত হয়। এর প্রধান ছিল নুরুল আমীন। পূর্ব পাকিস্তান থেকে এর নেতৃবৃন্দের মধ্যে ছিল মাহমুদ আলী, সৈয়দ আজিজুল হক (নান্না মিয়া), আব্দুল জব্বার খদ্দর, মৌলভী ফরিদ আহমদ, এডভোকেট জুলমত আলী খান, এ কে রফিকুল ইসলাম প্রমুখ। পিডিপি ছিল কার্যত একটি নির্বাচনী মঞ্চ। দলটি পাকিস্তানপন্থী অন্যান্য দলের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হয়ে ৭০-এর নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। এ দল থেকে একমাত্র নুরুল আমীন ছাড়া পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে আর কেউ নির্বাচিত হতে সক্ষম হয়নি।
পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টি বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের শুরু থেকেই এর বিরোধিতা করে আসে। ৭১-এর ৪ঠা এপ্রিল পিডিপি-র সভাপতি নুরুল আমীন ও জামায়াত নেতা গোলাম আযমের নেতৃত্বে সমমনা বিভিন্ন দলের ১২ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক গভর্নর লে. জেনারেল টিক্কা খানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে পাকিস্তানের অখণ্ডত্ব রক্ষার্থে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সকল কর্মতৎপরতার প্রতি সর্বাত্মক সমর্থন ও সহযোগিতার আশ্বাস দেয়। ৫ই মে পিডিপি-র সভাপতি ও সহ-সভাপতি মৌলভী ফরিদ আহমেদ মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করে ঢাকার রেডিওতে ভাষণ দেয়। পিডিপি-র অন্যতম সহ-সভাপতি মাহমুদ আলী পাকিস্তানের পক্ষে ও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে প্রচারণায় অংশ নিতে প্রতিনিধি দলের সদস্য হয়ে যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশ সফর করে।
মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী পরাজয়ের প্রাক্কালে নুরুল আমীনসহ দলের অনেকে পাকিস্তানে চলে যায়। পিডিপি-র নেতৃবৃন্দের কেউ-কেউ দালালি আইনে গ্রেফতার হয়ে কারাবরণ করে।

ইসলামী ছাত্র সংঘ
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালে বিভিন্ন সশস্ত্র বেসামরিক বাহিনীর নামে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের নেতা-কর্মী ও সমর্থকদের অপহরণ, হত্যা, সংখ্যালঘু হত্যা, নির্যাতন, বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ ও পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর চূড়ান্ত পরাজয়ের প্রাক্কালে এদেশের বুদ্ধিজীবীদের হত্যাকারী জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘ।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর ১৯৪৭ সালের ২০শে ডিসেম্বর লাহোরে জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তানের ছাত্র সংগঠন ইসলামী জমিয়তে তালেবার প্রতিষ্ঠা। বাংলায় এর নাম ইসলামী ছাত্র সংঘ। ১৯৫০ সালে পূর্ব পাকিস্তানে ইসলামী ছাত্র সংঘের কার্যক্রম শুরু হয়। মওদুদীর ভাবাদর্শের অনুসারী জামায়াতে ইসলামী ও এর ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘ সেকুলারিজম বা ধর্মনিরপেক্ষতার ঘোর বিরোধী ও পাকিস্তানকে একটি ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রে পরিণত করতে দৃঢ় বিশ্বাসী। ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের সময় ইসলামী ছাত্র সংঘের -নেতা-কর্মীরা রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনীতে যোগ দিয়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সহযোগী শক্তি হিসেবে সশস্ত্র অবস্থান গ্রহণ করে। মুক্তিযুদ্ধকালে এ সংগঠনের নেতা- কর্মীদের সবচেয়ে জঘন্য মানবতাবিরোধী অপরাধ ছিল এদেশের শ্রেষ্ঠ বুদ্ধিজীবীদের বেছে-বেছে মোহাম্মদপুর ও মিরপুর বধ্যভূমিতে নিয়ে অত্যন্ত নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা।
স্বাধীনতোত্তর বঙ্গবন্ধু সরকারের আমলে সাম্প্রদায়িক সংগঠন সাংবিধানিকভাবে নিষিদ্ধ থাকার পর জিয়ার শাসনামলে ঐ বিধি-নিষেধ তুলে দেয়া হলে জামায়াতে ইসলামীর পুনরুজ্জীবনের পাশাপাশি এর ছাত্র সংগঠনেরও পুনরুজ্জীবন ঘটে। তবে ইসলামী ছাত্র সংঘের স্থলে এর নতুন নামকরণ করা হয় ইসলামী ছাত্র শিবির।

মুক্তিযুদ্ধবিরোধী সংগঠন ও সশস্ত্র বেসামরিক বাহিনী

শান্তি কমিটি
মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা ও অখণ্ড পাকিস্তানের পক্ষে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে সাহায্য-সহযোগিতা প্রদানে পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ ও পাকিস্তান সমর্থক ব্যক্তিবর্গকে নিয়ে গঠিত বাহিনী।
১৯৭১ সালের ৯ই এপ্রিল মুসলিম লীগ (কাউন্সিল) নেতা ও ঢাকা নবাব পরিবারের সদস্য খাজা খয়েরউদ্দীনকে আহ্বায়ক করে ১৪০ সদস্যবিশিষ্ট ‘নাগরিক শান্তি কমিটি’ নামে একটি সংগঠন গঠন করা হয়। ১৪ই এপ্রিল এর নাম পরিবর্তন করে ‘পূর্ব পাকিস্তানি কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটি’ নামকরণ করা হয়। এর ২১ সদস্যবিশিষ্ট কেন্দ্রীয় কার্যকরী কমিটির সদস্যদের মধ্যে খাজা খয়েরউদ্দীন (আহ্বায়ক), গোলাম আযম, নুরুল আমীন, মাহমুদ আলী, মওলানা সিদ্দিক আহমেদ, আবুল কাশেম, এ কিউ এম শফিকুল ইসলাম, ইউসুফ আলী চৌধুরী (মোহন মিয়া), আব্দুল মতিন, ব্যারিস্টার আখতার উদ্দিন আহমেদ, মেজর (অব.) আফসার উদ্দিন প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। এর কেন্দ্রীয় কার্যালয় ছিল গোলাম আযমের মগবাজারের ৫নং এলিফ্যান্ট রোডের বাসা এ কমিটি গঠনের প্রধান উদ্যোক্তাও ছিল গোলাম আযম। দেশের বিভিন্ন জেলা ও মহকুমা পর্যায়ে শান্তি বাহিনীর সংগঠন ছিল। সেসব সংগঠনের যারা আহ্বায়ক ছিল, তারা হলো- আজিজুর রহমান (কুমিল্লা), এ কে এম ইউসুফ (খুলনা), সৈয়দ শামসুর রহমান (যশোর), সিরাজুল ইসলাম/মো. আমিন (রংপুর), নজুন হোসেন (সিলেট), আবদুর রব (বরিশাল), মাহমুদুন্নবী চৌধুরী (চট্টগ্রাম), এডভোকেট সাইদুল হক (নোয়াখালী), ডা. হাবিবুর রহমান (বগুড়া), আফজাল হোসেন আজাদী (ফরিদপুর), এডভোকেট এম এ কাসেম (দিনাজপুর), ক্যাপ্টেন এস এ এম জায়েদী (পাবনা), সাদ আহমদ (কুষ্টিয়া), মফিজউদ্দিন (ময়মনসিংহ), অধ্যাপক হাবিবুর রহমান (ব্রাহ্মণবাড়িয়া), আলহাজ্ব এম আবদুস সালাম (চাঁদপুর), মৌলভী কাছুদ্দীন (নাটোর), ডা. সফিউদ্দিন আহমদ (নারায়ণগঞ্জ), মিছির উল্লা (মৌলভীবাজার), মইদুর রহমান চৌধুরী (কক্সবাজার), ফজলুল হক এডভোকেট (নেত্রকোনা), মওলানা মোসলেহ উদ্দিন (কিশোরগঞ্জ), কাজী মহিউদ্দিন আহমদ/আবদুল আজিজ প্রিন্সিপাল (জামালপুর), হাকিম হাবিবুর রহমান (টাঙ্গাইল), খান বাহাদুর সৈয়দ মোহাম্মদ আফজাল (পিরোজপুর), খায়েজ আহমেদ (ফেনী), মওলানা আসাদুল্লাহ সিরাজী (সিরাজগঞ্জ), আয়েন উদ্দিন (রাজশাহী), আলহাজ্ব শামসুদ্দিন শিকদার/আলাউদ্দিন শিকদার (পটুয়াখালী), মওলানা এম এ আজিজ (জয়পুরহাট), আসগর আলী মোল্লা (মাগুরা), জামিউল আলম খান (চুয়াডাঙ্গা), সরদার আলী (মেহেরপুর), (সাতক্ষীরা), ডা. মোজাম্মেল হক (বাগেরহাট), মওলানা সোলায়মান (নড়াইল), পনির উদ্দিন আহমদ (কুড়িগ্রাম), মওলানা তমিজউদ্দিন (ঠাকুরগাঁও), আনোয়ার রাজা (সুনামগঞ্জ), সৈয়দ কামরুল আহসান (হবিগঞ্জ), গোলাম হক (শেরপুর), মজিদ সরকার (গাজীপুর), আজিজুর রহমান খন্দকার (গাইবান্ধা), হামিদ খন্দকার (মাদারীপুর) ও তোবারক (ঝিনাইদহ)। শান্তি কমিটির প্রধান দায়িত্ব ছিল পাকিস্তানের অখণ্ডত্ব রক্ষায় সেনাবাহিনীর সমর্থনে জনমত গঠন (দেখুন শান্তি কমিটি )।

রাজাকার বাহিনী
মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা ও পাকিস্তানের অখণ্ডত্ব রক্ষার্থে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পৃষ্ঠপোষকতায় মুক্তিযুদ্ধকালে গড়ে ওঠা একটি সশস্ত্র বেসামরিক বাহিনী।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ৭১-এর মে মাসে জামায়াতে ইসলামীর সদস্য মাওলানা এ কে এম ইউসুফের উদ্যোগে ৯৬ জন দলীয় ক্যাডার নিয়ে রাজাকার বাহিনী প্রতিষ্ঠা লাভ করে। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে পূর্ব বাংলায় শোচনীয়ভাবে পরাজিত জামায়াতে ইসলামী ও মুসলিম লীগসহ পাকিস্তানপন্থী অন্যান্য দলের নেতা-কর্মী-সমর্থক ও দরিদ্র সাধারণ মানুষদের অন্তর্ভুক্ত করে পরবর্তীতে সারাদেশে এর ইউনিট গড়ে তোলা হয়। তবে জামায়াতে ইসলামী/ইসলামী ছাত্র সংঘ ও মুসলিম লীগের কর্মী-সমর্থকদেরই এ বাহিনীতে প্রাধান্য ছিল। অক্টোবর মাসে রাজাকারদের সংখ্যা দাঁড়ায় ৫৫ হাজারে। এ বাহিনীর প্রধান নিযুক্ত হয়েছিল জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘের নেতা মোহাম্মদ ইউনুস। পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক গভর্নর ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক লে. জেনারেল টিক্কা খান এক অর্ডিন্যান্স বলে আধাসামরিক বাহিনীর মর্যাদা দিয়ে আনসার বাহিনীর বিকল্প হিসেবে রাজাকার বাহিনীকে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর অধীনে ন্যস্ত করে। পাকিস্তানি সেনাকর্মকর্তা কর্তৃক তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। রাজাকার বাহিনীর সদস্যরা ছিল বেতনভুক। তাদের প্রধান কাজ ছিল হানাদার বাহিনীকে পথ চিনিয়ে নিয়ে যাওয়া, মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোকজনদের তালিকা সরবরাহ করা, হানাদার বাহিনীর অপারেশনকালে তাদের সঙ্গে অংশগ্রহণ করা, সেতু, ব্রিজ, রেল স্টেশন, শিল্প কারখানা ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান পাহারা দেয়া ইত্যাদি। অনেক সময় তারা মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হতো। এছাড়া মানুষের ওপর অত্যাচার-নির্যাতন, হত্যা, নারীনির্যাতন ও বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগের মতো কর্মকাণ্ডের সঙ্গেও তারা সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিল। তাদের এসব অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের কারণে ‘রাজাকার’ শব্দটি এখনো বাংলাদেশে বহুল উচ্চারিত একটি ঘৃণ্য নাম (দেখুন রাজাকার বাহিনী )।

আলবদর বাহিনী
মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সক্রিয় পৃষ্ঠপোষকতায় প্রধানত জামায়াতে ইসলামী/ইসলামী ছাত্র সংঘের নেতা-কর্মীদের নিয়ে গড়ে ওঠা ও বুদ্ধিজীবী হত্যাকারী একটি দুর্ধর্ষ ঘাতক বাহিনী
মুক্তিযুদ্ধকালে ২২শে এপ্রিল ময়মনসিংহ জেলা ইসলামী ছাত্র সংঘের সভাপতি মোহাম্মদ আশরাফ হোসেনের নেতৃত্বে স্থানীয়ভাবে প্রথম এ বাহিনী গঠিত হয়। এরপর এরূপ বাহিনী গঠনে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী অনুমোদন ও পৃষ্ঠপোষকতা দেয়। হানাদার বাহিনীর পক্ষ থেকে লে. জেনারেল রাও ফরমান আলী এ বাহিনীর গঠন ও এর অপারেশনে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিল। আলবদর বাহিনীর হাইকমান্ডের মধ্যে ছিল- মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ, মীর কাশেম আলী, মোহাম্মদ ইউনুস, আশরাফ হোসেন, মো. শামসুল হক, আশরাফুজ্জামান খান, চৌধুরী মঈনুদ্দিন প্রমুখ। পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যাসহ সবধরনের মানবতাবিরোধী তৎপরতায় সহযোগিতা দেয়ার পাশাপাশি আলবদর বাহিনীর সবচেয়ে ঘৃণ্য কর্মকাণ্ড ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, ডাক্তারসহ এদেশের শ্রেষ্ঠ বুদ্ধিজীবীদের তাঁদের বাসা থেকে ধরে নিয়ে প্রথমে টর্চার সেলে অমানবিক নির্যাতন এবং এরপর মোহাম্মদপুর ও মিরপুর বধ্যভূমিতে নিয়ে হাত, পা ও চোখ বেঁধে বেয়নেট চার্জ ও গুলি করে নৃশংসভাবে হত্যা (দেখুন আলবদর বাহিনী )।

আলশামস বাহিনী
মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় গড়ে ওঠা স্বাধীনতাবিরোধী একটি বেসামরিক সশস্ত্র বাহিনী। জামায়াতে ইসলামী/ইসলামী ছাত্র সংঘ, মুসলিম লীগের কর্মী-সমর্থক ও মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের নিয়ে এ বাহিনীর সৃষ্টি। আলবদর ও আলশামস বাহিনীর কর্মকাণ্ড ছিল সম্পূরক। এসব বাহিনীর সদস্যরা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা ও পাকিস্তানের অখণ্ডত্ব রক্ষাকে জিহাদের অংশ হিসেবে দেখে। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গণহত্যাসহ মানবতাবিরোধী সর্বপ্রকার কর্মকাণ্ডের প্রতি এ বাহিনীর সদস্যরা সর্বাত্মক সমর্থন ও সহযোগিতা দেয়। আলবদর বাহিনীর মতো এটিও ছিল একটি ‘ডেথ স্কোয়াড’। দেশের অনেক শ্ৰেষ্ঠ বুদ্ধিজীবী এদের নির্মম হত্যাকাণ্ডের স্বীকার হন (দেখুন আলশামস বাহিনী )।

পাকহানাদার বাহিনীর সহযোগী বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক
৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে একদিকে দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অনেকে যেমন পাকিস্তানি হানাদার ও তাদের সৃষ্ট আলবদর-আলশামস বাহিনীর নৃশংস হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন, অন্যদিকে তেমনি শিক্ষক নামের কলঙ্ক কেউ-কেউ মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা ও পাকিস্তানের পক্ষ অবলম্বন করে হানাদার পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর সঙ্গে সহযোগিতা করেছে, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শিক্ষকদের বেনামে চিঠি লিখে প্রাণ সংহারে তাঁদের হুমকি দিয়েছে, তালিকা প্রণয়ন করে হানাদারদের সরবরাহ করেছে, আবার কেউ-কেউ ঘাতক আলবদর-আলশামস বাহিনীর হাতে কোনো-কোনো শিক্ষককে ধরিয়ে দিয়েছে।
৭১-এ হানাদার অধিকৃত বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী কার্যকলাপের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেট ১৯৭৩ সালের ১লা অক্টোবরের সভায় ৩০ জন শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে। হানাদার বাহিনীর সহযোগী এসব শিক্ষকদের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. সাজ্জাদ হোসেন (উপাচার্য), ড. মোহর আলী, ড. ফাতিমা সাদিক, আতিকুজ্জামান খান, ড. মোস্তাফিজুর রহমান, ড. কাজী দীন মুহাম্মদ, ড. গোলাম ওয়াহেদ চৌধুরী, ড. রশিদুজ্জামান, মীর ফকরুজ্জামান, মো. আফসার উদ্দিন, এ কে এম শহীদুল্লাহ, ড. আব্দুল জব্বার, ওবায়দুল্লাহ, হাবিবুল্লাহ, ড. শাফিয়া খাতুন এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. আব্দুল বারী (উপাচার্য), ড. মকবুল হোসেন (বাণিজ্য বিভাগ), ড. গোলাম সাকলায়েন (বাংলা বিভাগ), সোলায়মান মণ্ডল (অর্থনীতি বিভাগ), জিল্লুর রহমান (আইন বিভাগ), আহমেদুল্লাহ্ খান (ইংরেজি বিভাগ) প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। স্বাধীনতার পর এদের কেউকেউ দালাল আইনে গ্রেপ্তার, কেউ চাকরিচ্যুত, কেউ দেশ ছেড়ে বিদেশে পালিয়ে যায় (দেখুন মুক্তিযুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় )।

ডা. আব্দুল মোতালিব মালিক মন্ত্রিসভা
স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী এবং পাকিস্তানি সামরিক সরকারের প্রতি অনুগত পাকিস্তানপন্থী বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ব্যক্তিদের সমন্বয়ে ৩রা সেপ্টেম্বর পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক গভর্নর লে. জেনারেল টিক্কা খানের স্থলে ডা. আব্দুল মোতালিব মালিক-কে গভর্নর করে ১০ সদস্যের একটি বেসামরিক প্রাদেশিক সরকার গঠন করা হয়। মন্ত্রী হিসেবে এ সরকারে যারা অন্তর্ভুক্ত হয়, তারা হলো- আবুল কাশেম (সাধারণ সম্পাদক, কাউন্সিল মুসলিম লীগ; অর্থ মন্ত্রণালয়), নওয়াজেশ আহমেদ (সদস্য, কাউন্সিল মুসলিম লীগ; খাদ্য, কৃষি ও তথ্য মন্ত্রণালয়), এ এস এম সোলায়মান (সভাপতি, কৃষক শ্রমিক পার্টি; শ্রম, সমাজকল্যাণ ও পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়), ওবায়দুল্লাহ মজুমদার এমএনএ (আওয়ামী লীগ দলত্যাগী; ী; স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়), আব্বাস আলী খান (জামায়াতে ইসলামী; শিক্ষা মন্ত্রণালয়), মওলানা এ কে এম ইউসুফ (জামায়াতে ইসলামী; রাজস্ব, পূর্ত ও বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়), মওলানা মোহাম্মদ ইসহাক (নেজামে ইসলামী; মৌলিক গণতন্ত্র ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়), শামসুল হক এমপিএ (আওয়ামী লীগ দলত্যাগী; সাহায্য ও পুনর্বাসন মন্ত্রণালয়), আখতার উদ্দীন আহমেদ (কনভেনশন মুসলিম লীগ; বাণিজ্য, শিল্প, আইন ও পার্লামেন্টারি মন্ত্রণালয়), অং শু প্রু চৌধুরী এমপিএ (স্বতন্ত্র হিসেবে নির্বাচিত, পার্বত্য চট্টগ্রাম; সংখ্যালঘু, বন, সমবায় ও মৎস্য মন্ত্রণালয়)
মুক্তিযুদ্ধের শেষের দিকে ডা. আব্দুল মোতালিব মালিক-এর নেতৃত্বে এ বেসামরিক সরকার গঠন ছিল একটি আইওয়াশ মাত্র। বিশ্ব নেতৃবৃন্দ ও জনমতের চাপে সামরিক জান্তা এ ধরনের সরকার গঠনে এক প্রকার বাধ্যবাধকতার মধ্যে পড়ে। তবে এটি ছিল খোলস পরিবর্তন মাত্র। এ সরকারের সদস্যবৃন্দ ছিল সম্পূর্ণ জনবিচ্ছিন্ন এবং পাকিস্তানিদের দালাল হিসেবে গণধিকৃত। মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকেই এসব ব্যক্তি ও তাদের স্ব-স্ব রাজনৈতিক দল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গণহত্যাসহ সবধরনের মানবতাবিরোধী অপরাধের প্রতি সর্বপ্রকার সাহায্য-সহযোগিতা ও সমর্থন দিয়ে আসছিল। অতএব এ পদক্ষেপ নিষ্ফল হতে বাধ্য ছিল। ৩রা ডিসেম্বর থেকে মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় মিত্রবাহিনী যৌথভাবে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হলে পাকিস্তানের পরাজয় সময়ের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। এমতাবস্থায় ৯ই ডিসেম্বর গভর্নর ডা. মালিক ইয়াহিয়া খানের কাছে যুদ্ধ বিরতির আবশ্যকতা তুলে ধরে বার্তা পাঠায়। গভর্নর হাউজের ওপর ভারতীয় বিমান আক্রমণের ফলশ্রুতিতে ভীত-সন্ত্রস্ত গভর্নর মালিক ১৪ই ডিসেম্বর প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের কাছে তার সরকারের পদত্যাগ পত্র পেশ করে রেডক্রস কর্তৃক ঘোষিত নিরপেক্ষ জোন হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে গিয়ে আশ্রয় নেয় (দেখুন পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণ )। [হারুন-অর-রশিদ ও মেসবাহ কামাল]
তথ্যসূত্র: Siddiq Saliq, Witness to Surrender, Dhaka, UPL 1997; আবু মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন, ‘মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির তৎপরতা’, অধ্যাপক অজয় রায় ও শামসুজ্জামান খান (সম্পাদিত), বাংলা ও বাঙালির ইতিহাস, চতুর্থ খণ্ড (প্রথম পর্ব), বাংলা একাডেমি ২০১২; মুনতাসীর মামুন, শান্তি কমিটি ১৯৭১, মওলা ব্রাদার্স ২০১২; এ এস এম সামসুল আরেফিন, মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ব্যক্তির অবস্থান, ঢাকা, সময় প্রকাশন ২০১২; হারুন-অর-রশিদ, মূলধারার রাজনীতি : বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ কাউন্সিল ১৯৪৯-২০১৬, বাংলা একাডেমি ২০১৬; জান্নাত-ই-ফেরদৌসী কর্তৃক সরবরাহকৃত তথ্য

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৮ম খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!