মুক্তিযুদ্ধে ইপিআর
মুক্তিযুদ্ধে ইপিআর (বর্তমান বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ- বিজিবি) বাহিনীর ভূমিকা ছিল খুবই গৌরবোজ্জ্বল। মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি পর্বে মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং প্রদান, বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা বার্তা দেশের অন্যত্র বাহিনীর সদস্য ও জনগণের কাছে পৌছানো, দেশের বিভিন্ন স্থানে পাকহানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রাথমিক প্রতিরোধ গড়ে তোলা, সম্মুখ যুদ্ধ বা শত্রুর বিরুদ্ধে এম্বুশ এর প্রতিটি ক্ষেত্রে ইপিআর সদস্যরা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধে এ বাহিনীর ৮১৭ জন সদস্য শহীদ হন। ৭ জন বীরশ্রেষ্ঠ-এর মধ্যে ২ জনই এ বাহিনীর সদস্য।
ইপিআর আধা-সামরিক রক্ষী বাহিনী।১৯৭৫ সালে ’রামগড় লোকাল ব্যাটালিয়ন’ নামে এর যাত্রা শুরু হয়। তখন থেকে এ পর্যন্ত এ বাহিনী বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন নাম ধারণ করে বর্তমান পর্যায়ে পৌঁছেছে, যেমন ফ্রন্টিয়ার গার্ডস (১৮৬১), স্পেশাল রিজার্ভ কোম্পানি (১৮৭৯), বেঙ্গল মিলিটারি পুলিশ (১৮৯১), ইস্টার্ন ফ্রন্টিয়ার্স রাইফেলস্ (১৯২০), ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস্ (১৯৪৮), বাংলাদেশ রাইফেলস্ (১৯৭২), সর্বশেষে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (২০১১)।
পাকিস্তান রাষ্ট্রে বাঙালিদের ওপর পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর শোষণ-নিপীড়ন ও বৈষম্যমূলক আচরণ বাঙালি জনগণের পাশাপাশি রাষ্ট্রের বিভিন্ন বাহিনীতে নিয়োজিত বাঙালিদের মধ্যেও গভীর রেখাপাত করে। এর অবসান বা এ থেকে মুক্তির লক্ষ্যে ৭০-এর নির্বাচনে গোপন ব্যালটের মাধ্যমে জনগণের সঙ্গে এসব বাহিনীর সদস্যরাও বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ-এর ৬-দফা কর্মসূচির প্রতি পূর্ণ সমর্থন ব্যক্ত করেন। বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ এ ঘোষণা এবং স্বাধীনতা অর্জনে ‘যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে’ শত্রুকে মোকাবিলা করার আহ্বান সর্বস্তরের বাঙালিদের জন্য ছিল মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণের এক সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা। ইপিআর-সহ বিভিন্ন বাহিনীতে নিয়োজিত দেশপ্রেমিক বাঙালিদের নিকটও তাঁর এ বার্তা ছিল অতি স্পষ্ট। তাই বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণের পরপর পুলিশ, আনসার ও অবসরপ্রাপ্ত বা ছুটিতে আসা বাঙালি সৈনিকদের অনুরূপ ইপিআর-এর বহু সদস্য মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণের লক্ষ্যে জনগণকে ট্রেনিং প্রদানে নিজেদেরকে নিয়োজিত করেন। ২৩শে মার্চ পূর্ব বাংলার অন্যসব স্থানের মতো ঢাকার পিলখানায় ইপিআর সদর দপ্তরের বটবৃক্ষে বাঙালি ইপিআর সদস্যরা স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। অনুরূপভাবে একই দিন দেশের বিভিন্ন ইপিআর সেক্টর, উইং ও বিওপি-তে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়৷
২৫শে মার্চ কালরাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী অপারেশন সার্চলাইট নামে বাঙালিদের ওপর সশস্ত্র আক্রমণে ঝাঁপিয়ে পড়ে। পিলখানার ইপিআর হেডকোয়ার্টার্স ছিল তাদের অন্যতম টার্গেট। তাই ইপিআর-এর উচ্চপদে আসীন পশ্চিম পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তারা কয়েক দিন আগ থেকেই বাঙালি সদস্যদের অধিকাংশকে নিরস্ত্র করে। ২২তম বেলুচ রেজিমেন্টের একটি কোম্পানিকে সেখানে মোতায়েন করা হয়। ইপিআর-এর বিভিন্ন গেইটে যেসব বাঙালি জওয়ান দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন, তাঁদের প্রায় বিনা অস্ত্রে গেইট পাহারা দিতে বাধ্য করা হয়। ২৫শে মার্চ রাত ১২টার দিকে শুরু হয় পাকিস্তানি বাহিনীর পূর্বপরিকল্পিত পৈশাচিক আক্রমণ। সামান্য কিছু হাতিয়ার নিয়ে বিচ্ছিন্নভাবে বাঙালি ইপিআর সদস্যরা প্রতিরোধ গড়ে তোলার ব্যর্থ চেষ্টা করেন। দ্রুত ইপিআর ঘাঁটি পাকহানাদারদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। বেশকিছু ইপিআর সদস্য হানাদারদের হাতে শহীদ হন। অনেকে বন্দি হন। কিছু সদস্য পালিয়ে যেতে সমর্থ হন। তাঁরা ঢাকার বুড়িগঙ্গা নদীর অপর পাড়ে জিঞ্জিরায় একত্রিত হয়ে সেখান থেকে পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করেন, কিন্তু হানাদারদের ভারী অস্ত্র ও জনবলের কাছে তাঁদের পক্ষে বেশিক্ষণ টিকে থাকা সম্ভব হয়নি।
২৫শে মার্চের একই রাতে পাকিস্তানি হানাদাররা ঢাকায় প্রেসিডেন্ট হাউস ও গভর্নর হাউসে দায়িত্বে নিয়োজিত বাঙালি ইপিআর সদস্যদের ওপর সশস্ত্র আক্রমণ চালায়। এর পূর্বে কৌশলে তাঁদেরকে নিরস্ত্র করা হয়। শতাধিক ইপিআর সদস্যকে বন্দি করে ২৯শে মার্চ রাতে রমনা কালীমন্দির সংলগ্ন স্থানে নিয়ে গিয়ে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে ব্রাশ ফায়ার ও বেয়নেট চার্চ করে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। রমনা কালীমন্দির হত্যাকাণ্ড-এ নেতৃত্ব দেয় ইপিআর-এর অবাঙালি অফিসার মেজর গোলাম মোহাম্মদ।
এমনি এক চরম অবস্থায় নিজের জীবন তুচ্ছ করে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ সুবেদার মেজর শওকত আলী তাঁর বাসবভন থেকে পোর্টেবল ট্রান্সমিটারের সাহায্যে বঙ্গবন্ধুর ২৬শে মার্চের স্বাধীনতার ঘোষণা বার্তা ও তাঁর স্বকণ্ঠে স্বাধীনতার ঘোষণা ট্রান্সমিট করে এক ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেন।
হানাদাররা তাঁকে গ্রেপ্তার করে মোহাম্মদপুর শারীরিক শিক্ষা কলেজ বন্দিশিবির ও টর্চার সেলে নিয়ে মাসাধিকাল চরম নির্যাতন শেষে ফায়ারিং স্কোয়ারে গুলি করে হত্যার পর লাশ বুড়িগঙ্গা নদীতে ভাসিয়ে দেয়।
২৫শে মার্চ রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর রাজারবাগ পুলিশ লাইন্স, পিলখানা ইপিআর হেডকোয়ার্টার্স, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের আবাসিক কোয়ার্টার্স ও শিক্ষার্থীদের আবাসিক হলসহ ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্থানে ট্যাংক ও ভারী অস্ত্র নিয়ে নির্বিচারে হত্যার সংবাদ ইপিআর ওয়ারলেস ও অন্যান্য মাধ্যমে দ্রুত দেশময় ছড়িয়ে পড়ে। বিভিন্ন স্থানে ইপিআর সেক্টর, উইং ও বিওপি-তে পাকিস্তানি হানাদারদের বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে গণঅসন্তোষ দেখা দেয় এবং প্রতিরোধ গড়ে ওঠে|
বস্তুত ক্যাপ্টেন (পরবর্তীতে মেজর ও বীর উত্তম) রফিকুল ইসলামই সর্বপ্রথম ইপিআর সদস্যদের নিয়ে চট্টগ্রামে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন। তখন তিনি ছিলেন হালিশহরে অবস্থিত ইপিআর সেক্টর হেডকোয়ার্টার্সের এডজুট্যান্ট। তিনি হানাদারদের অপারেশন সার্চলাইট শুরুর কয়েক ঘণ্টা পূর্বেই তাঁর জওয়ানদের নিয়ে প্রতিরোধের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। ২৫শে মার্চ রাত থেকে ৩১শে মার্চ পর্যন্ত তাঁর বাহিনী হালিশহর ও চট্টগ্রাম শহরের বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে ও যুদ্ধে লিপ্ত হয়। এ-সময় উভয় পক্ষে বেশকিছু সৈন্য হতাহত হয়। হানাদারদের বিরুদ্ধে চট্টগ্রামে ক্যাপ্টেন রফিকের নেতৃত্বে পরিচালিত প্রতিরোধযুদ্ধ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এক বীরত্বপূর্ণ ঘটনা। উল্লেখ্য, ঢাকার পিলখানা ইপিআর হেডকোয়ার্টার্স থেকে সুবেদার মেজর শওকত আলী কর্তৃক ওয়ারলেসের মাধ্যমে ট্রান্সমিটকৃত বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার বার্তা ক্যাপ্টেন রফিকের হালিশহর সেক্টরের সিগন্যালম্যান আবুল খায়ের প্রথম পেয়ে তা তাঁর কাছে হস্তান্তর করেন এবং ক্যাপ্টেন রফিক বঙ্গবন্ধুর ঐ বার্তা অন্যত্র পৌঁছানো ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের মাধ্যমে জনগণের মাঝে প্রচারের ব্যবস্থা নেন।
রাজশাহীতেও ইপিআর সদস্যরা পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। ইপিআর সেক্টর হেডকোয়ার্টার্স ছিল রাজশাহী শহরে। এর ২টি উইং-এর একটি চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও একটি নওগাঁতে ছিল। তিন স্থানেই বাঙালি ইপিআর সদস্যরা অস্ত্রাগার ভেঙ্গে যেসব অস্ত্র পাওয়া যায় তাই নিয়ে হানাদারদের মোকাবিলা করার চেষ্টা করেন। কিছু সময় গুলি বিনিময়ের পর চাঁপাইনবাবগঞ্জে অবাঙালি ইপিআর সদস্যরা তাঁদের কাছে আত্মসমর্পণে বাধ্য হয়। এক পর্যায়ে বাঙালি ইপিআর সদস্যরা যৌথভাবে রাজশাহী শহরের উপকণ্ঠে অবস্থিত পাকিস্তানি সেনা ছাউনির ওপরও আক্রমণ পরিচালনা করেন।
২৫শে মার্চ রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী যশোর সেক্টরের ইপিআর হেডকোয়ার্টার্সের ওপর গুলি ছোড়ে। বাঙালি ইপিআর সদস্যরা পাল্টা জবাব দেন। ৩০শে মার্চ বাঙালি ইপিআর সদস্যরা অস্ত্রাগারের তালা ভেঙ্গে অস্ত্র নিয়ে অবস্থান নেন। তাঁরা অবাঙালি ইপিআর সদস্যদের নিরস্ত্র ও বন্দি করেন। তবে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে ইপিআর- এর চুয়াডাঙ্গা ৪নং উইং-এর প্রতিরোধযুদ্ধ ছিল বহুল আলোচিত ও সফল। এতে নেতৃত্ব দেন উইং কমান্ডার মেজর আবু ওসমান চৌধুরী। ২৬শে মার্চ তিনি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে তাঁর সদর দপ্তরে হাজার-হাজার জনতা ও ইপিআর সদস্যের উপস্থিতিতে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। ইপিআর সদস্যরা পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় পতাকাকে সামরিক অভিবাদন জানান। একই দিন তাঁর উইং-এর আওতাধীন বিওপিগুলোতে ওয়ারলেসের মাধ্যমে পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের প্রস্তুতি গ্রহণের তিনি নির্দেশ দান করেন। জনতাকে সঙ্গে নিয়ে ইপিআর সদস্যরা চুয়াডাঙ্গা-যশোর, দামুড়হুদা-চুয়াডাঙ্গা, চুয়াডাঙ্গা-জীবননগর ইত্যাদি সড়কে হানাদারদের বিরুদ্ধে ব্যারিকেড রচনা করেন। এ-সময়ের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা ছিল কুষ্টিয়া হানাদার মুক্তকরণ যুদ্ধ। আবু ওসমান চৌধুরীর নেতৃত্বে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইপিআর, পুলিশ, আনসার ও মুজাহিদ বাহিনীর সদস্যগণ বিপুল সংখ্যক জনতাকে সঙ্গে নিয়ে ৩০শে মার্চ থেকে ১লা এপ্রিল পর্যন্ত টানা ৩ দিন যুদ্ধ করে শত্রুপক্ষকে পরাস্ত করে কুষ্টিয়া শহর মুক্ত করেন। বহু পাকিস্তানি সৈন্য হতাহত হয়। বিপুল সংখ্যক অস্ত্র মুক্তিযোদ্ধাদের হস্তগত হয়। মধ্য-এপ্রিল পর্যন্ত কুষ্টিয়া হানাদারমুক্ত ছিল।
২৫শে মার্চের পরপর ময়মনসিংহের ইপিআর উইং-এর অবাঙালি সৈন্যরা বাঙালি ইপিআরদের হত্যা কিংবা বন্দি করার পরিকল্পনা করে। এটি বুঝতে পেরে বাঙালি ইপিআর ও জয়দেবপুর থেকে বিদ্রোহ করে আগত ২য় বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিকরা সম্মিলিতভাবে সেখানে অবাঙালি ইপিআর সদস্যদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হন। তাদের পরাস্ত করে বাঙালি ইপিআররা নিজেদের কতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন, যদিও তা বেশি দিন ধরে রাখা সম্ভব হয়নি। ইপিআর বাহিনীর আরেকটি সেক্টর হেডকোয়ার্টার্স ছিল দিনাজপুরে। ঠাকুরগাঁও ও রংপুরে এর উইং ছিল। সীমান্তবর্তী এ সেক্টর ও এর উইং-এর আওতাধীন একাধিক বিওপি ছিল। এ সেক্টর হেডকোয়ার্টার্স, উইং ও বিওপিগুলিতে পাকহানাদারদের সঙ্গে বাঙালি ইপিআরদের প্রতিরোধযুদ্ধ ও সংঘর্ষ হয়। প্রতিরোধযোদ্ধাদের হাতে বহু পাকিস্তানি সৈন্য হতাহত হয়।
আক্রমণের আশঙ্কায় দিনাজপুর সেক্টরের সদর হেডকোয়ার্টার্সের বাঙালি ইপিআর সদস্যরা অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে পূর্ব থেকে প্রস্তুত ছিলেন। ২৮শে মার্চ দিনাজপুর সার্কিট হাউসে অবস্থানরত পাকিস্তানি হানাদাররা ইপিআর হেডকোয়ার্টার্স কুঠিবাড়ির দিকে গোলাবর্ষণ করে। এরপর শুরু হয় পাল্টা আক্রমণ। অন্যান্য বাহিনীর সদস্যসহ ইপিআর, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও বিপুল সংখ্যক জনগণ সার্কিট হাউসের দিকে অগ্রসর হন। ২৯শে মার্চ পাকিস্তানি হানাদাররা রাতের আঁধারে দিনাজপুর থেকে পালিয়ে সৈয়দপুর ক্যান্টনমেন্টে চলে যায়। দিনাজপুর শহর ১৩ই এপ্রিলের পূর্ব পর্যন্ত হানাদারমুক্ত ছিল।
২৮শে মার্চ ঠাকুরগাঁও ইপিআর উইং-এ বাঙালি ও অবাঙালি সদস্যদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। তাতে বেশকিছু পাকিস্তানি ইপিআর নিহত হয়।
রংপুর ছিল ইপিআর উইং হেডকোয়ার্টার্স। এখানে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ২৩ ব্রিগেড হেডকোয়ার্টার্সও ছিল। ২৫শে মার্চ মধ্যরাতে এখানে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বাঙালি ইপিআর ও নিরস্ত্র জনতার ওপর আক্রমণে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এখানকার ইপিআর-এর অন্যতম সহকারী উইং কমান্ডার নওয়াজেস উদ্দিন পূর্বেই এটি অনুমান করতে পেরে তাঁর বাহিনীর অধিকাংশ সদস্যকে নিয়ে রংপুর শহর ছেড়ে তিস্তা নদীর অপর পাড়ে গিয়ে অবস্থান নেন। এদিকে যেসব ইপিআর সদস্য সরে যেতে ব্যর্থ হন, তাঁরা পাকিস্তানিদের হাতে হয় বন্দি না হয় মর্মান্তিকভাবে নিহত হন। তিস্তা ব্যারেজের অপর পাড়ে অবস্থান নেয়া ইপিআরদের সঙ্গে পাকিস্তানি হানাদারদের যুদ্ধ হয়। তাতে উভয় পক্ষে অনেকে হতাহত হয়। ২৮শে মার্চ ইপিআর, পুলিশ, আনসার, মুজাহিদ, সাঁওতাল সম্প্রদায় ও বিপুল সংখ্যক বিক্ষুব্ধ জনতা সম্মিলিতভাবে রংপুর পাকিস্তানি সেনা দপ্তর আক্রমণে এগিয়ে যায় (দেখুন রংপুর ক্যান্টনমেন্ট আক্রমণ)। শত্রুপক্ষ ভারী অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে তাঁদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। প্রতিরোধ যোদ্ধাদের মধ্যে বহু সামরিক-বেসামরিক লোক তাদের নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হন।
মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাসে এ সেক্টরের অধীন পাটগ্রাম, গোদাগাড়ী, হরিণামারী, তালপুকুর, পীরগঞ্জ, বক্সিগঞ্জ, হাতিবান্ধা ইত্যাদি স্থানে ইপিআর ও মুক্তিবাহিনীর অন্যান্য সদস্যদের সঙ্গে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়।
২৭শে মার্চ সিলেট সেক্টরের ৩নং ইপিআর উইং-এর সুবেদার ফজলুল হক চৌধুরীর নেতৃত্বে একটি কোম্পানি শমসেরনগর বিমান ঘাঁটিতে অবস্থানরত পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ওপর আক্রমণ পরিচালনা করে। পাকিস্তানি বাহিনী অনেক ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়ে সিলেট শহরে গিয়ে আশ্রয় নেয়। একই তারিখ মৌলভীবাজারেও উভয় পক্ষের মধ্যে যুদ্ধ হয় এবং একজন ক্যাপ্টেনসহ বেশকিছু পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়।
মুক্তিযুদ্ধে ২নং সেক্টর কমান্ডার মেজর খালেদ মোশাররফ, বীর উত্তমএর নেতৃত্বে ইপিআর-এর সিলেট ও কুমিল্লা সেক্টরের বিভিন্ন উইং হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধে আখাউড়া, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, গঙ্গাসাগর, কসবা, বিলোনিয়াসহ বিভিন্ন রণাঙ্গনে বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
বাঙালি ইপিআর সদস্যদের সঙ্গে পরশুরাম, ফেনী ও নোয়াখালীর বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তানি হানাদারদের যুদ্ধ হয়। ফেনী সিও অফিসে অবস্থান নেয়া পাকিস্তানি সেনাদের ওপর বাঙালি ইপিআর, পুলিশ, আনসার ছাত্র-জনতা সম্মিলিতভাবে আক্রমণ করে। তাতে একজন ক্যাপ্টেনসহ বেশকিছু অবাঙালি ইপিআর সদস্য নিহত হয়।
মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে পাবনায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে ইপিআর ও মুক্তিবাহিনীর অন্যান্য সদস্যদের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হয়। পাবনায় ২৫ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের একটি কোম্পানি ছিল। ইপিআর, পুলিশ, মুজাহিদ, আনসার ও জনতার সমন্বিত একটি বাহিনী ২৭শে মার্চ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের ওপর ব্যাপক আক্রমণ পরিচালনা করে। ২৮শে মার্চ পর্যন্ত সংঘর্ষ স্থায়ী হয়। উভয় পক্ষে বহু যোদ্ধা হতাহত হয়। বেসামরিক প্রতিরোধ যোদ্ধারাও হত্যার শিকার হন। তবে পাকিস্তানি বাহিনীর ক্ষয়ক্ষতি ও নিহতের সংখ্যা ছিল বেশি। প্রতিরোধ যোদ্ধাদের সম্মিলিত আক্রমণের মুখে টিকতে না পেরে অবশিষ্ট পাকিস্তানি হানাদাররা পাবনা থেকে রাজশাহীর উদ্দেশে পালিয়ে যায়। পাবনা ১০ই এপ্রিল পর্যন্ত হানাদার মুক্ত থাকে।
বরিশালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী থেকে ছুটিতে আসা মেজর এম এ জলিল রাজনৈতিক নেতৃত্বের সিদ্ধান্তক্রমে ইপিআর, পুলিশ, আনসার, মুজাহিদ ও ছাত্র-জনতাকে নিয়ে একটি প্রতিরোধ বাহিনী গড়ে তোলেন। ২৫শে এপ্রিল পর্যন্ত তাঁরা বরিশাল শহর হানাদারমুক্ত রাখতে সক্ষম হন।
মহান মুক্তিযুদ্ধে ইপিআর বাহিনীর ভূমিকা ছিল বীরত্বপূর্ণ। সে-সময়ে ইপিআর-এর মোট সদস্য সংখ্যা ছিল প্রায় কুড়ি হাজার। এর মধ্যে কিছু সংখ্যক পাকিস্তানিও ছিল। তাছাড়া সেক্টর ও উইং কমান্ডার, সহকারী কমান্ডারদের অধিকাংশই ছিল পশ্চিম পাকিস্তানি। তাদের ষড়যন্ত্রের নীলনকশা অধিকাংশ ক্ষেত্রে নস্যাৎ করে দিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে ইপিআর-এর বাঙালি সদস্যরা প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। হানাদার বাহিনীকে বিতাড়িত করে কোনো-কোনো শহর ও স্থান কয়েকদিন থেকে কয়েক সপ্তাহ পর্যন্ত মুক্ত রাখতে সক্ষম হন। সীমান্তবর্তী মুক্তাঞ্চল সংরক্ষণেও ইপিআররা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। মোট ৮ সহস্রাধিক ইপিআর সদস্য মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। তাঁদের মধ্যে ৮১৭ জন শহীদ হওয়া ছাড়াও বেশ কিছু সদস্য সম্মুখ যুদ্ধে দেহের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ হারান। স্বাধীনতার পর শত্রুর বিরুদ্ধে সম্মুখ যুদ্ধে বীরত্বের সঙ্গে লড়াই করে জীবন উৎসর্গ করায় ইপিআর-এর দুই সদস্য ল্যান্স নায়েক শহীদ মুন্সী আব্দুর রউফ ও ল্যান্স নায়েক শহীদ নূর মোহাম্মদ শেখ-কে সরকার কর্তৃক সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মাননা ‘বীরশ্রেষ্ঠ’ খেতাবে ভূষিত করা হয়। এছাড়া ইপিআর-এর ৮ জন সদস্যকে ‘বীর উত্তম’, ৩২ জনকে ‘বীর বিক্রম’ এবং ৭৭ জনকে ‘বীর প্রতীক’ খেতাব প্রদান করা হয়। মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০০৮ সালে বাহিনী হিসেবে বাংলাদেশ রাইফেলস্-কে সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মাননা ‘স্বাধীনতা পুরস্কার’-এ ভূষিত করা হয়। মুক্তিযুদ্ধে শহীদ ইপিআর-এর ল্যান্স নায়েক বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফ ও ল্যান্স নায়েক বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ শেখ- এর নামে পিলখানায় ২টি কলেজ প্রতিষ্ঠা, বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ মুন্সী আব্দুর রউফের নামে একটি সড়ক, বীর উত্তম শহীদ আনোয়ার হোসেনের নামে একটি প্যারেড গ্রাউন্ডের নামকরণ করা হয়েছে। পিলখানার অভ্যন্তরে একটি সুউচ্চ স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে। বীর উত্তম সালাহ উদ্দিন আহমদ গেইট (উত্তর দিকের ৪নং গেইট) সংলগ্ন ভেতরে ‘স্মৃতি অম্লান’ নামে একটি ভাস্কর্য, বহির দেয়ালে মুক্তিযুদ্ধের ম্যুরাল, ৩নং গেইট (দক্ষিণ-পূর্ব) সংলগ্ন অভ্যন্তরে ‘বর্ডার গার্ড জাদুঘর’ ও ‘অতন্দ্র প্রহরী’ নামে একটি ভাস্কর্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এছাড়া শহীদ ইপিআর কর্মকর্তা ও সদস্যদের নামে আরো কতিপয় সড়ক ও স্থাপনার নামকরণ করা হয়েছে। [হারুন-অর-রশিদ] তথ্যসূত্র: বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ, মুক্তিযুদ্ধে ইপিআর (বর্তমান বিজিবি), ঢাকা ২০১৫; মেজর মো. নাসির উদ্দিন মাহমুদ, অতিরিক্ত পরিচালক (শিক্ষা), বিজিবি-এর সাক্ষাৎকার, ১১ই মার্চ ২০১৯
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৮ম খণ্ড