You dont have javascript enabled! Please enable it!

মুক্তিযুদ্ধে জাতিসংঘের ভূমিকা

মুক্তিযুদ্ধে জাতিসংঘ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নানা কারণে দেশের ভৌগোলিক সীমা পেরিয়ে বৈশ্বিক রাজনীতির উত্তপ্ত বিষয়ে পরিণত হয়। বৃহৎ শক্তিবর্গের পাশাপাশি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা বিশেষ করে জাতিসংঘের কার্যধারায় বিষয়টি নানাভাবে স্থান পায়। বিশ্ব শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষার প্রধান সংস্থা হিসেবে ১৯৭১ সালের মার্চ মাস থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশে সংঘটিত ঘটনাবলিতে জাতিসংঘ সম্পূর্ণ নির্লিপ্ত থাকতে পারেনি। তবে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বাঙালিদের ওপর গণহত্যা, মানবাধিকার লংঘন, শান্তির প্রতি হুমকি এবং মানবতাবিরোধী বিভিন্ন অপরাধ দমনে জাতিসংঘ কার্যকর কোনো পদক্ষেপ গ্রহণে সক্ষম হয়নি। উল্লেখ্য, মানবতাবিরোধী অপরাধ দমনে ১৯৪৬ সালের ৮ই আগস্ট চার্টার অব লন্ডন স্বাক্ষরিত হয়। ১৯৪৮ সালের ৯ই ডিসেম্বর গৃহীত হয় গণহত্যা সম্পর্কিত কনভেনশন। একই বছর ১০ই ডিসেম্বর গৃহীত হয় মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণাপত্র। নীতি হিসেবে আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার গৃহীত হয় ১৯৫২ সালে। সকল ধরনের বর্ণবৈষম্য অবসানের কনভেনশন গৃহীত হয় ১৯৬৫ সালে। এরূপ আইনানুগ সাপোর্ট থাকা সত্ত্বেও বহুক্ষেত্রে জাতিসংঘ কাঙ্ক্ষিত ভূমিকা পালনে ব্যর্থ হয়। জাতিসংঘের গঠন-কাঠামোর আলোকে তা দেখা যেতে পারে।
মহাসচিবের ভূমিকা: মহাসচিব জাতিসংঘের প্রধান প্রশাসনিক পদাধিকারী। সাধারণ পরিষদ এবং নিরাপত্তা পরিষদের সিদ্ধান্তসমূহ বাস্তবায়নে মহাসচিব প্রধান ভূমিকা পালন করেন। জাতিসংঘ সনদের ৯৯নং অনুচ্ছেদ অনুযায়ী মহাসচিব আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তার ক্ষেত্রে বিঘ্ন সৃষ্টিকারী ঘটনা সম্পর্কে নিরাপত্তা পরিষদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে জাতিসংঘের মহাসচিব ছিলেন বার্মা (বর্তমান মিয়ানমার)-এর কূটনীতিক উ থান্ট (১৯০৯-১৯৭৪)। জাতিসংঘের তৃতীয় মহাসচিব হিসেবে তিনি ১৯৬১ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৭১ সালের ২৯শে মার্চ জাতিসংঘে নিযুক্ত ভারতের স্থায়ী প্রতিনিধি সমর সেন মহাসচিব উ থান্ট-কে পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্কট উত্তরণে উদ্যোগ গ্রহণের আনুষ্ঠানিক অনুরোধ জানান। সমর সেন তিনটি পদক্ষেপের কথা স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেন। প্রথমত, হত্যাযজ্ঞ বন্ধে মহাসচিবের উদ্যোগ গ্রহণ; দ্বিতীয়ত,
পূর্ব পাকিস্তানে আন্তর্জাতিক রেডক্রস টিম প্রেরণের ব্যবস্থা, এবং তৃতীয়ত, ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যসমূহে বাঙালি শরণার্থীদের জন্য ত্রাণের ব্যবস্থা। এর জবাবে মহাসচিব নিজে কোনো উদ্যোগ গ্রহণে তাঁর অপারগতার কথা জানিয়ে ভারতকে সরাসরি রেডক্রসের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পরামর্শ দেন।
১৯শে এপ্রিল পূর্ব পাকিস্তানে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (UNDP) উপ-আবাসিক প্রতিনিধি কে উলফ (K Wolff)-এর গোপন প্রতিবেদন উ থান্টের হাতে পৌঁছায়। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ব্যাপক হত্যাযজ্ঞের কথা উল্লেখ করে প্রতিবেদনে Wolff লেখেন, ‘পূর্ব পাকিস্তান সঙ্কটের সামরিক সমাধান অসম্ভব বলে মনে হচ্ছে। পাকিস্তানের দু’অংশের মধ্যে সম্পর্ক বজায় রাখতে হলে মুজিবের সঙ্গে আলাপ- আলোচনার মাধ্যমে রাজনৈতিক সমাধানে যেতে হবে। এ প্রতিবেদন পাওয়ার পর উ থান্ট অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে করণীয় নির্ধারণের জন্য আইনগত দিক পর্যালোচনার নির্দেশ দেন। একেবারে নিশ্চুপ বসে না থেকে মহাসচিবকে এ মর্মে আইনি পরামর্শ দেয়া হয় যে, তিনি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টকে ব্যক্তিগত ও গোপনীয় পত্রে মানবিক সহায়তার প্রস্তাব দেবেন। পরামর্শ অনুযায়ী মহাসচিব ১৯৭১ সালের ২২শে এপ্রিল জেনারেল ইয়াহিয়াকে লিখিত পত্রে উল্লেখ করেন, ‘পূর্ব পাকিস্তান পুরোপুরি পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়, তবে সম্পূর্ণ মানবিক বিবেচনায় পাকিস্তান সরকারের সম্মতি সাপেক্ষে জাতিসংঘ জরুরি ত্রাণ-সহায়তা প্রদান করতে পারে।’ এক সপ্তাহ পরে দেয়া উত্তরে জেনারেল ইয়াহিয়া খান মহাসচিবের সাহায্যের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। কিছুটা মার্কিন কূটনৈতিক চাপে ইয়াহিয়া খান ২২শে মে মহাসচিব বরাবর প্রেরিত অপর এক পত্রে দুই লক্ষ পঞ্চাশ হাজার টন খাদ্য ও এক লক্ষ টন ভোজ্য তেল অনুদান হিসেবে প্রদানের অনুরোধ জানান। নানা প্রকার টানাপোড়েনের মধ্যে মহাসচিব খুব সতর্কভাবে বাংলাদেশ ইস্যুতে কিছু করার চেষ্টা করেন। তাঁর সম্পূর্ণ ‘মানবিক’ পদক্ষেপ পরিস্থিতির উন্নয়নে কার্যত ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হয়। ২২শে জুলাই নিরাপত্তা পরিষদের সভাপতিকে তিনি এক পত্রে লিখেন, ‘কেবল মানবিক কারণে নয়, শান্তি ও নিরাপত্তার প্রতি সম্ভাব্য হুমকি মোকাবেলায় মানবিক বিপর্যয় এড়ানোর জন্য নিরাপত্তা পরিষদের উদ্যোগ গ্রহণ প্রয়োজন।’
শরণার্থী সমস্যা: বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সামগ্রিক কর্মকাণ্ডকে বিপুলভাবে একটি ইস্যু প্রভাবান্বিত করে আর তা হলো শরণার্থী সমস্যা। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অত্যাচার, নিপীড়ন, নারীনির্যাতন ও পরিকল্পিত গণহত্যা ইত্যাদি এক বিশাল শরণার্থী সমস্যার উদ্ভব ঘটায়। তা এক সময় নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার উপক্রম হয়। শরণার্থী সমস্যার সঙ্গে ক্রমে জড়িয়ে পড়ে ভারতের জনগণ, সরকার, দেশের অর্থনীতি, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি, বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্র, সর্বোপরি জাতিসংঘসহ বহু আন্তর্জাতিক সংগঠন-সংস্থা।
জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা UNHCR শরণার্থী সমস্যার দায় এড়াতে পারে না। ইরানীয় বংশোদ্ভূত প্রিন্স সদরুদ্দিন আগা খান ছিলেন এ সংস্থার প্রধান। সমস্যার গভীরতা উপলব্ধির জন্য তিনি জুন মাসের মাঝামাঝি প্রথমে পাকিস্তান, পরে ভারত সফর করেন।
১২ই জুন সদরুদ্দিন আগা খান চুয়াডাঙ্গা ও বেনাপোলে শরণার্থী প্রত্যাবর্তনে পাকিস্তান সরকারের স্থাপিত দুটি ক্যাম্প সরেজমিনে পরিদর্শন করেন। এছাড়া পাকিস্তান সরকারের ব্যবস্থাপনায় তিনি হেলিকাপ্টারে কিছু এলাকা পরিদর্শন করেন। পরবর্তীতে সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, “পূর্ব পাকিস্তানে জীবন যাত্রা ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে আসছে।’ শরণার্থী বিষয়ে ভারতের ভূমিকাকে সদরুদ্দিন কিছুটা বক্র দৃষ্টিতে দেখেছেন। তাঁর কাছে ভারতের অবস্থান পরস্পরবিরোধী বলে মনে হয়েছে। তিনি বলেন, ‘একদিকে ভারত ষাট লক্ষ শরণার্থীর বিরাট বোঝা এবং তাদের প্রত্যাবর্তনের জোর দাবি জানাচ্ছে, অন্যদিকে তাদের প্রত্যাবর্তনে রাজনৈতিক সমাধানের জন্য মুজিবের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার শর্ত জুড়ে দিচ্ছে। তথাপি শরণার্থীদের মানবিক সহায়তা প্রদানের জন্য UNHCR কিছু কর্মসূচি গ্রহণ করে। পাকিস্তান ও ভারতে ত্রাণ কার্যক্রম সমন্বয়ের উদ্দেশ্যে জেনেভায় স্ট্যান্ডিং কমিটি গঠন করা হয়।
১৯৭১ সালের ৫ই জুলাই বাংলাদেশের শরণার্থী সমস্যা নিয়ে জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদের (ECOSOC) অধিবেশন জেনেভায় শুরু হয়। শরণার্থী সমস্যার নানা দিক নিয়ে দীর্ঘ আলোচনার পর ১৬ই জুলাই ভারতে আশ্রয় নেয়া শরণার্থী এবং পূর্ব পাকিস্তানের জন্য পৃথক ত্রাণ কর্মসূচি পরিচালনার সিদ্ধান্ত হয়। শরণার্থীদের প্রয়োজন আর প্রাপ্ত ত্রাণ সহায়তার মধ্যে ব্যবধান ছিল অনেক। পূর্ব পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি ছিল আরো করুণ। পাকিস্তানি সামরিক জান্তা এবং তাদের সহযোগী রাজাকার, আলবদর, শান্তি কমিটির সদস্যগণ ত্রাণ সামগ্রীর বিরাট অংশ আত্মসাৎ করে। এমনি অনৈতিক কর্মকাণ্ড নিয়ে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনায় গঠিত বাংলাদেশ সরকার-এর প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ- ৫ই সেপ্টেম্বর এক বেতার ভাষণে বলেন, ‘বিগত ঘূর্ণিঝড়ের পর রিলিফের জন্য যেসব হেলিকপ্টার ও অন্যান্য যানবাহন এসেছিল, বাংলাদেশের মানুষের বিরুদ্ধেই পাকিস্তান সরকার নির্বিকার চিত্তে সেগুলো ব্যবহার করছে। দুর্গত মানুষের জন্য নির্দিষ্ট বহু সামগ্রী দখলদার সৈন্যদের প্রয়োজনে ব্যবহৃত হচ্ছে। জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেল যদি পৃথিবীর এই অংশে বিশ্ব প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রাখতে চান, তাহলে তাঁকে এমন ব্যবস্থা নিতে হবে, যাতে ত্রাণ কার্যক্রমের নামে নিষ্ঠুর প্রহসন অনুষ্ঠিত না হয়।’
সাধারণ পরিষদ ও নিরাপত্তা পরিষদের ভূমিকা: জাতিসংঘ সনদ অনুযায়ী সাধারণ পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠান, আর্থিক ও বাজেট সংক্রান্ত বিষয়, আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা, সুপারিশকৃত কার্যাবলি, সনদ সংশোধনসহ আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ কার্য সম্পাদন করে থাকে। যদিও সাধারণ সভার সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা খুব সীমিত, তথাপি বিশ্বের ছোট-বড় সব রাষ্ট্রের প্রতিনিধিত্বকারী সাধারণ পরিষদকে বিশ্ব-জনমতের মুখপাত্র হিসেবে গণ্য করা হয়। অন্যদিকে জাতিসংঘের সব কর্মতৎপরতার কেন্দ্রবিন্দু হলো নিরাপত্তা পরিষদ। সনদের ২৪নং অনুচ্ছেদ অনুযায়ী আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষার উদ্দেশ্যে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণের দায়িত্ব নিরাপত্তা পরিষদের ওপর ন্যস্ত করা হয়। যুদ্ধের প্রতি ভীতি-প্ৰদৰ্শন, শান্তিভঙ্গ এবং আগ্রাসনমূলক তৎপরতা প্রতিরোধের জন্য সনদের সপ্তম অধ্যায়ের ৩৯-৫১নং অনুচ্ছেদে নিরাপত্তা পরিষদকে যথাযথ ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে। বৃহৎ শক্তির স্বার্থের দ্বন্দ্ব এবং কাঠামোগত সীমাবদ্ধতার কারণে আন্তর্জাতিক সংকট মোকাবেলায় নিরাপত্তা পরিষদ অনেক ক্ষেত্রে শক্ত ভূমিকা পালনে সক্ষম হয়নি।
নানা প্রতিকূলতার মধ্যে বাংলাদেশ সরকার শুরু থেকে বাঙালির ন্যায়সঙ্গত ও গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের প্রতি জাতিসংঘের দৃষ্টি আকর্ষণের প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখে। ২১শে সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ২৬তম অধিবেশন শুরু হয়। এ অধিবেশনকে সামনে রেখে বাংলাদেশ সরকার মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিশ্বজনমতকে প্রভাবিত করার কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করে। প্রথা অনুযায়ী পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমেদের জাতিসংঘে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেয়ার কথা। কিন্তু ইতোমধ্যে খন্দকার মোশতাক এবং কলকাতায় অবস্থিত মার্কিন কনস্যুলেটের রাজনৈতিক কর্মকর্তা জর্জ গ্রিফিনের মধ্যেকার মুক্তিযুদ্ধবিরোধী তৎপরতার বিষয়ে বাংলাদেশ সরকার নিশ্চিত হয়। এ পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের নেতা মনোনীত হন বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী, যিনি যুক্তরাজ্য ও জাতিসংঘে বাংলাদেশ সরকারের স্থায়ী প্রতিনিধির দায়িত্বে ছিলেন।
১৭ সদস্যের প্রতিনিধিদলের নেতা হিসেবে বিচারপতি চৌধুরী সুচিন্তিত ও পরিকল্পনামাফিক কর্মতৎপরতার মাধ্যমে জাতিসংঘে বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিদের কাছে এবং সংবাদ সম্মেলন করে মুক্তিযুদ্ধের আইনানুগ ও ন্যায়সঙ্গত অবস্থান সুষ্পষ্টভাবে উপস্থাপন করতে সক্ষম হন। বিচারপতি চৌধুরী বাঙালির ন্যায়সঙ্গত যুদ্ধে জাতিসংঘের সমর্থন প্রদানের নৈতিক দায় সম্পর্কে বলেন, ‘প্রত্যেক জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার জাতিসংঘের সনদে ঘোষিত হয়েছে। একটি স্বতন্ত্র জাতিরূপে সেই ধারা অনুসারে বাঙালি জাতি স্বাধীনতা ঘোষণা করেছে। জাতিসংঘের কর্তব্য ইয়াহিয়া খানের নিষ্ঠুর নিপীড়নের বিরুদ্ধে এগিয়ে আসা, আমরা গণহত্যা বন্ধ করার জন্য পাকিস্তানের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার আবেদন জানাই। আমরা বিশ্বাস করি, জাতিসংঘ মানবাধিকার লঙ্ঘন, ঔপনিবেশিকতা, সামাজিক বৈষম্যের অবসান ঘটাবে বাংলাদেশ।’
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিবর্গ ও গণ-মাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের যৌক্তিক ব্যাখ্যা এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অত্যাচার, নির্যাতন, গণহত্যার বিবরণ অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে বিচারপতি চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন প্রতিনিধিদল তুলে ধরেন। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে অংশগ্রহণকারী বিভিন্ন রাষ্ট্রের প্রতিনিধিদের বিশ্ব পরিস্থিতি সম্পর্কিত বক্তব্যে বাংলাদেশ সঙ্কটের কথা উল্লেখ করা হয়। সঙ্কটের রাজনৈতিক দিক এড়িয়ে আলোচনায় শরণার্থীদের ত্রাণের বিষয়ে অধিক গুরুত্বারোপ করা হয়। উপমহাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে নিউজিল্যান্ড, লুক্সেমবার্গ, বেলজিয়াম, মাদাগাস্কার, নরওয়ে এবং সুইডেন গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে। ফ্রান্স এবং ব্রিটেনের সুষ্পষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি ছিল, পাকিস্তান সরকারের প্রধান কর্তব্য হলো পূর্ব পাকিস্তানে জনপ্রিয় সরকার প্রতিষ্ঠা করা। পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্কট কোনোভাবে আর পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয় নয় বলে সতর্ক করে দেয় সোভিয়েত ইউনিয়ন। তবে পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষার এক ধরনের দায়-দায়িত্ব নিজেদের ওপর নিয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
সেপ্টেম্বর মাসের শুরুতে আসন্ন সাধারণ পরিষদের অধিবেশনকে সামনে রেখে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী- তাঁর দীর্ঘ দিনের বন্ধু যুগোস্লাভ প্রেসিডেন্ট মার্শাল টিটোকে এক পত্রে পূর্ব বাংলার পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে লেখেন, ‘…[It] deserved the immediate attention of the world community both on humanitarian, economic, political and others grounds.’ ভারত যুদ্ধে প্ররোচিত হতে চায় না উল্লেখ করে তিনি আরো লিখেছেন, ‘We cannot be indifferent to this struggle for freedom against colonial and ethnic domination that is going on in our neighbourhood. ‘ যাহোক, সাধারণ পরিষদ বাংলাদেশ সঙ্কট নিয়ে গভীর পর্যালোচনায় আগ্রহ দেখায়নি।
প্রত্যক্ষ যুদ্ধের তীব্রতা বৃদ্ধি ও নিরাপত্তা পরিষদের তৎপরতা: অক্টোবর মাসের মধ্যে ভারত এবং পাকিস্তান উভয় রাষ্ট্র আসন্ন যুদ্ধের প্রস্তুতি হিসেবে নিজ-নিজ সীমান্তে সৈন্য সমাবেশ ও যুদ্ধের সরঞ্জাম সরবরাহের ব্যবস্থা প্রায় সম্পন্ন করে। ৩০শে অক্টোবর ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী জগজীবন রাম ভারতের যুদ্ধ প্রস্তুতি সম্পর্কে মন্তব্য করেন, ‘From alert to scramble should not take more than two minutes.’ একই রকম বক্তব্য প্রতিধ্বনিত হয় ভারতের প্রধানমন্ত্রীর বিদেশ সফর শেষে পার্লামেন্টে ১৫ই নভেম্বর তাঁর প্রদত্ত ভাষণে, ‘স্বাধীনতা এবং ভূখণ্ডগত অখণ্ডতার জন্য আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে। যতক্ষণ পর্যন্ত আমাদের নিরাপত্তার প্রতি হুমকি বিদ্যমান, আমাদের প্রস্তুত থাকা উচিত এবং আমরা, প্রতিটি ভারতীয় নরনারী প্রস্তুত আছি। বাংলাদেশ পরিস্থিতির সন্তোষজনক অগ্রগতি ভিন্ন সীমান্ত থেকে সৈন্য প্রত্যাহারের ঝুঁকি অবশ্যই নিতে পারি না।’ উল্লেখ্য, এর পূর্বে ৯ই আগস্ট ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে পারস্পরিক নিরাপত্তার বিধানসহ শান্তি, বন্ধুত্ব ও সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
মধ্য-নভেম্বর থেকে ভারত-পূর্ব পাকিস্তান সীমান্তে সংঘর্ষের তীব্রতা বাড়তে থাকে। ভারতীয় সেনাবাহিনীর সহায়তায় মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানি সীমান্ত চৌকিগুলোতে আক্রমণ ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি করে। ভারতীয় সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের নির্দেশে সীমান্ত রক্ষার পাশাপাশি পূর্ব পাকিস্তানের দশ মাইল অভ্যন্তরেও আক্রমণ পরিচালিত হয়। ১২ই নভেম্বর রাত থেকে ভারতীয় আক্রমণের ব্যাপকতা বাড়তে থাকে। ১৯শে নভেম্বর পাকিস্তান গোলন্দাজ ও বিমান বাহিনীর সহায়তায় ব্যাপক প্রতিআক্রমণ চালায়, কিন্তু সুবিধা করতে পারেনি। তিনটি যুদ্ধবিমান হারিয়ে পাকিস্তান পশ্চাদপসরণ করতে বাধ্য হয়। ২১শে নভেম্বর সংঘর্ষের তীব্রতা এক নতুন মাত্রা লাভ করে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ- ভারত যৌথকমান্ড গঠিত হয়। পরিস্থিতির গুরুত্ব অনুধাবন করে মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন এবং নিরাপত্তা উপদেষ্টা ড. হেনরি কিসিঞ্জার যত দ্রুত সম্ভব বিষয়টি নিরাপত্তা পরিষদে নিয়ে যেতে আগ্রহী হন। কিন্তু পাকিস্তান নিরাপত্তা পরিষদের সভা আহ্বানে আগ্রহী ছিল না, বরং ৩০শে নভেম্বর নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যদের দেয়া চিঠিতে পাকিস্তান পূর্ব রণাঙ্গনে ভারতীয় সীমান্তে জাতিসংঘের পর্যবেক্ষক নিয়োগের দাবি জানায়। ৩রা ডিসেম্বর পাকিস্তান কর্তৃক ভারত আক্রমণের পর ২৪ ঘণ্টার মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিরাপত্তা পরিষদের সভা আয়োজনের দাবি জানায়। মার্কিন দাবির সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে আর্জেন্টিনা, বেলজিয়াম, বুরুন্ডি, ইতালি, জাপান, নিকারাগুয়া, সোমালিয়া এবং যুক্তরাজ্য। যুক্তরাষ্ট্রের আহ্বানে ৪ঠা ডিসেম্বর নিরাপত্তা পরিষদের অধিবেশন শুরু হয়। সভার শুরুতে বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী নিরাপত্তা পরিষদে বক্তব্য উপস্থাপনের অনুমতি প্রার্থনা করেন। নিরাপত্তা পরিষদের সভাপতি বিচারপতি চৌধুরীকে বক্তব্য উপস্থাপনের অনুমতি না দিলেও তাঁর পত্রটি নিরাপত্তা পরিষদের দলিল হিসেবে সদস্যদের মাঝে বিতরণের ব্যবস্থা করেন। এই প্রথম পত্রের মাধ্যমে বাংলাদেশ সরকারের বক্তব্য জাতিসংঘে উপস্থাপিত হলো। পত্রে উল্লেখ করা হয়, … the United Nations had not addressed itself so far to this basic problem, nor has it so far taken into account the party most concerned in this tragic and dangerous crisis namely, the 75 million people of Bangla Desh. There can be no proper evaluation of the present situation, its causes, present state and future solution, without Bangla Desh being given a hearing.’ নিরাপত্তা পরিষদের বিতর্কে অংশ নিয়ে পাকিস্তানের স্থায়ী প্রতিনিধি আগা শাহী তার বক্তৃতায় জাতিসংঘ সনদের ২(৪) ও ২(৭) ধারা লঙ্ঘনের দায়ে ভারতকে অভিযুক্ত করেন এবং পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষার দাবি জানান। ভারতের স্থায়ী প্রতিনিধি সমর সেন পাকিস্তান অযথা ভারতকে দায়ী করছে উল্লেখ করে বলেন, ‘বাঙালিরা নির্বাচনে জয়লাভ করলেও ক্ষমতায় যেতে পারেনি। তাদের অহিংস অসহযোগ আন্দোলন দমনে গণহত্যা চালানো হয়েছে। সুতরাং বাঙালির আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের দাবি পুরোপুরি যৌক্তিক।’
উপমহাদেশের যুদ্ধ পরিস্থিতির জন্য ভারতীয় আগ্রাসনকে দায়ী করে জাতিসংঘে যুক্তরাষ্ট্রের স্থায়ী প্রতিনিধি জর্জ এইচ ডব্লিউ বুশ একটি প্রস্তাব উত্থাপন করেন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাব ছিল, অবিলম্বে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধবিরতি কার্যকর করা; উভয় রাষ্ট্র তাদের সেনাবাহিনীকে স্ব-স্ব সীমান্তে ফিরিয়ে নেবে এবং দুদেশের সীমান্তে জাতিসংঘের পর্যবেক্ষক মোতায়েন করতে হবে। সোভিয়েত ইউনিয়নের স্থায়ী প্রতিনিধি জ্যাকব মালিক মার্কিন প্রস্তাবকে ‘একপেশে ও অগ্রহণযোগ্য’ বলে অভিহিত করেন এবং মার্কিন প্রস্তাবের বিপরীতে তিনি সোভিয়েত প্রস্তাব পেশ করেন। রাত ১১টা পর্যন্ত বৈঠক চলার পর অধিবেশন মুলতবি করা হয়। পরের দিন ৫ই ডিসেম্বর দুপুরে পুনরায় নিরাপত্তা পরিষদের অধিবেশন বসে। মার্কিন প্রস্তাব ভোটে দেয়া হলে সোভিয়েত ইউনিয়নের ভেটোর কারণে তা বাতিল হয়ে যায়। তবে এ প্রস্তাবের পক্ষে ছিল যুক্তরাষ্ট্র, চীন, আর্জেন্টিনা, বেলজিয়াম, বুরুন্ডি, ইতালি, জাপান, নিকারাগুয়া, সিয়েরা লিয়ন, সোমালিয়া ও সিরিয়া। প্রস্তাবের বিপক্ষে ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পোল্যান্ড। ভোটদানে বিরত থাকে ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্য। ফ্রান্স এবং যুক্তরাজ্যের ভোটদানে বিরত থাকার বিষয়টি প্রেসিডেন্ট নিক্সনের জন্য যথেষ্ট বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। মার্কিন প্রেসিডেন্ট এর কারণ হিসেবে মনে করেন, ‘afraid to make Russia mad.’ উপমহাদেশে আনুষ্ঠানিক যুদ্ধ শুরু হবার পূর্বে ব্রিটিশ কূটনীতিক ভারত সরকারকে জানায় যে, উপমহাদেশের সংকট যদি শেষ অবদি নিরাপত্তা পরিষদ পর্যন্ত গড়ায় তাহলে ভারত সরকারের জন্য বিব্রতকর কোনো অবস্থান ব্রিটেন নেবে না। উল্লেখ্য, ব্রিটেন এবং ফ্রান্স সরাসরি বাংলাদেশের পক্ষে অবস্থান না নিলেও বাংলাদেশের স্বার্থবিরোধী মার্কিন বা চীনের প্রস্তাবও সমর্থন করেনি।
৫ই ডিসেম্বর নিরাপত্তা পরিষদের অধিবেশনে কয়েকটি পৃথক প্রস্তাব বিবেচনার জন্য উত্থাপিত হয়। আর্জেন্টিনা, বুরুন্ডি, বেলজিয়াম, ইতালি, জাপান, নিকারাগুয়া, সিয়েরা লিয়ন এবং সোমালিয়ার খসড়া প্রস্তাবে ভারত ও পাকিস্তান উভয় সরকারের কাছে আহ্বান জানানো হয়, … for an immediate cease-fire and withdrawal of their armed forces on the territory of the other to their own side of the India-Pakistan borders.’ বেলজিয়াম, ইতালি, জাপান, নিকারাগুয়া, সিয়েরা লিয়ন এবং তিউনিসিয়ার অপর প্রস্তাবে সংশ্লিষ্টদের অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি কার্যকরের আহ্বান জানানো হয়। চীন পৃথক প্রস্তাব উত্থাপন করলেও তার প্রস্তাব ভোটাভুটিতে দেয়া হয়নি। চীনের প্রস্তাবে পাকিস্তানের ওপর ব্যাপক আক্রমণের জন্য ভারতকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়, যা ইন্দো-পাকিস্তান উপমহাদেশে শান্তিভঙ্গের কারণ। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতের আগ্রাসন, পাকিস্তানের অখণ্ডতা বিনষ্ট করা এবং ‘তথাকথিত’ বাংলাদেশ সৃষ্টির জন্য চীনের প্রস্তাবে ভারত সরকারের তীব্র নিন্দা জানানো হয়। ৪ঠা ডিসেম্বর সোভিয়েত রাশিয়ার উত্থাপিত খসড়া প্রস্তাবে বলা হয়, ‘পূর্ব পাকিস্তানে বৈরিতার অবসানের জন্য অপরিহার্য হলো রাজনৈতিক সমাধান। পূর্ব পাকিস্তানে সকল ধরনের সন্ত্রাসী তৎপরতা বন্ধে পাকিস্তান সরকারকে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।’ সোভিয়েত প্রস্তাবের বিরুদ্ধে চীনের ভেটো প্রয়োগের কারণে তা বাতিল হয়ে যায়। আবার তাৎক্ষণিক যুদ্ধবিরতি ও উভয় পক্ষের সেনা প্রত্যাহারের পক্ষে ৮টি দেশের উত্থাপিত প্রস্তাবের বিরুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেটো প্রদান করে। এটি ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের দ্বিতীয়বার ভেটো। উপমহাদেশের যুদ্ধ পরিস্থিতি নিয়ে যখন নিরাপত্তা পরিষদে উত্তপ্ত বিতর্ক চলছে, বৃহৎ শক্তিবর্গের ভেটোর কারণে তৈরি হয়েছে অচলাবস্থা, তখন বাংলাদেশ- ভারতের যৌথ বাহিনীর সঙ্গে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর তুমুল যুদ্ধ চলছে। ৬ই ডিসেম্বর ভারত কর্তৃক বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতিদানের মধ্য দিয়ে পরিস্থিতির নাটকীয় পরিবর্তন ঘটে। নিরাপত্তা পরিষদকে আনুষ্ঠানিকভাবে বিষয়টি অবহিত করেন ভারতের স্থায়ী প্রতিনিধি সমর সেন। সাধারণ পরিষদের বিশেষ অধিবেশন: ৬ই ডিসেম্বর সোভিয়েত ইউনিয়ন উত্থাপিত প্রস্তাবের বিরুদ্ধে চীন ভেটো প্রয়োগ করে। নিরাপত্তা পরিষদ কোনো সিদ্ধান্তই নিতে পারছে না দেখে পরিষদের ১১টি সদস্য বিষয়টি জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে প্রেরণের পক্ষে অবস্থান নেয়। সোভিয়েত ইউনিয়ন, ফ্রান্স, ব্রিটেন ও পোল্যান্ড এ প্রস্তাব সমর্থন না করলেও ভোটদানে বিরত থাকে। এ পরিপ্রেক্ষিতে ৭ই ডিসেম্বর গভীর রাত পর্যন্ত জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ২৬তম (বিশেষ) অধিবেশনে উপমহাদেশের শান্তি প্রতিষ্ঠায় করণীয় নির্ধারণের বিষয়ে আলোচনা চলে। তিনটি প্রস্তাবের মধ্যে সাধারণ পরিষদে ৩৪টি দেশের সংশোধিত প্রস্তাব সম্পর্কে ভোট গ্রহণ করা হয়। প্রস্তাবের পক্ষে ১০৪, বিপক্ষে ১১ এবং ভোটদানে বিরত ছিল ১৬। বিপুল ভোটের ব্যবধানে প্রস্তাবটি গৃহীত হয়। প্রস্তাবের মূল বিষয় ছিল- ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে তাৎক্ষণিক যুদ্ধবিরতি, পরস্পরের ভূখণ্ড থেকে স্ব-স্ব সেনা প্রত্যাহার এবং পূর্ব পাকিস্তানের শরণার্থীদের স্বেচ্ছা-প্রত্যাবর্তনের জন্য জাতিসংঘ সনদ অনুযায়ী দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া।
সাধারণ পরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের সার্বভৌমত্ব এবং রাষ্ট্রীয় অখণ্ডতার নীতির প্রতি দুর্বলতা ছিল স্বাভাবিক। এর প্রতিফলন সাধারণ পরিষদের ভোটাভুটিতে ঘটে। এছাড়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন এবং মুসলিম দেশসমূহ এ প্রস্তাবের পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সমস্যার গভীর বিশ্লেষণ ছাড়াই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকেও অধিকাংশ রাষ্ট্র কাতাঙ্গা (Katanga) এবং বায়াফ্রা (Biafra)-র ন্যায় ‘বিচ্ছিন্নতাবাদ’ হিসেবে বিবেচনা করে। তারপরও বিপুল ভোটে এ প্রস্তাব পাশ হওয়া ছিল ভারতের জন্য এক ধরনের কূটনৈতিক বিপর্যয়। বিপক্ষে ভোটদানকারী ১১টি রাষ্ট্রের মধ্যে ছিল ভারত, ভুটান এবং সোভিয়েত ব্লক (রুমানিয়া ছাড়া)। ইউরোপ, আফ্রিকা তো বটেই, এমনকি দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিবেশীদের মধ্যেও ভারতের মিত্র পাওয়া বেশ দুর্লভ হয়ে পড়ে। একমাত্র ভুটান আগাগোড়া ভারতের পক্ষে ছিল। নেপালও ওপরে উল্লিখিত প্রস্তাব সমর্থন করে। মুক্তিযুদ্ধের সময় শ্রীলঙ্কা বিমান ট্রানজিট দিয়ে পাকিস্তানকে সহায়তা করে। আফগানিস্তান ও বার্মা সাধারণ পরিষদের বিতর্কে অংশ নেয়নি। এমনকি জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের বলিষ্ঠ সমর্থক যুগোস্লাভিয়া, মিশর এবং ইন্দোনেশিয়া প্রস্তাবের পক্ষে ছিল। স্বস্তির বিষয় হলো, আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তার প্রশ্নে সাধারণ পরিষদ সুপারিশ করতে পারে মাত্র, কিন্তু নিরাপত্তা পরিষদের সিদ্ধান্তের ন্যায় সাধারণ পরিষদের সিদ্ধান্ত সদস্য রাষ্ট্রসমূহের জন্য কোনো আইনানুগ বাধ্যবাধকতা তৈরি করে না।
যুদ্ধের চূড়ান্ত পর্যায়ে নিরাপত্তা পরিষদের সভা: সাধারণ পরিষদে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব পাস হলেও তা কার্যকর করা সম্ভব হয়নি। ৭ই ডিসেম্বর পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ডা. এ এম মালেক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার নিকট প্রেরিত তারবার্তায় জানান যে, যুদ্ধবিরতির জন্য পাকিস্তানের উচিত জাতিসংঘে রাজনৈতিক সমাধানের প্রস্তাব দেয়া। পরের দিন দেয়া উত্তরে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান যুদ্ধ অব্যাহত রাখার নির্দেশ দিয়ে বলেন, জাতিসংঘে উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন প্রতিনিধিদল প্রেরণ করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ-ভারতের যৌথ বাহিনীর মোকাবিলা করা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পক্ষে প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। ৯ই ডিসেম্বর পাকিস্তানি পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার জেনারেল এ এ কে নিয়াজী রাওয়ালপিন্ডিকে জানান, ‘situation extremely critical we will go on fighting and do our best.’ ইয়াহিয়া পরিস্থিতি অনুযায়ী উপর্যুক্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের এখতিয়ার গভর্নরের ওপর অর্পণ করেন। গভর্নরের সামরিক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী জাতিসংঘের বিবেচনার জন্য পাঁচটি সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব তৈরি করেন, যা ১০ই ডিসেম্বর বেলা ১:০০টায় ঢাকায় নিযুক্ত জাতিসংঘের সিনিয়র কর্মকর্তা Paul Marc Henri’র নিকট হস্তান্তর করা হয়। রাও ফরমান আলী যে বিষয়ে সর্বাধিক গুরুত্বারোপ করেন, তা হলো- তাৎক্ষণিক যুদ্ধবিরতি এবং পাকিস্তানের সামরিক-বেসামরিক লোকজন যাতে নিরাপদে পশ্চিম পাকিস্তানে প্রত্যাবর্তন করতে পারে তার ব্যবস্থা করা। এছাড়া, ১৯৪৭ সাল থেকে পূর্ব পাকিস্তানে বসতি স্থাপনকারী বিহারি ও অন্যান্য অবাঙালিদের নিরাপত্তা প্রদান এবং যে-কোনো ধরনের ক্ষতি বা ধ্বংস না হওয়ার নিশ্চয়তা বিধান করা।
রাও ফরমান আলীর প্রস্তাব জানাজানি হয়ে যাওয়ার পর ভারত বুঝতে পারে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী চূড়ান্ত পরাজয়ের দ্বারপ্রান্তে। বিশ্বস্ত মিত্র পাকিস্তানের স্বার্থ রক্ষায় মার্কিন সরকার ভীষণ তৎপর হয়ে ওঠে। পাকিস্তান এবং যুক্তরাষ্ট্রের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, এ মহাসংকটে চীন অবশ্যই রণাঙ্গনে পাকিস্তানের পাশে দাঁড়াবে। কিসিঞ্জারের উক্তি ছিল, ‘I am pretty sure, the Chinese are going to do something and I think that we’ll soon see.’ কিন্তু চীন নিরাপত্তা পরিষদে পাকিস্তানের পক্ষে শক্ত অবস্থান নিলেও সরাসারি যুদ্ধে অংশ গ্রহণ না করার নীতি গ্রহণ করে। এর কারণ হলো, সম্ভবত চীন ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের আরো অবনতি হোক তা চায়নি এবং বেইজিং বিশ্বাস করে বর্তমান পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে উপনীত হয়েছে যে, সামরিক বল প্রয়োগেও পূর্ব পাকিস্তানকে রক্ষা করা সম্ভব নয়। উপরন্তু ভারত- সোভিয়েত সহযোগিতা চুক্তিতো ছিলই। উপমহাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উদ্যোগে ১২ই ডিসেম্বর বিকেল ৪টায় পুনরায় নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক বসে। দিনের পর দিন দীর্ঘ বিতর্কের পরও নিরাপত্তা পরিষদ কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারেনি। ১৬ই ডিসেম্বর দুপুরে নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক শুরু হলে নিয়মমাফিক সভাপতি প্রাথমিক বক্তব্য প্রদান করেন। তারপর ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর একটি বিবৃতি পাঠ করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং। বিবৃতির মূল বিষয় ছিল, ঢাকায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয় এবং পশ্চিম রণাঙ্গনে ভারতের একতরফা যুদ্ধবিরতি ঘোষণা।
শেষ পর্যন্ত ২১শে ডিসেম্বর নিরাপত্তা পরিষদ একটি সিদ্ধান্ত গ্রহণে সক্ষম হয়। নিরাপত্তা পরিষদের ৬টি অস্থায়ী সদস্য রাষ্ট্রের উত্থাপিত প্রস্তাবের পক্ষে ১৩ ভোট এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পোল্যান্ড ভোটদানে বিরত থাকে। এ প্রস্তাব পাশের মধ্য দিয়ে উপমহাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে নিরাপত্তা পরিষদের দীর্ঘ অধিবেশনের সমাপ্তি ঘটে। প্রস্তাবের প্রধান বিষয় ছিল- দ্বন্দ্ব-সংঘাতের সকল ক্ষেত্রে যুদ্ধ ও শত্রুতার বিরতি কঠোর ও কার্যকরভাবে পালন করতে হবে; যত দ্রুত সম্ভব সকল সেনাবাহিনীকে নিজ নিজ ভূখণ্ডে প্রত্যাহারসহ জম্মু এবং কাশ্মীরের যুদ্ধ বিরতি-রেখাকে পরিপূর্ণ সম্মান দেখাতে হবে। প্রস্তাবে আরও আহ্বান জানানো হয় যে, ‘all those concerned to take all measures necessary to preserve human life and for the observance of the Geneva Conventions of 1949…’। এই প্রথমবারের মতো নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাবে ভারত-পাকিস্তানের পরিবর্তে সংশ্লিষ্ট পক্ষসমূহ উল্লেখ করা হয়। এভাবে সরাসরি না হলেও পরোক্ষভাবে জাতিসংঘের গৃহীত প্রস্তাবে বাংলাদেশকে স্বীকার করে নেয়া হয়।
পরিশেষে বলা যায়, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে স্নায়ুযুদ্ধের প্রভাবে সারা বিশ্ব ছিল বিভক্ত। বিশ্বের নানা অঞ্চলে গড়ে উঠেছিল বিভিন্ন সামরিক জোট। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর বৈশ্বিক রাজনীতিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রভাববলয় প্রতিষ্ঠার প্রতিদ্বন্দ্বিতার কারণে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে অবিশ্বাস, দ্বন্দ্ব ও সংঘাত বৃদ্ধি পায়।
নিরাপত্তা পরিষদের ৫ স্থায়ী সদস্য জাতিসংঘের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইস্যুতে সোভিয়েত ইউনিয়ন পক্ষে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীন বিপক্ষে দৃঢ় অবস্থান নেয়। অপর দুই স্থায়ী সদস্য ফ্রান্স ও ব্রিটেন নিরপেক্ষ অবস্থান নিলেও বাংলাদেশের প্রতি অনেকটা সহানুভূতিশীল ছিল। উল্লেখ্য, আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে বৃহৎ শক্তিবর্গের নীতি- নির্ধারণের ক্ষেত্রে ভূ-রাজনৈতিক কৌশল ও জাতীয় স্বার্থ নিয়ামক ভূমিকা পালন করে। জাতিসংঘ সনদের আদর্শিক চেতনা, মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণাপত্র, গণহত্যা সম্পর্কিত কনভেনশন, আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার কোনো কিছুই বৃহৎ শক্তির বাংলাদেশ নীতিকে প্রভাবিত করতে পারেনি। শেষ পর্যন্ত শরণার্থীদের জন্য ত্রাণ কার্যক্রম ও মানবিক সহায়তার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকে যায় জাতিসংঘের ভূমিকা। [মোহাম্মদ সেলিম]
তথ্যসূত্র: Srinath Raghavan 1971: A Global History of the Creation of Bangladesh, New Delhi, Permanent Black 2013; A M A Muhith, Bangladesh Emergence of a Nation, Dhaka, UPL 2014

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৮ম খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!