You dont have javascript enabled! Please enable it!

মুক্তিযুদ্ধে নারীর ভূমিকা

মুক্তিযুদ্ধে নারী বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ছিল বাঙালির জাতীয় মুক্তি বা স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে পরিচালিত যুদ্ধ। এ-যুদ্ধ জনযুদ্ধ-এ রূপ নিয়েছিল। নারী-পুরুষ, ছাত্র-যুবক, কৃষক, শ্রমিক, কবি, সাহিত্যিক, লেখক, শিল্পী, পেশাজীবী, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী, বাঙালি সেনাসদস্য, ইপিআর (বর্তমান বিজিবি), পুলিশ, আনসার সর্বস্তরের মানুষ এতে যোগ দেয়। এদের অনেকের ভূমিকা গুরুত্বসহকারে বিভিন্নভাবে নানা জনের লেখা ও গবেষণাকর্মে ফুটে উঠলেও নারীর ভূমিকা ও অবদানের কথা যথোপযুক্ত গুরুত্ব পায়নি। অথচ জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক হলো নারী এবং মহান মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষ- পরোক্ষভাবে আমাদের নারী সমাজ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, যা বহুলাংশেই অজ্ঞাত। তাঁদের ভূমিকা যথার্থভাবে তুলে ধরা ও এর সঠিক মূল্যায়ন ব্যতীত মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস কখনো পূর্ণতা পেতে পারে না। আশি ও নব্বইয়ের দশক থেকে নারী অন্দোলন ও নারী উন্নয়নের নেতা-নেত্রী, নারীর অধিকার আদায়ের সংগ্রামে নিয়োজিত সংগঠক এবং দেশের লেখক-সাহিত্যিক, কবি, বুদ্ধিজীবী, গল্পকার, ঔপন্যাসিক এ বিষয়ে কিছুটা লেখালেখি করে আসছেন, তবে তা অনেকটাই অপ্রতুল।
সাধারণত মুক্তিযুদ্ধে নারীর ভূমিকাকে দেখা হয়েছে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে নির্যাতনের শিকার হিসেবে। স্বাধীনতার পরপর মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর দ্বারা যেসব নারী বিভিন্নভাবে নির্যাতিত হয়েছেন, ধর্ষণের শিকার হয়েছেন, গর্ভধারণ করেছেন, স্বামী হারা হয়েছেন, তাঁদের সেবা-শুশ্রূষা করা ও পুনর্বাসনই তখন একমাত্র করণীয় হয়ে দাঁড়ায়। সেটিও ছিল একটি কঠিন কাজ। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ। চতুর্দিকে প্রতিকূল অবস্থা। তার ওপর সামাজিক কুসংস্কার। এসব সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধু সরকারকে ঐ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হয়েছে (দেখুন মুক্তিযুদ্ধে বীরাঙ্গনা)। কিন্তু মহান মুক্তিযুদ্ধে আমাদের দেশের নারীসমাজের গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকার কথা লোকচক্ষুর অন্তরালে থেকে গেছে।
বলার অপেক্ষা রাখে না, যেকোনো যুদ্ধে নারী ও শিশুরাই হয় এর প্রথম ও প্রধান শিকার। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে এর কোনো ব্যতিক্রম ছিল না। প্রায় ৫ লক্ষ নারী পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর দ্বারা কোনো-না-কোনোভাবে নির্যাতিত হন। তাঁদের মধ্যে ৩ লক্ষের মতো নারী পাশবিক নির্যাতনের শিকার হন এবং প্রায় পৌনে ২ লক্ষ নারী ধর্ষণের শিকার হয়ে গর্ভবর্তী হন (দেখুন নারীনির্যাতন)। স্বাধীনতার পরে তাঁদের আখ্যায়িত করা হয় বীরাঙ্গনা হিসেবে।
কিন্তু মুক্তিযুদ্ধে আমাদের দেশে নারীসমাজের ছিল অনন্যসাধারণ ইতিবাচক ভূমিকা। তাঁদের এ ভূমিকার মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতিপর্বে ট্রেনিং গ্রহণ, মুক্তিযোদ্ধারা প্রত্যন্ত অঞ্চলে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার সময় তাঁদেরকে আশ্রয় দান, থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করা, গাইড হিসেবে কাজ করা, শত্রুশিবিরের তথ্য সংগ্রহ করা, মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র লুকিয়ে রাখা ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত। এমনকি দেশমাতৃকার টানে জীবন বাজি রেখে শত্রুর বিরুদ্ধে প্রাথমিক প্রতিরোধ ও পরবর্তীতে রণাঙ্গনে তাঁদের অনেকে সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন।
মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতিপর্বে ভূমিকা: ৭১-এর ২৫শে মার্চ কালরাতে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর সর্বস্তরের বাঙালির ওপর সশস্ত্র আক্রমণ পরিচালনা ও নৃশংস গণহত্যা শুরু এবং হানাদারদের হাতে বন্দি হওয়ার পূর্ব মুহূর্তে অর্থাৎ ২৬শে মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান- কর্তৃক স্বাধীনতা ঘোষণার পরপর শুরু হয় বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ। তবে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু হয় মার্চের শুরু থেকে, বিশেষ করে বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের দিকনির্দেশনামূলক ঐতিহাসিক ভাষণের পর থেকে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা মেডিকেল কলেজের নারী শিক্ষার্থীদের প্রশিক্ষণ
মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতিপর্বে নারীসমাজ নিজেদের গৃহের মধ্যে আবদ্ধ করে রাখেনি। ২৫শে মার্চ পর্যন্ত দেশের অভ্যন্তরে সংঘটিত অসহযোগ আন্দোলন, মিছিল-মিটিং সবধরনের কর্মকাণ্ডে নারীসমাজ সক্রিয় অংশগ্রহণ করে। বঙ্গবন্ধুর আহ্বান অনুযায়ী তাঁরাও ‘ঘরে ঘরে দুর্গ’ গড়ে তুলেছিলেন।
আসন্ন মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি হিসেবে ডামি রাইফেল নিয়ে ট্রেনিং গ্রহণ করেছিলেন। এক্ষেত্রে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত নারী শিক্ষার্থীরা এগিয়ে আসেন। তাঁদের ট্রেনিংয়ের মধ্যে ছিল অস্ত্র পরিচালনা, শত্রুর হাত থেকে আত্মরক্ষার কৌশল, ব্যারিকেড তৈরি, গ্রেনেড ছোড়া ইত্যাদি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের মধ্যে ছাত্রলীগ-এর কর্মীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের জিমনেসিয়ামে এবং ছাত্র ইউনিয়নের কর্মীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠে প্রশিক্ষণ নেন। জিমনেসিয়ামে প্রশিক্ষণ নেয়া ছাত্রলীগের ছাত্রী কর্মীদের মধ্যে ছিলেন ফরিদা খানম সাকি (২৫শে মার্চ রাতে রোকেয়া হলের যে ৭ জন ছাত্রী হাউস টিউটরের বাসায় আশ্রয় নিয়ে পাকহানাদারদের হাত থেকে প্রাণে বেঁচে যান তাঁদের মধ্যে অন্যতম; স্বাধীনতাপরবর্তী ১১তম জাতীয় সংসদের এমপি), মমতাজ বেগম (স্বামী হাবিবুল্লাহ, কুমিল্লা), ফোরকান বেগম (রূপগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ), রাশেদা খানম (নড়িয়া, শরীয়তপুর), শামসুন নাহার ইকো (বিক্রমপুর, মুন্সিগঞ্জ), মমতাজ শেফালী (শ্রীনগর, মুন্সিগঞ্জ), রাবেয়া বেগম (স্বামী শাজাহান সিরাজ), সুলতানা ফেরদৌস আরা ডলি (ফেনী), বেগম শামসুন্নাহার (শ্রীপুর, মুন্সিগঞ্জ) প্রমুখ। এঁদের অবসরপ্রাপ্ত সেনাবাহিনীর সৈনিক দুদু ও যুবনেতা কামরুল ইসলাম খান খসরু প্রশিক্ষণ দেন। ছাত্র ইউনিয়নের প্রশিক্ষণ গ্রহণকারী ছাত্রীদের মধ্যে ছিলেন কাজী রোকেয়া সুলতানা রাকা (স্বামী নূহ আলম লেনিন), নাজমুন আরা মিনু, সৈয়দা মনিরা আক্তার খাতুন (নেত্রকোনা), রোকেয়া কবির (নেত্রকোনা; স্বাধীনতাপরবর্তী সময়ে ‘নারী প্রগতি সংঘ’ নামক এনজিও-র প্রতিষ্ঠাতা), কামরুন নাহার হেলেন, রতন (ন্যাপের মোজাফফর আহমেদের ভাগ্নী) ডা. নেলী সাহা (ঢাকা মেডিকেল কলেজ), ডা. রোকেয়া (ঢাকা মেডিকেল কলেজ), ডা. মেহেরোজ (ঢাকা মেডিকেল কলেজ), সীমা মোসলেম, নাজনীন সুলতানা ও তাজিন সুলতানা (মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমের ভগ্নি) প্রমুখ।

মরিচা হাউস-এ নারীদের প্রশিক্ষণ
৭ই মার্চের ভাষণের পর বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে মহিলা আওয়ামী লীগ-এর প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক সৈয়দা বেগম সাজেদা চৌধুরী এমএনএ-এর ইন্দিরা রোডের ‘মরিচা হাউস’-এর বাসার সামনের মাঠে ঢাকা শহরের বিভিন্ন এলাকার আওয়ামী লীগের মহিলা কর্মীদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। প্রশিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন ঢাকার তাইরুন নাহার রশিদ (টি এন রশিদ নামে পরিচিত)। এখানে যাঁরা প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন, তাঁদের মধ্যে মমতাজ বেগম (৭০-এ নির্বাচিত এমএনএ), রাফিয়া আক্তার ডলি (৭০-এ নির্বাচিত এমএনএ), এডভোকেট সাহারা খাতুন (সাবেক স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী), জাহানারা বেগম বুলা (বরিশাল), ফেরদৌসী পিনু (ঢাকা; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার ছাত্রী) প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। ২৩শে মার্চ সৈয়দা বেগম সাজেদা চৌধুরীর নেতৃত্বে এসব প্রশিক্ষণার্থী মার্চ-পাস্ট করে বঙ্গবন্ধুর ৩২ নম্বর ধানমন্ডির বাড়িতে গিয়ে তাঁর হাতে মানচিত্রখচিত বাংলাদেশের পতাকা তুলে দেন।

মুক্তিযুদ্ধের নারী সংগঠক
মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে অনেক নারী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তাঁদের মধ্যে সর্বাগ্রে যার নাম উল্লেখ করতে হয়, তিনি হলেন বেগম ফজিলাতুননেছা মুজিব। তিনি শুধু বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণীই ছিলেন না, তিনি তাঁর চিরদিনের রাজনৈতিক সঙ্গীও ছিলেন। বাঙালির জাতীয় মুক্তি বা স্বাধীনতা অর্জনে সংগ্রাম করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানের ২৪ বছরের ১২ বছরই কারাগারে কাটাতে হয়েছে। অনেক সময়, ৬-দফা আন্দোলনকালে, বঙ্গবন্ধুসহ যেমন দলের কেন্দ্রীয় থেকে বিভিন্ন পর্যায়ের অনেক
নেতা-কর্মীকে দীর্ঘদিনের জন্য বন্দিত্ব বরণ করতে হলে, বেগম মুজিব কীভাবে দলের কর্মীদের খোঁজখবর রেখেছেন, দলীয় কর্মকাণ্ড চালু রাখতে অর্থের যোগান দিয়েছেন, বিভিন্ন রাজনৈতিক সন্ধিক্ষণে বঙ্গবন্ধুকে সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়তা করেছেন, তা প্রায় সকলেরই জানা। মুক্তিযুদ্ধের সময় ধানমন্ডি ১৮ নম্বর রোডের ২৬নং বাড়িতে পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের নিয়ে তাঁকে বন্দিজীবন কাটাতে হয়। এরূপ অবস্থার মধ্যেও তিনি দুই পুত্র শেখ কামাল ও শেখ জামাল-কে গোপনে মুক্তিযুদ্ধে পাঠিয়ে দেন। বিভিন্ন সোর্সের মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধা ও – মুজিবনগর সরকার-এর নিকট তথ্য আদান-প্রদান করেন। ১৬ই ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের সঙ্গে-সঙ্গে তিনি নিজ হাতে পাকিস্তানি পতাকা নামিয়ে তাতে আগুন ধরিয়ে দেন। এভাবেই বাঙালির মুক্তির আন্দোলন- সংগ্রামের শুরু থেকে মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জন পর্যন্ত তিনি বিরল ভূমিকা পালন করেন।
মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে আরো যাঁদের নাম উল্লেখ করতে হয়, তাঁরা হলেন— কবি সুফিয়া কামাল, আওয়ামী লীগ নেত্রী সৈয়দা বেগম সাজেদা চৌধুরী এমএনএ, বেগম বদরুন্নেসা আহম্মেদ (৭০-এ নির্বাচিত এমএনএ ও আওয়ামী লীগের মহিলা সম্পাদিকা), নুরজাহান মুরশিদ এমএনএ (৭০-এ মহিলা আসনে নির্বাচিত; তখন তিনি নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের মহিলা সম্পাদিকা), ড. নীলিমা ইব্রাহিম, অধ্যাপিকা মমতাজ বেগম এমএনএ (৭০-এ নারী আসনে নির্বাচিত), আইভি রহমান (১৯৬৯ সালে মহিলা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক), শহীদ জননী অধ্যাপিকা জাহানারা ইমাম, বেগম মতিয়া চৌধুরী (ন্যাপ নেত্রী), ড. সনজীদা খাতুন, সালমা ইসলাম, বেগম লুলু বিলকিস বানু (লন্ডন), মিসেস জেবুন্নেসা বস (লন্ডন), ফেরদৌসী রহমান (লন্ডন), ডা. নুরুন্নাহার জহুর (আওয়ামী লীগের শ্রম সম্পাদক জহুর আহমেদ চৌধুরীর স্ত্রী), মুশতারী শফী প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। এঁরা বিভিন্নভাবে মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখেন। যেমন, বেগম সুফিয়া কামাল তাঁর দুই কন্যা সুলতানা কামাল ও সাঈদা কামালকে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণে ভারতে পাঠিয়ে দেন। এছাড়া তিনি অবরুদ্ধ বাংলাদেশের মধ্যে থেকেও মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয়দানসহ নানাভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করেন। মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে সৈয়দা বেগম সাজেদা চৌধুরীর ভূমিকা ছিল অসামান্য, যা ইতঃপূর্বে উল্লিখিত হয়েছে (নিম্নে আরো দ্রষ্টব্য)। মুক্তিযুদ্ধকালে মুজিবনগর সরকারের পক্ষ থেকে নয়াদিল্লিতে যে ৩ সদস্যের পার্লামেন্টারি দল প্রেরণ করা হয়েছিল, নুরজাহান মুরশিদ এমএনএ ছিলেন সে-দলের অন্যতম সদস্য। ড. নীলিমা ইব্রাহিম তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের চেয়ারপার্সনের দায়িত্বে থাকা অবস্থায়ও ঢাকা শহরের মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য খাদ্য সংগ্রহ, অর্থের যোগান, প্রচারপত্র বিলি এবং বাংলাদেশ সরকারের নিকট তথ্য সরবরাহ ইত্যাদির মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকা পালন করেন। এজন্য সামরিক প্রশাসক টিক্কা খান কর্তৃক পত্র দিয়ে তাঁকে সতর্ক করা হয়েছিল। ১৯৬৭-৬৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলের ছাত্রলীগের সভাপতি মমতাজ বেগম (৭০-এ এমএনএ, একই বছর অধ্যাপনা পেশায় যোগদান; বর্তমানে জাতীয় মহিলা সংস্থার চেয়ারম্যান) ৬-দফা, ১১-দফা আন্দোলন ও ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানে ভূমিকা পালন ছাড়াও মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। আইভি রহমান মুক্তিযুদ্ধকালে শরণার্থী শিবির-এ সেবাদান ও মুক্তিযুদ্ধে তরুণদের উদ্বুদ্ধকরণ ছাড়াও স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে নিয়মিত কথিকা পাঠ করতেন। অধ্যাপিকা জাহানারা ইমাম নিজ সন্তান শাফি ইমাম রুমীকে মুক্তিযুদ্ধে পাঠিয়েছিলেন এবং রুমী ঢাকা ক্র্যাক প্লাটুনের সদস্য হিসেবে ঢাকা শহরে একাধিক সফল অপারেশনের নেতৃত্ব দেন। এক পর্যায়ে পাকহানাদার বাহিনীর হাতে তিনি ধরা পড়েন এবং হানাদাররা অমানুষিক নির্যাতন শেষে তাঁকে হত্যা করে (দেখুন ক্র্যাক প্লাটুন)। বেগম মতিয়া চৌধুরী ন্যাপ- কমিউনিস্ট পার্টি-ছাত্র ইউনিয়নের যৌথ গেরিলা বাহিনীর অন্যতম সংগঠক ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধকালে ভারতের শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেয়া বাঙালিদের উজ্জীবিত করণে গঠন করা হয়েছিল সাংস্কৃতিক স্কোয়াড। এর দায়িত্বে ছিলেন ড. সানজীদা খাতুন, সালমা ইসলাম প্রমুখ। ডা. নুরুন্নাহার জহুর চট্টগ্রামে মহিলা মুক্তিযোদ্ধা স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গড়ে তুলেছিলেন। চট্টগ্রামের ডা. শফীকে পাকিস্তানি সেনারা ধরে নিয়ে হত্যা করলে তাঁর স্ত্রী মুশতারী শফী ছেলে-মেয়েদের নিয়ে প্রথমে গ্রাম-গঞ্জে আত্মগোপন করে থাকেন। এরপর মে মাসে তিনি ভারতে চলে যান এবং স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র-এর কর্মী হিসেবে অবদান রাখেন।

কলকাতায় গোবরা ক্যাম্পে নারীদের সশস্ত্র প্রশিক্ষণ
মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণের ব্যাপারে নারীদের মধ্যে তীব্র আকাঙ্ক্ষা লক্ষ করে বাংলাদেশ সরকার তাঁদের প্রশিক্ষণ দানের অনুমতি দেয়। কলকাতার পদ্মপুকুরের গোবরা এলাকায় ক্যাম্প স্থাপন করে সেখানে তাঁদের প্রশিক্ষণ দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়। গোবরা ক্যাম্প পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন সৈয়দা বেগম সাজেদা চৌধুরী এমএনএ। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও ব্যক্তির উদ্যোগে প্রায় ৩০০ তরুণী ও কিশোরীকে এ ক্যাম্পে সিভিল ডিফেন্স, নার্সিং ও সশস্ত্র প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়। এখানে প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদের মধ্যে গীতা মজুমদার (ফরিদপুর), গীতা কর, শিরিন বানু মিতিল, ডা. লায়লা পারভিন বানু (দৌলতপুর, কুষ্টিয়া), ডা. দীপা ইসলাম (সিলেট), রওশন আরা বেগম (কালকিনি, মাদারীপুর), উমা রাণী দাস (রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির ছাত্রী) প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। গোবরা ক্যাম্প প্রতিষ্ঠা ও এখানকার তৎপরতা সম্বন্ধে সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী পরবর্তীতে বলেন, ‘স্বাধীনতা সংগ্রামে নারীদের সরাসরি অংশগ্রহণের লক্ষ্যে প্রবাসী সরকারের তত্ত্বাবধানে পশ্চিমবঙ্গের পার্ক সার্কাসের গোবরা এলাকায় মহিলাদের জন্য সশস্ত্র প্রশিক্ষণ ক্যাম্প গঠন করা হয়। এ ক্যাম্পে সিভিল ডিফেন্স, নার্সিং ও সশস্ত্র প্রশিক্ষণ প্রদান করা হতো। এ ছাড়াও দেশ প্রেমে উদ্বুদ্ধ করার জন্য প্রতিদিন রাজনৈতিক প্রশিক্ষণ প্রদান করা হতো। এ ক্যাম্পটি পরিচালনা করতে গিয়ে আমি দেখেছি প্রশিক্ষণ শেষে কি অদম্য স্পৃহা ও উদ্যোগ নিয়ে নারীরা বিভিন্ন সেক্টরে সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে।’ উল্লেখ্য, মুক্তিযুদ্ধের সময় এখানে প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদের বিভিন্ন সেক্টরে মেডিকেল টিম ও অন্যান্য কর্মকাণ্ডে মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতার জন্য প্রেরণ করা হতো।

আগরতলা লেম্বুছড়া ক্যাম্পে নারীদের সশস্ত্র প্রশিক্ষণ
গেরিলা ট্রেনিংসহ সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য আগরতলার বিশালঘরের লেম্বুছড়ায় শেখ ফজলুল হক মনির পরিকল্পনায় একটি ক্যাম্প স্থাপন করা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জিমনেসিয়াম, কলকাতায় গোবরা ক্যাম্প ইত্যাদি স্থানে প্রাথমিক ট্রেনিংপ্রাপ্ত ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের কয়েকজন মহিলা সদস্য এ ট্রেনিং প্রোগ্রামে অংশগ্রহণ করেন। তাঁদের মধ্যে ফরিদা খানম সাকি, তাঁর বোন শিরিন জাহান দিলরুবা, মমতাজ বেগম, শামসুন নাহার ইকো, ফোরকান বেগম, মিনারা বেগম ঝুনু, বকুল মোস্তফা, স্বপ্না রায়, আমেনা সুলতানা বকুল (ব্রাহ্মণবাড়িয়া), রওশনরা বেগম প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। এসব নারীযোদ্ধাদের ভারতীয় দুজন সেনা অফিসার মেজর কে বি সিং ও মেজর শর্মা সশস্ত্র প্রশিক্ষণ দেন। প্রশিক্ষণ শেষে তাঁরা রণাঙ্গনে মুক্তিযোদ্ধাদের পাশে থেকে যুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। আনোয়ারা ও মনোয়ারা নামে দুই সহোদর বোন (পটুয়াখালী) সুন্দরবন সাব-সেক্টর কমান্ডার জিয়াউদ্দিনের ক্যাম্পে অস্ত্র প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন।

আগরতলার ক্র্যাপস হোস্টেল ক্যাম্পে নারীদের ভূমিকা
মুক্তিযুদ্ধকালে এখানে ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি ও ছাত্র ইউনিয়নের নেতা-কর্মীদের যুদ্ধে যোগদানের মোটিভেশন, আহত ও অসুস্থ মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা সেবা, শরণার্থীদের মনোবল বৃদ্ধি ইত্যাদি বিষয়ে পার্টির শীর্ষ নেতৃবৃন্দের তত্ত্বাবধানে একটি ক্যাম্প স্থাপন করা হয়। এ ক্যাম্পে নারী সদস্যদের মধ্যে যাঁরা বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেন, তাঁদের মধ্যে বেগম মতিয়া চৌধুরী, ডা. মকদুমা নার্গিস রত্না, মালেকা বেগম, ডা. ফৌজিয়া মোসলেম, আয়শা খানম, রোকেয়া কবির, মনিরা আক্তার খাতুন, নিবেদিতা দাস পুরকায়স্থ প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য।

সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে নারীর অংশগ্রহণ
অনেক নারী রণাঙ্গনে অস্ত্রহাতে পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে সরাসরি লড়াই করে মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। তাঁদের মধ্যে কুড়িগ্রামের তারামন বিবি, খাসিয়া আদিবাসী কাকন বিবি- ওরফে নুরজাহান বেগম, পাবনার শিরিন বানু মিতিল, বরিশালের মুলাদির করুণা বেগম, পিরোজপুর জেলার স্বরূপকাঠির শোভা রাণী মণ্ডল, বরিশালের মনিকা রাণী ও বিথীকা বিশ্বাস, বরিশালের গৌরনদীর বিভা রাণী প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। কৃষক পরিবারের সন্তান তারামন বিবি মেজর তাহেরের অধীন ১১নং সেক্টরে একাধিক সম্মুখ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। খাসিয়া আদিবাসী সন্তান কাকন বিবি (এক মুসলমান কৃষককে বিয়ে করার পর নাম রাখা হয় নুরজাহান বেগম; স্বাধীনতার পরে সুনামনগঞ্জের দোয়ারাবাজার উপজেলার লক্ষ্মীপুর ইউনিয়নের ঝিরাগাঁও গ্রামে বসবাস; বর্তমানে প্রয়াত) মেজর মীর শওকত আলীর অধীনে ৫নং সেক্টরে একাধিক সম্মুখ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন এবং শত্রুর ছোড়া গুলিতে বিদ্ধ হয়ে আহত হন। সিলেটের টেংরাটিলার ভয়াবহ যুদ্ধে তিনি অসীম সাহসিকতার পরিচয় দেন। পাবনার ছাত্র ইউনিয়ন নেত্রী শিরিন বানু মিতিল ছিলেন এক অকুতোভয় নারী মুক্তিযোদ্ধা। তিনি পুরুষের বেশে পাবনার প্রতিরোধযুদ্ধে সশস্ত্র লড়াইয়ে অংশগ্রহণ করেন। পরবর্তীতে তিনি ভারতে যান এবং কলকাতার পার্ক সার্কাসে নারীদের প্রশিক্ষণের জন্য প্রতিষ্ঠিত গোবরা ক্যাম্পে তিনি যুদ্ধের উন্নততর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। কলকাতায় অবস্থানকালে তিনি মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে বিভিন্ন সভা- সমাবেশে বক্তব্য রাখেন এবং মুক্তিযুদ্ধে যোগদানে বিশেষ করে তরুণদের উদ্বুদ্ধ করেন। মুক্তিযুদ্ধকালে করুণা বেগমের মুক্তিযোদ্ধা স্বামী শহিদুল হাসান চুন্নুকে আহত অবস্থায় বন্দি ও নির্মম নির্যাতন শেষে পাকহানাদার বাহিনী কর্তৃক হত্যা করা হলে, এর প্রতিশোধ নিতে করুণা বেগম গেরিলা হিসেবে প্রশিক্ষণ নিয়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে পুরুষের বেশে একাধিক যুদ্ধে অবতীর্ণ হন এবং বহু শত্রুসেনাকে ঘায়েল করেন। দুঃসাহিসক এ নারী মুক্তিযোদ্ধা এক যুদ্ধে হানাদার বাহিনীর গুলিতে আহত হন। বরিশাল অঞ্চলের বানারীপাড়া-স্বরূপকাঠি এলাকার সাহসী নারী মুক্তিযোদ্ধা শোভা রাণী মণ্ডল। তিনি প্রথমে স্বরূপকাঠির পেয়ারা বাগানে সিরাজ শিকদারের দলে যোগ দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তিনি দুহাতে অস্ত্র চালাতে পারতেন একবার তিনি পাকহানাদারদের হাতে বন্দি হয়ে কিছুদিন পর মুক্তিলাভ করে এবার ৯নং সেক্টরের সাব-সেক্টর ক্যাপ্টেন শাহজাহান ওমরের বাহিনীতে যোগ দিয়ে বিভিন্ন অপারেশনে .অংশগ্রহণ করেন যুদ্ধকালে বরিশালে গঠিত সুইসাইড স্কোয়াড-এর তিনি অন্যতম সদস্য ছিলেন। শর্ষিণার পীরের বাড়ির যুদ্ধে শোভা রাণী সাহসিকতাপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। বরিশালের মনিকা রাণী ও বিথীকা বিশ্বাস একই সুইসাইড স্কোয়াড-এর সদস্য ছিলেন। তাঁরাও একাধিক অপারেশনে অংশগ্রহণ করেন। গৌরনদীর কিশোরী বিভা রাণী পাকিস্তানি হানাদার ও রাজাকারদের কর্তৃক নির্যাতিত হওয়ার পর স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যোগ দিয়ে তাঁদের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করেন (দেখুন মুক্তিযুদ্ধে বীরাঙ্গনা)।

মুক্তিযুদ্ধে নারীর পরোক্ষ ভূমিকা
অনেক নারী অবরুদ্ধ বাংলাদেশে শত্রুশিবিরে বন্দি থেকে, নিজ বাসায় অবস্থান নিয়ে কিংবা ছদ্মবেশ ধারণ করে, কেউ কলকাতা ও ভারতের অন্যান্য সীমান্তবর্তী রাজ্যে থেকে শত্রুশিবিরের খবরাখবর মুক্তিযোদ্ধাদের নিকট গোপনে পৌঁছে দিয়েছেন, কেউ অস্ত্র লুকিয়ে রেখেছেন, কেউ মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য অর্থ সংগ্রহ, ঔষধ যোগানো, আশ্রয়দান, শরণার্থী শিবিরে ত্রাণ তৎপরতা পরিচালনা ইত্যাদির মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধে সহায়ক ভূমিকা পালন করেন। তাঁদের মধ্যে শ্রীমঙ্গল চা বাগানের শ্রমিক সালগী খাড়িয়া, রাখাইন নারী উ পিণছা খেঁ-, পিরোজপুরের হুলারহাটের ভাগীরথী সাহা, চট্টগ্রাম শহরের মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলামের বিধবা নানী (বেপারীপাড়ার), শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী (শহীদ ডা. আলীম চৌধুরীর স্ত্রী), ফেরদৌসী পিনু (ঢাকা), কবি কাজী রোজী (শরণার্থী শিবিরে ত্রাণ তৎপরতা ও স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ; স্বাধীনতোত্তর একাদশ সংসদের এমপি), ফেরদৌস আরা বেগম (ইসলামপুর, জামালপুর), মাহফুজা খানম (ডাকসু-র সাবেক ভিপি), ডা. শেফালীকা দাস (গোপালগঞ্জ; ২ নম্বর সেক্টরে মুক্তিযোদ্ধাদের সেবাদান) প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। এঁদের মধ্যে চা বাগানের নারী শ্রমিক সালগী খাড়িয়া, হুলারহাটের ভাগীরথী সাহা, রাখাইন নারী উ পিণছা খেঁ শত্রুশিবিরের খবরাখবর মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে গোপনে পৌঁছে দিয়ে তাঁদের অপারেশন পরিচালনায় সহায়তা করেন (দেখুন মুক্তিযুদ্ধে বীরাঙ্গনা)। চট্টগ্রামের মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলামের বিধবা নানী তাঁর বাড়িতে অপারেশন জ্যাকপট-এর ৪০টি লিমপেট মাইন ও অন্যান্য অস্ত্র সংরক্ষণ করে শত্রুর বিরুদ্ধে ঐ সফল অপারেশনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন।

ফিল্ড হাসপাতালে সেবাদান
মুক্তিযুদ্ধকালে যুদ্ধাহত ও অসুস্থ মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা ও সেবাদান প্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে। যুদ্ধের তীব্রতা যতই বৃদ্ধি পাচ্ছিল, ততই এর আবশ্যকতা বেশি করে অনুভূত হচ্ছিল ফলে সেক্টর কমান্ডারদের অধীন বিভিন্ন সেক্টরে ও স্থানীয়ভাবে গড়ে ওঠা বিভিন্ন মুক্তিবাহিনী-তে গুরুত্বপূর্ণ উইং হিসেবে চিকিৎসা দানের ব্যবস্থা গড়ে ওঠে। এসব উইংএ বিশেষ করে নারীরা সেবামূলক ভূমিকা পালন করেন। যেমন, হেমায়েত বাহিনী তে মেট্রন সুপ্রিয়া বিশ্বাস, মনা রাণী ব্যানার্জী, মঞ্জু রাণী রায়, ডলি রাণী বাড়ৈ, ১১নং সেক্টরের মহেন্দ্রগঞ্জ থানার চাপাহাটি ফিল্ড হাসপাতালে মধুপুরের সন্ধ্যা রাণী সাংমা ও ভেরোনিকা সিমসাং সেবিকার দায়িত্ব পালন করেন। এক্ষেত্রে মেজর খালেদ মোশাররফ, বীর উত্তমএর নেতৃত্বাধীন ২নং সেক্টরে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল- বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ত্রিপুরার মেলাঘরে তাঁর সেক্টরের হেডকোয়ার্টার্স সংলগ্ন মতিনগরে এটি অবস্থিত ছিল। এ হাসপাতালে যেসব নারী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন, তাঁদের মধ্যে ডা. সেতারা বেগম, বেগম সুফিয়া কামালের দুই কন্যা সুলতানা কামাল ও সাইদা কামাল, ইডেন কলেজের শিক্ষিকা জাকিয়া, মিসেস হামিদুল্লাহ, মেডিকেল কলেজের ছাত্রী ডালিয়া, আসমা আলম, নীলিমা বৈদ্য প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। ডা. সেতারা বেগম নিজ হাতে অস্ত্রোপচার করে অনেক যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাকে সুস্থ করে তোলেন।

প্রাবসী বাঙালি নারীদের ভূমিকা
মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে প্রবাসে বিশেষ করে লন্ডন ও আমেরিকায় প্রবাসী বাঙালি নারীরা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন। তাঁদের মধ্যে মিসেস জেবুন্নেসা বস, বেগম লুলু বিলকিস বানু, ফেরদৌসী রহমান, আসমা কিবরিয়া, আশালতা সেন প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। মুক্তিযুদ্ধের সময় মিসেস জেবুন্নেসা বস ও বেগম লুলু বিলকিস বানু ছিলেন লন্ডন প্রবাসী। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে তাঁরা গঠন করেছিলেন বাংলাদেশ উইমেন্স এসোসিয়েশন। ফেরদৌসী রহমানসহ আরো অনেকে এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তাঁরা লন্ডনে বাংলাদেশের পক্ষে জনমত গঠনে বিভিন্ন তৎপরতায় লিপ্ত ছিলেন। ৩রা এপ্রিল লন্ডনে তাঁদের নেতৃত্বে একটি মিছিল সহকারে বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ শেষে ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রীর ১০নং ডাউনিং স্ট্রিট বাসভবনে গিয়ে বাংলাদেশে পাকিস্তানি সেনাদের গণহত্যা বন্ধ ও স্বাধীন বাংলাদেশের পক্ষে একটি স্মারকলিপি দেয়া হয়। উল্লেখ্য, যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন শহরে মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে গড়ে ওঠা একশন কমিটিসমূহের ২৪শে এপ্রিল অনুষ্ঠিত প্রতিনিধি সম্মেলনে ৫ সদস্যের একটি স্টিয়ারিং কমিটি গঠিত হয়েছিল এবং ঐ সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেছিলেন লুলু বিলকিস বানু (দেখুন প্রবাসী বাঙালিদের ভূমিকা)। অন্যদিকে অসহযোগ আন্দোলন চলাকালে ২৩শে মার্চ আমেরিকায় বাঙালি নারীদের একটি গ্রুপ বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের প্রতি সংহতি প্রকাশার্থে ওয়াংশিংটনে রাষ্ট্রদূত এনায়েত করিমের বাসভবনে এক সভায় মিলিত হয়। কূটনীতিক শাহ এ এম এস কিবরিয়ার স্ত্রী আসমা কিবরিয়া বাংলাদেশের মানচিত্রখচিত একটি পতাকা বানিয়ে ঐ সভায় যোগ দেন। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে নারীদের এ সভা আয়োজনে অন্যান্যের মধ্যে আশালতা সেন সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন।

বিদেশী নারীদের ভূমিকা
মুক্তিযুদ্ধকালে নারী, শিশু, পুরুষ নির্বিশেষে বাঙালিদের ওপর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নিষ্ঠুর ও বর্বরোচিত গণহত্যা বিশ্ব বিবেককে গভীরভাবে নাড়া দেয়। নির্বিচারে গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ, নারীর ওপর পাশবিক নির্যাতন ছাড়াও পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ১ কোটি বাঙালিকে (মোট জনসংখ্যার প্রায় এক-সপ্তমাংশ) দেশ ছেড়ে পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারতে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নিতে বাধ্য করে। এরূপ বিপুল সংখ্যক মানুষকে আশ্রয়দান ভারতের জন্য ছিল এক বড় চ্যালেঞ্জ। পান করার জন্য বিশুদ্ধ জল, স্বাস্থ্যসম্মত স্যানিটেশন, পুষ্টিকর খাদ্য ও প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সেবার অভাবে শরণার্থী শিবিরগুলোতে বিশেষ করে নারী, শিশু ও বৃদ্ধদের মৃত্যুর ঘটনা ঘটতে থাকে। এর ওপর জুন-জুলাই মাসে এক দিকে বন্যা-বৃষ্টি, অপরদিকে মহামারী আকারে কলেরার প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। ফলে বহুসংখ্যক শরণার্থী মৃত্যুর কবলে পতিত হয়। এমনি অবস্থায়, বলা যায়, সমগ্র বিশ্ব সম্প্রদায় সহানুভূতি নিয়ে জীবন বিপন্ন, বিধ্বস্ত ও স্বজনহারা অসহায় বাঙালিদের পাশে এসে দাঁড়ায়। এক্ষেত্রে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের অনেক নারীর অবদান চিরস্মরণীয়। তাঁদের মধ্যে আলবেনীয় বংশোদ্ভূত ভারতে বসবাসকারী মাদার তেরেসা, যুক্তরাজ্যের মেরিয়েটা প্রকোপ, ব্রিটিশ নাগরিক পল কনেট এর মার্কিন স্ত্রী এলেন কনেট – আইরিশ বংশোদ্ভূত ব্যারিস্টার নোভা শরীফ (স্বাধীনতা সম্মাননাপ্রাপ্ত; স্বামী সুলতান শরীফ), যুক্তরাষ্ট্রের ফোক গায়িকা জোয়ান বায়েজ -, আর্জেটিনার খ্যাতনামা কবি ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো প্রমুখের নাম অগ্রগণ্য। তাঁদের অনেকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গণহত্যার বিরুদ্ধে ও বাংলাদেশের পক্ষে জনমত গঠনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন (দেখুন টেস্টিমনি অব সিক্সটি), অনেকে বাংলাদেশ ফান্ডে অর্থ সাহায্য দিয়েছেন, কেউ বাংলাদেশের পক্ষে প্রচার কার্যে ব্যবহারের জন্য নিজ বাড়ি ছেড়ে দিয়েছেন (মেরিয়েটা প্রকোপ), কেউ বেসরকারি সাহায্য সংস্থার মাধ্যমে শরণার্থীদের মধ্যে রিলিফ কার্য চালিয়েছেন (মাদার তেরেসা), কেউ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ত্রাণ-সামগ্রীসহ সীমান্ত অতিক্রম করে অবরুদ্ধ বাংলাদেশে প্রবেশের পর পাকসেনাদের দ্বারা গ্রেফতার হয়ে কারাগারে বন্দি থেকেছেন (এলেন কনেট), কেউ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে শরণার্থীদের সাহায্যার্থে অর্থ সংগ্রহ করেছেন (জোয়ান বায়েজ ও ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো)।

শহীদ বুদ্ধিজীবী নারী
৭১-এ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে এ দেশের ৩০ লক্ষ মানুষ শহীদ হন। তাদের মধ্যে অসংখ্য নারীও রয়েছেন। হানাদার বাহিনীর ঐ গণহত্যার একটি বিশেষ দিক হলো, দেশের শ্রেষ্ঠ বুদ্ধিজীবীদের তালিকা ধরে বেছে বেছে নৃশংসভাবে হত্যা করা, যাতে বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও কোনোক্রমে যেন মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে। এসব শহীদ বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, ডাক্তার ইত্যাদি পেশার ব্যক্তিবর্গ অন্তর্ভুক্ত রয়েছেন। বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চায় নিয়োজিত নারীরাও পাকিস্তানি হায়েনাদের নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড থেকে রেহাই পাননি। এ প্রসঙ্গে ঢাকার মিরপুরের কবি মেহেরুন্নেসা (২৭শে মার্চ শহীদ), মাগুরার স্কুল শিক্ষিকা লুৎফুন্নাহার হেলেন- (৫ই অক্টোবর অমানবিক শারীরিক নির্যাতন চালিয়ে হত্যা), বিশিষ্ট নারী সাংবাদিক সেলিনা পারভীন (১৩ই ডিসেম্বর – আলবদর বাহিনীর একদল সশস্ত্র সদস্য কারফিউর মধ্যে ঢাকার বাসা থেকে চোখ বেঁধে গাড়িতে করে মোহাম্মদপুর ফিজিক্যাল ট্রেনিং কলেজের টর্চার সেলে নিয়ে অমানুষিক নির্যাতন শেষে ১৪ই ডিসেম্বর গভীর রাতে রায়েরবাজার বটতলার বধ্যভূমিতে প্রথমে বেয়নেট চার্জ এবং এরপর গুলি করে অত্যন্ত পৈশাচিকভাবে হত্যা)-এর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য (দেখুন শহীদ সাংবাদিক)।

খেতাবপ্রাপ্ত নারী
মুক্তিযুদ্ধে জীবন উৎসর্গ বা বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ সরকার স্বাধীনতাপরবর্তী অনেক বীর মুক্তিযোদ্ধাকে রাষ্ট্রীয় সম্মাননায় ভূষিত করে। এরূপ সম্মাননাপ্রাপ্ত ৩ জন ‘বীর প্রতীক’ খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা নারী হলেন- তারামন বিবি, কাকন বিবি ও ডা. সেতারা বেগম।
৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ ছিল জনযুদ্ধ। এতে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সর্বস্তর ও সর্ব পর্যায়ের মানুষ অংশগ্রহণ করেন। এ-যুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণকারী নারীর সংখ্যা বেশি না হলেও নারীদের ভূমিকা কোনো অংশে কম ছিল না, বরং কোনো- কোনো দিক বিচারে তা ছিল পুরুষের চেয়ে অধিক। তাঁরা নিজ স্বামী-সন্তানকে যুদ্ধে পাঠিয়েছেন, অনেকে স্বামীহারা, সন্তানহারা, পিতৃহারা, ভ্রাতৃহারা হয়েছেন। পুরুষের পাশাপাশি তাঁরাও বহু সংখ্যায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। তাঁদের যুদ্ধযন্ত্রণার পাল্লা অনেক ভারী। কেননা হত্যার পূর্বে তাঁদের অনেকের ওপর চলেছে পাকিস্তানি হানাদারদের পাশবিক নির্যাতন বাঙ্কারে, বন্দিশালায় মাসের পর মাস অনেকের ওপর এ নির্যাতন চলে। অনেকে গর্ভবতী হয়ে পড়েন। জন্ম নেয় যুদ্ধশিশু। স্বাধীনতার পর সমাজ-আপন জন অনেককেই গ্রহণ পর্যন্ত করেনি। ফলে অনেকে আত্মহত্যা করেছেন আবার অনেকে লোকচক্ষুর অন্তরালে নিরুদ্দেশ হয়ে কালের গর্ভে বিলীন হয়েছেন। নারীর খেতাবপ্রাপ্তি ও তার সংখ্যা দ্বারা মুক্তিযুদ্ধে তাঁদের অবদানের সঠিক মূল্যায়ন করা যাবে না। তাঁদের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ ভূমিকা ছাড়া মুক্তিযুদ্ধে বিজয় লাভ সহজ ছিল না। তাই তাঁদের অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানি হানাদারদের হাতে নির্যাতিতা সকল নারীকে ‘বীরাঙ্গনা’ হিসেবে ভূষিত করেন। [হারুন-অর-রশিদ]
তথ্যসূত্রঃ অধ্যাপক মমতাজ বেগম ও মফিদা বেগম, স্বাধীনতা যুদ্ধে বাংলার নারী, ঢাকা, হাক্কানী পাবলিশার্স ২০১৮; নারী নেত্রী মালেকা বেগম, মহিলা আওয়ামী লীগ নেত্রী ফরিদা খানম সাকি এমপি, কাজী রোকেয়া সুলতানা রাকা ও অন্যান্য সূত্রে প্রাপ্ত তথ্য

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৮ম খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!