You dont have javascript enabled! Please enable it! মুক্তিযুদ্ধে পুলিশ বাহিনীর ভূমিকা - সংগ্রামের নোটবুক

মুক্তিযুদ্ধে পুলিশ বাহিনীর ভূমিকা

মুক্তিযুদ্ধে পুলিশ বাহিনী বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে পুলিশ বাহিনীর ছিল গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ, পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সংগ্রাম, রণাঙ্গনে যুদ্ধ, মুক্ত অঞ্চলে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা, শরণার্থী শিবির-এ দায়িত্ব, মুক্তিযুদ্ধকালে বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে নিরাপত্তার দায়িত্ব প্রতিটি ক্ষেত্রে পুলিশের সদস্যরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। স্বাধীনতার জন্য এ বাহিনীর সদস্যদের চরম আত্মত্যাগ শিকার করতে হয়।
২৫শে মার্চ রাতে রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সশস্ত্র আক্রমণের বিরুদ্ধে এখানকার পুলিশ সদস্যরা সর্বপ্রথম প্রতিরোধ গড়ে তুলেন। পুলিশ সদস্যের ওপর হানাদারদের বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ড মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এক মর্মস্পর্শী ঘটনা।
১৯৪৭ সালে ভারত ও বাংলা বিভক্তি এবং পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার প্রাক্কালে ভারতের বেঙ্গল পুলিশের পূর্ব বাংলায় বসবাসকারী অধিকাংশ বাঙালি মুসলিম পুলিশ সদস্য স্ব- ইচ্ছায় পুর্ব বাংলার পুলিশ বিভাগে যোগদান করেন। পাকিস্তানের প্রশাসনিক কাঠামোয় এ-সময় পুলিশ বাহিনী ‘ইস্ট পাকিস্তান পুলিশ’ নামে প্রতিষ্ঠিত হয়। পরবর্তী সময়ে পাকিস্তান সরকারের প্রশাসনিক ইউনিটসমূহের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে পুলিশ প্রশাসনকে পুনর্গঠিত করা হয়।
১৯৭০ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর নেতৃত্বে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে জয়লাভ করলেও ইয়াহিয়া খানের সামরিক জান্তা ক্ষমতা হস্তান্তরের পরিবর্তে ষড়যন্ত্রের আশ্রয় গ্রহণ করে। এর ধারাবাহিকতায় ১লা মার্চ ১৯৭১ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এক বেতার ভাষণে ৩রা মার্চ অনুষ্ঠেয় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করেন। ইয়াহিয়া খানের এ ঘোষণায় প্রতিবাদমুখর হয়ে ওঠে পূর্ব বাংলার মানুষ। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে শুরু হয় দেশব্যাপী -অসহযোগ আন্দোলন। বাঙালি জাতির এমনই এক যুগসন্ধিক্ষণে দেশপ্রেমিক পুলিশ বাহিনী স্বীয় ভূমিকা পালনে এগিয়ে আসে।
মার্চের সেই অগ্নিঝরা দিনে অস্ত্রধারী বাঙালি পুলিশ বাহিনীর সদস্যগণ সারাদেশে সাধারণ মানুষের একান্ত আপনজনে পরিণত হন। ৭০-এর নির্বাচন এবং নির্বাচনোত্তর সময়ে পূর্ব পাকিস্তান পুলিশের বাঙালি সদস্যগণ স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এবং জনগণের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেন। অসহযোগ আন্দোলনের শুরু থেকে ঢাকা শহরে আন্দোলনের পক্ষে ও বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনা কার্যকর করার ক্ষেত্রে রাজারবাগ পুলিশ বাহিনীর ভূমিকা পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এ-সময়ে পুলিশ বিভাগের বিভিন্ন স্তরের বাঙালি সদস্যদের পরিকল্পিত প্রশাসনিক অসহযোগিতা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অনেক নীল-নকশা বাস্তবায়নকে ব্যর্থ করে দেয়।
বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ এ বাঙালি জাতির জন্য একটি সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা ছিল। সর্বস্তরে শুরু হয় আসন্ন মুক্তিযুদ্ধের প্রস্ততি। বাঙালি পুলিশ সদস্যরা এ-সময় রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সের অস্ত্রাগারের সামনে থেকে পাকিস্তানি পতাকা নামিয়ে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। আইজিপি তসলিম উদ্দিন আহমেদ ও স্পেশাল ব্রাঞ্চের ডিআইজি এ এস মেজবাহউদ্দিন ৩২নং ধানমণ্ডিতে গিয়ে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাঁর প্রতি পুলিশ বাহিনীর আনুগত্য প্রকাশ করেন। এরপর পাকহানাদাররা তসলিম উদ্দিন আহমদকে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে গিয়ে গৃহবন্দি করে রাখে।
ঢাকার বাইরের জেলাগুলোতেও পুলিশ সদস্যদের মধ্যে একই ধরনের প্রস্তুতি লক্ষ করা যায়। ৩রা মার্চ পাবনা পুলিশ লাইন্সে আয়োজিত হয় জনতা-পুলিশের এক সমাবেশ। মার্চ মাসের ২য় এবং ৩য় সপ্তাহে পুলিশ সদস্যদের সহায়তায় দেশের বিভিন্ন থানা এলাকায় স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্রের প্রশিক্ষণ দেয়া শুরু হয়। পাকিস্তানি জেনারেল রাও ফরমান আলী তার How Pakistan Got Divided (Karachi: Oxford University Press 2017) বইতে উল্লেখ করেছেন, ‘প্রশাসনের ওপর আওয়ামী লীগের নিয়ন্ত্রণ থাকায় পুলিশের তত্ত্বাবধানে রক্ষিত রাইফেল আনসার-মুজাহিদদের হাতে তুলে দেয়া হয়েছিল।’ প্রথম দিকে প্রতিরোধ যুদ্ধে পুলিশ বাহিনীর এ-সমস্ত অস্ত্র মুক্তিবাহিনীর অস্ত্র প্রাপ্তির প্রধান উৎসে পরিণত হয়।
অসহযোগ আন্দোলনের শুরুতেই পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে আন্দোলনরত জনগণের একাত্মতা ছিল লক্ষণীয়। জেলা, মহকুমা থেকে থানা পর্যায় পর্যন্ত এ ধরনের যোগাযোগ সংগ্রামী জনগণকে আরো উৎসাহিত করে। পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের এই সহযোগিতা ২৫শে মার্চ রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আক্রমণের প্রাথমিক অবস্থায় সকল পর্যায়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সাহায্য করে।
প্রতিরোধযুদ্ধে পুলিশ সদস্যদের অংশগ্রহণ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে একটি উল্লেখযোগ্য অধ্যায়। অসীম সাহসিকতা নিয়ে যাঁর কাছে যে অস্ত্র ছিল তাই নিয়ে তাঁরা প্রতিরোধ যুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। জীবনের ঝুঁকি নিয়েও এক পুলিশ লাইন্স আক্রমণের সংবাদ অপর পুলিশ লাইন্সে অয়ারলেসের মাধ্যমে পৌঁছে দেন। ২৫শে মার্চ মধ্যরাতে রাজারবাগ পুলিশ লাইন্স আক্রমণের সংবাদ কনস্টেবল মো. শাহজাহান মিয়া পুলিশ ওয়ারলেসের মাধমে দেশব্যাপী পুলিশের সদর দপ্তরসমূহে পৌঁছে দেন। প্রথম সংবাদ ছিল, ‘Base for all stations of East Pakistan Police, keep listing, watch, we are [being] already attacked by the Pak army. কনস্টেবল মো. শাহজাহান মিয়া Try to save yourself, over’.
রাজারবাগ পুলিশ লাইন্স থেকে প্রেরিত এ সংবাদ দেশের প্রায় সকল জেলা, মহকুমা ও থানায় ছড়িয়ে পড়ে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আক্রমণ মোকাবেলায় পুলিশ সদস্যগণ নিজ- নিজ অবস্থানে প্রতিরোধযুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। অবশ্য পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আক্রমণের খবর জানা না থাকায় দেশের কয়েকটি জেলা শহরে হানাদারদের আকস্মিক আক্রমণে পুলিশ সদস্যগণ নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। এক পর্যায়ে পুলিশ লাইন্সের প্রতিরোধ ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়লে বেশিরভাগ সদস্য কর্মস্থল ত্যাগ করে দেশের বিভিন্ন স্থানে জনপ্রতিরোধ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।
অসহযোগ আন্দোলনের শুরুতেই চট্টগ্রামের পুলিশ সুপার শামছুল হক এ আন্দোলনে নিজেকে সম্পৃক্ত করেন। সেনাবাহিনী, ইপিআর এবং পুলিশ বিভাগের বাঙালি কর্মকর্তা এবং সদস্যদের সঙ্গে তাঁর নিয়মিত যোগাযোগ ছিল। ২৫শে মার্চ রাতে রাজারবাগ পুলিশ লাইন্স আক্রমণের সংবাদ পেয়ে চট্টগ্রামের পুলিশ কর্মকর্তাগণ অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে দামপাড়া পুলিশ লাইন্সের নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করেন।
২৬শে মার্চ পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগকারী চট্টগ্রাম ইপিআর বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে পুলিশ সদস্যগণ শহরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় প্রতিরোধ ব্যবস্থায় যোগ দেন। এ-সময় পুলিশ সুপারের অফিস হয়ে উঠেছিল চট্টগ্রাম এলাকার কন্ট্রোল রুম। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বেলুচ রেজিমেন্ট ২৯শে মার্চ ভোররাতে দুদিক থেকে দামপাড়া পুলিশ লাইন্সের ওপর আক্রমণ চালায়। ভোর ৬টার দিকে আক্রমণের তীব্রতা বাড়লে পুলিশ লাইন্সের প্রতিরোধ ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ে। অনেক পুলিশ সদস্য অস্ত্রসহ স্থান পরিবর্তন করলেও যুদ্ধরত পুলিশ সদস্যদের অনেকেই শাহাদাত বরণ করেন।
২৬শে মার্চ মধ্যরাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী রাজশাহী পুলিশ লাইন্সে প্রবেশের চেষ্টা করে। পূর্বপ্রস্তুতি থাকায় পুলিশ সদস্যদের প্রবল প্রতিরোধের মুখে তারা পুলিশ লাইন্সে প্রবেশে ব্যর্থ হয়। এদিকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ২৫ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের সৈনিকরা শহরের প্রান্তে অবস্থান গ্রহণ করে। ২৮শে মার্চ বেলা ১টায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী পূর্ণ প্রস্তুতিতে পুলিশ লাইন্সের ওপর মর্টার শেলিং ও মেশিনগানের গুলিবর্ষণ শুরু করে। রকেট লাঞ্চারের শেলের আঘাতে পুলিশ লাইন্সের ওয়ারলেস টাওয়ারটি ভেঙ্গে পড়ে। কয়েকটি ব্যারাকে আগুন ধরে যায়।
সারদা পুলিশ একাডেমিতেও তারা আক্রমণ চালায়। এক পর্যায়ে প্রতিরোধ ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ে এবং পুলিশ বহিনীর অনেক সদস্য অবস্থান পরিবর্তনে সক্ষম হন। এ প্রতিরোধ যুদ্ধে পুলিশ বাহিনীর ১৮ জন সদস্য শাহাদাত বরণ করেন। পুলিশ লাইন্সের অভ্যন্তরে তাদের সমাহিত করা হয়।
খুলনা পুলিশ লাইন্সের সদস্যগণ ২৫শে মার্চ মধ্যরাতে বিদ্রোহে অংশগ্রহণ করেন। খুলনায় অবস্থানরত পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর একটি অংশ ঐ রাতেই পুলিশ লাইন্সের নিয়ন্ত্রণ নেয়ার চেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হয়। ২৬শে মার্চ সকালে পাকিস্তানি বাহিনীর পিপলস জুট মিলসের পুলিশ পোস্ট দখলের চেষ্টাও ব্যর্থ হয়। ২৭শে মার্চ সকালে খালিশপুর নৌ-ঘাঁটির পাকিস্তানি গানবোট খুলনা শিপইয়ার্ডের কাছাকাছি অবস্থান থেকে শহর এবং পুলিশ লাইন্সের ওপর শেলিং শুরু করে। পাকিস্তানি সৈন্যদের ত্রিমুখী আক্রমণে পরদিন ২৮শে মার্চ খুলনার পুলিশ লাইন্সসহ শহরের প্রতিরোধ ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী শহরের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে। ২৭শে মার্চ রাত ১২টায় পাকহানাদার বাহিনী পাবনা পুলিশ লাইন্স দখলে নিতে আক্রমণ চালায়। পুলিশ সদস্যদের প্রবল প্রতিরোধে ভোররাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী পিছু হটতে বাধ্য হয়। ২৮শে মার্চ পাকিস্তান বিমান বাহিনীর ২টি জঙ্গি বিমান পাবনা শহরের ওপর বেপরোয়া গুলি বর্ষণ শুরু করে। লক্ষ্য ছিল পদাতিক সৈন্যদের সাহায্য দিয়ে শহরে তাদের প্রবেশের সুযোগ সৃষ্টি করা। কিন্তু তাদের সেই চেষ্টাও ব্যর্থ হয়। ৯ই এপ্রিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ব্যাপক প্রস্ততি নিয়ে পাবনা শহরে প্রবেশের লক্ষ্যে পুনরায় আক্রমণ চালায়। চতুর্দিক দিয়ে এ আক্রমণের তীব্রতায় পুলিশ-জনতার প্রতিরোধ ভেঙ্গে পড়ে এবং পাকিস্তানি সেনাবাহিনী পাবনা পুলিশ লাইন্স দখল করে নেয়।
এর পূর্বে ২০শে মার্চ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের একদল সৈন্যের বগুড়া জেলা পুলিশ লাইন্সের অভ্যন্তরে অবস্থান নেয়ার চেষ্টা পুলিশ সদস্যদের প্রতিরোধে ব্যর্থ হয়ে যায়। ফলে সেনাবাহিনীর সদস্যগণ পার্শ্ববর্তী বগুড়া মহিলা কলেজ ও পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে অবস্থান নেয়। শহরের রাজনৈতিক পরিস্থিতির অবনতি ঘটলে সেনাবাহিনীর দলটি শহরের অবস্থান ত্যাগ করে। ২৬শে মার্চ সকাল সাড়ে ৭টা নাগাদ পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সদস্যরা নদী পার হয়ে ভিন্ন পথে বগুড়া শহরে প্রবেশ করে অবস্থান নেয়। শুরু হয় আক্রমণ এবং পাল্টা আক্রমণ। ১লা এপ্রিল পাকিস্তানি জঙ্গি বিমান শহরের ওপর আক্রমণ চালিয়ে ব্যর্থ হয়। ফলে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর একজন ক্যাপ্টেনসহ ২৩ জন সৈন্য আত্মসমর্পণ করে। বগুড়া শহর শত্রুমুক্ত হলেও মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে বেশি দিন তা ধরে রাখা সম্ভব হয়নি। পাকিস্তানি বিমান বাহিনী এবং সেনাবাহিনীর অব্যাহত আক্রমণের মুখে বগুড়া শহরের প্রতিরোধ ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ে। হানাদাররা বগুড়া শহরসহ পুলিশ লাইন্সের দখল নেয়। ২৫শে মার্চ মেহেরপুরের এসডিও তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী, বীর বিক্রম এবং ঝিনাইদহের এসডিপিও মাহবুবউদ্দিন আহমেদ, বীর বিক্রম-এর যৌথ সিদ্ধান্তে কর্মরত পুলিশ, ইপিআর এবং আনসার সদস্যদের সমন্বয়ে প্রতিরোধ গড়ে ওঠে। ঐদিন মধ্যরাতে যশোর সেনানিবাস থেকে ২৭ বালুচ রেজিমেন্ট কুষ্টিয়া শহরে অবস্থান নেয়। এদিকে পুলিশ, ইপিআর এবং জনগণের সমন্বয়ে গঠিত হয় মুক্তিবাহিনী। ৩০শে মার্চ মুক্তিবাহিনী কুষ্টিয়া শহরে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অবস্থানের ওপর প্রচণ্ড আক্রমণ শুরু করে। এলাকার জনগণ পুলিশ ও ইপিআর সদস্যদের সহায়তায় এগিয়ে আসে। তাদের হাতে ছিল বাঁশের লাঠি, বন্দুক এবং কিছু ৩০৩ রাইফেল। তিনদিন যুদ্ধ শেষে মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানি বাহিনীকে পরাজিত করে শহরের দখল গ্রহণ করে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এটাই ছিল প্রথম জনযুদ্ধ।
অসহযোগ আন্দোলনের শুরুতেই বরিশাল পুলিশ বাহিনীর কর্মকর্তা ও সদস্যদের সম্পৃক্ততা লক্ষ করা যায়। ২৬শে মার্চ স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ প্রতিরোধযুদ্ধ পরিচালনা নিয়ে পুলিশ সুপারের বাসায় আলোচনায় বসেন। এ আলোচনায় পুলিশ সুপার নিজ সিদ্ধান্তে পুলিশ লাইন্সের অস্ত্রাগার থেকে ২৫টি অটোমেটিক এবং ৭৫টি সাধারণ (ম্যানুয়াল) অস্ত্র প্রতিরোধযুদ্ধের জন্য দেন। পুলিশ বাহিনীর সদস্যগণ সামগ্রিকভাবে প্রতিরোধযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। ১৮ই এপ্রিল সকাল ১১টায় পাকিস্তান বিমান বাহিনীর যুদ্ধ বিমান বরিশাল শহরের ওপর বিক্ষিপ্তভাবে গুলিবর্ষণ শুরু করে। ২৫শে এপ্রিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনী পরিকল্পিতভাবে জল, স্থল এবং আকাশপথে আক্রমণ চালায়। মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মিলিত প্রতিরোধ প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। পাকিস্তান সেনাবাহিনী বরিশালের দখল নেয়।
এছাড়াও কুমিল্লা, নোয়াখালী, যশোর ও দিনাজপরেও পুলিশ বাহিনী প্রতিরোধযুদ্ধে যোগ দিয়ে বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
অসহযোগ আন্দোলনের শুরু থেকেই কুমিল্লা জেলা প্রশাসনের সঙ্গে মিলে পুলিশ সদস্যরাও পুলিশ সুপার মুন্সী কবির উদ্দিন আহমদের নেতৃত্বে একাত্মতা ঘোষণা পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের পূর্ব-প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। ২৫শে মার্চ রাতে হানাদার বাহিনী ময়নামতি ক্যান্টনমেন্ট থেকে কুমিল্লা পুলিশ লাইন্সের ওপর বর্বরোচিত আক্রমণ চালায়। সারারাত ধরে যুদ্ধের পর প্রতিরোধ ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ে। অনেক পুলিশ সদস্য হতাহত হন। ২৭শে মার্চ কুমিল্লা জেলা প্রশাসক শামসুল হক খান ও পুলিশ সুপার মুন্সী কবির উদ্দিন আহমদকে পাকহানাদাররা ধরে ময়নামতি ক্যান্টমেন্টে নিয়ে বন্দি করে রাখে। ৩০শে মার্চ সেখানে তাঁদের নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।
দিনাজপুর পুলিশ সদস্যরা পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে সম্মিলিত প্রতিরোধযুদ্ধে যোগ দেন। ২৮শে মার্চ থেকে সংঘর্ষ শরু হওয়ার পর ৩০শে মার্চ হানাদারদের তাড়িয়ে সম্মিলিত প্রতিরোধযোদ্ধারা দিনাজপুর শত্রুমুক্ত করতে সক্ষম হন এবং ১৪ই এপ্রিল পর্যন্ত দিনাজপুর মুক্ত রাখতে তারা সক্ষম হন। মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য ১০ই এপ্রিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপ-রাষ্ট্রপতি (বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি) এবং তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী করে ৬ সদস্যবিশিষ্ট একটি মন্ত্রিসভা গঠন করা হয়, যা মুজিবনগর সরকার- নামে সুপরিচিত। ১৭ই এপ্রিল দেশী-বিদেশী সাংবাদিক ও বিপুল সংখ্যক জনতার উপস্থিতিতে মেহেরপুর মহকুমা (বর্তমান জেলার)-র বৈদ্যনাথতলায় সরকারের আনুষ্ঠানিকভাবে শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতিকে এসডিপিও মাহবুবউদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে যে ১৫ জন সদস্য গার্ড অব অনার প্রদান করেন, তাঁদের মধ্যে ৩ জন ছিলেন পুলিশ বাহিনীর সদস্য (বাকি ১২ জন আনসার সদস্য)। মন্ত্রিসভার অন্যতম সদস্য এ এইচ এম কামারুজ্জামান-এর ওপর সরকারের স্বরাষ্ট্র, ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব ন্যস্ত ছিল। স্বরাষ্ট্র সচিব ও পুলিশের ডাইরেক্টর জেনারেল হিসেবে সারদা পুলিশ একাডেমির অধ্যক্ষ আবদুল খালেক পিএসপি-কে নিয়োগ দেয়া হয় এবং মুক্তিযুদ্ধকালে তিনি ঐ দায়িত্ব পালন করেন। পাকিস্তান সরকারের পুলিশ প্রশাসনের দাপ্তরিক নথি অনুসারে মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রায় ১৩,০০০ (তের হাজার)-এর অধিক পুলিশ সদস্য কর্মস্থল ত্যাগ করেন। কর্মস্থলত্যাগী সকল পুলিশ সদস্যের অবস্থান নির্ণয় করা সম্ভব হয়নি। পুলিশ বাহিনীর সদস্যগণ যারা সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের মাধ্যমে বিভিন্ন সেক্টর, প্রশাসনিক জোন এবং শরণার্থী শিবিরে কর্মরত ছিলেন, তাদের সকলেই বাংলাদেশ সরকারের বেতন ও ভাতা পেতেন। অপরদিকে পুলিশ বিভাগের অনেক সদস্য পাকিস্তান সরকারের পক্ষ ত্যাগের মাধ্যমে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের নেতৃত্বে অথবা নিজে গ্রুপ তৈরি করে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। ঐ সকল পুলিশ সদস্যের অনেকেই বিভিন্ন এলাকায় স্থানীয়ভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ এবং যুদ্ধ পরিচালনায় সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন।
তাঁদের অনেকে যুদ্ধক্ষেত্রে শাহাদাত বরণ করেন। অতএব মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মোট পুলিশ সদস্যদের মতো তাঁদের মধ্যে যাঁরা শাহাদাত বরণ করেন, তাঁদের সংখ্যা নির্দিষ্ট করে বলা কঠিন। তবে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী শহীদ পুলিশের সংখ্যা ৭৫১।
মুক্তাঞ্চলে প্রশাসনিক কার্যক্রম শুরু করার বিষয়টি ছিল মুজিবনগর সরকারের একটি উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ। পুলিশ সদর দপ্তর কর্তৃক মুক্তাঞ্চলসমূহে দায়িত্বপূর্ণ প্রশাসনিক কাঠামো সৃষ্টির ফলে সরকারের জন্য স্থানীয় আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির স্বাভাবিক পরিবেশ রক্ষার বিষয়টি সহজতর হয়েছিল। পাকিস্তান সরকারের পক্ষ ত্যাগ করে যেসব পুলিশ সদস্য বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ ও মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন, তাঁদের একদল পুলিশ সদস্যকে আঞ্চলিক প্রশাসন বা জোনাল কাউন্সিলের অধীন আইন- শৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত করা হয়। একই সঙ্গে দেশ শত্রুমুক্ত হওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে বেসামরিক প্রশাসনের পাশাপাশি পুলিশ প্রশাসনের আবশ্যকতার দিকে লক্ষ রেখে মুক্তিযুদ্ধের শেষদিকে পুলিশ সদর দপ্তর কর্তৃক বাংলাদেশ সরকারের সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে ৪টি রেঞ্জের জন্য ৪ জন ডিআইজি এবং প্রতি জেলায় একজন করে এসপি নিয়োগ দেয়া হয়। এভাবে নিয়োগপ্রাপ্তরা স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম পুলিশ কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য ৩ জন পুলিশ সদস্য ও ১ জন অফিসারকে রাষ্ট্রীয় উপাধি প্রদান করা হয়। এঁদের মধ্যে ৩ জন ‘বীর বিক্রম’ ও ১ জন ‘বীর প্রতীক’। ৩ জন বীর বিক্রম হলেন- মাহবুবউদ্দিন আহমেদ, বীর বিক্রম (মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে ঝিনাইদহের এসডিপিও; ১৭ই এপ্রিল মুজিবনগর সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতিকে গার্ড অব অনার প্রদানে নেতৃদান; বর্তমানে ব্যবসা ও রাজনীতির সঙ্গে জড়িত), তৌহিদ আলী, বীর বিক্রম- (পুলিশ কনস্টেবল; মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে রাজশাহী পুলিশ লাইন্সে কর্মরত ও প্রতিরোধযুদ্ধে অংশগ্রহণ; ২৩শে এপ্রিল অভয়নগর এলাকায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ) এবং আবদুল মান্নান, বীর বিক্রম- (পুলিশ কনস্টেবল; মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে রাঙ্গামাটি পুলিশ লাইন্সে কর্মরত; রাঙ্গামাটি প্রতিরোধযুদ্ধ ও চট্টগ্রামের কালুরঘাট প্রতিরোধযুদ্ধে অংশগ্রহণ; ১৫ই অক্টোবর চট্টগ্রামের রাউজান থানার মদিনাঘাটে পাকহানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ)। ‘বীর প্রতীক’ উপাধিপ্রাপ্ত পুলিশ সদস্য হলেন— মোহাম্মদ সোলায়মান, বীর প্রতীক (পুলিশ কনস্টেবল; মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে নীলফামারী ‘পুলিশ ফাঁড়িতে কর্মরত; স্থানীয় প্রতিরোধযুদ্ধসহ দিনাজপুরের পঞ্চগড় এলাকার বিভিন্ন যুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ; পাকহানাদারদের বিরুদ্ধে এম্বুশ করতে গিয়ে গুলিতে আহত; সুস্থ হয়ে পুনরায় মুক্তিযুদ্ধে যোগদান ও বীরত্বপূর্ণ অবদান)। মহান মুক্তিযুদ্ধে কর্মকর্তাসহ ৭৫১ জন পুলিশ বাহিনীর সদস্য শহীদ হন। এঁদের কয়েকজন হলেন— শহীদ পুলিশ সুপার গোলাম হোসেন, বরিশাল, শহীদ এসআই আবদুল জলিল বিশ্বাস, ফরিদপুর, জেলা গোয়েন্দা কর্মকর্তা শহীদ আফতার উদ্দিন আহমেদ, বরিশাল, শহীদ ডিআইজি মামুন মাহমুদ, রাজশাহী, শহীদ পুলিশ সুপার শাহ আবদুল মজিদ, রাজশাহী, শহীদ পুলিশ সুপার মুন্সী কবিরউদ্দিন আহমেদ, কুমিল্লা, শহীদ পুলিশ সুপার এম শামসুল হক, চট্টগ্রাম, শহীদ পুলিশ সুপার নাজমুল হক, চট্টগ্রাম, শহীদ এসডিপিও ফয়জুর রহমান আহমেদ, পিরোজপুর, শহীদ এসআই হিরু মিয়া, ঢাকা, শহীদ ইন্সপেক্টর গোলাম রব্বানী, নড়াইল, যশোর, শহীদ ওসি আবদুল কাদের মিয়া (পঞ্চগড়)।
বাহিনী হিসেবে ২০১১ সালে বাংলাদেশ পুলিশকে স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। [এ এস এম শামসুল আরেফিন ও হারুন-অর-রশিদ]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৮ম খণ্ড