You dont have javascript enabled! Please enable it!

বীর উত্তম মীর শওকত আলী

মীর শওকত আলী, বীর উত্তম (১৯৩৬-২০১০) বীর মুক্তিযোদ্ধা ও ৫ নং সেক্টর কমান্ডার। ১৯৩৬ সালের ৯ই ডিসেম্বর পুরান ঢাকার নাজিরা বাজারে তাঁর জন্ম। তাঁর পিতার নাম মীর মাহবুব আলী ও মাতার নাম সৈয়দা শাহজাদী বেগম। পিতা রেলওয়ের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ছিলেন। চাকরি থেকে অবসর গ্রহণের পর মীর শওকত আলী কুমিল্লা শহরের উপকণ্ঠে জগন্নাথবাড়িতে বাড়ি নির্মাণ করে সেখানে বসবাস করেন। তাঁদের পূর্ব পুরুষ আসাম থেকে আগত। সেখানে পরিবারের ঘনিষ্ঠজনদের মধ্যে মামা স্যার সৈয়দ সা’দুল্লাহ আসামের মুখ্যমন্ত্রী এবং খালাতো ভাই মওলানা তৈয়বুল্লাহ কংগ্রেস সরকারের মন্ত্রী ছিলেন।
মীর শওকত আলী ১৯৫৩ সালে আরমানিটোলা সরকারি হাইস্কুল থেকে মেট্রিকুলেশন এবং ১৯৫৫ সালে ঢাকা কলেজ থেকে ইন্টারমেডিয়েট পাস করেন। এরপর ১৯৫৫ সালে পশ্চিম পাকিস্তানের কাকুলে অবস্থিত পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমিতে ক্যাডেট হিসেবে যোগ দেন। ১৯৫৮ সালে তিনি সেখান থেকে গ্র্যাজুয়েশন ও সেনাবাহিনীতে কমিশন লাভ করেন। অতঃপর তিনি সেনাবাহিনীর বিভিন্ন রেজিমেন্টে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭০ সালে তিনি পাকিস্তান স্টাফ কলেজে উচ্চতর কোর্স সম্পন্ন করেন।
১৯৭১ সালের জানুয়ারি মাসে মেজর শওকত আলীকে চট্টগ্রামের ষোলশহরে অবস্থিত ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে বদলি করা হয়। সে অবস্থায় তিনি বাঙালিদের নির্বাচিত প্রতিনিধি বঙ্গবন্ধুর হাতে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর ক্ষমতা হস্তান্তরের পরিবর্তে ষড়যন্ত্রের আশ্রয়গ্রহণ, বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে মার্চের অসহযোগ আন্দোলন, তাঁর ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ, বাঙালিদের দমনে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সৈন্য ও অস্ত্র আনা ইত্যাদি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেন।
লে. কর্নেল জানজুয়া (পাঞ্জাবি) ছিল ৮ম ইস্ট বেঙ্গলের কমান্ডিং অফিসার। মেজর জিয়াউর রহমান, বীর উত্তম ছিলেন এর সেকেন্ড-ইন-কমান্ড। মেজর শওকত আলীকে ডি-কোম্পানির কমান্ডার ও ইস্ট বেঙ্গলের এডজুট্যান্ট করা হয়। ক্যাপ্টেন অলি আহমেদ, লে. খালেকুজ্জামান, সেকেন্ড লে. মাহফুজুর রহমান এবং শমসের মবিন চৌধুরীও একই রেজিমেন্টে ছিলেন। ষোলশহর ইস্ট বেঙ্গল হেডকোয়ার্টার্স থেকে চট্টগ্রাম সেনানিবাস ২ কিমি দূরে নতুন পাড়ায় অবস্থিত ছিল। এর পাশাপাশি ছিল ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টার (ইবিআরসি) বা সৈনিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। চট্টগ্রাম শহরের বাইরে হালিশহর নামক স্থানে ছিল ইপিআর হেডকোয়ার্টার্স। প্রধানত মার্চ মাসের প্রথম থেকে ইস্ট বেঙ্গল, ইপিআর ও ইবিআরসি-র বাঙালি অফিসারদের মধ্যে দেশের সার্বিক পরিস্থিতি ও পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর মনোভাব সম্বন্ধে কথাবার্তা হতে থাকে। পূর্ব থেকেই সতর্ক দৃষ্টি রাখছিলেন বলে ২৫শে মার্চ রাত ১১টায় বাঙালিদের ওপর পাকিস্তানি সামরিক জান্তার অপারেশন সার্চলাইট শুরুর পূর্বেই ইপিআর-এর ক্যাপ্টেন রফিকুল ইসলাম তাঁর বাহিনী নিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করতে পেরেছিলেন। চট্টগ্রাম পোর্টে সোয়াত জাহাজে করে পাকিস্তান থেকে আসা অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধারে যাওয়ার মাঝপথে মেজর জিয়াকে বাঙালি সৈনিকদের কর্তৃক ফিরিয়ে নিয়ে আসা হয়েছিল। সব শুনে তিনি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। মেজর শওকতও অন্যান্য বাঙালি অফিসারসহ ইস্ট বেঙ্গলের সকল বাঙালি সেনাসদস্যদের নিয়ে ২৬শে মার্চ ভোরে মেজর জিয়া চট্টগ্রাম শহরের পূর্বদিকে কর্ণফুলি নদীর ওপর কালুরঘাট ব্রিজে অবস্থান নেন। দুদিন সেখানে থাকার পর ২৮শে মার্চ মেজর জিয়া ও মেজর শওকত কক্সবাজার চলে যান এবং ৩০শে মার্চ পর্যন্ত সেখানে তাঁরা অবস্থান করেন। সেখান থেকে মেজর জিয়া ৩১শে মার্চ স্বল্প সময়ের জন্য পুনরায় কালুরঘাট এসে সেখান থেকে ইস্ট বেঙ্গলের একদল সৈন্য নিয়ে পার্বত্য জেলার ভারত সীমান্তবর্তী রামগড়ে চলে যান। এদিকে ৪ঠা এপ্রিল মেজর শওকত কালুরঘাট ফিরে এসে ১১ই এপ্রিল পর্যন্ত অবস্থান করেন এবং সেখানকার প্রতিরোধ যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন। তাঁর নেতৃত্বে প্রতিরোধযোদ্ধারা অনেক পাকসেনা খতম করতে সক্ষম হন। তবে পাকবাহিনীর জনশক্তি ও ভারী অস্ত্রের কাছে বেশিদিন টিকে থাকা সম্ভব না হওয়ায় কৌশলগত কারণে তিনি তাঁর সেনাসদস্য ও অন্যান্য প্রতিরোধযোদ্ধাদের নিয়ে পটিয়া ও কাপ্তাই হয়ে প্রথমে রাঙ্গামাটি সদর এবং সেখানে একদিন থেকে পরের দিন খাগড়াছড়ির মহালছড়িতে তাঁর বাহিনীর সদরদপ্তর স্থাপন করেন। ২৯শে এপ্রিল পর্যন্ত সেখানে থাকেন। এখানে অবস্থানকালে তাঁর নেতৃত্বাধীন বাহিনী পাকবাহিনী, তাদের দোসর রাজাকার ও মিজোদের বিরুদ্ধে একাধিক সংঘর্ষে লিপ্ত হয় এবং অনেক পাকসৈন্য ও তাদের সহযোগীদের হত্যা করতে সক্ষম হন। এর মধ্যে নানিয়ারচর উপজেলার বুড়িঘাটের যুদ্ধ (২০শে এপ্রিল) বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এখানকার যুদ্ধে পাকহানাদার বাহিনীর ২টি লঞ্চ ও ১টি গানবোট ধ্বংস ও বহুসংখ্যক পাকসেনাকে মুক্তিযোদ্ধারা হত্যা করেন। একই যুদ্ধে গানার মুন্সী আব্দুর রউফ এককভাবে বীরের মতো লড়াই করা অবস্থায় শত্রুর মর্টারের গোলার আঘাতে শহীদ হন।
৩০শে এপ্রিল মেজর শওকত মহালছড়ি ছেড়ে তাঁর বাহিনী নিয়ে রামগড় এসে মেজর জিয়ার বাহিনীর সঙ্গে যোগ দেন। একদিন পর জিয়া সীমান্ত পার হয়ে ভারতে চলে যান। তখন রামগড়ের কমান্ডের দায়িত্ব মেজর শওকত গ্রহণ করেন। এখানেও পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে তাঁর নেতৃত্বাধীন মুক্তিযোদ্ধাদের ভয়াবহ যুদ্ধ হয়। ২রা মে তিনিও তাঁর যোদ্ধাদের নিয়ে সীমান্তের অপর পারে চলে যান। ভারতের মেঘালয় সীমান্তবর্তী বাংলাদেশের অভ্যন্তরে অবস্থিত বাঁশতলা নামক স্থানে তাঁর প্রধান ঘাঁটি স্থাপন করেন। জুলাই মাসের মধ্যবর্তী সময়ে বাংলাদেশকে মোট ১১টি সেক্টরে বিভক্ত করা হলে মেজর মীর শওকত আলীকে ৫নং সেক্টর কমান্ডারের দায়িত্ব দেয়া হয়। পূর্বে তামাবিল-সিলেট রোড, পশ্চিমে ময়মনসিংহ জেলার সীমান্ত এবং দক্ষিণে আজমেরিগঞ্জ জুড়ে বৃহত্তর সিলেটের এক বিশাল অঞ্চল নিয়ে ৫নং সেক্টর গঠিত ছিল। এটিকে অভ্যন্তরীণভাবে ৬টি সাব- সেক্টরে বিভক্ত করা হয়, যথা- ডাউকি, মুক্তাপুর, ভোলাগঞ্জ, শিল্পা, বালাট ও বারসোরা। এখানে ৮০০ নিয়মিত বাহিনীর সদস্য ও ৭০০০ গেরিলা নিয়ে একটি মুক্তিফৌজ গঠিত হয়। মুক্তিযুদ্ধকালে এ সেক্টরে পাকহানাদারদের বিরুদ্ধে বহু গেরিলা অপারেশন, এম্বুশ ও সম্মুখ যুদ্ধ সংঘটিত হয় এবং অনেক পাকিস্তানি সৈন্য মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে নিহত হয় এসবের মধ্যে সেলোটিকর বিমান বন্দরে উড্ডীন অবস্থায় সৈন্যবাহী পাকিস্তানি বিমানে গেরিলাদের গুলিবর্ষণ, টাংরাটিলার যুদ্ধে অনেক সৈন্য হতাহতের পর সেখান ছেড়ে পাকহানাদারদের পালিয়ে যেতে বাধ্য করা, কোম্পানিগঞ্জ, গোয়াইনঘাট, ছাতক সিমেন্ট ফ্যাক্টরি, রাধানগর ও গোবিন্দগঞ্জে মুক্তিযোদ্ধাদের সফল আক্রমণ ও সেসব দখলে নেয়া বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এভাবে মুক্তিযুদ্ধে চূড়ান্ত বিজয় অর্জনের পূর্বেই মেজর শওকত আলীর নেতৃত্বে ৫নং সেক্টরের অধীনে সিলেটের এক বিশাল অঞ্চল শত্রুমুক্ত হয়। মুক্তিযুদ্ধে সাহসী ও সুযোগ্য নেতৃত্ব দানের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জনে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক তাঁকে ‘বীর উত্তম’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়।
স্বাধীনতার পরে মীর শওকত আলী দুটি ব্রিগেড ও দুটি ডিভিশনের কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮১ সালে তিনি লে. জেনারেল হিসেবে সেনাবাহিনী থেকে অবসর গ্রহণ করেন। ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত তিনি বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত পদে নিয়োজিত ছিলেন। মীর শওকত আলী জিয়াউর রহমানের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। চাকরি থেকে অবসর গ্রহণের পর তিনি জিয়া প্রতিষ্ঠিত বিএনপি-তে যোগদান করেন। ১৯৯১ সালে ঢাকার লালবাগ থেকে তিনি জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ সালের মধ্যবর্তী সময় পর্যন্ত বিএনপি সরকারের মন্ত্রী ছিলেন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে ২০০৬ সালে সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম গঠিত হলে তিনি এর ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০১০ সালের ২০শে নভেম্বর তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তাঁকে বনানীর সামরিক কবরস্থানে রাষ্ট্রীয় ও সামরিক মর্যাদায় সমাহিত করা হয়। [হারুন-অর-রশিদ]
তথ্যসূত্র: Lt. Gen. Mir Shawkat Ali, BU, The Evidence, vol. one & two, Dhaka, Somoy Prakashan 2008; মীর শওকত আলীর বোন এডভোকেট আফরিন মহিউদ্দিন-এর সাক্ষাৎকার (৪-১১-২০১৮)

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৮ম খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!