মুক্তিযুদ্ধে মুকসুদপুর উপজেলা (গোপালগঞ্জ)
মুকসুদপুর উপজেলা (গোপালগঞ্জ) ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে, কিন্তু পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী জাতীয় সংসদের অধিবেশন আহ্বান করেও পরে অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করে। ক্ষমতা হস্তান্তরের পরিবর্তে তারা শুরু করে গভীর ষড়যন্ত্র। এর প্রতিক্রিয়ায় সারাদেশে প্রতিবাদ-বিক্ষোভের ঝড় ওঠে। শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন। মুকসুদপুরবাসী এ আন্দোলনে অংশ নিয়ে ব্যাপক তৎপরতা শুরু করে। মার্চ মাসের প্রথম দিকে বাটিকামারী উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্র এবং ছাত্রলীগ-এর সক্রিয় সদস্য মো. ফিরোজ খানসহ বেশকিছু সংখ্যক ছাত্র আন্দোলনের দিকনির্দেশনার জন্য ফরিদপুর যান। তারা সেখান থেকে স্বাধীন বাংলার পতাকা নিয়ে আসেন এবং পাকিস্তানি পতাকা পুড়িয়ে মুকসুদপুর সদরের টেংরাখোলা ও বাটিকামারীতে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করেন। ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পর এখানকার ১৭টি ইউনিয়নের আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীদের নিয়ে সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়।
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ, বিশেষ করে আবুল খায়ের এমএনএ, কাজী আব্দুর রশিদ এমপিএ, নজির আহমেদ তালুকদার এবং আব্দুর রশিদ খান ঠাকুর এলাকার নেতা-কর্মীদের নিয়ে বিভিন্ন স্থানে মিটিং করে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠন করতে থাকেন। তাঁরা মুকসুদপুরের প্রতিটি ইউনিয়নে সংগ্রাম কমিটি গঠন করে তাদেরকে সক্রিয় কর্মকাণ্ড চালানোর নির্দেশ দেন। ২৭শে মার্চ পূর্ব মুকসুদপুরে (দিগনগর, বাটিকামারি এবং মহারাজপুর) এক বিশাল মিছিল দিগনগরের বড় রাস্তা হয়ে ভাঙ্গা পর্যন্ত প্রদক্ষিণ করে এবং পাকিস্তান ও পাকিস্তানের সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে স্লোগান দেয়। এরপর ছাত্র-যুবকরা ভাংগা থানা থেকে অস্ত্র নিয়ে যায়। এ-সময় মুকসুদপুর সদরে এক বিশাল সমাবেশ হয়। স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা অত্র উপজেলার গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলোতে সভা-সমাবেশ করে মুক্তিযুদ্ধের ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে থাকেন। ২৫শে মার্চ পাকবাহিনীর আক্রমণের পর চাকরি থেকে পালিয়ে আসা ইপিআর, পুলিশ ও সেনাসদস্যদের সমন্বয়ে জাফর আহমেদ মল্লিক (পরবর্তীতে এফএফ গ্রুপ কমান্ডার) এবং ওয়াজেদ মোল্লাকে (পরবর্তীতে এফএফ গ্রুপ কমান্ডার) নিয়ে এ অঞ্চলে সর্বপ্রথম মুক্তিবাহিনী গঠন করা হয়। এরপর প্রায় সকল ইউনিয়নে স্থানীয়ভাবে প্রাক্তন সেনাসদস্যদের দ্বারা শারীরিক প্রশিক্ষণসহ ডামি অস্ত্র ও বন্দুক দিয়ে প্রশিক্ষণ শুরু হয়। হাচেন শিকদারের নেতৃত্বে বাটিকামারী স্কুলের মাঠে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ চলে।
মুক্তিযোদ্ধাদের সার্বিক তত্ত্বাবধানের জন্য এখানে একটি সিভিল প্রশাসন গঠিত হয়, যা মুকসুদপুর সিভিল প্রশাসন- নামে পরিচিত। এর থানা প্রশাসক ছিলেন আব্দুল মান্নান তালুকদার এবং আইন বিষয়ক সহযোগী ছিলেন আব্দুর রশিদ খান ঠাকুর। প্রতিটি ইউনিয়নেও একটি করে সিভিল প্রশাসন গঠিত হয়। টেংরাখোলা ইউনিয়নের প্রধান ছিলেন আতিয়ার রহমান, খান্দারপাড় ইউনিয়নে মো. ইদ্রিস মিয়া, বহুগ্রামে উকিল মিয়া, উজানিতে অনিল চন্দ্র রায়, বাঁশবাড়িয়ায় আবুল খায়ের তালুকদার, মহারাজপুরে আস্রাব আলী মিয়া, মোচনায় জুলফিকার আলী মুন্সী, কলিয়াতে আ. মাজেদ মিয়া, ননীক্ষিরে টুকু মুন্সী, জলিরপাড়ে মুকুন্দ বালা, গোহালায় সেকেন্দার হায়াৎ, রাঘদিতে রতন মিয়া, দিগনগরে রোকন মোল্লা এবং বাটিকামারীতে আব্দুল মোতালেব মৃধা।
এ অঞ্চলের জনপ্রতিনিধি আবুল খায়ের এমএনএ বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ-এর মূল ক্যাসেটটি সংরক্ষণ করেন এবং কয়েক দিন বাড়িতে রেখে পরে ভারতে যাওয়ার সময় সঙ্গে নিয়ে যান। তাঁর সংরক্ষিত ক্যাসেটটি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচার করা হয় এবং বিভিন্ন স্থানে বিলি করা হয়। এর মাধ্যমে তিনি এক ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেন।
ইতালীয় বংশোদ্ভূত খ্রিস্টান ধর্মগুরু বানিয়ারচর ক্যাথলিক মিশনের যাজক ফাদার মারিনো রিগন মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসাসহ নানারকম সাহায্য-সহযোগিতা করেন। এমনকি পাকসেনাদের গোপন তথ্য সংগ্রহ করে তা মুক্তিযোদ্ধাদের সরবরাহ করেন।
মুক্তিযুদ্ধের প্রথম দিকে মুকসুদপুরে কোনো কমান্ডার ছিল না। বিভিন্ন গ্রুপ কমান্ডাররা সমন্বিতভাবে এখানকার যুদ্ধ পরিচালনা করতেন। যুদ্ধের শেষদিকে আবুল হাশেম থানা ইনচার্জের দায়িত্ব পালন করেন। মুজিব বাহিনীর থানা কমান্ডার ছিলেন কে এম আবুল হাসান। এ উপজেলার যুদ্ধকালীন গ্রুপ কমান্ডাররা হলেন- আ. ওয়াজেদ মোল্লা (লোহাইড়; এফএফ, সেনাবাহিনী থেকে আগত), আ. মান্নান শিকদার (বনগ্রাম, মহারাজপুর), ইদ্রিস হোসেন মোল্লা (লোহাইড়, মহারাজপুর, এফএফ), মাইনুদ্দিন মৃধা (লোহাচুড়া, এফএফ), শাহাজাহান খান (মাইলদিয়া, কাশালিয়া; এফএফ), মো. সেলিম খান (ছাগলছিড়া, রাঘদি; এফএফ), আব্দুর রাজ্জাক শিকদার (আলীপুর, বাটিকামারী; এফএফ), মো. মজিবর রহমান মজনু (ননীক্ষির, এফএফ), অনীল চন্দ্ৰ বাড়ৈ (বেতগ্রাম, বহুগ্রাম; এফএফ), আ. মজিদ তালুকদার (ননীক্ষির, এফএফ), আবুল বাশার রঙ্গু (বাঁশবাড়িয়া, ঝুটিগ্রাম; এফএফ), আশরাফুজ্জামান কোহিনুর (খানজাপুর, বাঁশবাড়িয়া; এফএফ), জাফর আহমেদ মল্লিক (গোপ্তরগাতী, খান্দারপাড়া; এফএফ), আবুল হাশেম (পাছড়া, খান্দারপাড়া; এফএফ), খুরশিদ আলম খান (বেজড়া, খান্দাড়পাড়া; এফএফ), আশরাফুল হক সেন্টু (ঝুটিগ্রাম, বাঁশবাড়িয়া ; এফএফ), ফারুক আহমেদ তালুকদার (বাঁশবাড়িয়া, এফএফ), আবদুল মালেক শেখ (পারইহাটি, এফএফ), নাছির আহমেদ তালুকদার (বাঁশবাড়িয়া, এফএফ), আবুল হাসান খান (গাড়লগাতী, বিএলএফ), বিভূতি কাঞ্জীলাল (ধর্মরায়ের বাড়ি, উজানী; এফএফ), আবদুল ওদুদ ভূঁইয়া (চাওচা, বাটিকামারী; এফএফ), খন্দকার এনায়েত হোসেন (খানপুরা, মোচনা; বিএলএফ), হাফিজুল হক চোকদার (ননীক্ষির, এফএফ), শওকত আলী খন্দকার (তরশ্রীরামপুর, এফএফ) ও মো. হিরু মোল্লা (বনগ্রাম, এফএফ)। এখানে মুক্তিযুদ্ধে নিয়োজিত নিয়মিত বাহিনীর সদস্য ছিল ২৮৬ জন, মুক্তিবাহিনীর (ছাত্র- কৃষক-শ্রমিক) ৫৪২ জন এবং মুজিব বাহিনীর ১৪৭ জন।
পাকবাহিনী যাতে মুকসুদপুরে প্রবেশ করতে না পারে সেজন্য স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী এবং ছাত্র-যুবকরা সংগঠিত হয়ে ফরিদপুর-বরিশাল সড়কের দিগনগর ব্রিজটি বিকল করে দিয়ে প্রাথমিক প্রতিরোধ গড়ে তোলেন।
পাকসেনারা ২১শে এপ্রিল ফরিদপুর জেলা শহরে অবস্থান নেয়ার পর বরিশাল যাওয়ার জন্য দিগনগর নদীর পশ্চিম পাশে এসে পৌঁছায়। স্থানীয় স্বাধীনতাবিরোধীরা তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে পার্শ্ববর্তী হিন্দু অধ্যুষিত বগাইল গ্রামটি জ্বালিয়ে দেয় এবং মালামাল লুট করে নিয়ে যায়। তারপর পাকসেনারা দুটি ফেরি নৌকা একত্র করে তাদের গাড়ি পার করে। এখানে চলাচলে যাতে বিঘ্ন না ঘটে সেজন্য নদীর দুই পাড়ে তারা ক্যাম্প বসায়। এর কিছুদিন পর পাকসেনারা উপজেলা সদর দখল করে থানায় ক্যাম্প স্থাপন করে। এপ্রিল মাসের শেষদিকে পাকসেনারা তাদের তৎপরতা জোরালো করতে জেলা, মহকুমা, থানা এবং ইউনিয়ন পর্যায়ে শান্তি কমিটি গঠনের কাজ শুরু করে এবং মুকসুদপুর উপজেলার স্বাধীনতাবিরোধী দালাল ও স্থানীয় চেয়ারম্যানদের নিয়ে শান্তি কমিটি গঠিত হয়। ওয়াহাব মিয়াকে সভাপতি এবং হাজী আবদুল হান্নানকে সেক্রেটারি করে মুকসুদপুর থানা শান্তি কমিটি গঠিত হয়। কমিটির অন্য সদস্যরা হলো- বাবু মিয়া, মোতাহার হোসেন, আহমদ আলী, ছহিরুদ্দিন মাতুব্বর প্রমুখ। তারা স্থানীয় সবাইকে পাকসেনাদের সহযোগিতা ও সরকারকে সমর্থন করতে বলে। এর কিছুদিন পর তাদের অনুগত লোকদের রাজাকার বাহিনীতে নিয়োগ দিয়ে প্রশিক্ষণের জন্য গোপালগঞ্জ মহকুমা শহরে পাঠায়। প্রশিক্ষণ শেষে তাদেরকে অস্ত্র দিয়ে পাকসেনাদের ক্যাম্পে প্রেরণ করা হয়।
মুকসুদপুরে রাজাকার বাহিনীর সদস্য ছিল দুই শতাধিক। তাদের মধ্যে তৎপর ছিল তপু মিয়া (দিগনগর), খালেক মুন্সী (খান্দারপাড়), রাঙ্গা কাজী (খান্দারপাড়), আব্দুল কাজী (খান্দারপাড়), জলিল চৌকিদার (খান্দারপাড়), জলিল মিয়া (মহারাজপুর), আবুল খায়ের (উজানী), নয়া মিয়া, নওয়াব আলী, হায়াত মিয়া, হায়দার মিয়া, ওহাব মোল্লা প্রমুখ। পূর্ব মুকসুদপুর রাজাকার বাহিনীর প্রধান ছিল তপু মিয়া এবং পশ্চিম মুকসুদপুরে আব্দুল খালেক মুন্সী। রাজাকারদের অত্যাচারে এ অঞ্চলের আওয়ামী লীগ কর্মী ও হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন বনে-জঙ্গলে পালিয়ে থাকত। এছাড়া পাকবাহিনীর সহযোগী হিসেবে আরো তৎপর ছিল অপু মিয়া (বাটিকামারী), ধলা মিয়া (সদরদি), কায়সার মিয়া (চেয়ারম্যান, দিগনগর ইউপি), প্রিয়লাল বাড়ৈ (কলিগ্রাম, খান সাহেব নামে পরিচিত) প্রমুখ। অবাঙালি পুলিশের সহায়তায় রাজাকাররা আওয়ামী লীগ কর্মী আতিয়ার রহমান ও জব্বার মোল্লাকে ধরিয়ে দেয়।
মুকসুদপুরের কুখ্যাত আলবদর ছিল আশরাফুজ্জামান খান লায়েব (পিতা আজাহার আলী খান, ছোট ভাটরা)। ১৯৭১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিষয়ে এমএ শেষ বর্ষে লেখাপড়ার সময় আলবদর বাহিনীর সঙ্গে যুক্ত হয়। এ-সময় সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কয়েকজন শিক্ষক, ডাক্তার, সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবীকে হত্যার পরিকল্পনা করে। মহসিন হলের যে কক্ষে সে থাকত, যুদ্ধের পর সেখান থেকে উদ্ধারকৃত তার স্বহস্তে লিখিত ডায়রি থেকে হত্যার বিস্তারিত পরিকল্পনা জানা যায়। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে আলবদর ও আলশামস কর্তৃক বুদ্ধিজীবী হত্যা তথা মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য আশরাফুজ্জামানকে তার অনুপস্থিতিতে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেয়া হয়।
১৩ই এপ্রিল গোপালগঞ্জ থেকে লঞ্চে করে পাকসেনাদের একটা বড় দল মুকসুদপুর সদরে আসে। বাজারে হিন্দুদের দোকান লুট করতে এসে একটি দোকান তালাবদ্ধ অবস্থায় দেখে তারা তা ভাঙ্গতে গিয়ে রাইফেলের বাট দিয়ে আঘাত করে। এতে হঠাৎ রাইফেলের গুলি বের হয়ে দুজন পাকসেনা ঘটনাস্থলেই মারা যায়। এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে পাকবাহিনীর দোসর ভাংগার মুন্নু মিয়ার নেতৃত্বে একদল পাকসেনা চরযোশরদীর রাসু সাহাদের বাড়িটি পুড়িয়ে দেয়। এরপর তারা নদী পার হয়ে বাটিকামারী বাজারে এসে বেছে-বেছে হিন্দুদের দোকানে আগুন দেয়। একই দিন তারা কর্মকার বাড়ি, রাম ঠাকুর ও জয়গোপাল মাঝির বাড়ি পুড়িয়ে দেয়। বাজারে কালা সাহার বড় দোকান ঘর পোড়াতে গেলে ছুটিতে আসা ফ্লাইট সার্জেন্ট কাজী তাছলীম আহমেদের বাধায় তা রক্ষা পায়। পাকসেনারা বাটিকামারী বাজারে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে বরইতলা রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় পদ্মকান্দার শশী রায়ের ছেলে সতীশ ও সুধীরকে হত্যা করে। রাজাকারদের সহযোগিতায় পাকসেনারা মহারাজপুর গ্রামের গঙ্গা সাধুকে হত্যা করে। ১৭ই মে পাকবাহিনীর দোসর আব্দুল খালেক মুন্সী, জলিল চৌকিদার ও ইউনুস মুন্সীর নেতৃত্বে পাকসেনারা মঠবাড়ি, বনবাড়ি ও খোরট গ্রামের হিন্দুদের বাড়ি-ঘর পুড়িয়ে দেয় এবং ২৩ জন সাধারণ মানুষকে গুলি করে হত্যা করে, যা মঠবাড়ি-বনবাড়ি-খোরট গণহত্যা নামে পরিচিত। পাকসেনা ও রাজাকাররা মুকসুদপুর উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে প্রায় তিনশত বাড়ি-ঘর জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ধ্বংস করে।
পাকসেনা ও রাজাকাররা দিগনগর ক্যাম্প থেকে পার্শ্ববর্তী এলাকায় এসে লুটপাট এবং অত্যাচার-নির্যাতন চালাত। তারা মুক্তিযোদ্ধা ও আওয়ামী লীগের লোকদের বাড়ি-ঘর খুঁজে খুঁজে জ্বালিয়ে দিত। রাতে গ্রামে ঢুকে নারীদের ধর্ষণ করত। ভাজনদী গ্রামের কানন বালা ও মিরা রাণী নামের দুজন নারীকে স্বাধীনতাবিরোধীরা ধরে নিয়ে যায়। মুক্তিযোদ্ধারা তাদের উদ্ধার করে বাটিকামারি মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে নিয়ে আসেন। এ ক্যাম্প থেকে তারা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন।
দিগনগর ক্যাম্প ও মুকসুদপুর থানা ছিল পাকবাহিনীর নির্যাতনকেন্দ্র ও বন্দিশিবির। তারা লোকজনদের ধরে এনে এ-দুটি স্থানে আটকে রেখে নির্যাতন করত। মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মীয়-স্বজনদের ধরে এনে মুক্তিপণ আদায় করত। এছাড়া পাকসেনারা নয়া মিয়ার নেতৃত্বে সুন্দরদী গ্রামের বাসি পালের বাড়িতে ক্যাম্প করে সেখানে লোকজনদের ধরে এনে অত্যাচার-নির্যাতন চালাত।
মুকসুদপুরে নির্দিষ্ট কোনো বধ্যভূমির সন্ধান পাওয়া যায়নি। পাকসেনারা দিগনগর ক্যাম্পে যাদের হত্যা করত, তাদের লাশ নদীতে ফেলে দিত এবং গ্রামে ঢুকে যেখানে যাদের হত্যা করত, তাদের লাশ সেখানেই ফেলে রাখত। এ উপজেলার বনবাড়িতে একটি গণকবর রয়েছে। পাকসেনারা ২৩ জন সাধারণ মানুষকে হত্যা করে এ গণকবরে মাটিচাপা দেয়। এটি বনবাড়ি গণকবর- নামে পরিচিত।
মুকসুদপুরে পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর প্রথম যুদ্ধ হয় চাঁদহাটের কুমারদিয়ার বিলে, যা চাঁদহাট যুদ্ধ হিসেবে পরিচিত। ২৯শে মে সংঘটিত এ-যুদ্ধে ২৭ জন পাকসেনা ও রাজাকার নিহত হয় এবং ১ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। ১৮ই জুলাই রাত ১১টার দিকে কমান্ডার আজিজ মোল্লার নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা সিন্দিয়াঘাট নৌফাঁড়ি অপারেশন পরিচালনা করেন। এতে থানার দারোগা নিহত হয় এবং ২ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। ৮ই আগস্ট মুক্তিযোদ্ধাদের কয়েকটি দল সম্মিলিতভাবে মুকসুদপুর থানা অপারেশন করে। এখানে পাকবাহিনীর সঙ্গে দুদিন ব্যাপী যুদ্ধ হয়। এ-যুদ্ধে ৪০-৪৫ জন পাকসেনা, পুলিশ ও রাজাকার নিহত হয়। অন্যদিকে ২ জন মুক্তিযোদ্ধা আহত হন।
২রা অক্টোবর দুপুরে বামনডাঙ্গা বাজারে মুক্তিবাহিনীর কোহিনুর গ্রুপের সঙ্গে পাকবাহিনীর সম্মুখ যুদ্ধ হয়। বামনডাঙ্গা যুদ্ধ-এ ৮-১০ জন পাকসেনা নিহত হয় এবং ২ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। আব্দুল কুদ্দুস মীর নামে একজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ এবং সিরাজুল হক ও আবুল কালাম নামে দুজন মুক্তিযোদ্ধা আহত হন। কমান্ডার কোহিনুরও এ-যুদ্ধে আহত হন। অক্টোবর মাসের প্রথম দিকে নাসির আহমেদ তালুকদারের নেতৃত্বে প্রায় ২০ জন মুক্তিযোদ্ধা রাতে দিগনগর পাকসেনা ক্যাম্প অপারেশন করলে পরদিন সকাল পর্যন্ত সেখানে যুদ্ধ হয়। সকাল হওয়ায় কৌশলগত কারণে মুক্তিযোদ্ধারা সেখান থেকে নৌকাযোগে ফিরে আসার পথে অল্প পানিতে নৌকা আটকে যায়। এ-সময় ১০ জন মুক্তিযোদ্ধা পাকসেনাদের হাতে ধরা পড়েন এবং তাঁদের ৯ জনকে হত্যা করা হয়। নাসির আহমেদ তালুকদারকে জেলে আটক রাখলে তিনি প্রাণে বেঁচে যান।
অক্টোবরের প্রথম দিকে পাকসেনাদের নিরাপত্তা বাহিনীর প্রহরায় একটি বড় বার্জে বিপুল পরিমাণ খাদ্যশস্য নিয়ে টেকেরহাটের দিকে যাচ্ছিল। মুক্তিযোদ্ধারা সংবাদ পেয়ে জলিরপাড়ের নদীর উত্তর পাড় থেকে তাদের ওপর আক্রমণ করলে উভয় পক্ষের মধ্যে তুমুল গুলি বিনিময় হয়। এক পর্যায়ে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা আত্মসমর্পণে বাধ্য হয় এবং বার্জ উত্তর পাড়ে ভিড়িয়ে অস্ত্র সমর্পণ করে। মুক্তিযোদ্ধারা সব মালামাল তাদের দখলে নিয়ে নেন। এটি জলিরপাড় যুদ্ধ হিসেবে পরিচিত।
২৮শে অক্টোবর পাকসেনা ও রাজাকাররা দিগনগর ক্যাম্প থেকে বর্ণি ও মিরেরডাঙ্গিতে লুটপাট করতে এলে ইদ্রিস মোল্লা ও অদুদ আলী মিয়া গ্রুপের মুক্তিবাহিনীযোদ্ধারা পদ্মকান্দায় তাদের আক্রমণ করেন। পদ্মকান্দা যুদ্ধ-এ হানাদাররা পশ্চাদপসরণ করে এবং ২ জন মুক্তিযোদ্ধা আহত হন।
১৫ই নভেম্বর মুক্তিযোদ্ধারা রসদ সংগ্রহের জন্য সরকারি সিন্দিয়াঘাট গোডাউন অভিযান চালিয়ে সেখান থেকে বেশ কয়েক বস্তা চাল নিয়ে আসেন। একই মাসের শেষদিকে তাঁরা অপর একটি অভিযান চালিয়ে ঐ গোডাউন থেকে কয়েক হাজার খালি বস্তা উজানীতে নিয়ে আসেন। মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষ থেকে নিযুক্ত থানা প্রশাসক আব্দুল মান্নান তালুকদার তা বিক্রি করে লদ্ধ অর্থ মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন দলের মধ্যে খরচের জন্য বণ্টন করেন।
৯ই ডিসেম্বর মুকসুদপুরের মুক্তিযোদ্ধারা একত্রিত হয়ে দিগনগর ব্রিজের দুই পাড়ে পাকসেনাদের দুটি ক্যাম্পে চারদিক থেকে আক্রমণ করেন। উভয় পক্ষের মধ্যে ৩ দিনব্যাপী ভয়াবহ যুদ্ধ হয়। দিগনগর ব্রিজ যুদ্ধে পাকসেনারা আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। ভাংগা, নগরকান্দা ও রাজৈর এলাকার মুক্তিযোদ্ধারাও এ-যুদ্ধে অংশ নেন। যুদ্ধে ৩ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। বেশকিছু পাকসেনা নিহত হয় এবং শতাধিক পাকসেনা মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে আত্মসমর্পণ করে। ৯ই ডিসেম্বর থেকে ৩ দিনব্যাপী ভয়াবহ যুদ্ধ শেষে দিগনগর ব্রিজের দুই পাড়ে পাকবাহিনীর শক্ত দুটি ঘাঁটির পতনের মধ্য দিয়ে ১১ই ডিসেম্বর মুকসুদপুর উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়।
এ উপজেলার শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- হায়দার আলী খন্দকার (পিতা আবদুল মান্নান খন্দকার, বাটিকামারী), মোফাজ্জেল মৌল্লা (বাহাড়া), জাফর আলী শিকদার (পিতা এছলাম শিকদার, আলীপুর), আবুল কাশেম মোল্লা (পিতা মো. ফাজিল মোল্লা, লোহাইড়), মোফাজ্জেল খন্দকার (লোহাইড়), মো. বাদশা মিয়া (গোপীনাথপুর), মো. জিন্নাত আলী খান (পিতা সামসুল হক খান, গুণহার), মো. রত্তন খান (পশ্চিম নওখন্ডা), নওসের আলী খান (গুণহার), আক্কাস আলী সরদার (পিতা মো. কালা সরদার, গুনহার; সেনাসদস্য), আসমত আলী শেখ (পিতা আজহার শেখ, কাশালিয়া; সেনাসদস্য), নূরুল হক খান (পিতা ফজলুর রহমান খান, গুনহার; সেনাসদস্য), রজব আলী (পিতা রাঙ্গা মুন্সি, পোড়াউজানি), লিয়াকত আলী দেওয়ান (ভাবড়াশুর), কাজী গিয়াসউদ্দিন (পিতা সাখাওয়াত আলী, পালপাড়া), বাবর আলী (ফকিরহাটখোলা), আজাহার আলী সরদার (পাথরাইল), আবু বক্কার মোল্লা রঙ্গু (শাশুনিয়া), আবুল কালাম আজাদ (ফুলারপাড়), আব্দুল কুদ্দুস মীর (ফুলারপাড়), আব্দুল হালিম মিনা (কাউনিয়া), মাধব চন্দ্ৰ বাড়ৈ (ঝুটিগ্রাম), মো. শাজাহান মিনা (পিতা মো. আলতাফ হোসেন মিনা, পূর্ব নওখন্ডা সেনাসদস্য), জালালুদ্দিন (মুনিরকান্দি), মতিয়ার রহমান শেখ (মুনিরকান্দি), সামছুল হক মল্লিক (উত্তর গঙ্গারামপুর), নুরুল হক মল্লিক (পিতা রজব আলী মল্লিক, উত্তর গঙ্গারামপুর), আবুল কালাম শেখ (পিতা সাদেক আলী, রামচন্দ্রপুর), কাজী আলাউদ্দিন (পিতা গগন কাজী, খাঞ্জাপুর), ল্যান্স নায়েক আবদুল কুদ্দুস (পিতা সৈয়দ জোনাব আলী, বলনারায়ণপুর; সেনাসদস্য), মো. আবুল বাসার খান (পিতা আবদুল হালিম খান, ছাগলছিড়া), হায়দার আলী মাতুব্বর (পিতা হামেদ মাতুব্বর, দক্ষিণ গঙ্গারামপুর), হারুনুর রশীদ ফরিদ (পূর্ব নওখন্ডা), মোসলেম শেখ (খানপুরা), শহীদুর রহমান (রওহাটা), আব্দুল ওয়াজেদ মোল্লা (লোহাইড়), মোশাররফ হোসেন সরদার (মুকসুদপুর), তাসলেম সিকদার (দিগনগর), প্রমথ বাগচী (ভেন্নবাড়ি) ও খোকা ফকির (ডুমুরিয়া)।
সাবেক সংসদ সদস্য অবসরপ্রাপ্ত লে. কর্নেল মো. ফারুক খানের উদ্যোগে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে দিগনগর ব্রিজের পূর্ব পাড়ে একটি স্মৃতিস্তম্ভ এবং সিন্দিয়াঘাটে নদীর পাড়ে ওয়াপদা অফিসের পাশে স্থানীয় শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে শহীদ স্মৃতিক্লাব ও শহীদদের নামসংবলিত একটি শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ নির্মিত হয়েছে, যা সিন্দিয়াঘাট শহীদ স্মৃতিক্লাব ও স্মৃতিস্তম্ভ নামে পরিচিত। বাটিকামারীতে মুকসুদপুর-বরইতলা সড়কে খোকা তালুকদার এবং আব্দুল মতিন মাওলানার বাড়ির মধ্য দিয়ে চাওচা প্রাথমিক বিদ্যালয় পর্যন্ত সড়কটির নামকরণ করা হয়েছে শহীদ মুক্তিযোদ্ধা হায়দার আলী খান্দকার সড়ক। মুকুসদপুর-বরইতলা সড়কে বাটিকামারী ব্রিজের পশ্চিম পাড় থেকে লোহাইড় মাদ্রাসা হয়ে ঈদগাহর পাশ দিয়ে বনগ্রাম-মাইটা ব্রিজ পর্যন্ত রাস্তার নামকরণ করা হয়েছে শহীদ মুক্তিযোদ্ধা আবুল কাশেম মোল্লা সড়ক এবং বাটিকামারী-কহলদিয়া সড়কের শিবগঞ্জ থেকে রথখোলা বড়মাঠ পর্যন্ত রাস্তাটির নামকরণ করা হয়েছে মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলাম সড়ক। স্থানীয় শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতি রক্ষার্থে গোহালা বাজার স্মৃতিস্তম্ভ- নির্মাণ করা হয়েছে। এছাড়া গুণহার গ্রামে শহীদ মুক্তিযোদ্ধা মো. জিন্নাত আলী খানের নাম অনুসারে শহীদ জিন্নাহ ক্লাব স্থাপিত হয়েছে। [মো. ফিরোজ খান]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৮ম খণ্ড