You dont have javascript enabled! Please enable it!

মুকসুদপুর সিভিল প্রশাসন (মুকসুদপুর, গোপালগঞ্জ)

মুকসুদপুর সিভিল প্রশাসন (মুকসুদপুর, গোপালগঞ্জ) মুক্তিযুদ্ধকালীন একটি স্থানীয় প্রশাসন। ৯ই আগস্ট মুকসুদপুর থানা দখলের যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের বিজয়ের পর পাকসরকারের সকল প্রশাসনিক কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। মুকসুদপুর থানার পূর্বপাশে দিগনগর ইউনিয়নের ওপর দিয়ে চলে যাওয়া ফরিদপুর-বারিশাল সড়কে দিগনগর ব্রিজের দুই পাড়ে পাকসেনা ও রাজাকারদের দুটি ক্যাম্প বাদে সকল এলাকা মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে চলে আসে। তবে সিন্দিয়াঘাট নৌ-ফাঁড়িটি পাকসেনাদের নিয়ন্ত্রণে থাকে। এর পরপরই -মুজিব বাহিনীর থানা কমান্ডার আবুল হাসান খান মুজিব বাহিনীর প্রথম দলটি নিয়ে এলাকায় এসে সিভিল প্রশাসন গঠন করার নির্দেশ দেন। সে মোতাবেক অত্র থানার সকল গ্রুফ কমান্ডার ও মুজিব বাহিনীর নেতৃবৃন্দ আলোচনা করে ইঞ্জিনিয়ার আব্দুল মান্নান তালুকদার (পারইহাটি, বর্তমান উজানী)-কে প্রধান করে মুকসুদপুর থানা সিভিল প্রশাসন গঠিত হয়। মান্নান তালুকদার ফরিদপুর পলিটেকনিক্যাল ইন্সিটিটিউটের প্রধান ছিলেন। তাঁর নিজস্ব অস্ত্র ছিল এবং অস্ত্রচালনার প্রশিক্ষণও ছিল। এছাড়া এলাকায় একটি সশস্ত্র গ্রুপ তাঁকে নিরাপত্তা দিত। এই প্রশাসনের সদর দপ্তর ছিল বাঁশবাড়িয়া ইউনিয়ন পরিষদে। এখান থেকে তিনি তাঁর কার্যক্রম পরিচালনা করতেন।
মুক্তিযোদ্ধাদের যাতায়াত ও খাওয়া-দাওয়াসহ যাবতীয় খরচ নির্বাহের জন্য অর্থের প্রয়োজন ছিল। প্রথমে প্রতিটি গ্রুপের কমান্ডাররা বিত্তবানদের নিকট থেকে অর্থ সংগ্রহ করে প্রয়োজন মেটাতেন। সিভিল প্রশাসন গঠিত হওয়ার পর এই থানা প্রশাসন প্রতি ইউনিয়নে একটি করে সিভিল এডমিনিস্ট্রেশন কমিটি গঠন করে। প্রতিটি কমিটি স্থানীয় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা করত এবং সরকারের সম্পত্তি বিলি- বণ্টনসহ বিত্তবানদের কাছ থেকে চাঁদা তুলে থানা প্রশাসনের নিকট জমা দিত। থানা প্রশাসন সেই তহবিল থেকে প্রতিটি মুক্তিযোদ্ধা গ্রুপকে সদস্য সংখ্যার ভিত্তিতে মাসোহারা প্রদান করত। সিভিল প্রশাসনের আরো একটি বড় কাজ ছিল কোনো মুক্তিযোদ্ধা গ্রুপের সঙ্গে অন্য কোনো গ্রুপের বিবাদ বা দ্বন্দ্ব বাঁধলে আলোচনার মাধ্যমে তার সমাধান করা। থানা প্রশাসনের আইন বিষয়ক উপদেষ্টা ছিলেন আ. রশিদ খান ঠাকুর। তিনি গোপালগঞ্জ কোর্টের মোক্তার ছিলেন, পরে এডভোকেট হন। এই সিভিল প্রশাসনের নিকট মুক্তিযুদ্ধে বিরোধিতাকারীদের সম্পর্কে অভিযোগ দেয়া হতো এবং কোনো মুক্তিযোদ্ধা বা মুক্তিযোদ্ধা গ্রুপ কোনো অন্যায় করলে সে অভিযোগও দেয়া হতো। সিভিল প্রশাসন সেসব বিষয়ে ব্যবস্থা নিত। একবার বানিয়াচরের ক্যাথলিক মিশনের ফাদার মারিনো রিগন (যিনি মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসাসহ বহুবিধ সাহায্য-সহযোগিতা করেছেন) আবদুল মান্নান তালুকদারকে জানান যে, বাটিকামারীর মাওলানা আ. মতিন ফরিদপুর জেলা পাকবাহিনীর কর্মকর্তাদের কাছে গিয়ে মুকসুদপুর থানার মুক্তিযোদ্ধদের খবর জানিয়ে দেয়। এ খবর জানার পর মান্নান তালুকদার মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে মাওলানা আ. মতিনকে আটক করেন।
মুকসুদপুর থানায় তখন ১৫টি ইউনিয়ন ছিল এবং প্রতিটি ইউনিয়নেই সিভিল প্রশাসন ছিল। সেগুলো হলো- টেংরাখোলা ইউনিয়ন: প্রধান ছিলেন আতিকুর রহমান মিয়া; সদস্য ছিলেন আ. জব্বার মোল্লা, মুন্সি আতিয়ার রহমান, রওশন আলি মিয়া এবং মোহাম্মদ আলি (বর্তমান পসারগাতি ইউনিয়ন তখন টেংরাখোলা ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্ত ছিল); গোবিন্দপুর ইউনিয়ন: প্রধান ছিলেন আতিয়ার রসুল মুন্সি (গোবিন্দপুর); সদস্য ছিলেন টুলু মিয়া (নগরসুন্দরদী), সাম মোল্লা (গোবিন্দপুর), আবদুল রব মুন্সি (গোবিন্দপুর); খান্দার পাড়া ইউনিয়ন: সদস্য ছিলেন ইদ্রিস আলী মিয়া (কেন্দুয়া), কাজী শিরাজুল হক (কেন্দুয়া), আ. হালিম খন্দকার (মাছিয়াড়া), মোসারেফ হোসেন (বেজড়া), কাজী আবদুল কালাম (কেন্দুয়া), শেখ শহিদুল ইসলাম (কেন্দুয়া); বহুগ্রাম ইউনিয়ন: প্রধান ছিলেন আক্রামুজামান ওরফে উকিল মিয়া (গাড়লগাতী), তাঁর সঙ্গে সদস্য ছিলেন কয়েকজন; উজানী ইউনিয়ন: প্রধান ছিলেন অনীল চন্দ্র রায় (উজানী); সদস্য ছিলেন মুকুন্দ লাল সরকার (উজানী, আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতা); বাঁশবাড়িয়া ইউনিয়ন: প্রধান ছিলেন আবুল খায়ের তালুকদার (বাঁশবাড়িয়া); সদস্য ছিলেন আওলাদ মিয়া (ঝুটিগ্রাম), আসমত মোল্লা (কৃষ্ণপুর), খবির উদ্দিন মোল্লা (কৃষ্ণপুর), ওলিউল হক ওরফে হিরু মিয়া (ঝুটিগ্রাম), আবুল কালাম আজাদ (বাঁশবাড়িয়া); ননীক্ষির ইউনিয়ন: প্রধান ছিলেন আবুল হোসেন ওরফে টুকু মিয়া (ননীক্ষির); সদস্য ছিলেন খোকা মিয়া ওরফে কেরানী সাব (ননীক্ষির), সোনা মিয়া; জলির পাড় ইউনিয়ন: প্রধান ছিলেন মুকুন্দ বালা; সদস্য ছিলেন খগেন্দ্রনাথ, জগদীশ বিশ্বাস; গোহালা ইউনিয়ন: প্রধান ছিলেন সেকেন্দার হায়াত (বামনডাঙ্গা); সদস্য ছিলেন সামছুদ্দিন আহমেদ (প্রসন্নপুর); রাঘদি ইউনিয়ন: প্রধান ছিলেন গোলাম সরোয়ার মিয়া (দাসেরকান্দী); সদস্য ছিলেন রুস্তম আলী ফকির (বটদিয়া), আ. মজিদ (ছাগলছিড়া); দিগনগর ইউনিয়ন: প্রধান ছিলেন রোকনউদ্দিন মোল্লা চেয়ারম্যান; সদস্য ছিলেন সম্রাট মোড়ল (সোর্সি), রহমান (বিশ্বমবর্দী), মৌলভী হাবিবুর রহমান (বর্নি); বাটিকামারী ইউনিয়ন: প্রধান ছিলেন আ. মোতালেব মৃধা ওরফে জোনারংক; সদস্য ছিলেন মতিয়ার রহমান ফকির (বাটিকামারী), জীবন তপাদার, জহরলাল বসু, আ. রশিদ মিয়া, লাল মিয়া (চাওচা); মহারাজপুর ইউনিয়ন: প্রধান ছিলেন আশ্রাব আলী মিয়া (বনগ্রাম); সদস্য ছিলেন নূরুল ইসলাম (রামকৃষ্ণপুর), আ. আউয়াল মুন্সি (নারায়ণপুর, ফতে আলী মিয়া ওরফে ক্যাপ্টেন সাব (বনগ্রাম); মোচনা ইউনিয়ন: প্রধান ছিলেন জুলফিকার আলী মুন্সি (নওহাটা); সদস্য ছিলেন কয়েকজন এবং কাশালিয়া ইউনিয়ন: প্রধান ছিলেন মাজেদুর রহমান (কাশিলিয়া); সদস্য ছিলেন মোহাম্মদ আলী শেখ (গুনহর), আ. হক শেখ (গুনহর)। [মো. ফিরোজ খান]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৮ম খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!