You dont have javascript enabled! Please enable it!

মুক্তিযুদ্ধে মুক্তাগাছা উপজেলা (ময়মনসিংহ)

মুক্তাগাছা উপজেলা (ময়মনসিংহ) মুক্তিযুদ্ধের সময় ছিল ১১ নম্বর সেক্টরের অধীন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, সৈয়দ নজরুল ইসলাম সহ জাতীয় নেতারা মুক্তিযুদ্ধের আগে এখানে একাধিক রাজনৈতিক জনসভা করেন। ১৯৭০-এর নির্বাচনে সকল প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর জামানত বাজেয়াপ্ত করে আওয়ামী লীগ প্রার্থী সৈয়দ আব্দুস সুলতান জাতীয় পরিষদ এবং খোন্দকার আব্দুল মালেক শহিদুল্লাহ প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১লা মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করলে বাঙালিরা বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। অন্যান্য অঞ্চলের মতো মুক্তাগাছার সর্বস্তরের জনগণও রাস্তায় নেমে মিছিল করে খোন্দকার আব্দুল মালেক শহিদুল্লাহ এমপিএ-সহ শীর্ষ স্থানীয় নেতৃবৃন্দ এতে অংশগ্রহণ করেন। এদিন বিকেলে শহরের দরিচারআনি বাজার মাঠে এক জনসভা হয়। থানা ছাত্রলীগ-এর সভাপতি এবং পরবর্তীকালে গঠিত সংগ্রাম পরিষদের অন্যতম নেতা খবির উদ্দিন ভূঁইয়ার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এ সভায় হাজার-হাজার মানুষ উপস্থিত হয়। থানা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ফজলুল হক দুদুর পরিচালনায় সভা চলার এক পর্যায়ে মুক্তাগাছা কলেজ (বর্তমানে সরকারি শহীদ স্মৃতি কলেজ) ছাত্র সংসদের ভিপি বছির উদ্দিন ও জিএস আবুল কাসেম পাকিস্তানের পতাকা তুলে ধরলে সভার প্রধান অতিথি খোন্দকার আব্দুল মালেক শহিদুল্লাহ তাতে আগুন ধরিয়ে দেন। মঞ্চ থেকে বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করা হয়, এ অঞ্চলে আর কখনো পাকিস্তানি পতাকা উড়বে না। ৫ই মার্চ বিভিন্ন অফিসে কালো পতাকার পাশাপাশি মুক্তাগাছার ঘরেঘরে বাংলাদেশের মানচিত্রখচিত লালসবুজ পতাকা ওড়ানো হয়। ৫ ও ৬ই মার্চ সকাল-সন্ধ্যা হরতাল পালিত হয়। ৭ই মার্চ সকাল থেকে হাজার-হাজার নেতা-কর্মী ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর জনসভায় যোগদানের উদ্দেশ্যে দরিচারআনি বাজারের আওয়ামী লীগ অফিসের সামনে জড়ো হয় এবং সেখান থেকে একযোগে এসে জনসভায় যোগ দেয়। ৮ই মার্চ থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি মৌলভী ইয়াকুব আলীকে আহ্বায়ক করে সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। পাশাপাশি একটি ছাত্র সংগ্রাম পরিষদও গঠিত হয়। এই দুই পরিষদের নেতৃত্বে অসহযোগ আন্দোলন-এর পাশাপাশি স্থানীয় প্রশাসনিক কার্যক্রমকে গতিশীল রাখার কাজও চলতে থাকে। খোন্দকার আব্দুল মালেক শহিদুল্লাহ এমপিএ, মৌলভী ইয়াকুব আলী, থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট শামসুল হক (পরে এমপি), আওয়ামী লীগ নেতা শিশির কুমার রক্ষিত, সুভাষ চন্দ্র রক্ষিত, আবু তাহের সরকার (ছানা মিয়া),
হাবিবুর রহমান, শ্রমিকনেতা আব্দুল খালেক মির্জা, হায়াতুল্লাহ ফকির এবং ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের খবির উদ্দিন ভূঁইয়া, বছির উদ্দিন, ফজলুল হক দুদু, আবুল কাসেম, ইদ্রিস আলী আকন্দ, আব্দুল হাই আকন্দ, সত্যস্বপন চক্রবর্তী, আব্দুর রহিম বাদশা প্রমুখ আন্দোলন-সংগ্রামে নেতৃত্ব দেন।
বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ-এর পর মুক্তাগাছার ছাত্র-যুবকরা চূড়ান্ত সংগ্রামের প্রস্তুতি নিতে থাকেন। ১০ই মার্চ থানার সকল সরকারি প্রতিষ্ঠানে বেসরকারি বাংলাদেশের মানচিত্রখচিত পতাকা উত্তোলন করা হয়। ১৯শে মার্চ বিভিন্ন বাড়িতে কালো পতাকা ওড়ানো হয়।
আওয়ামী লীগ অফিসে নিয়ন্ত্রণ কক্ষ খোলা হয় এবং এর অধীনে টেলিফোন, টেলিগ্রাম, পেট্রল, ডিজেল, যানবাহন, বাজার ব্যবস্থাপনাসহ স্থানীয় জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো পরিচালিত হয়। চলমান এ অসহযোগ আন্দোলনের পথ বেয়ে প্রতিরোধ ও পাল্টা আঘাতের প্রস্তুতিও শুরু হয়ে যায়।
২৫শে মার্চ রাতে পাকবাহিনীর অপারেশন সার্চলাইট-এর পর অসংখ্য মানুষ ঢাকা শহর থেকে গ্রামের দিকে আসতে থাকে। তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসে মুক্তাগাছার মানুষ। তাদের জন্য হুলাশ চাঁন আগরওয়ালাকে আহ্বায়ক করে একটি আশ্রয় শিবির খোলা হয়। স্ব-উদ্যোগে গ্রামের মানুষ সাধ্যমতো চাল, ডাল, তেল, নুন, তরকারিসহ নানা রকম খাদ্যদ্রব্য সংগ্রহ করে দরিচারআনি বাজারের সংগ্রহশালায় জমা করতে থাকে। আশ্রয় শিবিরের সমন্বয়কারী প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা মেহের আলী সরকারের সহযোগিতা এবং খাদ্য কমিটির আহ্বায়ক মহিউদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে কর্মীরা তা গ্রহণ করেন।
২৬শে মার্চ ভোরে জেলা আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক সৈয়দ আহমেদ বঙ্গবন্ধু কর্তৃক স্বাধীনতা ঘোষণার টেলিগ্রাম কপি নিয়ে মুক্তাগাছায় খোন্দকার আব্দুল মালেক শহিদুল্লাহর বাড়িতে আসেন এবং স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের নিয়ে এক জরুরি বৈঠক করেন। বৈঠকে থানার ওসি মোশাররফ হোসেনও উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে ঢাকা থেকে ময়মনসিংহের প্রবেশপথ টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহ সড়ক বেরিকেড দিয়ে বন্ধ করে দেয়া, যুবকদের যুদ্ধের প্রশিক্ষণ দেয়া ইত্যাদি বিষয়ে বেশকিছু সিদ্ধান্ত হয়। বেলা ১২টার দিকে সংগ্রামী জনতা দা, কুড়াল ও শাবল নিয়ে বাঁশ কেটে রাস্তায় প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে। টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহ সড়কে প্রথমে ঢলুয়াবিল ও লেংড়ার বাজারের পশ্চিম পাশে এবং পরে আরো অনেক স্থানে বেরিকেড দেয়া হয়। লক্ষ্মীখোলার নায়েব আলী মিস্ত্রির নেতৃত্বে একটি দল ত্রিমোহনী নতুন বাজারের লোহার ব্রিজ ভাঙ্গতে যায়। ফায়ার সার্ভিস অফিস থেকে গাড়ি ও কর্মীদের নিয়ে হোজপাইপের সাহায্যে মনতলা ব্রিজের দুই পাশের মাটি ১০ ফুট করে সরিয়ে দিয়ে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়। ২৭শে মার্চ রাত ২টার দিকে নেতৃবৃন্দ পুনরায় বৈঠকে বসে অস্ত্রের ব্যবস্থা করার জন্য খোন্দকার আব্দুল মালেক শহিদুল্লাহ এমপিএ-কে দায়িত্ব দেন। আনসার ও প্রাক্তন সৈনিকদের সঙ্গে যোগাযোগ করে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে একটি সুসংগঠিত মুক্তিবাহিনী গড়ে তোলার লক্ষ্যে সংগ্রাম কমিটি ও স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর ওপর দায়িত্ব দেয়া হয়।
২৭শে মার্চ ওসি মোশাররফ হোসেন স্থানীয় নেতাদের জানান যে, রসুলপুরে পাকিস্তান বিমান বাহিনীর প্রশিক্ষণ ক্যাম্প স্থানীয় জনতা ঘেরাও করে রেখেছে। এ ক্যাম্পের প্রতি তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখতে গাবতলী এলাকার নেতাকর্মীদের পূর্বেই নির্দেশ দেয়া ছিল। ইদ্রিস আলী সরকার নামে সেখানকার এক যুবক ক্যাম্প এলাকা ঘুরে দেখে এসেছিলেন। এ ব্যাপারে তাঁকে সার্বিক সহযোগিতা করেন ফরেস্ট সেক্টরের এসিএফ গোলাম কুদ্দুস এবং আব্দুল হক ড্রাইভার। পাকিস্তানি সৈন্যরা পালিয়ে গেছে ভেবে ইদ্রিস আলী সরকার কুড়াল দিয়ে ক্যাম্পের ফটক ভেঙ্গে ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করেন। এমন সময় ভেতর থেকে গুলি ছোড়া হয়। প্রথমে কিছুটা বিচলিত হলেও কিছুক্ষণের মধ্যে চতুর্দিক থেকে জনতা দা, লাঠি, বল্লম, কুড়াল ইত্যাদি দেশীয় অস্ত্র নিয়ে ক্যাম্প ঘেরাও করে। পেছনের দরজা দিয়ে দুজন বিমানসেনা শালগড়ের দিকে পালিয়ে যাচ্ছিল। এ-সময় ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়ে সকলে ক্যাম্পের ভেতরে ঢুকে পড়ে। ক্যাম্পে কোনো অস্ত্র পাওয়া না গেলেও ওয়ারলেস সেটের যন্ত্রাংশ, অচল একটি জিপগাড়ি এবং কিছু কাগজপত্র তাদের হস্তগত হয়। বন বিভাগের এসিএফ গোলাম কুদ্দুস তাঁর অফিস থেকে ৭টি রাইফেল স্থানীয় নেতা-কর্মীদের দিয়ে দেন। এর ৬-৭ দিন পরে বিমান বাহিনীর পলাতক সৈনিক মো. লিয়াকত পাঠান ও অপর একজনকে বনের ভেতর থেকে ধরে এনে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা ময়মনসিংহ জেলে পাঠিয়ে দেন। মুক্তাগাছায় মাইকিং করে ময়মনসিংহ ইপিআর ক্যাম্পে অবস্থানরত বাঙালি সৈনিকদের জন্য খাবার সংগ্রহ করে আওয়ামী লীগ কর্মীদের মাধ্যমে পাঠানো হয়।
রফিক উদ্দিন ভূঁইয়াসহ ময়মনসিংহের নেতাদের সহযোগিতায় খোন্দকার আব্দুল মালেক শহিদুল্লাহ পুলিশ লাইন থেকে গুলিসহ ৫০টি ৩০৩ রাইফেল নিয়ে মুক্তাগাছায় ফেরেন। অত্যন্ত গোপনীয়তার সঙ্গে ৫০ জন উদ্যমী তরুণের অংশগ্রহণে খন্দকার বাড়িতে অস্থায়ী মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণ ক্যাম্প চালু করা হয়। প্রথমদিকে ইপিআর সদস্য আবু রুস রজ প্রশিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন। ৩১শে মার্চ প্রশিক্ষণ ক্যাম্পটি মুক্তাগাছা কলেজে স্থানান্তরিত করা হয় এবং অবসরপ্রাপ্ত হাবিলদার রফিজ উদ্দিন রেফাজ ও সুবেদার আব্দুল হামিদের নেতৃত্বে প্রশিক্ষণ চলতে থাকে। ২রা এপ্রিল মুক্তাগাছার আকাশে পাকিস্তানি বিমানকে চক্কর দিতে দেখা যায়। এদিন সন্ধ্যায় শম্ভুগঞ্জ ফেরিঘাটে প্রচণ্ড গুলি বর্ষণ করা হলে মধুপুর শালগড়ের টেলকি মিশনারিতে মুক্তিবাহিনীর গোপন আস্তানা গড়ে তোলা হয়। এখানকার ফাদার হোমরিক মুক্তিযোদ্ধাদের পাশাপাশি নির্যাতিত মানুষের জন্য অনেকটা ত্রাতার ভূমিকা পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়ার জন্য মুক্তাগাছার নানা পেশার নানা বয়সের মানুষ যোগ দেয়।
মুক্তাগাছায় মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সংগঠক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন ময়মনসিংহ জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খোন্দকার আব্দুল মালেক শহিদুল্লাহ এমপিএ। এছাড়া তৎকালীন থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি মৌলভী ইয়াকুব আলী, সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট শামসুল হক, আওয়ামী লীগ নেতা আবু তাহের সরকার (ছানা মিয়া), শিশির কুমার রক্ষিত (ডালু ইয়ুথ ক্যাম্পের ডেপুটি ইনচার্জ), ছাত্রনেতা ফজলুল হক দুদু, ইদ্রিস আলী আকন্দ, খবির উদ্দিন ভূঁইয়া, বছির উদ্দিন (মুক্তাগাছা কলেজের প্রথম ভিপি), আবুল কাসেম (মুক্তাগাছা কলেজের প্রথম জিএস), আব্দুর রহিম বাদশা, হাবিবুর রহমান, সত্যস্বপন চক্রবর্তী, শ্রমিকনেতা হায়াত উল্লাহ ফকির, আব্দুল খালেক মির্জা প্রমুখও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন। আর কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন হাবিলদার রফিজ উদ্দিন রেফাজ, সুবেদার আব্দুল হামিদ, ল্যান্স নায়েক আব্দুল খালেক (মেজর খালেক), ইব্রাহিম হোসেন, জবেদ, রাজ্জাক, মোজাফ্ফর এবং লাল্টু।
২৫শে মার্চ ঢাকায় গণহত্যার পর থেকে মুক্তাগাছায় পাকবাহিনীর অনুপ্রবেশ প্রতিহত করার প্রস্তুতি চলতে থাকে। এপ্রিল মাসের প্রথম দিকে ছাত্রনেতা বছির উদ্দিন, আবুল কাসেম, খবির উদ্দিন ভূঁইয়া, ইদ্রিস আলী আকন্দ ও হাবিবুর রহমানসহ রাজনৈতিক নেতা-কর্মীরা স্থানীয় যুবক ও অবসরে থাকা সৈনিকদের সমন্বয়ে গঠিত একটি দল নিয়ে টাঙ্গাইল- ময়মনসিংহ সড়কের মধুপুর বন এলাকায় অবস্থান নেন। তাঁরা সেখানে পাকবাহিনীর অনুপ্রবেশ ঠেকাতে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন।
প্রতিরোধের কারণে পাকবাহিনী এদিক দিয়ে প্রবেশ করতে না পেরে টাঙ্গাইল থেকে মধুপুর বনের ভেতর দিয়ে দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে ২৩শে এপ্রিল মুক্তাগাছায় প্রবেশ করে। স্বতঃস্ফূর্ত জনতার সকল প্রতিরোধ ভেঙ্গে দেশীয় দালালদের সহায়তায় তারা মুক্তাগাছা দখল করে নেয়। সুসজ্জিত কনভয় নিয়ে ভাবকির মোড় থেকে ব্রাশ ফায়ার, মর্টাল শেল নিক্ষেপ এবং অনবরত গুলি বর্ষণ করতে-করতে তারা শহরে ঢোকে। শহরে ঢুকেই তারা বিভিন্ন দোকানে ভাঙচুর ও লুটপাট চালায়। রাস্তার পাশের বিভিন্ন বাড়িতে আগুন দেয়। এদিন তাদের গুলিতে শহরের বেশ কয়েকজন নিরীহ মানুষ শহীদ হন। কিছু সময় অবস্থান করার পর পাকবাহিনী ময়মনসিংহে চলে যায়।
মুক্তাগাছা শহরের মহারাজা রোডে পরিত্যক্ত একটি দোতলা বাড়ি (বর্তমানে মহিলা সমিতির কার্যালয়) দখল করে রাজাকাররা সেখানে ক্যাম্প স্থাপন করে। বটতলা ও ফকিরগঞ্জ বাজারেও তাদের ক্যাম্প ছিল। বড় মসজিদের কাছে অবস্থিত তন্তু শ্রমিক ইউনিয়ন (বর্তমানে বিলুপ্ত) দখল করে সেখানে আলবদর বাহিনী ক্যাম্প স্থাপন করে। মুক্তাগাছা থানাকে পাকসেনাদের অস্থায়ী ক্যাম্প হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
২৩শে এপ্রিল পাকবাহিনী মুক্তাগাছায় প্রবেশের পর মুসলিম লীগ নেতা কেরামত আলী তালুকদার, পৌরসভার চেয়ারম্যান আব্বাস আলী, এ এইচ এম ইজাহারুল হক, কাজী মনিরুজ্জামান মৌলভীসহ মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্র সংঘ-এর তত্ত্বাবধানে মুক্তাগাছায় শান্তি কমিটি, রাজাকার ও -আলবদর বাহিনী গঠিত হয়।
মুক্তাগাছায় মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ব্যক্তিদের মধ্যে কেরামত আলী তালুকদার (সভাপতি, মুক্তাগাছা থানা শান্তি কমিটি; চেয়ারম্যান, ৯ নং কাশিমপুর ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা চেয়ারম্যান, পরে এমপি ও বিএনপি নেতা), এ এইচ এম ইজাহারুল হক (জেনারেল সেক্রেটারি, থানা শান্তি কমিটি; প্রধান শিক্ষক, আর কে হাইস্কুল; স্বাধীনতার পর যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে জেলে গেলেও পরে মুক্তি পায়, আব্বাস আলী (থানা শান্তি কমিটির সদস্য ও পৌর শান্তি কমিটির সভাপতি; স্বাধীনতার পর যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে কারাবরণ এবং সেখানেই মৃত্যু), আ. রেজ্জাক (সদস্য, শান্তি কমিটি ও চেয়ারম্যান, ১ নং দুল্লা ইউনিয়ন), খন্দকার আ. হালিম ওরফে ডালিম মৌলভী (সদস্য, শান্তি কমিটি; চেয়ারম্যান, ২নং বড়গ্রাম ইউনিয়ন পরিষদ), নুরুল ইসলাম ওরফে তোতা মৌলভী (সদস্য, শান্তি কমিটি; চেয়ারম্যান, ৩ নং তারাটী ইউপি), সুরত জামান (সদস্য, শান্তি কমিটি; চেয়ারম্যান, ৪ নং কুমারগাতা ইউপি), আ. হামিদ (সদস্য, শান্তি কমিটি; চেয়ারম্যান, ৫নং বাঁশাটি ইউপি), আ. হামিদ (সদস্য, শান্তি কমিটি; চেয়ারম্যান, ৬ নং মানকোন ইউপি), আ. রাজ্জাক (সদস্য, শান্তি কমিটি; চেয়ারম্যান, ৭ নং ঘোগা ইউপি), ফয়জুর রহমান (সদস্য, শান্তি কমিটি; চেয়ারম্যান ৮ নং দাওগাঁও ইউপি), আ. মান্নান তালুকদার (সদস্য, শান্তি কমিটি; মেম্বার, ৯ নং কাশিমপুর ইউপি), শেখ আব্দুল হাকিম (শান্তি কমিটির সদস্য ও রাজাকার সংগঠক; মুক্তাগাছার জমিদার বকুল আচার্য চৌধুরীসহ বেশ কয়েকটি হত্যাকাণ্ডে নেতৃত্ব দেয়ার অভিযোগে অভিযুক্ত), আনছার আলী মাস্টার (নন্দীবাড়ি; শান্তি কমিটির সদস্য) প্রমুখ উল্লেখযোগ্য।
থানার রাজাকারদের মধ্যে কমান্ডার চানু (পিতা কাজী মনিরুজ্জামান মৌলভী, ঈশ্বর গ্রাম), দানেশ আলী (শ্রীপুর), জবেদ আলী তালুকদার (সোনারগাঁও), আলতাব আলী, জবেদ মুন্সী (বিনোদবাড়ি-মানকোন; বড়গ্রাম গণহত্যায় সরাসরি জড়িত), আব্দুস সালাম (পিতা জবেদ মুন্সী, বিনোদবাড়ি-মানকোন; সে বড়গ্রাম গণহত্যা ও অগ্নিসংযোগে সরাসরি অংশ নেয়, স্বাধীনতার পরে জনতা তাকে আটক করে গণধোলাই দিয়ে মৃত ভেবে মধুপুর জলই ব্রিজের কাছে ফেলে রাখে, কিন্তু সে বেঁচে যায় এবং ১৯৭৫-এর ১৫ই আগস্টের পর এলাকায় ফিরে আসে), আব্দুল মান্নান তালুকদার (কাশিমপুর) প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। আলবদরদের মধ্যে থানা কমান্ডার সুরুজ (পিতা কাজী মনিরুজ্জামান মৌলভী, ঈশ্বর গ্রাম), জুলু, দুলাল, (পাড়াটুঙ্গী, সাবেক পৌর চেয়ারম্যান), ডা. শামসুল ইসলাম ওরফে আক্কেল ডাক্তার (গোয়ারী) প্রমুখ কুখ্যাত ছিল।
২৩শে এপ্রিল পাকবাহিনী মুক্তাগাছা দখল করার পর তাদের হাতে লক্ষ্মীখোলার মনিরুদ্দিন, টানবাজারের অমিয়বালা সাহা, সুরেন্দ্র চন্দ্রসহ অনেকে শহীদ হন। ২৫শে এপ্রিল দালালদের সহযোগিতায় পাকসেনারা আওয়ামী লীগ নেতা শিশির কুমার রক্ষিতের বাড়িতে হামলা চালায়। কিন্তু তাঁকে না পেয়ে তারা ঐ বাড়ি থেকে ৭ জনকে ধরে নিয়ে যায়।
ধৃতদের মধ্যে পরেশ দাস, ব্রজেন দাস, হরিদাস বৈরাগী ও বসুয়াকে গুলি করে হত্যা করে। সুবোধ রক্ষিতকে ধনবাড়ি সেনাক্যাম্পে নিয়ে গিয়ে ২-৩ দিন নির্মম নির্যাতনের পর হত্যা করে। ২৮শে এপ্রিল গভীর রাতে স্থানীয় সহযোগীদের নিয়ে পাকবাহিনীর একটি দল মুজাটি গ্রামের শ্রীশ চন্দ্র দে-র বাড়িতে হামলা চালায় এবং তাঁকে ও তাঁর পুত্র রবি চন্দ্র দে- কে গুলি করে হত্যা করে। তাদের গুলিতে শ্রীশ চন্দ্র দে-র .স্ত্রী, কন্যা ও ভাইসহ আরো কয়েকজন আহত হন। ১৩ই মে পাকবাহিনী বেশ কয়েকটি এলাকায় হামলা চালায়। এদিন শহর থেকে তারা মিজুরিয়া হরিজনকে তুলে নিয়ে যায়। বিকেলে পাথালিয়া গ্রামের ব্রজগোপাল দত্তের বাড়িতে হামলা চালিয়ে মুক্তাগাছা পৌরসভার সচিব ত্রৈলোক্য বাবু ও তাঁর দেহরক্ষীকে আটক করে। এদিন পাকবাহিনী গাবতলীর ব্যবসায়ী নকুল চন্দ্র দে-কে তাঁর বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে যায় এবং পরে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে গিয়ে হত্যা করে। ২৩শে মে স্থানীয় দালালদের সহযোগিতায় পাকবাহিনী মুক্তাগাছা শহরের পার্শ্ববর্তী শ্রীপুর, মাইজহাটি ও মুজাটি গ্রামে আক্রমণ চালায়। সেখানে দাসবাড়িতে ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ধরে আনা পাঁচজনকে হাত-পা বেঁধে একটি ঘরে ঢুকিয়ে আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে মারে। জুলাই মাসে হানাদার বাহিনী মুজাটি গ্রামের ভাটবাড়িতে হামলা চালায় এবং মোটর মেকানিক দীনেশ ভাট ও যতীন ভাটকে প্রথমে গুলি করে ও পরে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করে। জুলাই মাসের মাঝামাঝি সময়ে পাকসেনারা কালাঘোগার কুমুদ বাবু ও দামু বাবুকে গুলি ও বেয়নেট চার্জ করে হত্যা করে।
মুক্তাগাছা উপজেলায় পাকবাহিনী ও তাদের দোসরররা ৫টি বড় গণহত্যা চালায়। সেগুলো হলো- বাজেমানকোন গণহত্যা, দড়িকৃষ্ণপুর গণহত্যা, কাতলসার উত্তরপাড়া গণহত্যা,
কেজাইকান্দা গণহত্যা – এবং শশা গ্রাম গণহত্যা। ২রা আগস্ট বাজেমানকোন গ্রামে অনেক লোককে হত্যা করা হয়। দড়িকৃষ্ণপুরে পাকবাহিনী স্থানীয় দোসরদের সহায়তায় ২৮ জনকে হত্যা করে। কাতলসার উত্তরপাড়ায় ঘাতকরা ১৪ জনকে হত্যা করে। জামালপুরের কামাল খান মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষকরা পাকবাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে কেজাইকান্দা গ্রামের ৯ জন কৃষককে হত্যা করে। অক্টোবর মাসের ১২ তারিখ হানাদাররা শশা গ্রামে অনেককে হত্যা করে। এছাড়া মুক্তিযোদ্ধাদের নানাভাবে সহযোগিতা করার অভিযোগে পাকবাহিনী দাওগাঁও ইউনিয়নের মহেশপুর গ্রামের বৃদ্ধ হাজী কাসেম আলীকে নির্মম নির্যাতন শেষে মাথা মাটিতে ঠেকিয়ে পায়ুপথে গুলি করে হত্যা করে। সেখানে তারা আরো পাঁচজনকে হত্যা করে এবং এলাকার অনেক বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়। এভাবে দখলদার পাকবাহিনী ও তাদের দোসররা নয় মাসে মুক্তাগাছায় সহস্রাধিক মানুষকে হত্যা করে এবং অসংখ্য ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট চালায়।
মহারাজা রোডের দ্বিতল বাড়ির রাজাকার ক্যাম্প, তন্তু শ্রমিক ইউনিয়ন অফিসে স্থাপিত আলবদর ক্যাম্প ও মুক্তাগাছা থানায় স্থাপিত পাকবাহিনীর ক্যাম্প নির্যাতনকেন্দ্র ও বন্দিশিবির হিসেবে ব্যবহার করা হতো। বিভিন্ন এলাকার আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মী, মুক্তিযোদ্ধা এবং সাধারণ লোকজনদের ধরে এনে এসব ক্যাম্পে নির্যাতন চালানো হতো। এছাড়া পৌর ভবনের পূর্বপাশে বর্তমান পৌর সাধারণ পাঠাগার ও থানার পেছনের সান্যাল বাড়িতে বিভিন্ন বয়সের নারী-পুরুষদের আটকে রেখে নির্যাতন করা হতো। বটতলা ও ফকিরগঞ্জ বাজারের রাজাকার ক্যাম্পেও নির্যাতন চালানো হতো।
২৩শে মে রাতে পাকবাহিনী ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা থেকে পাঁচজন যুবককে ধরে এনে মুজাটির দাস বাড়িতে হাত-পা বেঁধে পুড়িয়ে হত্যা করে এবং একই কবরে তাদের কবর দেয়। এই গণকবর এখনও অবহেলায় পড়ে আছে। পাকহানাদার বাহিনী মুক্তাগাছা-বেগুনবাড়ি রাস্তার পাশে আয়মন নদীর তীরে বিভিন্ন এলাকা থেকে ধরে আনা বহু বাঙালিকে অমানুষিক নির্যাতনের পর হত্যা করে লাশ সেখানে ফেলে রাখত। এ-স্থানটি আয়মন নদী তীর বধ্যভূমি- নামে পরিচিত। পাকবাহিনী বানারপাড় নামক স্থানে বহু মানুষকে হত্যা করে বানার নদীতে ভাসিয়ে দেয়। স্থানটি বানারপাড় বধ্যভূমি নামে পরিচিত। মুক্তাগাছার জমিদার বকুল আচার্য চৌধুরীর বাড়ির পুরাতন ইঁদারাটিও একটি বধ্যভূমি ও গণকবর হিসেবে পরিচিত। মুক্তিযুদ্ধের সময় এখানে অসংখ্য নারী-পুরুষ, ধনী-গরিব সকল শ্রেণির মানুষকে হত্যার পর ঘাতকরা লাশগুলো এই ইঁদারায় ফেলে দেয়। সেসব শহীদের লাশে ভর্তি বিরাট ইঁদারাটি এখন আর নেই। বর্তমানে জায়গাটি সামরিক পুলিশ বাহিনীর সদর দপ্তরের গাড়ি রাখার গ্যারেজ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। উপজেলার শশা গ্রামের এডভোকেট অভিমন্যু দাসের বাড়িতে যাদের হত্যা করা হয়, তাদের লাশগুলো একটি ক্ষেতের কোণোয় মাটিচাপা দেয়া হয়। এছাড়া মানকোন, বাজেমানকোন, দড়িকৃষ্ণপুর, কাতলসার, বুনবাড়ি, ভাইস্যাবিল, কয়াবিল, কেজাইকান্দা, মোগলটুলা, মহেশপুর, বনবাংলা ও মির্জাকান্দা গ্রামে অনেক গণকবর ও বধ্যভূমি অরক্ষিত অবস্থায় পড়ে আছে।
মুক্তাগাছা উপজেলায় রেফাজ কোম্পানি নামে একটি স্থানীয় মুক্তিবাহিনী ছিল। হাবিলদার রফিজ উদ্দিন রেফাজের নেতৃত্বে গঠিত এ বাহিনীতে প্রায় দেড়শ মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। তাঁরা বৃহত্তর ময়মনসিংহের বিভিন্ন অঞ্চলে যুদ্ধ করে বেশ পরিচিত লাভ করেন।
মুক্তিযোদ্ধারা পাকবাহিনী ও তাদের দোসরদের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি অপারেশন পরিচালনা করেন এবং দুটি যুদ্ধে অংশ নেন। সেগুলো হচ্ছে— মুক্তাগাছা থানা অপারেশন, কমলাপুরে পাকবাহিনীর ওপর হামলা, কাকরাইদ ব্রিজ অপারেশন, পাকবাহিনীর গাড়ি ধ্বংস, রাঙ্গামাটিয়ার যুদ্ধ, চেরুমগুলে পাকবাহিনীর টহল গাড়িতে হামলা, ভিটিবাড়ি যুদ্ধ, তেলিগ্রাম বাজারে পাকবাহিনীর গাড়ি দখল এবং লেংড়ার বাজার ও নিমুরিয়া বরিল ব্রিজ ধ্বংস। মুক্তাগাছা থানা অপারেশন পরিচালিত হয় দুবার ৭ই জুলাই ও ২৯শে অক্টোবর। প্রথমবার রেফাজ কোম্পানির টুআইসি ইব্রাহিম হোসেনের নেতৃত্বে পরিচালিত অপারেশনে ১৭ জন মুক্তিযোদ্ধা অংশ নেন। তাঁরা থানা থেকে বেশকিছু অস্ত্র ও গোলাবারুদ এবং একটি টেলিফোন সেট উদ্ধার করেন এবং থানার সকল কাগজপত্র বাইরে বের করে আগুন ধরিয়ে দেন। দ্বিতীয়বারের অপারেশনে অংশ নেন রেফাজ কোম্পানি, জবেদ কোম্পানি ও বিএলএফ লিডার রাজ্জাকের দলসহ অন্য মুক্তিযোদ্ধারা। কিন্তু প্রচণ্ড কুয়াশা ও নিজেদের কিছু ভুলের কারণে মুক্তিযোদ্ধারা চূড়ান্ত লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হন। এদিন শত্রুর ছোড়া গ্রেনেড ও গুলিতে রফিজ উদ্দিন রেফাজ, আব্দুর রশিদ ও ইছব আলী আহত হন। কমলাপুরে পাকবাহিনীর ওপর হামলা পরিচালিত হয় ৯ই জুলাই। এদিন রেফাজ কোম্পানির যোদ্ধারা ফুলবাড়িয়ায় একটি সফল অপারেশন শেষে মধুপুর গড়ের দিকে যাচ্ছিলেন। পথে খবর পান যে, মুক্তাগাছার কমলাপুর গ্রামে শামছু মৌলভীসহ কয়েকজন দালালের সাহায্যে পাকবাহিনী অনেক বাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট করছে। ঘটনাস্থলে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা দেখতে পান খাঁ বাড়িতে দাউ-দাউ করে আগুন জ্বলছে। পার্শ্ববর্তী মাঠে কয়েকজন রাজাকারকে নিয়ে পাকসেনারা বিশ্রাম নিচ্ছে। তখন মুক্তিযোদ্ধারা অতর্কিতে তাদের ওপর আক্রমণ চালান। এতে শত্রুপক্ষের কয়েকজন নিহত হয় এবং মুক্তিযোদ্ধারা ৩টি রাইফেল ও কিছু গোলাবারুদ উদ্ধার করেন।
কাকরাইদ ব্রিজ অপারেশন পরিচালিত হয় যুদ্ধের মাঝামাঝি সময়ে। পাকবাহিনীর অবাধ চলাচলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির লক্ষ্যে টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহ সড়কে মধুপুর থানার অন্তর্গত এ ব্রিজটি ধ্বংস করা জরুরি হয়ে পড়ে। এজন্য রেফাজ কোম্পানি ও মোজাফ্ফর কোম্পানির যোদ্ধারা মুটের হাট থেকে লক্ষ্যস্থলে পৌছান এবং ডিনামাইট দিয়ে ব্রিজটি ধ্বংস করে দেন। এতে পাকবাহিনীর চলাচল চরমভাবে বিঘ্নিত হয়।
জুলাই মাসে রেফাজ কোম্পানির যোদ্ধারা মধুপুর গড়ের জয়নাগাছি গ্রামে এক গারো বাড়িতে অবস্থান করছিলেন। এ-সময় খবর আসে যে, পাকসেনারা তাঁদের আক্রমণ করতে আসছে। এ খবর শুনে মুক্তিযোদ্ধারা সান্তার ব্রিজে একটি মাইন পুঁতে রাখেন। কিন্তু পাকসেনাদের বহন করা গাড়িটি এ-পথে কিছুদূর এসে আবার ঘুরে অন্য পথে ন্যাশনাল পার্কের দিকে যায়। সে-পথে আগে থেকেই মুক্তিযোদ্ধাদের পুঁতে রাখা মাইন বিস্ফোরণে গাড়িটি ধ্বংস হয়ে যায়।
রাঙ্গামাটিয়ার যুদ্ধ সংঘটিত হয় ১২ই আগস্ট। মধুপুর বনসংলগ্ন ফুলবাড়িয়া উপজেলার পশ্চিমে এ স্থানে পাকবাহিনীর একটি ক্যাম্প ছিল। ঘটনার দিন ল্যান্স নায়েক আব্দুল খালেক (মেজর খালেক) ও কাদেরিয়া বাহিনী র এক কোম্পানি কমান্ডার লাল্টুর নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা এ ক্যাম্প আক্রমণ করেন। কিন্তু সেদিনের সে আক্রমণ সফল হয়নি। এরপর মুক্তাগাছার রেফাজ কোম্পানিকে খবর দেয়া হলে তাঁরা পুরো কোম্পানি নিয়ে যুদ্ধে অংশ নেন। এবার মুক্তিযোদ্ধারা বিজয় অর্জন করেন এবং যুদ্ধে একজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ ও কয়েকজন আহত হন।
চেরুমণ্ডলে পাকবাহিনীর টহল গাড়িতে হামলা করা হয় সেপ্টেম্বর মাসে। রেফাজ কোম্পানির যোদ্ধারা ঐ সময় মধুপুর গড়ের একটি গারো বাড়িতে নিরাপদ অবস্থান নিয়ে যুদ্ধের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ ও বিভিন্ন অপারেশন পরিচালনা করছিলেন। ঘটনার দিন টুআইসি ইব্রাহিম হোসেন ময়মনসিংহ-টাঙ্গাইল সড়কে টহলরত পাকবাহিনীর গাড়িতে আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেন। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সহযোদ্ধা শামসুল হক ও আব্দুল কাদেরসহ ৮/৯ জনের একটি দল মুক্তাগাছা শহর থেকে প্রায় চার কিলোমিটার পশ্চিমে চেরুমণ্ডল নামক স্থানে পাকসেনাদের টহল গাড়িতে হামলা করে।
ভিটিবাড়ি যুদ্ধ সংঘটিত হয় ২৬শে অক্টোবর। এদিন কমান্ডার রফিজ উদ্দিন রেফাজের নেতৃত্বাধীন মুক্তিযোদ্ধা এবং অন্য মুক্তিযোদ্ধাদের একটি বৃহৎ দল খেরুয়ানী ইউনিয়নের ভিটিবাড়িসহ তিনটি বাড়িতে আশ্রয় নেন। এ খবর পেয়ে পাকবাহিনী ও রাজাকাররা তাঁদের ওপর আক্রমণ করে। ফলে উভয় পক্ষে তুমুল যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে ১৯ জন রাজাকার নিহত হয় এবং প্রচুর অস্ত্র ও গোলাবারুদ মুক্তিযোদ্ধাদের হস্তগত হয়।
তেলিগ্রাম বাজারে পাকবাহিনীর গাড়ি দখল করা হয় নভেম্বর মাসের প্রথমদিকে। তার আগে ২৭ জন মুক্তিযোদ্ধার একটি দল ভারত থেকে দেশে আসে। ময়মনসিংহের দাপুনিয়া বাজারে পৌঁছলে তাঁদের নিকট খবর আসে যে, দেওখোলা বাজার থেকে কতিপয় রাজাকার ও আলবদর নিয়ে পাকসেনাদের একটি গাড়ি সেদিকে আসছে। এ খবর পেয়ে টুআইসি ইব্রাহিম হোসেনের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা পাকসেনাদের আক্রমণ করার উদ্দেশ্যে সতর্ক অবস্থান নেন। পাকসেনাদের গাড়িটি তেলিগ্রাম বাজারের কাছাকাছি আসামাত্রই মুক্তিযোদ্ধারা একযোগে আক্রমণ করেন। হঠাৎ আক্রমণের মুখে টিকতে না পেরে হানাদাররা গাড়ি ফেলে পালিয়ে যায়। পরে এ গাড়িটি যুদ্ধক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধাদের অনেক কাজে লাগে এবং মুক্তাগাছা হানাদারমুক্ত হওয়ার পর গাড়িটি নিয়ে আনন্দ মিছিল করা হয়।
লেংড়ার বাজার ও নিমুরিয়া বরিল ব্রিজ ধ্বংস করা হয় কমান্ডার রফিজ উদ্দিন রেফাজ ও টুআইসি ইব্রাহিম হোসেনের নেতৃত্বে। টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহ সড়কে অবস্থিত এ-দুটি ব্রিজ ছিল পাকবাহিনীর চলাচলের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাই তাদের চলাচলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির লক্ষ্যে ব্রিজদুটি ধ্বংস করার সিদ্ধান্ত হয়। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ঘটনার দিন রাতে ফুলবাড়িয়ার পীরগঞ্জ এলাকা থেকে ৮০-৯০ জন বাছাই করা মুক্তিযোদ্ধা মণ্ডলসেন গ্রামে এসে দুটি দলে বিভক্ত হয়ে অবস্থান নেন। তারপর সুযোগমতো রফিজ উদ্দিনের নেতৃত্বে একটি দল বরিল ব্রিজ এবং ইব্রাহিম হোসেনের নেতৃত্বে অপর দল লেংড়ার বাজার ব্রিজ ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দেয়। ১০ই ডিসেম্বর মুক্তাগাছা উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়।
উপজেলার খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা হলেন- হায়দার আলী, বীর বিক্রম- (পিতা জাবেদ আলী ফকির, পাড়াটঙ্গী)।
মুক্তাগাছা উপজেলার শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন— নূরুজ্জামান (পিতা মোফাখখারুল ইসলাম, মইশাদিয়া; ২৬শে জুলাই নেত্রকোনার কলমাকান্দার নাজিরপুরে পাকবাহিনীর সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ এবং ভারতীয় সীমান্তে কবরস্থ), আব্দুস ছাত্তার (পিতা আবেদ আলী সরকার, কাতকাই; ১৯শে আগস্ট নালিতাবাড়ি উপজেলার রামচন্দ্রকুড়ায় পাকবাহিনীর এম্বুশে পড়ে শহীদ এবং সেখানকার একটি ফসলের ক্ষেতে কবরস্থ), হাছেন আলী (পিতা মোসলেম উদ্দীন, রায়থোরা), মনির উদ্দিন (পিতা নজর আলী মণ্ডল, ঘাটুরি; নালিতাবাড়ি যুদ্ধে শহীদ), হযরত আলী (পিতা মামুদ আলী, শৈলচাপড়া; ঈশ্বরগঞ্জের উচাখিলায় পাকবাহিনী ও রাজাকারদের সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ এবং সেখানেই কবরস্থ), হাতেম আলী (পিতা জিয়া ফরাজী, মহিষতারা; নালিতাবাড়ি যুদ্ধে শহীদ), কার্তিক চন্দ্র শীল (পিতা শ্রীনাথ চন্দ্র শীল, ২ নং ওয়ার্ড, মুক্তাগাছা পৌরসভা; আগস্ট মাসে নালিতাবাড়ির তন্তর নামক স্থানে যুদ্ধরত অবস্থায় শহীদ), নুরুল ইসলাম (পিতা আব্দুর রহমান আকন্দ, বন্দগোয়ালিয়া; ১৯শে আগস্ট রামচন্দ্রকুড়ায় পাকবাহিনীর এম্বুশে পড়ে শহীদ), মোফাজ্জল হক (পিতা আব্বাস আলী, গাড়াইকুটি; দুই সহযোদ্ধাসহ মুক্তাগাছার নতুন বাজার এলাকায় রাজাকারদের সহায়তায় পাকবাহিনীর হাতে ধরা পড়েন এবং পাকবাহিনী ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পে নিয়ে তাঁকে হত্যা করে লাশ নদীতে ফেলে দেয়), আজগর আলী (পিতা জবেদ আলী, নন্দীবাড়ি, মুক্তাগাছা পৌরসভা; আগস্ট মাসে নালিতাবাড়ির গাছুয়াপাড়া গ্রামে এক দালালের কারণে পাকবাহিনীর হাতে ধৃত হয়ে শহীদ), আব্দুল খালেক মির্জা (পিতা আব্দুল জব্বার মির্জা, নন্দীবাড়ি, মুক্তাগাছা পৌরসভা; ভারতে প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশে ফেরার পথে রামচন্দ্রকুড়ায় পাকবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে শহীদ), বাবর আলী (পিতা ফরমান আলী, নন্দীবাড়ি, মুক্তাগাছা পৌরসভা; নালিতাবাড়ির তন্তর নামক স্থানে পাকবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে শহীদ এবং সেখানেই কবরস্থ), মকবুল হোসেন (পিতা বাহাজ উদ্দিন মণ্ডল, কাটবওলা; সরিষাবাড়ি যুদ্ধে শহীদ), মহর আলী (পিতা আহাদ আলী, কান্দুলিয়া; নভেম্বরে ময়মনসিংহ সদর উপজেলায় পাকবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে শহীদ), শাহ আলম (পিতা মোছলেম উদ্দিন, সিমলা; নভেম্বরে ভালুকায় শহীদ), মেহের আলী (পিতা নায়েব আলী ওরফে নবুশেখ, ঘাটুরী; দালাল কর্তৃক ধৃত হয়ে পাকবাহিনীর ক্যাম্পে নির্মম নির্যাতনের পর শহীদ), দ্বিজেন্দ্র চন্দ্র বিশ্বাস (পিতা যতীন্দ্র চন্দ্র বিশ্বাস, বড়গ্রাম; কলমাকান্দা উপজেলার নাজিরপুরে পাকবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে শহীদ এবং সীমান্তের ১১৭২ নম্বর পিলারের নিকট সমাহিত), ইয়ার মাহমুদ (পিতা শেখ লহর মামুদ, রঘুনাথপুর; ২৬শে জুলাই নাজিরপুর যুদ্ধে শহীদ এবং সেখানেই কবরস্থ), ভবতোষ চন্দ্র দাস (পিতা দেবেন্দ্র চন্দ্র দাস, বড়গ্রাম; ২৬শে জুলাই নাজিরপুর যুদ্ধে শহীদ), আবুল কালাম (পিতা জাহেদ আলী মণ্ডল, তারাটিচরপাড়া; সরিষাবাড়ি যুদ্ধে শহীদ), সিপাহি আবুল হোসেন (পিতা আফছার উদ্দিন, কুমারগাতা), সিপাহি সোহরাব আলী (পিতা আব্দুল সরকার, খুকশিয়া), সিপাহি আব্দুল কাদের (পিতা শফিউল্লাহ, নিমুরিয়া; ইপিআর-এর সদর দপ্তর পিলখানায় শহীদ), হাবিলদার হাতেম আলী (পিতা লহর আলী মণ্ডল, শ্রীপুর মাইজহাটি; রংপুর ইপিআর ক্যাম্পে শহীদ) এবং আবদুল জব্বার তালুকদার (পিতা এশার উদ্দিন)।
মুক্তাগাছা উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতি রক্ষায় বহু পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। মুক্তাগাছার জমিদারদের পরিত্যক্ত বাড়িতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ‘সরকারি শহীদ স্মৃতি কলেজ’। কাতলসার গণহত্যায় শহীদের স্মরণে ‘কাতলসার শহীদ স্মৃতি রেজিস্টার্ড প্রাথমিক বিদ্যালয়’ নামে একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠিত হয়েছে (বর্তমানে এটি কাতলসার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়)। মুক্তাগাছা পৌর পরিষদের মূল ভবনের সামনে ‘রক্তিম স্বাধীনতা’ নামে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মিত হয়েছে। মুক্তাগাছার ২৫ জন শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধার স্মৃতিকে অম্লান করে রাখার লক্ষ্যে পৌরসভার সামনে রক্তিম স্বাধীনতা ভাস্কর্যের পূর্বপাশে পৌর পরিষদের উদ্যোগে একটি নামফলক স্থাপন করা হয়েছে। এতে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের নাম খোদাই করা রয়েছে। মুক্তাগাছা-বেগুনবাড়ি রাস্তার পাশে আয়মন নদীতীর বধ্যভূমিতে প্রথমে একটি অস্থায়ী স্মৃতিস্তম্ভ নির্মিত হয়। পরে ২০১২-১৩ সালে সরকারের উদ্যোগে একটি স্থায়ী স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে, যার নাম ‘ডওয়াখোলা বধ্যভূমি স্মৃতিস্তম্ভ’। কয়াবিলে শহীদদের স্মরণে ২০১০ সালে সরকারি উদ্যোগে একটি দৃষ্টিনন্দন স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে, যার নাম ‘কয়াবিল বধ্যভূমি স্মৃতিস্তম্ভ’। মুক্তিযোদ্ধা আবুল কাসেমের নামে ‘সন্তোষপুর বীর মুক্তিযোদ্ধা আবুল কাসেম প্রাথমিক বিদ্যালয়’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহ সড়কের পাশে ‘মুক্তাগাছা মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিস্তম্ভ’ নির্মিত হয়েছে। কমলাপুর গ্রামে শহীদদের স্মৃতির প্রতি সম্মান প্রদর্শনপূর্বক এলাকাবাসী ‘কমলাপুর শহীদ মুক্তিযোদ্ধা প্রাথমিক বিদ্যালয়’ নামে একটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছে। বড়গ্রাম ইউনিয়নের বিনোদবাড়ি-মানকোন গ্রামের হিন্দুবাড়িতে ‘বিনোদবাড়ি- মানকোন গণহত্যা স্মৃতিস্তম্ভ’ নির্মিত হয়েছে। দড়িকৃষ্ণপুর গণহত্যায় শহীদদের স্মরণে ২০১২ সালে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মিত হয়েছে। [এম ইদ্রিছ আলী]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৮ম খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!