You dont have javascript enabled! Please enable it!

মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশের সাহিত্য

শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি যেমন একটি দেশের মুক্তিসংগ্রামকে ত্বরান্বিত করে, তেমনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্দীপিত হয়ে সে-দেশের শিল্প- সাহিত্যও যুগান্তকারী নতুন সৃষ্টিতে ঋদ্ধ হয়। জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের চেতনায় উদ্দীপিত হয়ে পৃথিবীর দেশে-দেশে গড়ে উঠেছে সমৃদ্ধ শিল্প-সাহিত্য। মুক্তিসংগ্রামের প্রেক্ষাপট নির্মাণেও এদেশের সাহিত্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। আবার যুদ্ধোত্তরকালে জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের চেতনাকে মর্মমূলে লালন করে এদেশের সাহিত্য-অঙ্গনও হয়েছে নতুন ভাবনা ও মূল্যবোধে সমৃদ্ধ; সাহিত্যে সঞ্চারিত হয়েছে নতুন-নতুন মাত্রা।
১৯৭১ সালের পরে মুক্তিযুদ্ধকে অবলম্বন করে অনেক সাহিত্যকর্ম রচিত হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই তাতে জড়িয়ে আছে সংগ্রাম ও বিজয়ের বিমিশ্র অভিব্যক্তি। সে-সাহিত্য একান্তভাবেই মুক্তিযুদ্ধের উত্তরাধিকার। দীর্ঘ সিকি-শতাব্দী ধরে নিজেদের শনাক্ত করার যে সাধনায় বাংলাদেশের সাহিত্যিকরা ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ, তার সাফল্যে যুদ্ধোত্তর কালে সাহিত্যের বিষয় ও প্রকরণে এসেছে নতুন মাত্রা। বিষয় ও ভাবের দিক থেকে এ সময়কার সাহিত্যে যেমন মুক্তিযুদ্ধের প্রতিফলন ঘটেছে, তেমনি প্রকরণ-পরিচর্যায়ও মুক্তিযুদ্ধের অনুষঙ্গ উপস্থিত। সাহিত্যে মুক্তিযুদ্ধের প্রতিফলন ঘটেছে বিভিন্নভাবে। কখনো সরাসরি যুদ্ধকে অবলম্বন করে সাহিত্য রচিত হয়েছে, কখনো বা সাহিত্যের বিষয়াংশ সৃষ্টি হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে। কোনো-কোনো সাহিত্যকর্মে স্বাধীনতার স্বপক্ষীয়দের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা এবং বিপক্ষীয়দের প্রতি ঘৃণা প্রকাশ পেয়েছে; আবার কোথাও রচনার বহিরঙ্গে লেগেছে মুক্তিযুদ্ধের স্পর্শ স্বাধীনতাচেতনা বাংলাদেশের সাহিত্যিকদের নতুন মূল্যবোধে পুনর্জাত করেছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নে তাঁদের অনেকেই হতে চেয়েছেন এক একজন মুক্তিযোদ্ধা। তাই তাঁরা অস্ত্র হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন কলমকে। স্বাধীনতাযুদ্ধ চলার সময় তাঁরা ছিলেন পাকিস্তানি ঘাতকদের অন্যতম শিকার। ভীতি ও সন্ত্রাসের মধ্যে বাস করেও তাঁরা সংগ্রামের মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ হয়ে সাহিত্য রচনা করেছেন, পালন করেছেন শব্দসৈনিকের ভূমিকা। যুদ্ধকালীন সময়ে যেমন, যুদ্ধপরবর্তী সময়েও তেমনি রক্তাক্ত শব্দ ও সংলাপে তাঁরা বাণীবদ্ধ করেছেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে। তবে মুক্তিযুদ্ধের সময় কিংবা তার অব্যবহিত পরে যেসব সাহিত্যকর্ম রচিত হয়েছে, তাতে মননের চেয়ে আবেগ প্রাধান্য পেয়েছে। এটি প্রত্যক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধকে নিয়ে রচিত সাহিত্যের সাধারণ বৈশিষ্ট্য। যুগের দাবিতে রচিত এসব সাহিত্যকর্মের অধিকাংশতেই যুদ্ধের সংবাদ আছে, পাকিস্তানি সৈন্যকর্তৃক নারীধর্ষণের চিত্র আছে, করতালি-নিনাদিত জনপ্রিয় বক্তৃতার মেলা আছে, বিপুল আবেগের উদ্দাম প্লাবন আছে; কিন্তু নেই শিল্পবোধ ও স্রষ্টার নিরাসক্ত জীবনচেতনা। তবে বেশকিছু যুগোত্তীর্ণ সাহিত্যকর্মও রচিত হয়েছে। সে-সবের মধ্যে আছে কবিতা, উপন্যাস, ছোটগল্প, নাটক এবং অন্যান্য।

দুই
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে এদেশের কবিরা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এক-একজন শব্দযোদ্ধা হয়ে উঠেছিলেন। তাঁদের তখনকার অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে কবি শামসুর রাহমান লিখেছেন— ‘আমরা প্রতিমুহূর্তে মৃত্যুর প্রতীক্ষা করতাম। সব সময় মনে হতো কেউ যেন দরজায় কড়া নাড়ছে। ঘুম থেকে চিৎকার করতাম কোনো কোনো রাতে। বধ্যভূমির ধারে বেঁধে রাখা জীবজন্তুর অনুরূপ আমরা আতঙ্ককে জেনেছি নিত্যসঙ্গী বলে। এমন কোনো দিনের কথা মনে করতে পারি না, যেদিন হত্যা কিংবা ধর-পাকড়ের কোনো-না-কোনো খবর কানে না এসেছে। সেই নরকবাসের সাক্ষী হয়ে আছে তখনকার লেখা আমার কবিতা—
কখনো নিঝুম পথে হঠাৎ লুটিয়ে পড়ে কেউ গুলির আঘাতে,
মনে হয় ওরা গুলিবিদ্ধ করে স্বাধীনতাকেই।
দিন-দুপুরেই জীপে একজন তরুণকে কানামাছি করে নিয়ে যায় ওরা;
মনে হয় চোখ-বাঁধা স্বাধীনতা যাচ্ছে বধ্যভূমিতে।
বেয়নেটবিদ্ধ লাশ বুড়িগঙ্গা কি শীতলক্ষ্যায় ভাসে;
মনে হয়, স্বাধীনতা-লখিন্দর যেন,
বেহুলা-বিহীন
জলেরই ভেলায় ভাসমান।
(সচিত্র সন্ধানী, বিজয় দিবস সংখ্যা, ১৯৭৯)

স্বাধীনতা যুদ্ধ এদেশের কবিদের কীভাবে উদ্বুদ্ধ করেছে, তার পরিচয় পাওয়া যায় কবি আল মাহমুদের ভাষায়। আল মাহমুদের কবিতা কাব্যগ্রন্থের ভূমিকায় কবি লিখেছেন— ‘গত কয়েকমাস আমার স্বদেশভূমি স্বাধীনতার যুদ্ধে রক্তাক্ত হয়েছে। বাংলাদেশকে স্বৈরাচারী বর্বরতার হাত থেকে মুক্ত করার এই সর্বাত্মক যুদ্ধে আমার দেশবাসী প্রতিটি তরুণ-তরুণীর সাথে আমিও সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছি। এ ব্যাপারে অগ্র-পশ্চাৎ বিবেচনার কোন প্রশ্ন ওঠেনি। এ ছিল বাঙালি জাতির অস্তিত্বের লড়াই।’
মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক কবিতা একাত্তরের যুদ্ধ-শিবিরে মুক্তিসেনাদের প্রাণে আগুন জ্বেলে দিত। সে-আগুন ঝলসে উঠত তাঁদের থ্রি-নট-থ্রি রাইফেলের শব্দে। গ্রামের স্কুলে সামান্য শিক্ষা পাওয়া গেঞ্জি-লুঙ্গিপরা যুবকরা উদ্দীপ্ত হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন স্বাধীনতাযুদ্ধে। এই দামাল ছেলেদের কথা ধ্বনিত হয়েছে বাংলাদেশের নানা কবির পংক্তিমালায়। মুক্তিযুদ্ধের অগ্নিগর্ভ দিনগুলোতে বাংলাদেশের ঘরে-ঘরে ব্যাকুল প্রত্যাশার একটি নাম ছিল ‘গেরিলা’। গেরিলার সঠিক কোনো স্বরূপ গ্রামের মানুষদের জানা ছিল না। ক্রমে তারা চিনেছে, জেনেছে যে গেরিলা তাদেরই ভাই, তাদেরই প্রাণপ্রতিম সন্তান-
দেখতে কেমন তুমি? অনেকেই প্রশ্ন করে, খোঁজে
কুলুজি তোমার আঁতিপাঁতি। তোমার সন্ধানে ঘোরে
ঝানু গুপ্তচর, সৈন্য পাড়ায় পাড়ায়। তন্ন তন্ন
করে খোঁজে প্রতিঘর, পারলে নীলিমা চিরে বের
করতো তোমাকে ওরা, দিতো ডুব গহন পাতালে।
তুমি আর ভবিষ্যৎ যাচ্ছো হাত ধরে পরস্পর।
সর্বত্র তোমার পদধ্বনি শুনি, দুঃখ তাড়ানিয়া
তুমি তো আমার ভাই, হে নতুন, সন্তান আমার।
(শামসুর রাহমানের শ্রেষ্ঠ কবিতা, ১৯৮৩)

মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি জল্লাদ বাহিনী গণহত্যায় মেতে উঠেছিল। লক্ষ-লক্ষ বাঙালি শহীদ হয়েছেন তাদের নৃশংস হত্যাযজ্ঞে। কবির ভাষায় সেই বর্বরতার চিত্র এরূপ-
ক. হানাদার খুঁজে ফিরল নগর গ্রাম
বধ করে গেল স্বজন, সুহৃদ, আসাদ লক্ষ নাম।
(মোহাম্মদ মনিরুজ্জামানের কাব্যসংগ্রহ, ১৯৭৬)

খ. হঠাৎ স্তব্ধতা বিদীর্ণ হয়ে যাবার একটি শব্দ আমরা শুনতে পাই।
হঠাৎ চব্বিশটি রক্তাক্ত দেহ – রমণী, শিশু, যুবক, প্রৌঢ়-
আমরা দেখতে পাই, এক মুহূর্তের জন্যে,
রক্তাক্ত এবং লুণ্ঠিত,
দ্বিতীয়বার আর নয়,
রক্তাক্ত, লুণ্ঠিত এবং প্রাণহীন-
দেয়ালের পায়ের কাছে চত্বরে তারা শুয়ে আছে।
(সৈয়দ শামসুল হক, অন্তর্গত, ১৯৮৪)

এই হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করার মানসে কবির কণ্ঠে ধ্বনিত হয় প্রতিহিংসার আহ্বান-
টিক্কার ইউনিফর্মে শিশুর মগজ,
যুবকের পাঁজরের গুঁড়ো
নিয়াজির টুপিতে রক্তের প্রস্রবণ,
ফরমান আলীর টাইয়ের নটে ঝুলন্ত তরুণী…
তুমি কি তাদের
কখনো করবে ক্ষমা?
(শামসুর রাহমান, ফিরিয়ে নাও ঘাতক কাঁটা, ১৯৮১)

পরাধীনতার শৃঙ্খল মোচনের জন্য একাত্তরে বাঙালি জাতিসত্তার যে উদ্বোধন ঘটে, কবি সেখান থেকে প্রতিনিয়ত কবিতা লেখার অণুপ্রেরণা লাভ করেন। ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্তির আকাঙ্ক্ষায় সমবেত বাঙালির আত্মজাগরণ এবং মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার ইতিহাস হাসান হাফিজুর রহমানের কবিতায় ধরা পড়েছে এভাবে-
ঝোপঝাড়, নদীনালা, ফসলের ক্ষেত,
সমস্ত বাংলাই আজ কঠোর এ্যামবুশ।
সবুজ মানুষেরা আচম্বিতে আজ প্রত্যেকেই গেরিলা।
……
বাংলার আপদে আজ লক্ষ কোটি বীর সেনা
ঘরে ও বাইরে হাঁকে রণধ্বনি, একটি শপথে
আজ হয়ে যায় শৌর্য ও বীরগাথার মহান
সৈনিক, যেন সূর্যসেন, যেন স্পার্টাকাস স্বয়ং সবাই।

পাকিস্তানি দখলদার বাহিনী আর তাদের এ-দেশীয় দোসরদের হাতে বাংলার দুলক্ষ নারীর লাঞ্ছনা মুক্তিযুদ্ধের একটি বেদনার্ত পরিচ্ছেদ। দেশমাতৃকার মতোই তারা ছিন্ন- ভিন্ন ও ধর্ষিতা। তাদের কাছে মুক্তিযুদ্ধ মানেই এক দুর্মর যন্ত্রণার স্মৃতি। বাংলার এই বীরাঙ্গনাদের যন্ত্রণার শব্দরূপ সৃজনে কবিও হয়ে ওঠেন বেদনার্ত। তিনি তাদের আহ্বান করেন আসন্ন বিজয়ের মহোৎসবে-
তোমাদের ঠোঁটে দানবের থুথু,
স্তনে নখরের দাগ, সর্বাঙ্গে দাঁতালের ক্ষতচিহ্ন প্রাণান্ত গ্লানিকর
লুট হয়ে গেছে তোমাদের নারীত্বের মহার্ঘ্য মসজিদ।
উচ্ছিষ্টের দগদগে লাঞ্ছনা তোমরা
পরিত্যক্ত পড়ে আছ জীবনের ধিকৃত অলিন্দে নাকচ তাড়িত।
…..
শত্রু হননের আগুন বইছ দু’হাতে, এর চেয়ে বেশী
চাইনা কিছুই। দু’হাত বাড়িয়ে ডাকি,
‘ফিরে এসো ফিরে এসো, তোমারই নতুন যৌবনে,
আসন্ন বিজয়ের আগম উৎসবে।
(যখন উদ্যত সঙ্গীন, ১৯৭৯)

মুক্তিযুদ্ধের স্থপতি বঙ্গবন্ধুকে নিয়েও যুদ্ধোত্তরকালে রচিত হয়েছে একগুচ্ছ কবিতা, যার শরীরে ও মর্মে উৎকীর্ণ হয়ে আছে ঐ মহান মুক্তিসংগ্রামীর গৌরবগাথা। একাত্তরের ৭ই মার্চ বাঙালির আকাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতার জন্য বঙ্গবন্ধুর সেই প্রদীপ্ত ঘোষণা কবির হাতে পায় নতুন ব্যঞ্জনা-
শত বছরের শত সংগ্রাম শেষে রবীন্দ্রনাথের মতো দৃপ্ত পায়ে হেঁটে
অঃপর কবি এসে জনতার মঞ্চে দাঁড়ালেন।
তখন পলকে দারুণ ঝলকে তরীতে উঠিল জল,
হৃদয়ে লাগিল দোলা।
জনসমুদ্রে জাগিল জোয়ার সকল দুয়ার খোলা-
কে রোধে তাঁহার বজ্রকণ্ঠ বাণী?
গুসূর্যের মঞ্চ কাঁপিয়ে কবি শোনালেন তাঁর অমর কবিতাখানি:
“মবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম,
এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
সেই থেকে ‘স্বাধীনতা’ শব্দটি আমাদের।
(নির্মলেন্দু গুণ, চাষা-ভুষার কাব্য, ১৯৮১)

মুক্তিযুদ্ধ কবির কাছে বাঙালির বিজয়ের চিরায়ত আকাশ। তাই প্রায় অর্ধ-শতাব্দীর ব্যবধান অতিক্রম করে একালের কবির পংক্তিমালায় উঠে আসে বাঙালির বিজয়ের কথা, বেদনার কথা, প্রিয়জন হারানোর বেদনা, শিল্পিতা পায় মহাকালের তর্জনীর বরাভয়। কবি কামাল চৌধুরীর উচ্চারণে প্রকাশিত হয়েছে এমনই সব ভাবনা-
এখনো চাপা দীর্ঘশ্বাস আছে
এখনো আছে অশ্রু ও কাতর চিৎকার
বোনটি হারিয়ে গেছে, ভাই কোথায়?
মা এখনো রক্তাক্ত আঁচল
হারানো গল্পগুলো এখনো অতীত নয়
এখনো বধ্যভূমি
বিজয়ীর শোকার্ত কবিতা।
(কামাল চৌধুরী, ‘বিজয়ী আকাশ’, ২০১৮)

মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ যে অভিন্ন, কবির উচ্চারণে প্রকাশিত হয় সে-সত্য। আনোয়ারা সৈয়দ হকের কবিতায় শিল্পিত হয়েছে এ প্রত্যয়- ‘তুমি যখন নিহত হলে, আমি তখন বিদেশে/ বিদেশের মাটিতেই তোমাকে প্রথম চাক্ষুস করলাম/ ঝিলিমিলি ও ক্রন্দিত এক পর্দায়/ তখন অবাক হয়ে দেখি তুমি ও দু’জনেই দু’জনার।’ (‘তুমি ও মাতৃভূমি’, ২০১৮)
কবিতার অন্তরঙ্গে যেমন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সঞ্চারিত হয়েছে, তেমনি তার বহিরঙ্গেও উপস্থিত মুক্তিযুদ্ধের বিচিত্র অনুষঙ্গ। স্বাধীনতা-পরবর্তী কবিতায় এমন কিছু শব্দের প্রয়োগ দেখা যায়, যা একান্তই মুক্তিযুদ্ধের উত্তরাধিকার। সেসব শব্দের মধ্যে রয়েছে বুলেট, বেয়নেট, রাইফেল, মর্টার, এ্যাম্বুশ, গেরিলা, বধ্যভূমি, ট্রিগার, ইউনিফর্ম, হেলমেট, বারুদ, রাজাকার ইত্যাদি। উপমা-রূপক-উৎপ্রেক্ষা-চিত্রকল্প
নির্মাণেও কবিতায় আসে মুক্তিযুদ্ধের বিচিত্র অনুষঙ্গ। যেমন-
ক. চকিতে অক্ষরগুলো পাতা থেকে দ্রুত
তুমুল বেরিয়ে পড়ে, বুঝি
জঙ্গী ট্রাক থেকে ঝুপঝাঁপ
লাফিয়ে নামছে সৈন্যদল।
(শামসুর রাহমান, ফিরিয়ে নাও ঘাতক কাঁটা, ১৯৮১)

খ. সল্টলেক একাকী ঘুমিয়ে আছে
যেন পরিত্যক্ত দেশ-প্রেমিকের খালি বাড়ি
রাজাকার, আল-বদরের ভয়ে ভীত,
মৃত ম্রিয়মাণ।
(নির্মলেন্দু গুণ, নির্বাচিত কবিতা, ১৯৮৩)

গ. স্বাধীনতা – সে আমার প্রিয় মানুষের রক্তে কেনা অমূল্য ফসল।
ধর্ষিতা বোনের শাড়ি ওই আমার রক্তাক্ত জাতির পতাকা।
(রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ, উপদ্রুত উপকূল, ১৯৭৯)

ঘ. শরণার্থী শিবিরের মতো সেই গাঢ় অন্ধকার আজ
আবার আমাদের এই
বিপন্ন লোকালয়ে বাঁধিতেছে ঘর।
(দাউদ হায়দার, উপদ্রুত উপকূল, ১৯৯৬)

তিন
স্বাধীনতার সোনালি প্রভায় বাঙালিদের মন ও মননে যে নতুন চেতনা জাগ্রত হয়েছে, উপন্যাসে তার প্রতিফলন ছিল একান্তই প্রত্যাশিত। কিন্তু এ-সময়ে অধিকাংশ ঔপন্যাসিকই যুদ্ধোত্তর জাতীয় হতাশা ও অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের শব্দচিত্র অঙ্কনে অধিক আগ্রহী ছিলেন; দ্রোহ-বিদ্রোহ-প্রতিবাদ- প্রতিরোধ আর উত্তরণের কথাচিত্র নির্মাণে তাঁরা তদ্রূপ উৎসাহী ছিলেন না। তবে কারো কারো উপন্যাসে আবেগ- উচ্ছ্বাস নিয়ে জড়িয়ে আছে সংগ্রাম ও বিজয়ের অবিমিশ্র অভিব্যক্তি। যুদ্ধোত্তর সময়ে মূল্যবোধের অবক্ষয়, সর্বব্যাপী হতাশা, নৈরাজ্য এবং অর্থনৈতিক বিপর্যয় কাটিয়ে মহৎ শিল্পিমানস অনুসন্ধান করে জীবন ও শিল্পের জন্য সদর্থক ও আলোকোজ্জ্বল এক মানসভূমি। এটি মুক্তিযুদ্ধোত্তর উপন্যাস সাহিত্যের আশাব্যঞ্জক দিক|
১৯৭১ সালের ১৪ই ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী আনোয়ার পাশা সংগ্রাম-সঙ্কুল সময়ে রচনা করেন মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস রাইফেল রোটি আওরাত (প্রকাশিত ১৯৭৩)। পঁচিশে মার্চ রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আবাসিক এলাকায় পাকবাহিনীর বর্বর হত্যাকাণ্ড ও বহ্ন্যুৎসবকে কেন্দ্র করে রচিত এ উপন্যাস একদিকে স্বাধীনতা সংগ্রামের ঐতিহাসিক দলিল, অপরদিকে আবেগসিক্ত এক সার্থক সাহিত্যকর্ম। উপন্যাসের নায়ক সুদীপ্ত শাহিন কাহিনীর সমাপ্তিতে হয়ে ওঠে নির্ভীক এক সাহসী মানুষ। চরম বিপর্যয় আর রক্তস্রোতের মধ্যে অবস্থান করেও শেষ পর্যন্ত তার কণ্ঠ থেকে ভেসে আসে এগিয়ে যাওয়ার মাভৈঃ বাণী। সমস্ত দ্বিধা-দ্বন্দ্ব-সংশয় এবং শ্রেণিচরিত্র অতিক্রম করে সে শামিল হয় মুক্তিযুদ্ধের রক্তিম স্রোতে।
মুক্তিযুদ্ধের অনুষঙ্গে শওকত ওসমান লিখেছেন চারটি উপন্যাস- জাহান্নাম হইতে বিদায় (১৯৭১), নেকড়ে অরণ্য (১৯৭৩), দুই সৈনিক (১৯৭৩) এবং জলাঙ্গী (১৯৭৬)। জাহান্নাম হইতে বিদায় উপন্যাসে অঙ্কিত হয়েছে একাত্তরে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর বর্বরতা, মানুষের অসহায়ত্ব এবং বাঙালির প্রতিবাদ-প্রতিরোধের চিত্র|
শওকত আলীর যাত্রা (১৯৭৬) উপন্যাসে একাত্তরের পঁচিশে মার্চের কালো রাতে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর পাশবিক আক্রমণে ভীত ঢাকা শহরের বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে গ্রামের পথে যাত্রা করে। সৈয়দ শামসুল হকের নীল দংশন (১৯৮১) ও নিষিদ্ধ লোবান (১৯৮১) নামক উপন্যাসোপম রচনাদুটি মুক্তিযুদ্ধকালে বাঙালি জাতিসত্তার সামগ্রিক জাগরণ নয়, বরং একটি খণ্ডিত পরিচ্ছেদের শব্দরূপ। যুদ্ধোত্তর সময়ের পটভূমিতে রচিত সৈয়দ শামসুল হকের দ্বিতীয় দিনের কাহিনী-তে (১৯৮৪) স্মৃতিচারণের মধ্য দিয়ে এসেছে গৌরবোজ্জ্বল মুক্তিযুদ্ধের কথা। উপন্যাসের নায়ক শিক্ষক তাহের এ সত্যে আত্মস্থ হন যে, মুক্তিসংগ্রাম একাত্তরের ১৬ই ডিসেম্বর শেষ হয়ে যায়নি, কারণ সমাজে এখনো আছে অশুভ শক্তির পাঁয়তারা।
গৌরবোজ্জ্বল মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে রচিত সেলিনা হোসেনের হাঙর নদী গ্রেনেড (১৯৮৭) উপন্যাসে উঠে এসেছে একাত্তরের গ্রামীণ জীবনের আলোড়ন-সংক্ষোভ-স্বপ্ন উপন্যাসের নায়ক বুড়ি তার প্রাণপ্রতিম সন্তানকে মুক্তিযুদ্ধে উৎসর্গ করেছে এবং এভাবে সে আত্মকেন্দ্রিক চিন্তা থেকে মুক্ত হয়ে জাতীয় মুক্তিসংগ্রামে সম্পৃক্ত হয়েছে। হলদী গাঁয়ের নিস্তরঙ্গ জীবনধারায় বেড়ে ওঠা বুড়ি মুক্তিযুদ্ধের রক্তস্রোতে অবগাহন করে হয়ে ওঠে সূর্যপ্রতিম। বুড়ির অপর নাম মুক্তির আকাঙ্ক্ষা। সে যেন হাজার-লক্ষ সন্তানহারা গর্বিতা মাতৃভূমির শাশ্বত শিল্পরূপ।
স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে মুক্তিযুদ্ধকে অবলম্বন করে নানা দৃষ্টিকোণ ও অনুষঙ্গে অনেক উপন্যাস রচিত হয়েছে। সে- সবের মধ্যে উল্লেখযোগ্য রশীদ হায়দারের খাঁচায় (১৯৭৫), অন্ধ কথামালা (১৯৮২), নষ্ট জোছনায় এ কোন অরণ্য (১৯৮২); হুমায়ুন আহমেদের শ্যামল ছায়া (১৯৭৩), সৌরভ (১৯৮৪), ১৯৭১ (১৯৮৬); ইমদাদুল হক মিলনের ঘেরাও (১৯৮৪), কালো ঘোড়া (২০১০); শামসুর রাহমানের অদ্ভুত আঁধার এক (১৯৮৫); আবু জাফর শামসুদ্দীনের দেয়াল (১৯৮৬); হারুন হাবীবের প্রিয়যোদ্ধা প্রিয়তম (১৯৮২), সেলিনা হোসেনের সাতই মার্চের বিকেল (২০১৮); মাহমুদুল হকের জীবন আমার বোন (১৯৭৬); আনিসুল হকের আলো- আঁধারের যাত্রী (২০১৮); হুমায়ুন আহমদের জ্যোৎস্না ও জননীর গল্প (২০০৬); শাহীন আখতারের তালাশ (২০০৫); মোস্তফা কামালের অগ্নিপুরুষ (২০১৮); মহীবুল আজিজের যোদ্ধা জোড় (২০১৪); শামস সাইদের ধানমন্ডি ৩২ নম্বর (২০১৮) ইত্যাদি। এসব উপন্যাসের মধ্যে হারুন হাবীবের প্রিয়যোদ্ধা প্রিয়তম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ, বিজয়ের উল্লাস আর ত্যাগের মহিমা যেমন ছড়িয়ে আছে এ উপন্যাসে, তেমনি আছে হাসান-ইয়াসমিনকার রোমান্টিক প্রেমের প্রতীকে শাশ্বত বিশ্বজনীনতা। উপন্যাসের নায়ক, যার বুকের পাঁজরে লুকিয়ে আছে পাকবাহিনীর বুলেট, হাসানের আবেগসিক্ত সংলাপে ধ্বনিত হয়েছে একাত্তরের বাঙালি জাতিসত্তার রক্তিম উজ্জীবনের রৌদ্রোজ্জ্বল চেতনা: একাত্তরের মৃত অথবা জীবিত স্বাধীনতা-সংগ্রামী আবুল হাসানরাই বাংলাদেশ। এ সত্যের মৃত্যু মানেই তো বাঙালির ইতিহাস থেকে ৭১ সালটা নেই। নেই পল্টন ময়দান, ঘেরাও আন্দোলন, নেই রেসকোর্স উদ্যানের স্বাধীনতা-পাগল জনতা, নেই ২৫শে মার্চের কালো রাত, নেই ২৩ বছরের পাকিস্তানী দুঃশাসন-বর্বরতা-নিষ্ঠুরতা, নেই সাভার-এর জাতীয় শহীদ মিনার, মীরপুরের বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ। ৫২ থেকে ৭০-এর যে ইতিহাস, সেই ইতিহাসই বাংলাদেশ সৃষ্টির গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস। এ প্রসঙ্গে তাহমিনা আনামের A Golden Age (2007) উপন্যাসের কথাও আমরা স্মরণ করতে পারি। এ উপন্যাসে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট স্বতন্ত্র মাত্রায় শিল্পিত হয়েছে।

চার
স্বাধীনতা-উত্তরকালে মুক্তিযুদ্ধের অনুষঙ্গ ও উপাদান ব্যবহার করে ছোটগল্প রচনায় বাংলাদেশের নবীন-প্রবীণ সাহিত্যিকদের মধ্যে দেখা দেয় ব্যাপক উৎসাহ। তাঁদের অনেকেই মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন। তাই মুক্তিযুদ্ধের অভিজ্ঞতা তাঁদের কাছে বিপুল অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে দেখা দেয় এবং তাঁদের প্রায় সকলেই এ অভিজ্ঞতার আলোকে ছোটগল্প রচনা করেন। কেবল মুক্তিযুদ্ধের গল্প নিয়ে যাঁদের গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে, তাঁদের মধ্যে আছেন বশীর আল হেলাল (প্রথম কৃষ্ণচূড়া, ১৯৭২), শওকত ওসমান (জন্ম যদি তব বঙ্গে, ১৯৭৫), হাসান আজিজুল হক (নামহীন গোত্রহীন, ১৯৭৫), আলাউদ্দিন আল আজাদ (আমার রক্ত, স্বপ্ন আমার, ১৯৭৫), আবু জাফর শামসুদ্দীন (রাজেন ঠাকুরের তীর্থযাত্রা, ১৯৭৭), আবুবকর সিদ্দিক (মরে বাঁচার স্বাধীনতা, ১৯৭৭), সাদেকা শফিউল্লাহ (যুদ্ধ অবশেষে, ১৯৮০), সৈয়দ ইকবাল (একদিন বঙ্গবন্ধু ও অন্যান্য গল্প, ১৯৮৬), এহসান চৌধুরী (একাত্তরের গল্প, ১৯৮৬), খালেদা সালাহউদ্দিন (যখন রুদ্ধশ্বাস, ১৯৮৬), কাজী ফজলুর রহমান (ষোলই ডিসেম্বর ও মুক্তিযুদ্ধের গল্প, ১৯৮৮), সৈয়দ শামসুল হক (জলেশ্বরীর গল্পগুলো, ১৯৯০), বিপ্রদাস বড়ুয়া (যুদ্ধজয়ের গল্প, ১৯৯১) প্রমুখ।
মুক্তিযুদ্ধের নানা অনুষঙ্গ নিয়ে যাঁরা ছোটগল্প রচনা করেছেন, তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সত্যেন সেন (পরিবানুর কাহিনী), শওকত ওসমান (দুই ব্রিগেডিয়ার, আলোক-অন্বেষা), বশীর আল হেলাল (বাংলার প্রাণ), কায়েস আহমদ (আসন্ন), হারুন হাবীব (গেরিলা), রাজিয়া খান (ইজ্জত), তাজুল ইসলাম ফিরোজী (সপ্তর্ষী অনেক দূরে), মঞ্জু সরকার (শান্তি বর্ষিত হোক), শওকত আলী (সোজা রাস্তা, আকাল দর্শন), আফসান চৌধুরী (ফাটা শহরের গল্প), সিরাজুল ইসলাম (দূরের খেলা), রাহাত খান (মধ্যিখানের চর), রশীদ হায়দার (কল্যাণপুর, এ কোন ঠিকানা), মীর নূরুল ইসলাম (স্বৈরিণী ফিরে এসো), কায়েস আহমেদ (আসন্ন), আখতারুজ্জামান ইলিয়াস (অপঘাত, রেইনকোট), মাহমুদুল হক (কালো মাফলার), সেলিনা হোসেন (আমিনা ও মদিনার গল্প), মঈনুল আহসান সাবের (কবেজ লেঠেল, ভুলবিকাশ), সুচরিত চৌধুরী (নিঃসঙ্গ নিরাশ্রিত), আবদুল গাফফার চৌধুরী (কেয়া, আমি এবং জারমান মেজর), জহির রায়হান (সময়ের প্রয়োজনে), শামসুদ্দীন আবুল কালাম (পুঁই- ডালিমের কাব্য), আমজাদ হোসেন (উজানে ফেরা), হুমায়ুন আহমদ (শীত, উনিশ শ’ একাত্তর), রিজিয়া রহমান (ইজ্জত), হুমায়ুন আজাদ (যাদুকরের মৃত্যু), মামুন হুসাইন (মৃত খড় ও বাঙাল একজন) প্রমুখ।
মুক্তিযুদ্ধের গল্প নিয়ে প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য কয়েকটি সংকলন গ্রন্থ হলো— আবদুল গাফফার চৌধুরী সম্পাদিত বাংলাদেশ কথা কয় (১৯৭১), আবুল হাসনাত সম্পাদিত মুক্তিযুদ্ধের গল্প (১৯৮৩), হারুন হাবীব সম্পাদিত মুক্তিযুদ্ধের নির্বাচিত গল্প (১৯৮৫), বিপ্রদাস বড়ুয়া সম্পাদিত মুক্তিযোদ্ধার গল্প (১৯৯১) প্রভৃতি। এসব গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত গল্পসমূহে মুক্তিযুদ্ধের নানা ঘটনা ও অনুষঙ্গ শৈল্পিক ব্যঞ্জনায় উদ্ভাসিত হয়েছে।

পাঁচ
স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় বাংলাদেশের নাট্যকাররা ছিলেন পাকিস্তানি ঘাতকদের অন্যতম শিকার। সন্ত্রাসের মধ্যে বাস করেও তাঁরা সংগ্রামের মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ হয়ে নাটক রচনা করেছেন, পালন করেছেন শব্দসৈনিকের ভূমিকা। যুদ্ধের সময় যেমন, তেমনি যুদ্ধপরবর্তী সময়েও তাঁরা শোণিতাক্ত শব্দ ও সংলাপে বাণীবদ্ধ করেছেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে। শুধু ১৯৭১ থেকে ১৯৭৫ সালের মধ্যেই মুক্তিযুদ্ধকে অবলম্বন করে পঞ্চাশের অধিক নাটক রচিত হয়েছে।
মমতাজউদ্দীন আহমদ ১৯৭১ সালের অসহযোগ আন্দোলন-এর সময় একাধিক নাটক রচনা করেছেন। এ পর্যায়ে তাঁর স্মরণীয় তিনটি নাটক হলো স্বাধীনতা আমার স্বাধীনতা, এবারের সংগ্রাম এবং স্বাধীনতার সংগ্রাম। পরবর্তীকালে এসব নাটক নিয়ে প্রকাশিত হয় তাঁর স্বাধীনতা আমার স্বাধীনতা (১৯৭৬) শীর্ষক নাট্যগ্রন্থ। স্বাধীনতার পরে ১৯৭২ সালে তিনি রচনা করেন বর্ণচোর এবং ১৯৮৬ সালে কিশোরদের জন্য রচনা করেন বকুলপুরের স্বাধীনতা|
এবারের সংগ্রাম এবং স্বাধীনতার সংগ্রাম নাট্যদ্বয়ে রূপকের ব্যঞ্জনায় মমতাজউদ্দীন আহমদ তুলে ধরেছেন পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শক্তির অত্যাচারের কাহিনি এবং একই সঙ্গে বাঙালির রুখে দাঁড়ানোর গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস। বর্ণচোর নাটকে চিত্রিত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীনতাবিরোধী চক্রের ভণ্ডামি, পাশবিকতা ও মনুষ্যত্বহীনতার কাহিনি। মুক্তিযুদ্ধ অবলম্বনে রচিত মমতাজউদ্দীন আহমদের শ্রেষ্ঠ নাটক বিবাহ ও কি চাহ শঙ্খচিল (১৯৮৫)। বিবাহ নাটকের কেন্দ্রীয় বিষয় ভাষা-আন্দোলন হলেও ইতিহাসের ক্রমধারায় তা মুক্তিযুদ্ধকেন্দ্রিক কি চাহ শঙ্খচিল নাটকের সঙ্গে একাত্ম হয়ে গেছে। এ প্রসঙ্গে নাট্যকারের ভাষ্যটি স্মরণীয়— ‘স্বাধীনতা যুদ্ধের পটভূমিতে কি চাহ শঙ্খচিলের বিষয় নির্ধারিত। বিবাহ নাটকের সখীনা এবং কি চাহ শঙ্খচিলের রৌশন আরা আবেগ ও যন্ত্রণার সূত্রে আমার কাছে অভিন্ন চরিত্র। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন স্বাধিকার এবং একাত্তরের যুদ্ধ স্বাধীনতার শপথে যেমন ধারাবাহিক সূত্রে গ্রথিত, তেমনি বিবাহ ও কি চাহ শঙ্খচিল একই আবেগ ও বেদনার ধারাবাহিক বিকাশ।
মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সৈন্য-কর্তৃক নারীধর্ষণের কলঙ্কিত ইতিহাস নিয়ে রচিত হয়েছে কি চাহ শঙ্খচিল নাটক। নির্যাতিত নারীদের অপরিমেয় যন্ত্রণা ও বেদনার ইতিহাস মমতাজউদ্দীন আহমদ শৈল্পিক ব্যঞ্জনায় উপস্থাপন করেছেন, তুলে ধরেছেন সর্বস্বহারা নারীদের বুকফাটা আর্তনাদ। নাটকের নায়িকা রৌশন আরার অন্তিম সংলাপটি এ-ক্ষেত্রে স্মরণীয়— ‘যুদ্ধকে নিয়ে তোমরা ভাগ্য গড়ে নাও, সাধের সিংহাসন মজবুত কর, পৃথিবীর রঙকে মলিন কর, আমি তো প্রতিবাদ করিনি – আমি তো সূর্যের আলোতে মুখ দেখাতে চাইনি কিন্তু আমার সন্তানকে নিয়ে তোমরা বাণিজ্য গড়তে চাও কেন? আমার সন্তানের পরিচয়কে তোমরা অপবিত্র কর কেন? … স্বাধীনতা? কার স্বাধীনতা? কেমন স্বাধীনতা? মায়ের কোলে বাচ্চা নাই, মানুষের চোখে নিদ নাই, নদীর বুকে পানি নাই। কেমন স্বাধীনতা? তোমার মাথার উপর থাইক্কা উড়া জাহাজের মতোন জল্লাদ পাখি তাড়াইতে পারবা? তোমার বইনের মুখ থাইক্কা লাঞ্ছনা মুছতে পারবা? আমার মাথার আগুন নিভাইতে পারবা?’
পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কর্তৃক নারীধর্ষণের প্রেক্ষাপটে লেখা হয়েছে আরো কিছু নাটক। সে-সবের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য আলাউদ্দিন আল আজাদের নিঃশব্দ যাত্রা (১৯৭২), নরকে লাল গোলাপ (১৯৭৪); মোহাম্মদ এহসানুল্লাহর কিংশুক যে মরুতে (১৯৭৪); নীলিমা ইব্রাহিমের যে অরণ্যে আলো নেই (১৯৭৪), আমি বীরাঙ্গনা বলছি (১৯৯৬); জিয়া হায়দারের সাদা গোলাপে আগুন (১৯৮২), পঙ্কজ বিভাস (১৯৮২) প্রভৃতি। উপর্যুক্ত নাটকগুলোর মধ্যে নরকে লাল গোলাপ, আমি বীরাঙ্গনা বলছি, সাদা গোলাপে আগুন এবং পঙ্কজ বিভাস বন্দি নারীদের মর্মযাতনা উপস্থাপনে অন্য নাটকগুলোর তুলনায় অনেক বেশি সংহত ও শিল্পসফল।
মুক্তিযুদ্ধকে অবলম্বন করে সবচেয়ে সার্থক ও মঞ্চসফল নাটক রচনা করেছেন সৈয়দ শামসুল হক। এ প্রসঙ্গে বিশেষভাবে স্মরণীয় তাঁর পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায় (১৯৭৬) শীর্ষক কাব্যনাটকটি। মুক্তিযুদ্ধের সমাপ্তিতে আসন্ন বিজয়লগ্নে গ্রামে প্রবেশ করেছে মুক্তিবাহিনী। এ সংবাদে যে যুদ্ধের সময় পাকিস্তানের দালালি করেছে, এমনকি নিজের কন্যাকে তুলে দিয়েছে পাকিস্তানি সেনা-অফিসারের হাতে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। অবশেষে মাতবরের সামনে তার আত্মজা আত্মহত্যা করে এবং মুক্তিযোদ্ধারা মাতবরকে হত্যা করেন। এ নাটকে মাতবরের বুকফাটা কান্না ও অপমানিত আর্তিতে মুক্তিযুদ্ধের একটি বিশেষ দিক উন্মোচিত হয়েছে। এ নাটক আঞ্চলিক শব্দের নিপুণ ব্যবহারে যুদ্ধকালীন উত্তরবাংলার গ্রামীণ জীবনকে ধরে রেখেছে। ভাষার গীতিময়তা, আঞ্চলিক শব্দের কুশলী প্রয়োগ, যুদ্ধকালীন জীবন-বাস্তবতার কাব্যিক উচ্চারণ – এসব বৈশিষ্ট্যের কারণে পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায় বাংলাদেশের নাট্যসাহিত্যে একটি পালাবদলকারী নাটক হিসেবে বিবেচিত। নাটকের সমাপ্তিতে পাইকের সংলাপে যে প্রতিশোধের বাণী উচ্চারিত হয়, তা বাংলাদেশের জন্য বর্তমানেও সমান প্রাসঙ্গিক-
এদিকে, এদিকে সব আসেন এখন
দেখাইয়া দেই সব কোথায় কখন
কি গজব কি আজাবে ছিল লোকজন
জালেমের হাতে ছিল যখন শাসন
শত শত মারা গেছে আত্মীয় স্বজন।
এদিক, এদিকে সব আসেন এখন
দেখাইয়া দেই সব কীভাবে কখন
মেলেটারি ঘাঁটি নিয়া ছিল কয়জন
কারা কারা সঙ্গে ছিল তাদের তখন।
অবিলম্বে সারা দেশ ঘেরা প্রয়োজন।
জলদি জলদি সব চলেন এখন।
(পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়)

সৈয়দ শামসুল হকের নূরলদীনের সারাজীবন (১৯৮২) বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামকে ভরকেন্দ্রে রেখে রচিত এক কালজয়ী নির্মাণ। মুক্তিযুদ্ধ-উত্তর বিপন্ন সময় থেকে উত্তরণের লক্ষ্যে সৈয়দ শামসুল হক দুশো বছরের পুরোনো ইতিহাস থেকে তুলে এনেছেন রংপুরের বীর কৃষক-নেতা নূরলদীনকে। ১৭৮৩ সালে রংপুর-দিনাজপুর অঞ্চলের সামন্তবাদ-সাম্রাজ্যবাদবিরোধী কৃষক-নেতা নূরলদীনের সংগ্রাম, সাহস আর সংক্ষোভ নিয়ে গড়ে উঠেছে সৈয়দ শামসুল হকের অবিস্মরণীয় এ নাটক। নূরলদীনের ব্রিটিশ- বিরোধিতার সঙ্গে সৈয়দ শামসুল হক অসামান্য নৈপুণ্যে এখানে মিলিয়ে দিয়েছেন ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের উপনিবেশবাদবিরোধী মুক্তিসংগ্রামকে এবং এখানেই নূরলদীনের সারাজীবন নাটকের কালোত্তীর্ণ সিদ্ধি। সৈয়দ শামসুল হক মনে করেন, ১৭৮৩ কি ১৯৫২ কিংবা ১৯৭১ সালে বাঙালির সমবেত জাগরণ বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়। বাঙালি জাতিসত্তার এ সংগ্রামী চেতনা উপস্থাপনের জন্যই তাঁর নূরলদীন স্মরণ।
মুক্তিযুদ্ধের নানা অনুষঙ্গ নিয়ে রচিত অন্য নাটকগুলোর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য রণেশ দাশগুপ্তের ফেরী আসছে (১৯৭২), কল্যাণ মিত্রের জল্লাদের দরবার (১৯৭২), আল মনসুরের হে জনতা আরেক বার (১৯৭৪), সাঈদ আহমদের প্রতিদিন একদিন (১৯৭৮) প্রভৃতি। এসব নাটকে মুক্তিযুদ্ধের নানা খণ্ডচিত্র উপস্থাপিত হয়েছে – কখনো আবেগীয় ভাষায়, কখনো বা শিল্পিত পরিচর্যায়। এ ধারায় কয়েকটি টেলিভিশন নাটক রচনা করেছেন রাবেয়া খাতুন, হুমায়ুন আহমেদ এবং ইমদাদুল হক মিলন। এ ত্রয়ী নাট্যকারের রচনায় মুক্তিযুদ্ধের নানা খণ্ডচিত্র শিল্পরূপ লাভ করেছে।

ছয়
মুক্তিযুদ্ধোত্তর কালে বাংলাদেশের শিশুসাহিত্যে ব্যাপক রূপান্তর পরিলক্ষিত হয়। এ-সময় শিশু-কিশোরদের জন্য ছড়া, গল্প, উপন্যাস যা-ই লেখা হয়েছে, তাতেই নতুন চিন্তা-চেতনার প্রকাশ ঘটেছে। শিশুসাহিত্যিকরা তাঁদের রচনায় নানাভাবে মুক্তিযুদ্ধের কথা বলার চেষ্টা করেছেন। এ-ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য কয়েকজন শিশুসাহিত্যিক হলেন আবু কায়সার, শাহরিয়ার কবির, মাহমুদুল হক, হুমায়ুন আহমেদ, নাজমা জেসমীন চৌধুরী, সুজন বড়ুয়া, আমীরুল ইসলাম, লুৎফর রহমান রিটন প্রমুখ। এঁদের সম্মিলিত সাধনায় শিশু-কিশোরদের জন্য লেখা রচনায় মুক্তিযুদ্ধের যে প্রতিফলন ঘটেছে, তা বাংলা সাহিত্যের ধারায় সুদূরপ্রসারী এক মাত্রা সংযোজন করেছে।

সাত
বিগত প্রায় অর্ধ-শতাব্দীতে বাংলাদেশের সাহিত্যে মুক্তিযুদ্ধের যে প্রতিফলন ঘটেছে, তা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে সাহিত্য রচনা একটি চলমান প্রক্রিয়া, মুক্তিযুদ্ধ অনিঃশেষ-অবিনাশী শিল্প-উপাদান। এখন যেমন মুক্তিযুদ্ধ অবলম্বনে সাহিত্যকর্ম রচিত হচ্ছে, ভবিষ্যতেও হবে। সময় পেরিয়ে যখন আসবে নতুন প্রজন্মের সাহিত্যিক, হয়তো তাদের হাতেই লেখা হবে আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে লেখা একগুচ্ছ কালোত্তীর্ণ সাহিত্যকর্ম। [বিশ্বজিৎ ঘোষ]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৮ম খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!