মুক্তিযুদ্ধে মির্জাগঞ্জ উপজেলা (পটুয়াখালী)
মির্জাগঞ্জ উপজেলা (পটুয়াখালী) ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা করলে মির্জাগঞ্জের স্বাধীনতাবিরোধীরা পাকসেনাদের সঙ্গে হাত মেলায় এবং তাদের সহায়তায় এলাকার সাধারণ মানুষের ওপর অত্যাচার শুরু করে। তাদের অত্যাচার থেকে এলাকাবাসীকে রক্ষা করা এবং মির্জাগঞ্জকে শত্রুমুক্ত রাখার জন্য সেনাসদস্য মো. আলতাফ হায়দার-এর (দেউলি; প্রকৃত নাম মো. আলতাফ হোসেন, মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বের জন্য ঐ সময় ‘হায়দার’ নামে অভিহিত হন) নেতৃত্বে এলাকার যুবকরা সংগঠিত হয় এবং মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়। আবদুল কাদের জোমাদ্দার (উপজেলা আওয়ামী লীগ-এর সভাপতি)সহ মির্জাগঞ্জের রাজনৈতিক নেতারা তাদের দিকনির্দেশনা দেন।
মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি হিসেবে আলতাফ হায়দার, সেনাসদস্য মো. আবদুল আজিজ মল্লিক, ছাত্র ইউনিয়ন- নেতা মজিবুর রহমান মুন্সী প্রমুখ উপজেলা সদরস্থ সুবিদখালী হাইস্কুল মাঠে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন। সেখানে ছাত্র-যুবকরা প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে। এপ্রিল মাসের শেষদিকে পাকবাহিনী মির্জাগঞ্জে প্রবেশ করার পর প্রশিক্ষণ বন্ধ হয়ে যায়। পরবর্তীকালে আলতাফ হায়দারের পটুয়াখালী ও বরগুনায় মুক্তিযোদ্ধাদের কয়েকটি ক্যাম্প স্থাপিত হয়। সবচেয়ে বড় ক্যাম্পটি ছিল তাঁর বাড়িসংলগ্ন দেউলি বাজারে।
যুদ্ধের সময় মির্জাগঞ্জ উপজেলায় সংগঠকের দায়িত্ব পালন করেন আবদুল কাদের জোমাদ্দার, মো. আলতাফ হায়দার, মো. আবদুল আজিজ মল্লিক (পূর্ব সুবিদখালী), মজিবুর রহমান মুন্সী (ঐ), চিত্তরঞ্জন দাস (ঐ), মো. ইসমাইল হোসেন মৃধা (পশ্চিম সুবিদখালী), গণেশ পোদ্দার (সুবিদখালী বাজার), গোলাম উকিল খান (ঐ), আবদুল বারেক সিকদার (ঐ), সালাম জোমাদ্দার (ঐ), মো. আনিসুর রহমান (পশ্চিম সুবিদখালী), অমল দাস (পূর্ব সুবিদখালী), হাদি মাস্টার, মো. সিরাজুল ইসলাম, মজিদ জোমাদ্দার (পশ্চিম সুবিদখালী), সুবল চন্দ্র দেবনাথ (সুবিদখালী বাজার), মোবারক আলী মুন্সী (পূর্ব সুবিদখালী), খালেক হাওলাদার (পশ্চিম সুবিদখালী), সালাম মৃধা (চত্রা), সুনীল কু (সুবিদখালী বাজার), মৃদুল কান্তি সেন প্রমুখ। কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন মো. আলতাফ হায়দার এবং মো. আবদুল আজিজ মল্লিক।
এপ্রিল মাসের শেষদিকে পাকবাহিনী মির্জাগঞ্জে প্রবেশ করে এবং মির্জাগঞ্জ হাসপাতালে ক্যাম্প স্থাপন করে। ক্যাম্প স্থাপনের পর তারা হাসপাতালের চারপাশে প্রায় দুই কিলোমিটার পর্যন্ত গাছপালা কেটে ফেলে, যাতে মুক্তিযোদ্ধারা কাছ থেকে ক্যাম্প আক্রমণ করতে না পারেন। তবে ক্যাম্প স্থাপন করলেও পাকসেনারা এখানে থাকত না, থাকত থানার পুলিশ ও স্থানীয় রাজাকাররা।
মির্জাগঞ্জে শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনীর লোকজন সক্রিয় ছিল। শান্তি কমিটির সভাপতি ছিল আজাহার খান (পিতা আরজ আলী খান, খৈলাবুনিয়া) ও সাধারণ সম্পাদক আব্দুল ওয়াজেদ সিকদার (পিতা জয়ুদ্দিন সিকদার, উত্তর সুবিদখালী)। রাজাকার কমান্ডার ছিল শাহজাহান সিকদার (সুবিদখালী বাজার) এবং তার সহকারী ছিল জবেদ আলী, আবদুল হামিদ ওরফে কালা হামিদ, আনসার কমান্ডার আদম আলী কেরানী ওরফে বৈজ্ঞানিক ও ধলু সিকদার।
পাকবাহিনী ও তাদের দোসররা মির্জাগঞ্জের সাধারণ মানুষের ওপর নানারকম অত্যাচার শুরু করে। রাজাকার কমান্ডার শাহজাহান সিকদার, হামেদ রাজাকার, জবেদ আলীসহ আরো কয়েকজন উপজেলা সদরের সুবিদখালী বাজারে গোলাপী রাণী নামে একজনকে ধর্ষণ করে। এতে তার মৃত্যু হয়। ১২ই আগস্ট দুপুরে শান্তি কমিটির সহায়তায় পাকবাহিনী পটুয়াখালী থেকে মির্জাগঞ্জ সদরের সুবিদখালী বন্দরে এসে ডা. দেবেন্দ্রনাথ সরকারের বাসভবনে ঢুকে তাঁকে হত্যা করে। তাঁর স্ত্রী বিভা রাণী সরকার স্বামীকে বাঁচানোর জন্য এগিয়ে এলে বর্বর পাকসেনারা তাঁকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে- খুঁচিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে। এরপর তারা মির্জাগঞ্জ আওয়ামী লীগের সভাপতি আবদুল কাদের জোমাদ্দারকে তাঁর বাড়ি থেকে এবং পার্শ্ববর্তী কাজি অফিস থেকে কাকড়াবুনিয়ার মুক্তিযোদ্ধা হাবিব খলিফাকে ধরে নিয়ে গানবোটে করে পটুয়াখালীর উদ্দেশে চলে যায়। পথিমধ্যে তাঁদের হত্যা করে লাশ পায়রা নদীতে ফেলে দেয়। দুদিন পর স্বজনরা তাঁদের লাশ তুলে দাফন করে।
২০শে আগস্ট (৩রা ভাদ্র) কাকড়াবুনিয়া বাজার-সংলগ্ন হিন্দুপাড়ায় স্থানীয় রাজাকার ও ইউনিয়ন শান্তি কমিটির সভাপতি আকবর গাজীর সহযোগিতায় সাহেদ আলী হাওলাদার, হাতেম হাওলাদার, মোসলেম হাওলাদার, মজিদ হাওলাদার প্রমুখ ১৫-২০টি বাড়ি লুট করে। ২২শে আগস্ট (৫ই ভাদ্র) সকালে পাকসেনাদের একটি দল পায়রা নদী দিয়ে গানবোটে এসে কাকড়াবুনিয়া বাজারে নামে এবং একজন মুসলমানের ঘরে আগুন দেয়। পরে তারা গুলি করতে-করতে বাজার-সংলগ্ন হিন্দুপাড়ায় ঢোকে এবং বিপেন ভক্ত নামে এক হিন্দুর ঘরসহ ১২টি ঘরে আগুন দেয়। এ-সময় রাজাকাররা রাধা ভক্ত নামে এক ব্যক্তিকে স্থানীয় রাজাকার সাহেদ আলীর বাড়িতে নিয়ে গিয়ে নির্মমভাবে নির্যাতন করে। পরে ৫০০ টাকার বিনিময়ে তাঁকে ছেড়ে দেয়।
কাকড়াবুনিয়া বাজারে স্থানীয় হাতেম মৃধার কন্যাকে রাজাকাররা ধরে ফেলে। মেয়েকে বাঁচানোর জন্য হাতেম মৃধা পাকসেনাদের গানবোটের দিকে যেতে চাইলে রাজাকাররা তাঁকে ঘটনাস্থলেই হত্যা করে এবং তাঁর মেয়েকে ধর্ষণ করে। নূর মোহাম্মদ নামে এক ব্যক্তি ধানক্ষেতের পাশে পানিতে ডুব দিয়ে পালিয়ে ছিলেন। এক সময় মাথা উঁচু করে পাকবাহিনী চলে গেছে কি-না তা দেখতে গেলে পাকসেনারা তাঁকে গুলি করে হত্যা করে। এদিন পাকবাহিনী মোট ১৪ জন নিরীহ মানুষকে হত্যা করে, যা কাকড়াবুনিয়া গণহত্যা নামে পরিচিত। এসব অত্যাচারের খবর শুনে আলতাফ হায়দার ২৩শে আগস্ট (৬ই ভাদ্র) তাঁর বাহিনীসহ কাকড়াবুনিয়ায় এসে অনন্ত গোলদারের বাগান বাড়ির উত্তর পাশে একটি গর্ত খুঁড়ে সেখানে কয়েকজন সহযোদ্ধাকে রেখে যান এবং এখানকার খবরাখবর নিয়মিত দেউলিতে তাঁর নিকট পৌছানোর নির্দেশ দেন। এর ফলে সার্বিক অবস্থার উন্নতি ঘটে।
এদিকে পার্শ্ববর্তী বেতাগী উপজেলার আবদুল মালেক মহারাজ এবং আনোয়ার হোসেন পনু নামে দুজন রাজাকার মির্জাগঞ্জ উপজেলার ডোকলাখালী গ্রামে লুটপাট করার সময় স্থানীয়রা তাদের মেরে ফেলে। এ খবর শুনে পরদিন ভোরে পটুয়াখালী ক্যাম্প থেকে পাকবাহিনী ও স্থানীয় রাজাকাররা এসে সুবিদখালী বাজারে নেমে বৃষ্টির মতো গুলি করতে থাকে। পরে তারা ডোকলাখালী গ্রামে গিয়ে ১৫টি ঘরে আগুন দেয়। এখান থেকে চলে যাওয়ার সময় তারা সুবিদখালী বাজারের কয়েকটি দোকান ও বাসা-বাড়ি লুট করে। দুর্ধর্ষ মুক্তিযোদ্ধা আলতাফ হায়দারকে হত্যা করার জন্য একদিন পাকসেনা ও রাজাকাররা তাঁর দেউলির বাড়িতে হানা দেয়। কিন্তু তাঁকে না পেয়ে তাঁদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়।
মির্জাগঞ্জে আলতাফ হায়দারের নেতৃত্বে একটি স্থানীয় মুক্তিবাহিনী গড়ে উঠেছিল, যা আলতাফ বাহিনী নামে পরিচিত। মির্জাগঞ্জের বাইরেও এ বাহিনী একাধিক সফল অভিযান পরিচালনা করে পাকবাহিনী ও তাদের দোসরদের ব্যাপক ক্ষতি সাধন করে এবং তাদের সর্বদা সন্ত্রস্ত করে রাখে।
এ উপজেলার কমান্ডার আলতাফ হায়দার ছিলেন ৯ নম্বর সেক্টর কমান্ডার মেজর এম এ জলিলের অধীন। ২৪শে নভেম্বর পাকবাহিনীর দখল থেকে বরগুনা জেলার বামনা থানা মুক্ত করার ক্ষেত্রে তিনি সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। এরপর পর্যায়ক্রমে পটুয়াখালী, বাউফল, বরগুনা, পাথরঘাটা ও বেতাগী হানাদারমুক্ত হয়। এক্ষেত্রেও তিনি বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এর ফলে ক্রমশই তাঁর নাম চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। বামনা থানা মুক্ত করার পর আলতাফ হায়দার নিজগ্রাম দেউলিতে এসে ঘাঁটি স্থাপন করেন। এখানকার হিন্দুপাড়ায় একটি বকুল গাছের নিচে বিরাট পরিখা খনন করে তার মধ্যে অস্ত্রসহ আত্মগোপন করে থাকতেন। শত্রু এলে এখান থেকেই তিনি দলবল নিয়ে ছুটে যেতেন। মির্জাগঞ্জে পাকবাহিনী ও রাজাকারদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের একটিমাত্র যুদ্ধ হয়, সেটি হলো দেউলি যুদ্ধ। ডিসেম্বরের প্রথম দিকে আলতাফ হায়দারকে হত্যা করার জন্য হানাদাররা দেউলি আসে। তারা দেউলি স্কুলের কাছাকাছি আসামাত্র আলতাফ বাহিনী তাদের ওপর আক্রমণ করে। প্রায় সমস্ত দিন ধরে যুদ্ধ চলে। অবশেষে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে না পেরে হানাদাররা পালিয়ে যায়।
আলতাফ হায়দারের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা মির্জাগঞ্জ ও পটুয়াখালী আক্রমণ করবে এ-সংবাদ শুনে ৭ই ডিসেম্বর রাতে হানাদার বাহিনী পালিয়ে যায় এবং মুক্তিযোদ্ধা চেরাগ আলী ফকির, আবদুল খালেক ও মো. সামসু ফকিরের মাধ্যমে শতাধিক রাজাকার দেউলি ক্যাম্পে গিয়ে অস্ত্রসহ আত্মসমর্পণ করে। পরের দিন ৮ই ডিসেম্বর মির্জাগঞ্জকে মুক্তাঞ্চল ঘোষণা করা হয় এবং আলতাফ হায়দার তাঁর সহযোদ্ধাদের নিয়ে প্রথমে সুবিদখালী হাইস্কুল মাঠ ও পরে পটুয়াখালীর আলাউদ্দিন শিশুপার্কে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন।
মির্জাগঞ্জে একজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার নাম জানা যায়। তিনি হলেন- মো. হাবিব খলিফা হাফিজ (পিতা হাচন আলী, কাকড়াবুনিয়া)।
মির্জাগঞ্জ উপজেলায় বীর মুক্তিযোদ্ধাদের একটি নামফলক স্থাপন করা হয়েছে। মেহেন্দিয়াবাদ-দেউলি বাজার থেকে উপজেলা সড়ক পর্যন্ত রাস্তার নামকরণ করা হয়েছে কমান্ডার মো. আলতাফ হায়দার সড়ক। শহীদ আবদুল কাদের জোমাদ্দারের নামে আরেকটি সড়ক এবং শহীদ সুলতানের নামে একটি গ্রামের নামকরণ করা হয়েছে। এছাড়া উপজেলার শহীদদের স্মরণে মির্জাগঞ্জ উপজেলা প্রশাসন ২০১২ সালে উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সামনে একটি স্মৃতিস্তম্ভের নির্মাণ কাজ শুরু করে, যা অসমাপ্ত অবস্থায় পড়ে আছে। [উত্তম গোলদার]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৮ম খণ্ড