You dont have javascript enabled! Please enable it!

মাহবুবুর রহমান গ্রুপ (চকরিয়া, কক্সবাজার)

মাহবুবুর রহমান গ্রুপ (চকরিয়া, কক্সবাজার) কক্সবাজার জেলার চকরিয়া এবং চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপজেলার মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে গঠিত গঠিত একটি মুক্তিবাহিনী। গ্রুপের কমান্ডার মাহবুবুর রহমানের নামে এ গ্রুপ গঠিত হয়। মুক্তিযুদ্ধের ১১ নম্বর সেক্টর থেকে এ গ্রুপের মুক্তিযোদ্ধাদের ১ নম্বর সেক্টরে প্রেরণ করা হয়। এ গ্রুপের মুক্তিযোদ্ধারা দেওয়ানজীর খিল যুদ্ধসহ কয়েকটি যুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
ভারতে ১ নম্বর সেক্টরের হরিণা ক্যাম্পে ১৫৫ নম্বর মাহবুবুর রহমান গ্রুপ গঠিত হয়। গ্রুপ গঠিত হওয়ার পূর্বে এ দলের সদস্যরা আরো অনেকের সঙ্গে দেমাগ্রী মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে ভারতের ৩১ জাঠ রেজিমেন্টের কর্নেল নন্দলাল সিং-এর অধীনে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। তাঁর সঙ্গে আরো ছিলেন কর্নেল বাজুয়া, কর্নেল বেল সিং, মেজর নাগ্রা সিং ও সুবেদার মেজর রাজু হালদার। রাজু হালদার ছিলেন প্রশিক্ষণ ক্যাম্পের সুপারভাইজার। চন্দনাইশ উপজেলার দোহাজারী সরকারি হাসপাতালের মেডিকেল অফিসার ডা. মৃণাল কান্তি বড়ুয়া এ ক্যাম্পের চিকিৎসক ছিলেন। তিনি প্রশিক্ষণার্থীদের রিক্রুটমেন্টের সময় শারীরিক পরীক্ষা নিতেন।
প্রশিক্ষণের সুবিধার্থে দেমাগ্রী ক্যাম্পে প্রশিক্ষণার্থীদের নানা গ্রুপে ভাগ করা হতো। এক গ্রুপে একজন কমান্ডার থাকতেন, যেমন— চন্দনাইশ উপজেলার হারলা এলাকার সিরাজুল ইসলাম রহমানী (পিতা মোখলেসুর রহমান) একটি প্রশিক্ষণার্থী গ্রুপের কমান্ডার ছিলেন। এ গ্রুপের অন্য সদস্যদের মধ্যে ছিলেন- চন্দনাইশ উপজেলার দোহাজারীর প্রভাষ চন্দ্র দাশগুপ্ত (পিতা সতীশ চন্দ্র দাশগুপ্ত), রাখাল চন্দ্র দাস (পিতা তেজেন্দ্র লাল দাস), মদন মোহন দাস (পিতা কিষ্ট চন্দ্র দাস) ও সুধীর কান্তি দাস (পিতা প্যায়ারি মোহন দাস), সাতকানিয়া উপজেলার মাইঙ্গাপাড়ার উমর আলী, একই উপজেলার ফকিরখীলের পিন্টু দাশগুপ্ত, কাটগড়ের হরিমোহন জলদাস, আনোয়ারা উপজেলার বটতলের আবদুল মন্নান প্রমুখ। প্রশিক্ষণ চলাকালে বিভিন্ন গ্রুপের সদস্যদের বাংলাদেশে প্রবেশ করে বিভিন্ন অপারেশনে অংশগ্রহণ করতে হতো। বিভিন্ন গ্রুপের প্রায় ১২০ জন সদস্য সিরাজুল ইসলাম রহমানীর নেতৃত্বে ছোট হরিণা, বড় হরিণা, বরকল, কর্ণফুলি নদী ও বড় হরিণা সংলগ্ন স্থানে মোট ৫টি গুরুত্বপূর্ণ অপারেশন পরিচালনা করেন।
দেমাগ্রী ক্যাম্পে ৩০৩ রাইফেল, মার্ক-০৪ রাইফেল, ৩৬ কার্বন মেশিনগান, স্টেনগান, এসএলআর, এলএমজি, দুই-ইঞ্চি- মর্টার, হ্যান্ড গ্রেনেড, মাইন, বিস্ফোরক প্রভৃতি সম্পর্কে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করার পর এখানকার অনেক মুক্তিযোদ্ধা লুংলাই ও আইজল হয়ে ১১ নম্বরের আওতাধীন মাইনকার চরে পৌঁছেন। সেখানে তাঁদের কুড়িগ্রাম এলাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধ করার নির্দেশ দেয়া হলে ১১ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার কর্নেল আবু তাহেরের সঙ্গে তাঁদের বাদানুবাদ হয়। তাঁরা জানান যে, যেহেতু কুড়িগ্রাম তাঁদের কাছে অপরিচিত এলাকা, তাই এখানে গেরিলা যুদ্ধ করা ঝুঁকিপূর্ণ। কর্নেল আবু তাহের তাঁদের কথায় ক্ষুব্ধ হন। এরপর মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি জেনারেল আতাউল গণি ওসমানী- মাইনকার চর ক্যাম্প পরিদর্শনে গেলে তিনি নির্দেশ দেন যে, দেশমাতৃকার টানে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণে আগ্রহীদের নিজেদের ইচ্ছেমতো এলাকার যুদ্ধে অংশ নিতে কোনো বাধা নেই। তবে বিভিন্ন বাহিনীতে কর্মরত ইপিআর, আনসার ও পুলিশ সদস্যরা কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা অনুসারে বিভিন্ন স্থানের যুদ্ধে অংশ নেবে। এরপর দেমাগ্রী থেকে মাইনকার চরে আসা মুক্তিযোদ্ধাদের ১ নম্বর সেক্টরের হরিণা ক্যাম্পে প্রেরণ করা হয়। এখানে তাঁদের থেকে ৩০-এর অধিক সদস্য নিয়ে ১৫৫ নম্বর মাহবুবুর রহমান গ্রুপ গঠন করা হয়। অন্য সদস্যদের নিয়ে আরো দুটি গ্রুপ গঠন করা হয়। ৩ গ্রুপকে শপথবাক্য পাঠ করান ডা. বি এম ফয়েজুর রহমান এমপিএ। সে-সময় পাশে ছিলেন স্বপন কুমার চৌধুরী। ১৫৫ নম্বর গ্রুপের সদস্যরা কয়েকটি যুদ্ধে অংশ নেন। ৭ই ডিসেম্বর ১৫৫ নম্বর গ্রুপ অন্য দুই গ্রুপের সঙ্গে চন্দনাইশ উপজেলার জঙ্গলহাশিমপুরস্থ দেওয়ানজীর খিল এলাকায় পৌঁছে আলী হোসেন মাস্টারের কৃষিখামারে অবস্থান গ্রহণ করে। তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল চন্দনাইশ উপজেলার জামিজুরি এলাকার উত্তর পাশের রেলব্রিজ মাইন দ্বারা উড়িয়ে দিয়ে দোহাজারী-জামিজুরি এ রহমান উচ্চ বিদ্যালয়স্থ রাজাকার মুজাহিদ ঘাঁটি আক্রমণ করা। কিন্তু সেদিন সন্ধ্যায় পাকিস্তানি বাহিনী ও রাজাকাররা তাঁদের আক্রমণ করলে দুপক্ষের মধ্যে ভয়াবহ যুদ্ধ হয়। প্রায় ৪ ঘণ্টা ধরে এ-যুদ্ধ চলে। যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা সুভাষ মজুমদার (পিতা ক্ষিতীশ মজুমদার, লোহাগাড়া উপজেলা) ও বিমল কান্তি চৌধুরী (পিতা সুধাংশু বিমল চৌধুরী, সাতকানিয়া উপজেলা) শহীদ হন। তাঁরা এলএমজি-ম্যান ছিলেন। ভয়াবহ এ যুদ্ধ স্থানীয়ভাবে দেওয়ানজীর খিল যুদ্ধ নামে পরিচিত|
১৫৫ নম্বর গ্রুপের কমান্ডার মাহবুবুর রহমান (পিতা মীর হোসেন, কাকারা, চকরিয়া) ছাড়া অন্য সদস্যদের মধ্যে ছিলেন- সাধন চন্দ্র দাশ (পিতা রমণী মোহন দাশ, দিগরপানখালী, ফাঁশিয়াখালী, চকরিয়া), দুলাল কান্তি নাথ (পিতা সুরেন্দ্র লাল নাথ, বারবাকিয়া, চকরিয়া), ধনঞ্জয় দেবনাথ (পিতা সুরেন্দ্র লাল নাথ, বারবাকিয়া), অনিল কান্তি নাথ (পিতা দেবেন্দ্র কান্তি নাথ, বারবাকিয়া), অনন্ত কুমার নাথ (পিতা নিশি চন্দ্র নাথ, বারবাকিয়া), কৃষ্ণ মোহন দে (পিতা যামিনী মোহন দে, বড়ইতলি হিন্দুপাড়া, চকরিয়া), রাইমোহন দে (পিতা শিরমনি দে, বড়ইতলি), সন্তোষ কুমার দাশ (পিতা উপেন্দ্র লাল দাশ, বড়ইতলি), বিরেন চন্দ্র দে (পিতা রমণী মোহন দে, বড়ইতলি), সুনীল কান্তি দে (পিতা যতীন্দ্র লাল দে, বড়ইতলি), সুশীল বিকাশ নাথ (পিতা যোগেন্দ্র লাল নাথ, বারবাকিয়া), নুরুল ইসলাম (ঈদগাঁ, রামু, কক্সবাজার), খোকন মল্লিক (ঈদগাঁ), অরুণ সাহা (রাঙ্গুনিয়া), অশোক চাকমা ওরফে অশোক কারবারি (রাঙ্গামাটি), খগেন্দ্র লাল শীল (মহেশখালী), সুভাষ চন্দ্র তালুকদার (বাঁশখালী, চট্টগ্রাম), পুলিন পাল (বাঁশখালী), অধ্যাপক হান্নান ও রঞ্জিত (কুতুবদিয়া, কক্সবাজার)। [শামসুল আরেফীন]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৮ম খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!