মাহীসন্তোষ যুদ্ধ (ধামইরহাট, নওগাঁ)
মাহীসন্তোষ যুদ্ধ (ধামইরহাট, নওগাঁ) সংঘটিত হয় ১৪ই অক্টোবর। এ-যুদ্ধে ২৭ জন পাকিস্তানি সৈন্য নিহত হয়। অপরপক্ষে ৩ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। ১৯৭১ সালের মার্চ থেকে মধ্য ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়কালে নওগাঁ জেলার বিভিন্ন অঞ্চলে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের সংঘটিত যুদ্ধসমূহের অন্যতম ধামইরহাট উপজেলার মাহীসন্তোষ যুদ্ধ।
মাহীসন্তোষ নওগাঁ জেলার ধামইরহাট উপজেলার অন্তর্গত একটি গ্রাম। এর উত্তরে এবং পূর্ব দিকে ভারতীয় সীমান্ত, পশ্চিমে আত্রাই নদী এবং দক্ষিণে শাখাহাটি। ১৪ই অক্টোবর উপজেলার ঐতিহাসিক তকিউদ্দীন পার্শি আল আরাবি (রহ.)-র মাজার তথা মাহীসন্তোষ গ্রামে পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের এ-যুদ্ধ সংঘটিত হয়। স্থানীয় রাজাকারদের সহায়তায় মাজারটি ছিল তখন পাকবাহিনীর দখলে। এক পর্যায়ে এ এলাকায় পাকহানাদারদের অত্যাচার-নির্যাতনের মাত্রা বৃদ্ধি পায়। সেপ্টেম্বর মাসের প্রথমদিকে মাহীসন্তোষের নিকটবর্তী ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বালুরঘাট থানার কুরমাইল অপারেশন ক্যাম্পে মুক্তিযোদ্ধারা ক্যাপ্টেন ডোগড়ার নেতৃত্বে অপারেশন চালানোর সিদ্ধান্ত নেন। এখানকার মুক্তিযোদ্ধারা শিলিগুড়িতে ক্যাপ্টেন ধামী, ক্যাপ্টেন রায় সিং, ক্যাপ্টেন ডোগড়া প্রমুখের অধীনে প্রশিক্ষণ নেন। পরিকল্পনা অনুসারে ৮০ জন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা একযোগে এ-যুদ্ধে অংশ নেন। মুক্তিযোদ্ধাদের নেতৃত্ব দেন জয়পুরহাটের কালু এবং বগুড়ার নারায়ণ। উভয়ের নেতৃত্বে ৪০ জন করে মোট ৮০ জন মুক্তিযোদ্ধা উত্তর, পূর্ব এবং পশ্চিম দিক থেকে পাকবাহিনীকে ঘিরে ফেলেন। পাকবাহিনী শুরুতে উপজেলার রাঙ্গামাটি ক্যাম্প থেকে, পরে উপজেলার ফার্সিপাড়া ক্যাম্প থেকে এসে যুদ্ধে অংশ নেয়। পাকবাহিনীর আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রের বিপরীতে এক পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধারা ভারতীয় অংশ থেকে আক্রমণ চালালে পাকবাহিনী পিছু হটতে থাকে। এ যুদ্ধে জয়নাল আবেদীন সিদ্দিকী (চকযদু), এ কে এম বদিউজ্জামান (জয়জয়পুর), অফিরউদ্দীন (হরিতকিডাঙ্গা), রইসউদ্দীন (বেনিদুয়ার, হরিতকিডাঙ্গা), তালিবুর রহমান (রূপনারায়ণপুর), সুধীর চন্দ্র (চকযদু), গৌড়চন্দ্র (পারকাটা) প্রমুখ মুক্তিযোদ্ধা অংশ নেন।
প্রায় ৪ ঘণ্টাব্যাপী মাহীসন্তোষ যুদ্ধে ২৭ জন পাকিস্তানি সৈন্য নিহত হয়। অপরদিকে ৩ জন মুক্তিযোদ্ধা যথা- নওগাঁর পত্নীতলা উপজেলার আমাইপুকুর গ্রামের আবু বক্কর সিদ্দিক, একই উপজেলার প্রতাপ এবং মহাদেবপুর উপজেলার উপেন শাহাদাৎ বরণ করেন। এ ৩ জন শহীদের লাশ সারারাত যুদ্ধক্ষেত্রে পড়ে থাকে। পরদিন সকালে শহীদ উপেন এবং প্রতাপের লাশ বালুরঘাট শ্মশানে এবং শহীদ আবু বক্কর সিদ্দিকের লাশ কুরমাইলে সমাহিত করা হয়। এ-যুদ্ধের অন্যতম নেতৃত্বদানকারী মুক্তিযোদ্ধা নারায়ণকে জীবিত ধরে নিয়ে যায় পাকবাহিনী। পরবর্তীতে তিনি ঘটনাক্রমে মুক্তি পান। মাহীসন্তোষ যুদ্ধে নিহত শহীদদের স্মৃতি রক্ষার্থে অদ্যাবধি কোনো স্মৃতিস্তম্ভ বা নামফলক স্থাপন করা হয়নি। [চিত্তরঞ্জন মিশ্র]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৮ম খণ্ড