You dont have javascript enabled! Please enable it!

মাহেরপুর যুদ্ধ (বোচাগঞ্জ, দিনাজপুর)

মাহেরপুর যুদ্ধ (বোচাগঞ্জ, দিনাজপুর) সীমান্তবর্তী এলাকা হওয়ায় এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি থেকে ডিসেম্বরের প্রথমার্ধ পর্যন্ত চলে। ডিসেম্বরে যৌথবাহিনী অগ্রসর হলে হানাদাররা পালিয়ে যায় এবং মাহেরপুর ও আশপাশের এলাকা হানাদারমুক্ত হয়।
দিনাজপুর জেলার বোচাগঞ্জ উপজেলার ছাতইল ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত মাহেরপুর। এপ্রিল মাসের মধ্যবর্তী সময়ে হানাদার বাহিনীর ক্রমাগত অগ্রাভিযানের মুখে মুক্তিসেনারা পিছিয়ে যেতে থাকেন এবং সুখদেবপুরের বগলাখাড়ি ব্রিজ ভেঙ্গে দিয়ে টাঙ্গন নদীর পশ্চিম প্রান্তে অবস্থান নেন। পাকিস্তানি বাহিনী অবস্থান নেয় টাঙ্গন নদীর পূর্ব দিকে মাহেরপুর ও এর আশপাশের এলাকায়। যুদ্ধের বিভিন্ন পর্যায়ে টাঙ্গন নদীর পশ্চিম প্রান্তের মাধবপুর, শিরাইল, জগন্নাথপুর ও চান্দোহর বাজার এলাকায় মুক্তিবাহিনী ক্যাম্প স্থাপন করে। প্রতিটি ক্যাম্পে অর্ধশত থেকে একশত মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন এবং এক ক্যাম্প থেকে আরেক ক্যাম্প ছিল দেড়-দুই কিলোমিটারের মধ্যে। তবে সবগুলো ক্যাম্প ভারতীয় সীমান্তের দুই-তিন কিলোমিটার দূরত্বে ছিল। সীমান্ত এলাকাগুলো হলো ভবানীপুর, পরমেশ্বরপুর, জগন্নাথপুর, বৈরচুনা ইত্যাদি।
মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে এপ্রিল মাসে মাহেরপুরের বর্তমান বাজার এলাকা, বাজারের নিকটবর্তী জিনাহারি পুকুরপাড়, আনাহাড়ি পুকুরপাড় এবং পাকুড়া এলাকা জুড়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী অবস্থান নিয়ে একাধিক বাংকার ও ট্রেঞ্চ খনন করে। স্থানীয় বাঙালিদের দ্বারাই এগুলো জবরদস্তি খনন করিয়ে নেয়া হয়। মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকে ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত পাকিস্তানি বাহিনীর দেড়-দুই শত সদস্য এসব বাংকার ও ট্রেঞ্চে অবস্থান করে। ট্রেঞ্চের ভেতর দিয়ে তারা এক বাংকার থেকে আরেক বাংকারে যাতায়াত করত। তাদের নেতৃত্বে ছিল আসলাম সুবেদার, উমর কেতাব, মজিদ খান, লাল জমিরা প্রমুখ। তারা ভীষণ অত্যাচারী ছিল।
পাকিস্তানি বাহিনী মাহেরপুরে অবস্থান নিয়ে মাঝে-মাঝেই মুক্তিযোদ্ধাদের লক্ষ করে গুলি ও শেল বর্ষণ করত। জবাবে মুক্তিবাহিনীও গুলি ও শেল নিক্ষেপ করত। পুরো মুক্তিযুদ্ধকালে ঐ এলাকাটি একটি যুদ্ধক্ষেত্র ছিল। এলাকার হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সবাই ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে ভারতে চলে গিয়েছিল। মুসলমানদেরও শিশু ও নারী সদস্যের অধিকাংশ ভারতে চলে যায়। পুরুষরা, বিশেষত বয়স্ক লোকেরা নিজ- নিজ বাড়িতে অবস্থান করেন। তাদের অনেককেই পাকিস্তানি বাহিনীর নির্যাতনের শিকার হতে হয়। পাকিস্তানিরা ব্যাপক নির্যাতন চালিয়ে যাশা গ্রামের দবিরুল ইসলাম ওরফে দবির দাড়িয়া এবং বেলবাঁশ গ্রামের মনিরুজ্জামান মাস্টার নামে দুই ব্যক্তিকে হত্যা করে। পাকিস্তানি সেনাদের নিক্ষিপ্ত গোলায় জগন্নাথপুরের আব্দুর রশিদ নামে একজন মারা যান। সুখদেবপুরের জয়নাল আবেদীন (পিতা মো. অনিরউদ্দিন)-এর পেটে গুলি লাগে। তবে শেষ পর্যন্ত অপারেশন করে তিনি সুস্থ হন। তিনি এখনো বেঁচে আছেন। ছাতইল ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আবুল কাশেমের ভাতিজা আনোড়া গ্রাম নিবাসী মোবারক হোসেন ব্যাপক নির্যাতনের শিকার হন। সুখদেবপুরের মঙ্গলি নামের এক তরুণীসহ বেশ কয়েকজনের ওপর হানাদাররা পাশবিক নির্যাতন চালায়।
পাকিস্তানি বাহিনী প্রতিনিয়ত নদী পার হওয়ার চেষ্টা করলেও মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধের কারণে তারা বারবার ব্যর্থ হয়। মাহেরপুরের দিক দিয়ে টাঙ্গন নদী পার হবার জন্য কোনো ব্রিজ ছিল না। অপরদিকে বাঙালিরা নৌকা চলাচলও বন্ধ করে রেখেছিল। একবার পাকিস্তানিরা নদী পার হওয়ার জন্য দুটি বড় নৌকা জোগাড় করে ঘাটের পারে রেখে দেয়। কিন্তু রাতের বেলা মুক্তিবাহিনী গ্রেনেডের বিস্ফোরণ ঘটিয়ে নৌকা দুটি উড়িয়ে দেয়। বিস্ফোরণের সময় মুক্তিবাহিনীর সহযোগী চুরমত আলী (পিতা মজিরউদ্দিন, সুখদেবপুর)-র পায়ে নৌকার একটি বড় কাঠ এসে আঘাত লাগে। ঐ আঘাতে তিনি গুরুতর জখম হন। এখনো তার পায়ে আঘাতের চিহ্ন রয়ে গেছে।
মাহেরপুরে পাকিস্তানি সেনা ও মুক্তিবাহিনী মুখোমুখি অবস্থানে ছিল। মাঝখানে তাদের মধ্যে ব্যবধান তৈরি করে দিয়েছিল টাঙ্গন নদী। নদীর পূর্বে পাকিস্তানি সেনা ও পশ্চিমে মুক্তি সেনারা অবস্থান নিয়ে পরস্পরের দিকে গুলি বর্ষণ করত। পাকিস্তানিরা একটি গুলি করলে মুক্তিযোদ্ধারা ২০- ২৫টি গুলি করে জবাব দিতেন। রাতের বেলা মুক্তিসেনারা নদী পার হয়ে গেরিলা অপারেশন চালাতেন। কিন্তু পাকিস্তানি সেনারা রাতে নদীর কাছে যেত না। দিনের বেলা সংঘবদ্ধভাবে নদী পার হবার চেষ্টা করে একাধিকাবার ব্যর্থ হয়। ডিসেম্বরে যখন মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় সেনারা সম্মিলিতভাবে অগ্রসর হয়, তখন পাকিস্তানি সেনারা প্রতিরোধের চেষ্টা না করে রাতের অন্ধকারে মাহেরপুর ছেড়ে চলে যায়। ফলে, পুরো বছর ধরেই যুদ্ধপরিস্থিতিতে নিমজ্জমান মাহেরপুর ও এর আশপাশের এলাকা ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে অনেকটা বিনা যুদ্ধেই মুক্ত হয়। এ জয়ের ফলে সেতাবগঞ্জ, মঙ্গলপুর, ঢেড়াপাটিয়া ও ধুকুরঝাড়ি মুক্ত করার পথ সহজ হয়। [আজহারুল আজাদ জুয়েল]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৮ম খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!