You dont have javascript enabled! Please enable it!

মিজোবাহিনী (খাগড়াছড়ি সদর)

মিজোবাহিনী (খাগড়াছড়ি সদর) ৭১-এ বর্তমান তিন পার্বত্য জেলা নিয়ে একটিমাত্র জেলা ছিল – রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা। মার্চ মাসের প্রথম থেকেই রাঙ্গামাটির চাকমা সার্কেল চিফ রাজা ত্রিদিব রায় ও মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা (স্বাধীনতার পর পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির চেয়ারম্যান) কোনো কারণে মুক্তিকামী বাঙালিদের কাছ থেকে দূরত্ব বজায় রেখে চলতেন। অনেক নৃ-গোষ্ঠীর লোকজন এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যায়। সে-সময় হঠাৎ মিজোদের আনাগোনা পরিলক্ষিত হয়। উল্লেখ্য, ভারতের মিজোরাম অঞ্চলের বিচ্ছিন্নতাবাদীরা পালিয়ে এসে পার্বত্য চট্টগ্রামে আশ্রয় নিয়েছিল। পাকিস্তান সরকার তাদের রাজনৈতিক আশ্রয় দিয়েছিল। কারণ শুরু থেকেই পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে ভারতের বৈরী ভাব ছিল। মিজোরা তাদের বিপ্লবী সরকার গঠন করেছিল লালডাঙ্গার নেতৃত্বে। মিজোরা বেশিরভাগ সাজেক ভ্যালি এবং মারিশ্যা অঞ্চলে আশ্রয় নিয়েছিল। সাজেক ও মারিশ্যা থেকে তারা লংগদু, দীঘিনালা ও খাগড়াছড়ির বিভিন্ন জঙ্গলেও আশ্রয় নিয়েছিল। প্রশাসন ও স্থানীয়দের প্রতি পাকিস্তান সরকারের নির্দেশ ছিল তাদের সর্বপ্রকারে সাহায্য-সহযোগিতা করার জন্য।
রাঙ্গামাটির জেলা প্রশাসক মিজোদের সাহায্য-সহযোগিতা করতেন। জেলা প্রশাসনের সার্বিক তত্ত্বাবধানে এ কর্মকাণ্ড পরিচালিত হতো। সাধারণত মিজোরা শহরের দিকে আসত না। ঠেগা, ছোট হরিণা, বড় হরিণা ইত্যাদি এলাকাগুলোতেই তারা প্রশিক্ষণ পরিচালনাসহ নিজেদের কার্যক্রম পরিচালনা করত। মিজোদের প্রশিক্ষণ, হাতিয়ার পাঠানো ও অন্যান্য ভারতবিরোধী কর্মকাণ্ডের পরিকল্পনা ও সমন্বয় করত পাকিস্তান গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই। প্রশিক্ষণের জন্য প্রধান সমন্বয়কারী ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর তিন কমান্ডো ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক কর্নেল শামস। কর্নেল শামস পাকিস্তান স্পেশাল সার্ভিস গ্রুপ (এসএসজি) বাহিনীর সদস্য এবং একজন কঠোর মানসিকতার প্রশিক্ষক হিসেবে খ্যাত ছিল। ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে সে “সিতারা-ই- জুরোত’ খেতাব লাভ করে। তার অধীনে বিভিন্ন এসএসজি অফিসার ১৯৬৭ সাল থেকে মিজোদের প্রশিক্ষণের ব্যাপারে নিয়োজিত ছিল। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন ক্যাপ্টেন পারভেজ মোশাররফ, যিনি পরবর্তীতে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন।
৩ কমান্ডো ব্যাটালিয়ন চট্টগ্রামে মোতায়ন করা হয়েছিল। ১৯৬৯ সালে কিছু শৃঙ্খলাপরিপন্থী কর্মকাণ্ডের জন্য তাদের কুমিল্লা স্থানান্তর করা হয়। কিন্তু তাদের ওপর মিজোদের প্রশিক্ষণ চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ বহাল থাকে। কুমিল্লায় তারা ৫৩ ইনফ্রেন্টি ব্রিগেডে অর্ন্তভুক্ত হয়। এ ব্রিগেডের অধিনায়ক ছিল ব্রিগেডিয়ার ইকবাল শফিক, যে ৭১-এ বাংলাদেশে গণহত্যার সঙ্গে জড়িত ছিল।
মিজোরা অনেক সময় উচ্ছৃঙ্খল কাজে নিয়োজিত থাকত। তারা পার্বত্য চট্টগ্রামের জঙ্গলে হাতি, হরিণ ইত্যাদি শিকার করে খেত। তারা গ্রামে গিয়ে লুটপাটও করত। মাঝে-মাঝে যখন তারা সীমান্ত অতিক্রম করে রাতের বেলা ভারতে যেত, তখন ভারতের বিএসএফ তাদের পিছু ধাওয়া করত এবং অনেক সময় পূর্ব পকিস্তানের সীমান্তের ভেতরে বিএসএফ প্রবেশ করত। এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বেসামরিক প্রশাসন মিজোদের ওপর অসন্তুষ্ট ছিল।
ভারত সরকার দীর্ঘদিন ধরে সীমান্তের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রেখে আসছিল এবং মিজো বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে সান্ধ্য আইন বলবৎ করছিল। হঠাৎ রাঙ্গামাটি শহরে বিপুল সংখ্যক মিজোদের উপস্থিতি দেখে প্রশাসনের বাঙালি অফিসাররা উদ্বিগ্ন হন। মিজোদের সিনেটর থাঙ্গিমা বারবার তাদের রেশনের জন্য চাপ দিচ্ছিলেন। এদিকে চাকমাদের অনেকেই গভীর জঙ্গলে চলে যাওয়া শুরু করল। মিজো সিনেটর রামালা কিছু সময় পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছিলেন। প্রায়-পরিত্যক্ত রাঙ্গামাটি শহরে মিজোদের আনাগোনা ও লুটতরাজ বৃদ্ধি পেতে থাকে। ভারত থেকে তখন মুক্তিবাহিনীর কাছে বার্তা এলো যে, মিজোদের তাদের হাতে তুলে দিতে হবে।
তখন ভারতের দিক থেকে প্রচার করা হলো যে, মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের জয় অনিবার্য এবং মিজোরা স্বেচ্ছায় মুক্তিবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করছে। এমনকি এও প্রচার করা হয় যে, মিজোদের তথাকথিত রাষ্ট্রপতি লালডেঙ্গা ইতোমধ্যে ভারত সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করেছে। এ খবর প্রচারের সঙ্গে-সঙ্গে মিজোদের মধ্যে ভীতি ছড়িয়ে পড়ে। তাদের হয়তো ভারতের কাছে হস্তান্তর করা হবে এরূপ ভাবনা তারা করতে থাকে। এমতাবস্থায় তারা তখন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ বৃদ্ধি করে। আগে থেকেই পাকিস্তানি সেনাবাহিনী মিজোদের ভারতের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের জন্য উস্কানি, প্রশিক্ষণ, হাতিয়ার, গোলাবারুদ নিয়মিতভাবে দিয়ে আসছিল, যা পূর্বে উল্লিখিত। ২৮শে মার্চ আকাশবাণী থেকে মিজোদের আত্মসমর্পণের খবর ঢালাওভাবে বারবার প্রচার করা হতে থাকে। থাঙ্গিমা আর রামালার বক্তব্য টেপ করে প্রচার করা হয়। মারিশ্যা ও সাজেক ভ্যালিতেও একই প্রচারণা চালানো হয়।
একই তারিখ নেতৃস্থানীয় মিজো লোকজন রাঙ্গামাটিতে মুক্তিযুদ্ধে যোগদানকারী এডিসি সৈয়দ আবদুস সামাদকে উত্তেজিত কণ্ঠে জানায় যে, যদি মুক্তিবাহিনী মিজোদের ভারতীয়দের হাতে তুলে দেয়ার চেষ্টা করে, তাহলে তার পরিণাম হবে ভয়াবহ। তারা রাঙ্গামাটি শহর দখল করে পাকিস্তান বাহিনীর কাছে তা হস্তান্তর করবে। মিজোদের দুশ্চিন্তা তখন চরমে। তারা মার্চ মাসে রাঙ্গামাটি শহরের আশেপাশে বেশি করে আনাগোনা শুরু করে। ইতোমধ্যে মিজো নেতারা যে-সব মিজো পাকিস্তানি বাহিনী দ্বারা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত তাদের পাকিস্তান বাহিনীর সঙ্গে যোগদান করার নির্দেশ দেয়। এ ঘটনা মহালছড়ি যুদ্ধের ওপর প্রভাব বিস্তার করে। এ কারণেই এ এলাকায় মুক্তিবাহিনী প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে পড়ে।
পাকিস্তানি বাহিনীর পাশাপাশি মিজোবাহিনীও মুক্তিবাহিনীর বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে তুলে নেয়। মিজোরা চাকমা রাজা ত্রিদিব রায়ের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় পার্বত্য অঞ্চলের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর একটি অংশের সঙ্গে মিলিত হয়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সমর্থনে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের বিরোধিতা করে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী দ্বারা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মিজোদের সংখ্যা ছিল তিন হাজারের মতো এবং তারা তিনটি ব্রিগেডে অন্তর্ভুক্ত ছিল। তাদের বেশিরভাগ প্রশিক্ষণ হতো রাঙ্গামাটির সীমান্তবর্তী সাজেক ভ্যালিতে। তাদের নেতা ছিলেন ফিজো। তিনি বেশিরভাগ সময় ঢাকায় আইএসআই-র সহযোগিতা নিয়ে থাকতেন। তাদের সর্বোচ্চ নেতা লালডেঙ্গা পূর্বে ভারতের সেনাবাহিনীর সিগন্যাল কোরের হাবিলদার ছিল।
ইংরেজি ভাষায় তার দক্ষতা ছিল। ট্রেনিংপ্রাপ্ত মিজোরা ছিল শারীরিকভাবে সবল ও সুঠাম দেহের অধিকারী। পাহাড়ি এলাকা সম্বন্ধে তাদের বিস্তারিত ধারণা ছিল। কিছু মিজো মেয়েও সামরিক প্রশিক্ষণে শামিল হয়। তাদের রাইফেল, এলএমজি, মেশিনগান ইত্যাদি চালানোর বিশেষ প্রশিক্ষণ দেয়া হতো। তাদের ট্রেনিং ছিল ৮ সপ্তাহের।
এদিকে ২০শে এপ্রিল রাঙ্গামাটির নানিয়ারচরের বুড়িঘাটে পাকিস্তানিদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মুখ যুদ্ধের পর পাকিস্তানিরা মহালছড়ি মুক্তিযোদ্ধা হেডকোয়ার্টার্সের দিকে অগ্রসর হওয়ার পরিকল্পনা করে। ২৭শে এপ্রিল পাকিস্তানি বাহিনী মহালছড়িতে আক্রমণ করে। আক্রমণের পরিকল্পনা অনুযায়ী মিজোদের তারা সামনে রাখে। মিজোদের একের পর এক সামনে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর আক্রমণের জন্য পাঠায়। কোনো মিজো যদি আক্রমণ থেকে পিছু হটতে চাইত, তাহলে তাকে পাকিস্তানি কমান্ডো বাহিনী গুলি করে হত্যা করবে এরূপ ধারণা তারা পায়। ফলে মিজোরা প্রাণপণে যুদ্ধ চালায়। এ-যুদ্ধে ক্যাপ্টেন আফতাবুল কাদের শহীদ হন। অন্য মুক্তিযোদ্ধারা নিরাপদ স্থানে চলে যেতে সক্ষম হন। এখানকার যুদ্ধে মিজোবাহিনীর প্রায় ১৫০০ সদস্য পাকিস্তানিদের পক্ষে অংশ নেয়।
পাকিস্তানি ও মিজো বাহিনী মহালছড়ি দখলে নিয়েই প্রথমে মহালছড়ি বাজার ও আশপাশের বহু ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়। এছাড়াও অনেক নারীকে ধরে নিয়ে তাদের ওপর নির্যাতন চালায়।
পুরো খাগড়াছড়ি ও রাঙ্গামাটি পাকিস্তানিদের দখলে চলে গেলে লংগদু, বাঘাইছড়ি, দীঘিনালা, রামগড়, পানছড়ি, লক্ষ্মীছড়ি, মাটিরাঙা প্রভৃতি স্থানে মিজোবাহিনীর সদস্যরা লোকজনের মালামাল ও গবাদি পশু লুটপাট করত। খাগড়াছড়ি থানা, পোস্ট অফিস, হসপিটালসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোতে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে মিজোবাহিনী ছিল। খাগড়াছড়িতে মিজোদের সবচেয়ে বড় ক্যাম্প ছিল মাটিরাঙার কুকিছড়ায়। দেশ স্বাধীন হওয়ার আগ পর্যন্ত তারা খাগড়াছড়ি ও রাঙ্গামাটিতে ছিল। পাকিস্তানি বাহিনীর পক্ষে হয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অপারেশনে অংশ নেয় তারা। দেশ স্বাধীন হওয়ার প্রাক্কালে যখন পাকিস্তানি বাহিনী বিভিন্ন স্থানে মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর কাছে পরাস্ত হচ্ছিল, তখন অনেক স্থানেই পাকিস্তানি বাহিনী মিজোদের রেখেই পালিয়ে যায়। এদিকে মিজোরাও নিজেদের অবস্থা বেগতিক দেখে গভীর জঙ্গলে পালিয়ে যায়। [ইয়াছিন রানা সোহেল]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৮ম খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!