You dont have javascript enabled! Please enable it! মিজোবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর সংঘর্ষ - সংগ্রামের নোটবুক

মিজোবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর সংঘর্ষ

সাম্প্রদায়িক বিভাজন সূত্রে জন্মলগ্ন থেকে পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে বৈরী সম্পর্কের কারণে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে মিজো বিদ্রোহের সময় (১৯৬৬-১৯৭১) পাকিস্তান সরকার বিদ্রোহী মিজোদেরকে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে আশ্রয় ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে। লালডেঙ্গার নেতৃত্বে বিদ্রোহীরা মিজো ন্যাশন্যাল ফ্রন্ট গড়ে তোলে। ১৯৬৬ সালের ২৮শে ফেব্রুয়ারি রাতে মিজো ন্যাশনাল আর্মী এক ‘সিভিলিয়ান ক্যু দে’ তার মাধ্যমে তৎকালীন আসাম রাজ্যের লুসাই পার্বত্য জেলার গুরুত্বপূর্ণ সকল সরকারি স্থাপনা দখল করে স্বাধীনতা ঘোষণা এবং মিজোরাম সরকার গঠন করে। কিন্তু ভারতীয় সেনা ও বিমান বাহিনীর পাল্টা আক্রমণের মুখে তারা নিয়ন্ত্রণ হারায় এবং দেশত্যাগ করে পার্শ্ববর্তী পূর্ব পাকিস্তান ও বার্মায় আশ্রয় নেয়। মিজো ‘স্বাধীনতাযোদ্ধা’দের আশ্রয়, অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ দেয়ার বিনিময়ে পাকিস্তান মিজো বিদ্রোহীদেরকে ভারতের বিরুদ্ধে ব্যবহার করত। ১৯৭০ সালে লংগদু সদরের পাহাড়ে কয়েক হাজার মিজো যুদ্ধাস্ত্রের প্রশিক্ষণ নেয় এবং বাঘাইছড়ি ও বরকলের সীমান্ত এলাকায় সশস্ত্র অবস্থান গড়ে তোলে। মিজোদের লায়ন ব্রিগ্রেড ছিল আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত ও দুর্ধর্ষ। এই ব্রিগেডে নারীরাও ছিল। ১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারি মাস থেকে মিজোবাহিনী রাঙামাটি শহরে সভা-সমাবেশ করতে শুরু করে। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান সেনাবাহিনী মিজো বিদ্রোহীদের মুক্তিবাহিনীর বিরুদ্ধে ব্যবহার করে।
চট্টগ্রামের প্রাথমিক প্রতিরোধ ভেঙ্গে পড়ার পর সেনাবাহিনীর বাঙালি সদস্য ও মুক্তিবাহিনীর একটি দল রামগড়ে অবস্থান নেয়। পাকিস্তানি বাহিনীর সম্ভাব্য আক্রমণ থেকে রামগড়কে নিরাপদ রাখার জন্য মহালছড়িতে মুক্তিবাহিনীর প্রতিরোধব্যূহ গড়ে তোলা হয়। ১৯৭১ সালের ২৬শে এপ্রিল মেজর মীর শওকত আলী গোয়েন্দাসূত্রে হানাদার বাহিনী কর্তৃক মহালছড়ি আক্রমণের পরিকল্পনা জানতে পারেন। হানাদার বাহিনীকে মোকাবেলা করার লক্ষ্যে তাঁর নির্দেশে ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান নানিয়ারচর বাজারের কাছে পাহাড়ের ওপরে অবস্থান নেন। অপরদিকে ক্যাপ্টেন আফতাব কাদের তাঁর কোম্পানি নিয়ে মহালছড়ি- নানিয়ারচর সড়কপথ অবরোধ করেন। পার্শ্ববর্তী বুড়িঘাট বাজারে রিজার্ভ রাখা হয় লেফটেন্যান্ট মাহফুজকে। ২৭শে এপ্রিল এখানে ভয়াবহ সংঘর্ষ হয়, যা মহালছড়ির যুদ্ধ- নামে খ্যাত। পাকিস্তানি বাহিনী ৩ কমান্ডো ব্যাটালিয়নের ১টি কোম্পানি এবং মিজোদের ১৫০০ সৈন্যের বিশাল লায়ন ব্রিগেড নিয়ে যৌথভাবে মহালছড়ি আক্রমণ করে। মিজোদের তারা সম্মুখ ভাগে রাখে যাতে নিজেদের ক্ষয়ক্ষতি কম হয় এবং নিজেরা পেছনে এমনভাবে অবস্থান নেয় যাতে কোনো মিজো পালাতে না পারে। গুলিবিদ্ধ হয়ে ২০ জন মিজো সদস্য নিহত হলে আরো ২০ জন পুনরায় পজিশন নেয়। এভাবে লাইনের পর লাইন ধরে যেন ঢেউ এর মতো তারা ধাবমান হচ্ছিল। লক্ষ্যবস্তু দখলের জন্য যেমন করে আদিকালের রণকৌশলে একের পর এক আক্রমণকারী বাহিনী পাঠানো হতো, পাকিস্তানি বাহিনীও সেভাবে মিজোদের পাঠাতে থাকে। প্রতিরোধকারী মুক্তিযোদ্ধাদের ফায়ারিংএর মুখে তারা ব্যর্থ হয় এবং অনেক মিজো হতাহত হয়। পাকিস্তানি বাহিনী মহালছড়ির প্রতিরোধব্যূহের ওপর ক্রমাগত গোলাবর্ষণ করতে থাকে এবং স্মোক-শেলের আড়ালে হেলিকপ্টারের সাহায্যে এক কোম্পানি মিজোবাহিনীকে দুটি পৃথক অবস্থানে নামায়। মিজোরা তাদের অবস্থান থেকে আক্রমণ চালাতে থাকে। একটানা তিনঘণ্টা আক্রমণের মুখে মুক্তিবাহিনীর গোলাবারুদ শেষ হয়ে যায়। একদিকে মিজো ও হানাদারদের সাঁড়াশি আক্রমণ, অন্যদিকে পাহাড়ি এলাকায় যুদ্ধের কৌশল, প্রশিক্ষণ ও প্রয়োজনীয় রসদ না থাকায় অসীম সাহসের সঙ্গে যুদ্ধ করেও শেষ পর্যন্ত মহালছড়ির এই যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের বিপর্যয় ঘটে। যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপ্টেন আফতাবুল কাদের শহীদ হন।
মহালছড়ির যুদ্ধের পরপর মেজর জিয়াউর রহমান তাঁর বাহিনীসহ রামগড় ছেড়ে ভারতে চলে যান। ভারতীয় মিজোদের সঙ্গে পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষের অবয়বের সাদৃশ্য থাকায় তিনি পাহাড়িদের আক্রমণকারী বলে সন্দেহ করেন এবং মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সকল যুবককে মুক্তিবাহিনী থেকে বাদ দিয়ে দেন। চাকমা রাজা ত্রিদিব রায় পাকিস্তানের পক্ষাবলম্বন করায় মুক্তিযুদ্ধে পার্বত্য নৃ-গোষ্ঠীর আনুগত্যের ব্যাপারে সন্দেহ বাড়ে। অন্যদিকে, লংগদু ও বাঘাইছড়ি-সহ বিভিন্ন এলাকায় হানাদার ও মিজোবাহিনী একসঙ্গে পাহাড়িদের গ্রাম আক্রমণ, বাড়িঘরে আগুন দেয়া ও লুটপাট করতে থাকে। ফলে পাহাড়ি নৃ-গোষ্ঠীর বাসিন্দারা নতুন এক ধরনের সংকটের মধ্যে পড়ে। একদিকে তাদের ওপর পাকিস্তানি ও মিজোবাহিনীর আক্রমণ, অন্যদিকে বাঙালি কর্তৃক অবিশ্বাস। এসব প্রতিকূল অবস্থা মোকাবেলা করেই তারা বাঙালি যোদ্ধাদের পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। [মেসবাহ কামাল ও জান্নাত-এ-ফেরদৌসী]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৮ম খণ্ড